গল্পঃ মায়ের গন্ধ – অর্পিতা ঘোষ পালিত

মায়ের গন্ধ
অর্পিতা ঘোষ পালিত

স্টেশন যেতে বাক নেওয়ার মুখের রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গাটায় স্তূপাকার জঞ্জাল। মনে হয় এই মফস্বল শহরের সমস্ত নোংরা-আবর্জনা এখানে ফেলা হয়। পথ যাত্রীদের যাতায়ত করতে দুর্গন্ধে প্রায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এটুকু রাস্তা সবাই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাঁটে, দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পেতে। শহরের ভেতরে যাওয়ার গাড়ি চলাচলের বড় রাস্তাটা অনেকটা ঘোর পথ; এই একটাই শর্টকাট পথ তাই সবসময় অটো, টোটো, সাইকেল,বাইক অহরহ চলতেই থাকে। যারা পায়ে হেঁটে যায় তারাও স্টেশনে যাতায়াতের জন্য এই পথ বেছে নেয়।
আজ ভোর থেকেই নিত্যযাত্রীরা স্টেশনে যাওযার পথে, আবর্জনার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নোংরার ভেতর থেকে কচি বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। যাতায়াতের পথে একটু থমকে গিয়ে কেউ কেউ উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে, বাচ্চাটার জন্মদাত্রী মায়ের উদ্দেশ্যে গালাগালি দিতে দিতে ব্যস্ততায় গন্তব্যে যাচ্ছে। কেউ বাচ্চাটাকে নোংরার থেকে তুলে আনছেনা, বা বাচ্চাটা যাতে নোংরা থেকে বাইরে এসে, কারোর বাড়িতে না হোক অন্তত অনাথ আশ্রমে ঠাঁই পায় সে ব্যাবস্থাও করছে না। নিঃস্বার্থ-ভাবে কে আর বাড়তি ঝামেলায় যেতে চায়। সবার সময়ের দাম আছে। তাছাড়া মানুষের মানবিকতা এখন পয়সার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে।
রমা স্টেশনের ওভারব্রিজে ওঠার আগে এককোণে বসে নিয়মিত ভিক্ষা করে। এ দুনিয়ায় ওর কেউ নেই। কত বছর ধরে এভাবে এখানে বসে ভিক্ষা করছে সেসব হিসেব নেই ওর; তবে কুড়ি-বাইশ বছর তো হবেই। স্নান করে রাস্তার কলে। রান্না করার বালাই নেই। ভিক্ষা করে যেদিন যেমন পায়, সেদিন সেরকম স্টেশনের সামনের হোটেল থেকে খাবার কিনে এনে স্টেশনের শেষ সীমানায় বসে খায়। রাতে ওয়েটিং-রুমের বাইরে দরজার একপাশে শুয়ে থাকে। আবছা মনে পড়ে – ছোটবেলায় ওর বাবা ওকে বেঞ্চে বসিয়ে রেখে কি যেন কিনতে গিয়েছিল, সারাদিন খুঁজেও আর ফিরে পাইনি বাবাকে। তারপর থেকে স্টেশনই রমার ঘর- বাড়ি। আগে আপ-ডাউন ট্রেন স্টেশনে ঢুকলেই রমা ছুটে গিয়ে যাত্রীদের লক্ষ্য করতো, যদি ওর খোঁজে বাবা ফিরে আসে। নিজের মা’কে মনে নেই রমার। বাবাকে খুব ভালোবাসতো। প্রথম প্রথম বাবার জন্য আর সৎ ভাইবোন দু’টোর জন্য খুব মন খারাপ করতো। অনেক বছর পর বুঝেছিল – আসলে ওর বাবা ওকে নিজের ইচ্ছেয় ফেলে রেখে গেছে।
ডাউন ট্রেনের অপেক্ষায় রমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন লোক নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলো। নোংরা-আবর্জনার ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা আলোচনা করছিলো।
রমা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো – ‘আমি একজন ভিখারিণী হয়ে আপনাদের একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি, কিছু মনে করবেন না। কোথাও কি কেউ বাচ্চা ফেলে রেখে গেছে? আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে।’
একজন বললো – ‘স্টেশনে আসার পথে রাস্তার ধারে যেখানে নোংরা ফেলা হয়, সেখানে কেউ ছোট্ট বাচ্চাকে ফেলে রেখে গেছে। নোংরার ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
শুনে রমার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। একদিন ওকেও যে ওর বাবা ফেলে গিয়েছিল। ছোট্ট রমা সারাদিন না খেয়ে, কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেললেও কেউ ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি। সেসব দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তড়িঘড়ি উঠে দৌঁড়তে লাগলো নোংরা ফেলার জায়গার দিকে। নোংরা ফেলে জায়গাটা পাহাড়ের মতো হয়ে গেছে। সেই পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়ালো রমা। প্রথমে কিছু শুনতে বা বুঝতে পারলো না, এত নোংরার মধ্যে কোথায় খুঁজবে বাচ্চাটাকে? কোনো কান্নার আওয়াজও তো শুনতে পাচ্ছেনা, তবে কি কেউ বাচ্চাটাকে নিয়ে গ্যাছে? নিজেকেই প্রশ্ন করলো রমা, একটু শান্তি পেলো – যাক বাচ্চাটা তাহলে মনে হয় কোনো একটা আশ্রয় পেয়েছে। কি মনে করে তাও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। হঠাৎ শুনতে পেলো কেঁদে কেঁদে গলা বসে যাওয়া বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। কয়েকটা কুকুর জটলা করে নোংরার মধ্যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, সেখান থেকেই আওয়াজ এলো মনে হচ্ছে। একটা লাঠি কুড়িয়ে নিয়ে কুকুরগুলোকে হ্যাট হ্যাট করে তাড়িয়ে দিল। কুকুরগুলো সরে যেতে দেখতে পেলো কাপড়ে জড়ানো এক ছোট্ট শিশুকে। রমা তাড়াতাড়ি বাচ্চাটাকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
পথচলতি সানগ্লাস চোখে এক আধুনিকা রমাকে নোংরা থেকে বাচ্চা তুলে আনার দৃশ্য দেখে একটু দাঁড়ালো, লিপস্টিক রাঙানো ঠোঁট দিয়ে শব্দ ছুঁড়ে এলো – ‘ডিসকাস্টিং, নিজের খাবার জোটেনা তার ওপর পোষ্য! যত্তসব আদিখ্যেতা।’ উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে স্কার্ফ উড়িয়ে চলে গেল। চলে যাওয়ার পরেও নিজের গায়ের নোংরা গন্ধ ঢাকতে সারা গায়ে যে সুগন্ধ মেখেছে সেটা অনেকক্ষণ বাতাসে ভেসে বেড়ালো।
রমা বাচ্চাটাকে কোলে করে নোংরা ফেলার স্থান থেকে রাস্তায় এলো। যারা দাঁড়িয়ে ওর কাজ দেখছিল তাদের দিকে একমুখ গর্বের হাসি হেসে বললো– ‘আমি ভিখারিণী, ভিক্ষা করে আমি যদি দুটো খেতে পাই তাহলে এই বাচ্চাটাও আমার সাথে খাবার পাবে। আজ থেকে আমি এর মা, সবসময আমি এর দেখভাল করবো। ওর আপদে বিপদে পাশে থাকবো। কেঁদে কেঁদে ওর গলা শুকিয়ে গেছে, খুব খিদেও পেয়েছে মনে হচ্ছে। কোথা থেকে একটু দুধ জোগাড় করতে পারি কিনা দেখি…’
সভ্য সমাজের দিকে একটু হেসে বাচ্চাটাকে আদর করতে করতে রমা স্টেশনের দিকে এগোয়। হঠাৎ এতো দুর্গন্ধের মধ্যেও নোংরা ভিখারিনীর গা থেকে সুন্দর গন্ধ বেরিরে এসে, চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। যারা দাঁড়িয়ে দেখছিলো তারা সবাই গন্ধটা পায়।

2 thoughts on “গল্পঃ মায়ের গন্ধ – অর্পিতা ঘোষ পালিত

Leave a Reply to চিত্রাভানু Chaitali Sengupta Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *