বিপ্রতীপে
চিত্রাভানু সেনগুপ্ত
অভিমন্যু দাশগুপ্ত আজকাল অনেক রান্নাই নিজে নিজে করে ফেলতে পারেন। মা জীবিত থাকাকালিন যা যা অভিমন্যু খেতে ভালোবাসতেন তার প্রায় সব পদই তিনি এখন বানাতে শিখে গেছেন। মা বলতেন সব কাজ একটু একটু শিখতে হয়। দরকারে অদরকারে কাজে লাগে। অভিমন্যু মায়ের কথায় হাসতেন।
–মানুষ চাঁদে চলে গেল মা, আর তুমি আমায় কাজের ভয় দেখাও?
— বেশ তো, কর না দেখি হাতে হাতে কটা কাজ।
— যেদিন চাঁদে যাবো মা, তোমার ওই হাতে হাতে কাজও শিখে নেব।
এখন অভিমন্যু অনেক রান্না অনায়াসে পেরে যায়। সকালের জলখাবার আর রাতের রান্নার সবটাই তিনি করেন। গোলগাল নরম-সরম হাতরুটি বানাতে শিখেছেন। ডুমো ডুমো করে আলু কেটে কালোজিরে, হিং আর কাঁচালঙ্কা ফোড়ন, আধখানা টমেটো কুচিয়ে সামান্য নুন হলুদে নাড়াচাড়া। নামানোর আগে ঢিমে আঁচে বসিয়ে উপর দিয়ে অল্প ধনেপাতাকুচি ছড়িয়ে দিয়ে ঢাকা দিয়ে দেন। ব্যাস! ছোটমাপের একখানা পদ রেডি। ছুটির দিন একঘেয়ে রুটির পরিবর্তে লুচি বা পরোটা হয়। পরোটার আবার প্রকারভেদ আছে। ডালপুরিটা এখনো জুতসই বানাতে শেখেননি অভিমন্যু। কাবলি ছোলা আর মটর দিনভর ভিজিয়ে ঘন করে ঘুগনি বানাতে শিখেছেন। ডবল ডিমের মধ্যে নুন, হলুদ, সামান্য পেঁয়াজ কাঁচামরিচ কুচিয়ে বেশ করে ফেটিয়ে পাউরুটিটা ডুবিয়ে নিয়ে এপাট ওপাট ভেজে নেন। সকাল সকাল এসব জলখাবারে দিব্যি চলে যায় অভিমন্যু আর তাঁর বাবার। তবে কিনা বাবার বয়স চারকুড়ি পেরিয়েছে, রক্তে শর্করার কথা মাথায় রেখে আলু আর মাটির তলার সবজিতে ও তেল-মশলাতে একটু লাগাম রাখতেই হয়। সাতসকালেই খালিপেট ভরাপেট মিলিয়ে চার-পাঁচটা ওষুধ লিখেছেন ডাক্তার। সারাদিনে আরো কতরকমের যে পথ্যি গিলতে হয়! বহুদিনের রোগভোগ তাঁর, রোগমুক্তির পথ জানা নেই। অগত্যা দাওয়াইয়ের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, জিভে মোটা হয়ে ছালা পড়েছে। রোজ একঘেয়ে রুটি আর লুচি খেতে বাবার তত ভালো লাগে না। যদিও অভিমন্যুর মুখ চেয়ে তিনি মুখ ফুটে কখনোই কিছু বলেননি, কিন্তু কখনো-সকনো পাতের দিকে এমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন, অভিমন্যু তা ভালোই বোঝেন। বাবার পাতে নতুনত্ব আনতে মাঝেমধ্যে নোনতা সুজি, চিড়ের পোলাও হয়, কখনো সাদা ফ্যাটফ্যাটে সুগারফ্রি সন্দেশ আনিয়ে রাখেন। অভিমন্যুর মেয়েদের ম্যাগি,চাউমিন, পাস্তা চলে, কিন্তু বাবার এসব সাহেবী খাবার মুখে রোচে না। তাই প্রায়সই দুরকমের জলখাবার তৈরি করতে হয়। সেরকম এক-আধদিন সকালে উঠে একটু চাপে পড়েন অভিমন্যু। ওভেনে চায়ের জল বসিয়ে দিয়েই বেশ কিছুটা বাসন মেজে ফেলেন। জল ফুটে উঠলেই চায়ের পাতা ছড়িয়ে দিয়ে গ্যাস নিভিয়ে দেন, ওমনি একটা ঢাকনা দিয়ে তিন মিনিট ঘড়ি ধরে অপেক্ষা। এর মধ্যেই হাত চালিয়ে আগের দিনের অফিসের জামাকাপড়, আর বাবার রোজকার জামাকাপড়গুলো মেশিনে দিয়ে দেন। ঘন করে দুধ জাল দিয়ে ঘরেই ঘন দই বসিয়ে নেন অভিমন্যু। একমাত্র ওটাই খাবার বিষয়ে বাড়ির সকলের একবাক্যে রাজী। স্যান্ডুইচ, পিজা, পাওভাজী এসব হিজিবিজি বাহারি রান্না হলে অবিশ্যি কাজের চাপ কম থাকে অভিমন্যুর। ওদেরটা ওরা করে খায়, ঘরোয়া রান্না ছাড়া অভিমন্যু যে কোন কিছু করতে পারে, সে নিয়ে বাড়ির আর সকলের আস্থা নেই। চটপট রান্নার পাট শেষ করে আপিস যাবার তাড়া থাকে। বাবা চোখে ভালো দেখেন না। তাই ওষুধ খাবার আগে অভিমন্যুকে দেখিয়ে নেয়। খালি পেটে ওষুধ খাবার পর দশ মিনিট বিরতি দিয়ে জলখাবারের প্লেট সাজিয়ে আসে। নটায় ঘড়ি ধরে কাজে বের হতেই হয় অভিমন্যুকে। দুপুরের ক্যাপসুল কটা হাতের কাছে একটা ছোট কৌটোতে গুছিয়ে রেখে যান অভিমন্যু। আপিসে হাজিরা দিতে হবে দশটার মধ্যে। যতই তাড়া থাকুক, সাড়ে আটটার আগে স্নানে যেতে পারেন না অভিমন্যু। ততক্ষণ বাড়ির বাথরুম কন্ট্রোলরুমের কব্জায়। গত দুইদিন আপিসে পৌছতে একটু লেট হয়ে গেছে। আজ একটু আগে না গেলেই নয়। অগত্যা স্নানঘরে টোকা দিতে হয়েছে।
— অনেক দেরি হবে রুপু?
ভেতর থেকে তাড়স্বর হুঙ্কারে কেঁপে উঠলো গোটা ঘর … ফের তুমি দরজা নাড়ছো? মাকে বলছি দাঁড়াও। মাআআ! ওমাআ! বাবা আবার আমায় বিরক্ত করছে…
দক্ষিণের ঘরের ভেতর থেকে আরো একটা বিকৃত কন্ঠস্বর ভেসে এলো … মেয়েকে তো শেখাতে পারি না বাপের গালে ঠাস্ করে থাপ্পড় কষাতে! তাই সহ্য করে নিই। রোজ এতো পরিপাটি চান আর স্নো পাওডার মেখে অফিস যাওয়া! কাকে দেখানো! কোন কারণে বুঝি না নাকি? থতমত খেয়ে যান অভিমন্যু।
সোমার সাথে তাঁর ষোল বছরের দাম্পত্য। সমাজের নানান স্তরে এমনি নিরন্তর গতিতে রোজ জন্ম নেয় বিবিধ চারিত্রিক সামাজিক ফ্লপকথা, বহুল ভয়াল দিক আর মুখমুখোশেরা। অভিমন্যু ঘড়ি দেখে, খাবার গোছায়, বাজার গোছায়। বাবার হাতে খাবারের প্লেট গুঁজে দিয়ে বলেন… বের হচ্ছি। ওষুধটা খেয়ে আমায় ফোনে জানিও। আজ একটু তাড়া আছে।
বাবা বলেন … খেলি কিছু?
— সময় নেই। মিটিংটার আগে পৌঁছতেই হবে।
তারপর বাবার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে … আরে বাবা, রাস্তায় খেয়ে নেব ঠিক। চিন্তা কোর না।
আগে বের হবার আগে দক্ষিণের বদ্ধ দরজায় টোকা মেরে ‘বেরোচ্ছি’ কথাটা জানান দিয়ে যেত। এখন আর ইচ্ছে করে না। দোতলার সিঁড়িতে জুতোজোড়া পায়ে গলাতে একটু দাঁড়াতেই হয়। আজ হঠাৎ অসময়ে একটা ফোন বাজছে। এতো দেরি হলে আবার দোতলায় উঠে গিয়ে ফোন ধরার অবকাশ পায় না অভিমন্যু। সোমা দরজা ঠেলে বের হয়ে ফোনটা ধরেছে।
দূর থেকে সোমার কথাবার্তা যা কানে ভেসে আসে
… তোমার দাদা কখন কোথায় যায়, কার সাথে যায়, কখন ফিরবে জানিও না, জানতে চাইও না। তোমার বাবা এসে দাঁড়িয়েছে, ওনার সাথে কথা বল।
অভিমন্যু মনে মনে বোঝে, মৌ-এর ফোন এসেছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে টাইম দেখে নিয়ে এগিয়ে যান সদর দরজায়।
অর্জুনবাবু রিসিভারটা কানে ধরলেন। অর্জুনবাবু অভিমন্যু আর মৌমিতার বাবা। মৌমিতা দুর্গাপুরে একটা কলেজে পড়ান, ওখানেই থাকেন। বিয়েটা টেকেনি, একাই থাকেন।
— ও কেমন করে কথা বলে বাবা? কোন শিক্ষাই কী পায়নি?
— ছাড়! জানিসই তো ও ওরকম। তোর কথা বল।
— ও দাদাকে উদ্দেশ্য করে এমন করে কথা বলে? তবে তোমায় তো …
কথা ঘোরান অর্জুন। … ও তো একটু পাগলাটে, ওর কথা গায়ে মাখিস না।
— পাগলাটে? নিজেরটুকু বেশি করেই বুঝে নেয়, আর অন্যের বেলায়…
অর্জুন হঠাৎ বিরক্তিবোধ করেন। … আহঃ! থাম না! কী বলবি বল।
— আচ্ছা বেশ। তোমার শরীর কেমন, বাবা?
— শরীরের আর কী? যা আছে আছে, যা নেই নেই। বয়স কী আর কম হল রে?
— কাল তোমায় দেখতে মেজো মামা এসেছিলেন শুনলাম। তারপর?
— এসেছিলেন যখন শুনেছিস, তখন তো সবটাই শুনেছিস। সোমা অসন্তুষ্ট। একরকম অভদ্রতা করেই চলে যেতে বলেছিল।
–কেন?
— মেয়েদের পড়ার অসুবিধা হবে তাই।
— তুমি হসপিটাল থেকে ফিরলে, তোমায় কেউ দেখবে না বাবা? ও কী চায়? আমিও তো কতদিন তোমায় দেখি না বাবা! গাড়ি করে নিয়ে আসবে তোমায় আমার এখানে। আসবে আমার কাছে?
–না।
–কেন?
— তুই তো তবু একা, অভি যে ওদের মধ্যে পড়ে যাবে।
–আমায় তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না? তুমি ছাড়া আমার কে আছে বল?
— তুই দুদিন আমার কা-ছে —। কথা বলতে বলতে থেমে যায় অর্জুন)।
মৌমিতা ফিক করে হাসে। চোখের কানায় ভরে জল জমে। নিরুত্তর দাঁড়িয়ে জানলার বাইরে চেয়ে থাকেন অর্জুন।
মোবাইলটা পকেটে দপ করে জ্বলে ওঠে। অভিমন্যু ফোনটা কানে দেয়।
— দাদা!
–কেমন আছিস মৌ?
— কিছু খেয়েছিস দাদা?
— এখানে যা পাওয়া যায়!
— ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দেব। কলকাতায় কাজ নিলে তুই মাঝেমধ্যে বাবাকে আমার কাছে রাখতে পারবি।
–চট্ করে হটকারী কোন সিদ্ধান্ত নিস না। তবে চেষ্টা করে দেখ।
— তুই কখনো প্রতিবাদ করিস না কেন দাদা?
— মেয়েদের পক্ষে আইন। বাবা যতদিন আছেন, চুপ থাকি। বাড়ি নিয়ে টানাটানি পড়লে বাবাকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াব? বাবা কি এখন এতো ধকল নিতে পারবে?
— বাড়িটায় তো আমার ও ভাগ আছে। পুরো বাড়িতে ও কব্জা করবে কেমন করে? এতো মুখ বুজে থাকিস না।
আজ সকালের মিটিংটার পর অভিমন্যুর কাজের চাপটা অনেক হালকা। টুকটাক কাজ আছে, তবে মন আর আজ কাজের টেবিলে বসতে চায় না। সকালের বাক্যবাণ বারে বারে কলজেটা কামড়ে ধরছে। দুই মেয়ে আর মেয়েদের মায়ের ঔদ্ধত্য দিন-দিন অসুস্থ করে তুলছে জীবনযাপন। আজ সকাল থেকেই অভিমন্যুর মন অশান্ত। ইন ফ্যাক্ট মন ভালো নেই গতকাল থেকেই। মেজো মামার মত বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ একরকম চরম অপমানিত হয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছেন। সোমার অসভ্যতার ভয়ে কেউ-ই আজকাল আর এবাড়িমুখো হন না। মায়ের সময় বাড়িটা গমগম করত। অভিমন্যুর মা ছিলেন ব্যাক্তিত্বময়ী, বাবা ছিলেন তাঁর পাশের মানুষ। অন্যায়টা চুপচাপ মেনে নেওয়া মায়ের ধাতে সইতো না। মৌমিতাও খানিকটা তেমনই। তাই হয়তো আজ সে একা। তবে কখনো কখনো ভালো থাকার জন্য একা থাকাটা কাম্য এমনটা অভিমন্যু মনে করেন। আরো মনে করেন, সংসারে প্রতিটি মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়। নিজের মেয়েদেরকেও নিজের পায়ে দাঁড় করাতে চান অভিমন্যু। যতই অপমান করুক ওরা, অভিমন্যু তো বাবা! বাবার ধর্ম তো বাবাকেই পালন করে যেতে হয়। অবসাদ গ্রাস করছে ধীরে ধীরে, চেয়ারে হেলান দিয়ে হঠাৎ চোখটা বুজে ফেলেন অভিমন্যু। কতদিন স্বপ্ন দেখেন না! ছোটবেলায় মা গল্প বলতেন। তালপাতার পাখায় হাওয়া করতে করতে কখন যেন মায়ের চোখও জুড়িয়ে আসত। হাতের পাখাখানা ঝিমুনির আছিলায় অভিমন্যুর গায়ে ঠেকলেই মা সজাগ হয়ে উঠে বসতেন। পাখিটা দুবার মাটিতে ঠুকে দিয়েই আবার হাতটা দুলে উঠতো দোদুলদোলে। মায়ের মুখটা মনের মধ্যে ভেসে উঠলো। কোনদিনই খুব বেশি হাসতেন না মা, তবে মুখে একটা হালকা হাসির আভাস লেগে থাকতো। অভিমন্যুর প্রকৃতি আবার একেবারেই বিপরীত, দিনভর কেবল হৈচৈ আর টইটই। বাড়িতে থাকলে হাসির চোট পাড়ার মোড়ে টের পাওয়া যেত। রাস্তায় বের হলে পথেঘাটে আত্মীয়-কুটুম্ব যাকে পেতেন বগলদাবা করে ঘরে টেনে আনতেন। বন্ধুবান্ধব ছাড়া এক পাও চলতে পারতেন না অভিমন্যু। আগের কথা মনে হতেই চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন অভি। মোবাইলে সকাল দশটা
একচল্লিশে একটা মিসকল। অন্তরা, অন্তরা মজুমদার। আজ ব্যস্ততায় সকাল থেকে কথা হয়নি একটুও। অভিমন্যু রিঙব্যাক করলেন।
— ব্যস্ত?
— নাহ্! দোকান বন্ধ করব এখন।
— তারপর? বের হবে?
— হতেই পারি।
–বাড়িতে কী বলবে?
অন্তরা হাসে। … কোথায় যেতে হবে বল।
— প্রিন্সেপ ঘাট? ডট্ আড়াইটা।
— এই মন্যু, বাদাম খাবে? অকারণ খোসমেজাজে হাসতে থাকলো অন্তরা।
— এখন বাদাম?
— কেন? বাদাম আবার কখন খায় মানুষ? যত্তোসব!
— এই জন্যই দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছ তুমি।
— থু-থু! নজর দিও না মন্যু। এমন খাবো, মানুষ দেখে বুঝবে খাতে-পিতে ঘরকে বেটি। নইলে খেয়ে লাভ কী? তারপর অভিমন্যুর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে হেসে ফেলে।
–তুমি তো অভিমন্যু! নামের মধ্যে ভীম লুকিয়ে আছে কিনা? দেখি মাসেল দেখাও!
এই অকারণ বাচ্চাদের মত হাসিটার দিকে তাকালে মনে ভরে যায় অভিমন্যুর।
— তুমি যে কবে বড় হবে জানি না?
— বড়? খামোখা বড় হতে যাব কেন? যতদিন এই হাসিটাকে আগলে রাখবো আমি ততদিন বাঁচব। তারপর আমি একদিনও বাঁচতে চাই না। আর তুমিও হাসবে। প্রাণ খুলে হাসবে। হাসির মধ্যেই জীবনীশক্তি লুকিয়ে আছে অভি। তাকে কখনো কারো কথায় মরতে দিও না। তুমি অভিমন্যু … পরাক্রমী, জয় তোমার হাতের মুঠোয়! চোখে মুখে কী দারুণ এক দীপ্তি ফুটে ওঠে অন্তরার।
কথাটা শুনে হঠাৎ বাকরুদ্ধ অপলক তাকিয়ে ছিল অভিমন্যু। কী অদ্ভুত প্রাণচঞ্চল এই মেয়েটি! সংসারের দুর্বিসহ টানাপোড়েনকে তুচ্ছ করে অবলীলায় হাসতে পারে। কোথা থেকে পায় সে এই মনের জোর?
— অমন করে কী দেখ?
— কোথাও তো বসতে হয়। স্কুপে যাই?
— না। বদ্ধ দেওয়ালে আমার ভালো লাগে না। উন্মুক্ত আকাশের নিচে, খোলা বাতাসে তোমার বুক ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে না মন্যু?
— করে। কিন্তু কোথাও তো বসতে হয়।
পার্কের ভেতরে একটা খোলা বেঞ্চের উপরের ধুলোটা একটা টিস্যুতে ঘষে মুছে নিলো অন্তরা। তারপর বসার জায়গাটায় এমন করে অনর্থক ফুঁ দিলে, যেন ভারি শুদ্ধ পরিপাটি হল আসনখানা।
— এই তো এখানে বসি পাশাপাশি ?
চা-কফি হেঁকে বেরানো ফেরিওয়ালার থেকে দুজনে দুটো কফি নিলো কড়া করে।
— এবার বল। তোমার লেখালেখি কতদূর?
— হয়নি। অনেক কাজ। ব্যবসাটা নতুন শুরু করেছি। কত খাটনি জানো? তারপর সংসারেও কত পাওনাগন্ডা, উসুল না করে ছাড়ে?
— কিন্তু কলম থামালে তো চলবে না, অন্তর। একসাথে অনেকটা লেখার সময় না পাও অল্প করে লেখ।
তবুও …
চোখ আটকে যায় অন্তরার ঘাড়ের কাছে। একটা কালো পোড়া দাগের দগদগে ফোস্কা ঠেলে উঠে আসছে। উড়ো চুলের গোছা সরানো বুকের কাছে আচমকা স্পর্শে কেঁপে উঠল অন্তরা। কতোদিন—।
— এটা? কী করে হল?
একটু অপ্রতিভ ঠেকলো অন্তরার চোখমুখের চাহনি। ঠোঁটটা কেঁপে উঠল। কাল সন্ধ্যের আগে ফিরতে পারিনি। সামনে পুজো তো!
— শুধুমাত্র তার জন্য?
— না, রান্নাটায় নুন কম ছিল যে! কাল সব রান্না জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে। বাচ্চাগুলোও সারারাত কিছু না খাওয়া।
অভিমন্যু অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে বসল। … থাক ছাড়ো, এসব শুনতে আমার ভালো লাগে না।
অন্তরা অপ্রস্তুতের মত তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
— আমি তো বলতে চাইনি। তুমি জিজ্ঞেস করলে তাই। আচ্ছা তবে আমি যাই।
অভিমন্যু তাড়াতাড়ি হাতখানা চেপে ধরল… না, যেও না অন্তর। একটু বোস। আজ সত্যিই মনটা ভালো নেই।
কিছুক্ষণ কথা সরল না কারো মুখে। দুটি নিষ্পলক চোখ অকাতরে তাকিয়ে ছিল সামনের অগাধ জলরাশির দিকে। জোয়ারের টানে পেছনমুখে ধেয়ে চলা জলরাশির দিকে চেয়ে কত যে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো চুপিসারে কে জানে? ফোনটা বাজছে পকেটে।
–কোথায়?
–কেন? কী দরকার বল।
— তোমার মোবাইল টাওয়ার বলছে তুমি এখন অফিসে নেই।
— তাই? খুঁজে বের কর।
— আপিস ফেলে কোন চুলোয় কাজ জানতে পারি?
–না।
মিচকি হাসলেন অভিমন্যু, তারপর কানেকশন অফ করে ফোনটাকে একেবারে সুইচ অফ করলেন। আচমকা পরিবেশটাকে হালকা করার আপ্রাণ চেষ্টা করল অন্তরা।
— আইসক্রিম খাবে মন?
— আইসক্রিম?
— এই তো স্কুপে যেতে চাইছিলে। আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছিলো নিশ্চই?
— হ্যাঁ। তবে এই তো একটু আগে কফি খেলাম।
— তাতে কী? আচ্ছা বেশ! তবে পার্কের ওই মাথা পর্যন্ত হেঁটে চল। ততক্ষণে কফি হজম হয়ে যাবে। ওইপাড় থেকে আমরা কাঠি আইসক্রিম খাবো, কেমন? আর টাকা তুমি দেবে।
অভিমন্যু হেসে ফেললেন। … আচ্ছা বেশ তারপর? এপাড় থেকে ওপাড় হাঁটা শেষ হলে কী করবেন ম্যাডাম? কোথায় যাবে কিছু প্ল্যান বল?
— তারপর? দুই হাত পাখির মত দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে গান গেয়ে উঠলো অন্তরা। পথ হারাবো বলেই এবার… এই এত্তোবড় কলকাতা শহর আছে সামনে। যেদিকে তাকাও শুধু পথ আর পথ। হাঁটার রাস্তার অভাব?
— তার মানে পায়দল?
— ইয়েস স্যার, পায়দল। একেবারে এগারো নম্বর। এটা এমন একটা জায়গা মু্ন্যুবাবু, ঢঙের কোথাও যেতে হলে সুবিধার কোন বাস ট্যাক্সি কিছুই পাবে না। হেঁটেই চল না দেখি কতদূর যাওয়া যায়। যেদিকে ইচ্ছে…
অভিমন্যু হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল… হাতটা ধরবে তো, নাকি?
— হ্যাঁঅ্যআ! শ্রীযুক্ত অভিমন্যু দাশগুপ্ত বাবু! খুব সাহস বেড়েছে দেখছি? অভির কনুইটা জড়িয়ে ধরলো অন্তরা। দুজনে হেঁটে চলল পথে পথে, কথা ছিল কত কে জানে? হাসিও আছে অনেকটা … জমানো।