সম্পাদকীয়ঃ রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

সাড়া দিলেন এ সময়ের অনেক কবি ও কবিতাপ্রেমিক সাহিত্যিক, কেউ খ্যাতি বা প্রচারের অনেকটা অংশ অতিক্রম করেছেন, কেউ করছেন, কেউ হয়তো আমাদের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে একদিন, বিস্মিত হয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হবো, কেননা অবেক্ষণপত্রিকার আমন্ত্রণে গত ২৭ শে মে ২০২৩ বিকেল পাঁচটায় হাজির হয়েছিলেন তাঁরা কলকাতার ‘ অবনীন্দ্র সভাঘরে ‘। তাঁরা এসেছিলেন কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে ( জন্ম ১৮৯০ খ্রী. ২৭ শে মে , অনন্তধামে গমন ১৪ই মার্চ ১৯৭৫, ) যাঁর ১৩৪ তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। তাঁরা সংখ্যায় নেহাৎ কম ছিলেন না। দেখা গেল, মোট একচল্লিশ জন মঞ্চে উঠেছিলেন। ঠিক বিকেল ৫ টায় কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের একটি প্রিয় গান ‘ আমায় থাকতে দে না, আপন মনে……’ খালি গলায় গাইলেন কবির জ্যেষ্ঠ পৌত্রী শ্রীমতী ভূমিকা গোস্বামী। গানের সুর ও বাণী এক মধুর পরিবেশ তৈরী করে দিল সমস্ত সভা ঘরটি।
এরপর অবেক্ষণপত্রিকার পক্ষে সভাপতি শ্রীরাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (শ্রীরাধু গোস্বামী) আগত ও তখন পর্যন্ত অনাগতদের জন্য স্বাগত ভাষণ দেবার পরই উদ্বোধনী ভাষণে সকল কবি ও আলোচকদের এক এক করে মঞ্চে এসে অংশগ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। ইতিমধ্যে অবেক্ষণপত্রিকার সম্পাদক শ্রীমতী মন্দিরা গাংগুলীর পরিচালনায় সকলকে উত্তরীয় পরানো ও যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের ছোট্ট একটি প্রতিকৃতি সহ স্মারক সম্মান সকলের হাতে তুলে দেয়া হল।

অন্যতম বিশেষ অতিথি বিশিষ্ট বক্তা শ্রী অভিযান বন্দ্যোপাধ্যায় কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে মৈমনসিংহ গৌরীপুর জমিদারীর নায়েব থাকা সত্ত্বেও চাষী মজুর দীনদরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল থেকে তাদের সুখদুঃখের কথা লিখে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুরাহা করা ও প্রতিবাদ করায় কবিকে প্রতিবাদী কবি আখ্যা দিয়ে কবির রচনা ‘ লেনিন ‘ , ‘স্নেহলতার আত্মদান’ ও ‘বালবিধবা’ কবিতার উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, অভিযান বাবু একসময় বহুদিন ধরে ‘ কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য স্মারক সমিতি’র সহ সভাপতিও ছিলেন।

বিশিষ্ট লেখক অজিতেশ নাগ তাঁর ভাষণে কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে ছন্দ মেনে নিখুঁত কবিতা রচনায় পারদর্শী বলে প্রণাম জানিয়েছেন। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছিলেন, কবিতা লিখতে বসে অবশ্যই ছন্দের ব্যবহার জানতে হবে। তবে ছন্দ জানার পর ছন্দের কথা ভুলে যেতে হবে। আধুনিক কবিতা এভাবেই রচিত হচ্ছে। তবে ছন্দ ভোলার আগে তো ছন্দ শিখতে হবে ! কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য দেশী বিদেশী অজস্র ছন্দের নিপুণ প্রয়োগ করে কবিতা লিখতেন। আজকের দিনে নতুন নতুন কবিরা উঠে আসছেন, তাঁদের স্বাগত জানিয়ে তিনি নূতনের আবাহন করেছেন।

কবি স্বপন ভট্টাচার্য, একজন বিশিষ্ট বক্তা তাঁর বক্তব্যে বলেন কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের কবিতা ছন্দনির্ভর হলেও ছন্দ কখনো উৎস ছাড়িয়ে যায় নি। মানব দরদী কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ অজস্র কবিতা রচনা করেছেন, অথচ তাঁকে অনেকেই জানেন না। তাঁকে কম জানা বা না জানা বাংলাভাষীদের বিশেষ করে বাঙালীর লজ্জার বিষয়। আমরা অনেকেই জানিনা কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে। তিনি এত অপ্রচারিত কেন থাকলেন তা আমাদের ভাবায়। এখনকার পাঠকরা কেন বঞ্চিত থাকলেন তাঁর কবিতা পাঠের সুযোগ থেকে?

একজন কবি যথেষ্ট প্রচারিত ও বহুমাত্রায় পঠিত হবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাঙালি সাধারণ পাঠকদের কাছে পৌঁছতে পারলেন না দেখে অবেক্ষণপত্রিকার নজরে আসে সেই সত্তর দশকের দিনগুলোতে। তখন কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য কলকাতার ক্রিস্টোফার রোডের সরকারী আবাসনে। কবির বাসভবনে অবেক্ষণপত্রিকার সম্পাদক ও অন্যান্যরা হাজির হলাম। কয়েকটা সদ্য লেখা কবিতা চেয়ে এনে অবেক্ষণ পত্রিকায় মুদ্রিত করার ব্যবস্থা হয়েছিল। দেখা গেল, পাঠকদের কাছে তাঁর কবিতাগুলো বেশ আদর পাচ্ছে। একটা লিটল ম্যাগাজিন ও পত্রিকার পরিচালকরা এর চাইতে বেশি আর কি করতে পারতেন ? অবেক্ষণপত্রিকা, এই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যাঁরা প্রচার পাননি তাঁদের সামনে আনার প্রয়াস তখন থেকেই চালিয়ে যাচ্ছেন। কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে গত বছর অবেক্ষণপত্রিকা বার্ষিক অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধাস্মরণ করেছে।

স্বরচিত কবিতা পাঠে অংশ নিলেন কবি দীপঙ্কর সেন, সুন্দর ও অনবদ্য কবিতা। সকলের মুগ্ধতা যেন টেনে নিল।

কবি কাজল সেন স্বরচিত কবিতা পাঠের সঙ্গে কামনা করলেন বাংলা কবিতার দিগন্ত প্রসারিত হোক, পুরনো ধারা অতিক্রম করে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লিখতে হবে। তিনি আধুনিক কবিতা পাঠকদের উদ্দেশ্য করে বললেন অনেকেই কবিতা পাঠের আসরে নিজের কবিতা পাঠের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে কবিতা পাঠ করেই সভার বাইরে চলে যান, অন্য কবিদের কবিতা শোনার জন্য আর অপেক্ষা করেন না। ধৈর্য ধরে অপরের কবিতা শোনার জন্য একটু সময় তো দিতেই হয় ! না হলে নতুন কবিতার, উত্তর আধুনিক কবিতার গতি প্রকৃতি অজানাই থেকে যাবে ।

বিদগ্ধ কবি ও আলোচক সৈয়দ হাসমত জালাল তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট করে বললেন – কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যর বিখ্যাত কবিতা ‘ লেনিন ‘ শুধু আবেগ তাড়িত কবিতা নয়। এই কবিতাটি পড়ে মনে হয়েছে এই কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কবি মনের গভীর অনুসন্ধিৎসার প্রকাশ রয়ে গেছে।” ইংরেজদের অপছন্দের সোভিয়েত রাশিয়ার নেতা লেনিনের মৃত্যু নিয়ে যেখানে ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে খবরের প্রাধান্য একেবারেই দেয়া হয় নি সেখানে লেনিনকে নিয়ে এক অসামান্য কবিতা রচনা করা ইংরেজ সরকার ভালভাবে নেয়নি। লেনিনের মৃত্যুর অনেক পরে কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের কাছে সংবাদ পৌঁছেছিল। এই দুঃসংবাদ শোনামাত্র কবি অধীর হয়ে উঠেছিলেন । কবি সুদূর গ্রামে মৈমনসিংহ গৌরীপুরে বসে নিজের আবেগের বশবর্তী হয়ে ২রা চৈত্র ১৩৩০ বঙ্গাব্দে লেনিন সম্পর্কে এক দীর্ঘ কবিতা লিখলেন। সেটি তো মুদ্রিত হয়েছিল রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বঙ্গবাণী পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৩১ সংখ্যায়। ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ কর্তৃক তারপর তাতে লাল কালি দিয়ে পেন্সিলে দাগ কেটে কবির মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল এবং প্রয়োজনে গ্রেপ্তার করার হুকুমও ছিল।
সৌভাগ্যবশতঃ যিনি খবর নিতে এসেছিলেন তিনি কবির ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সর্ব ভারতীয় সাহিত্যে লেলিনের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলির সর্বপ্রথম নিদর্শন রূপে কবিতাটি ঐতিহাসিক মূল্য পেয়েছে।
বক্তা জালাল সাহেব কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের বিভিন্ন কবিতা লক্ষ্য করে দেখেছেন কবির মধ্যে নিপীড়িত জনগণের কথা যেমন আছে তেমনই আছে উপনিষদীয় মনোভাব আর মানবধর্মের প্রতি টানও।

পরবর্তী বক্তা কবি সৌমিত বসু কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের একটি কবিতা পাঠ করেন ও কবির বাড়ি মৈমনসিংহ জানতে পেরে কিছুটা নষ্টালজিক হয়ে পড়েছিলেন কেননা তাঁর মায়ের বাড়ি এই মৈমনসিংহ জেলায় ছিল।

কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের অন্যতম পৌত্র শ্রীমান জয়িষ্ণু ভট্টাচার্য তাঁর পিতামহের সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলার পরই কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের ‘ আধুনিক কবিদের প্রতি ‘ কবিতাটি পাঠ করলেন :-

তোমরা বাঙলা দেশের কবি, হ ও না কেন আধুনিক ,
সত্যি আমি করবো স্বীকার হ ও যেচে ‘নির্বাধুনিক’।
মহৎ ভাবে ঋদ্ধ সবাই ছন্দ কিন্তু করছো জবাই,
ভাবের আবেগ জানাও বটে, আঁধার রেখে চারিদিক ,
ভাষায় বেগের টগবগি নেই, শোনাও কথা প্রামাণিক।

প্রাণের অধিক তোমরা তবু, বুকের গভীর প্রীতি নাও !
বৈজ্ঞানিকী যুক্তিবাদী, আবেগে তাই বাধা পাও ।
সুশিক্ষিত জ্ঞানী মানুষ কেউ ওড়াতে চাও না ফানুস,
মাথার বিচার-বুদ্ধি দিয়েই তোমরা ভাবের তরী বাও,
চতুর্দিকে দৃষ্টি হেনে আস্তে ধীরে চলে যাও !

দেশের মানুষ সোজা সরল, প্রাণের কথা তারা চায়।
বিদ্যা নেহাৎ কমতি তাদের, তাই তো তারা নিরূপায়।
কাঁদছে তারা কত ব্যথায়! সান্ত্বনা দাও সহজ কথায়।
হাসাও মাতাও সোজা ভাষায়, জাগাও দেব প্রতিভায়।
পোকার মতো মরছে তারা সূচীভেদ্য তমসায়।

এরকম আটটি স্তবকের কবিতাটির শেষ অষ্টম স্তবকটি হল –

ছন্দ-মিলের তাল-যতিতে প্রাণের কথা করি পেশ !
মর্জি হলে আর্জি আমার স্মরণ রেখো সবিশেষ।
সবকে আমি মহৎ ভাবি, মূক মানবের জানাই দাবী,
আমায় তোমরা ভুল বুঝো না, যদিও আমার পাকাকেশ !
মহাকালের দরবারী হও, মুখ চেয়ে আজ আছে দেশ।

কবি অরিন্দম মুখোপাধ্যায়, কবি অনুপম দাশশর্মা, কবি দেবাশিস মল্লিক, কবি চন্দন আচার্য কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য সম্পর্কে কিছু কথা বলে স্বরচিত দুটি করে কবিতা পাঠ করেন।
কবি চন্দন আচার্য কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সম্মান প্রাপ্তির বিষয়ে বলেন -“সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ থেকে কবিকে তাঁর শতবর্ষ পূর্তিতে লেনিনের মুখের প্রতিকৃতি সমন্বিত একটি স্বর্ণপদক উপহার কলকাতার রুশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দ্বারা কবির জ্যেষ্ঠ তনয় পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দেয়া হয়।” তিনি তা’ কবিপুত্র কবি ও স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্যের কাছে গিয়ে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন।

আমন্ত্রিত কবিকুল বিভিন্ন বিষয়ের উপর স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন, বিশেষ করে কবি তপজা মিত্র বৃন্দাবনেশ্বরী শ্রীমতী রাধারাণী বিষয়ে দুটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করে যেন মাধুর্যের মধ্যে অন্য সুর জুড়ে মাধুর্যের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলেন।

স্বরচিত কবিতা পাঠ করলেন কবি হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় , কবি কাজরী বসু, কবি অরূপ গুছাইত, কবি দেবার্ঘ সেন, কবি রতন পালিত, কবি পিনাকী রায় । কেউ দুটি বা একটি নিজের প্রিয় কবিতা পাঠ করেন।

সদ্য যৌবনে উত্তীর্ণ কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের অন্যতম প্রপৌত্র শ্রীমান ত্রম্বক ভট্টাচার্য প্রথমে কবির শিশুদের নিয়ে ‘ছোটদের সেরা কবিতা ‘ গ্রন্থ থেকে একটি ছোট কবিতা পাঠ করেই বললেন – আমি সদ্য যৌবনে উঠেছি তাই কবির লেখা ‘যৌবনের গান’ কবিতাটি পড়ে শোনাচ্ছি –

আজ ফাগুনের হালকা হাওয়ায়
গেল মনের খিল খুলে ;
মৌমাছিরা লুটছে মধু,
গাছে কোকিল সব ভুলে !
সে সুর বাজে বুকের তারে,
কি সুখ জাগে বোলবো না রে !
ইচ্ছা করে নতুন করে
সাজাই প্রিয়ায় বনফুলে !

আমরা সবুজ, নিতুই নতুন
চির-চপল সংসারে !
…..
পুলক দিয়ে দূর করি সব
মনের জরা-ঝঙ্কারে !

কুন্ঠা রেখে এসো, প্রিয়া,
আর রোয়ো না কুঞ্চিত !
…….
বর্তমানের সুযোগ থেকে
মিছাই রবে বঞ্চিত ?

এরপর কবি তাপস রুদ্র, কবি নির্মাল্য বিশ্বাস, কবি রুদ্রানী মিশ্র ও কবি পার্থ রায় স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন।

এরপরেই বিশিষ্ট কবি ও আলোচক ড: দীপঙ্কর বাগচী পল্লীবাংলার কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের উপর ভাষণের শুরুতেই বললেন পল্লীবাংলার প্রায় দশজন কবিকে রবীন্দ্র অনুসারী কবি বলে পূর্বেকার সমালোচকরা আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতমরা ছিলেন কুমুদ রঞ্জন মল্লিক,কালিদাস রায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য প্রমুখ। আসলে এঁরা কেউই রবীন্দ্র অনুসারী ছিলেন না, এঁরা প্রত্যেকেই রবীন্দ্র উজ্জ্বল উপস্থিতিতে নিজ নিজ ঘরাণায় নিজ নিজ কলমে পল্লীবাংলার নিত্য প্রয়োজনে সুখ-দুঃখের কথা লিখেছেন। যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য ইংরেজ শাসকদের অপছন্দের ‘ লেনিন ‘ লেখার জন্যে কেউ আর তাঁকে প্রচারের আলোয় এনে শাসকের বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁদের বিষ নজরে পড়তে সাহস করেননি। ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটলেও ততদিনে নতুন কবিপ্রতিভার আগমন ঘটছে তাই কে আর সাহস দেখিয়ে পল্লীকবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের কবিতা আলোর নীচে আনবেন ? আর সেজন্যই তিনি শহরের উজ্জ্বল আলোর নীচে ব্রাত্য হয়েই রয়ে গেছেন। যদিও আট বছরের ছোট কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের উত্তরসূরী বলা হয়েছে তাঁকে। কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য কিন্তু বিভিন্ন ভাষার কবিতা অনুবাদ করেননি। তিনি দেশী বিদেশী বিভিন্ন ছন্দের ব্যবহার করে নিজস্ব মৌলিক কবিতা গুলো রচনা করেছেন। সংস্কৃত ভাষার পঁচাত্তরটি ছন্দ নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। শুধু তা-ই নয় সংস্কৃত ভাষা ছাড়াও পূর্ব এশিয়ার জাপানি ও চীনা ভাষার এবং পশ্চিম এশিয়ার আরবি ফার্সি ইরানীয় ছন্দ ব্যবহার করে অনেকগুলি নিজের কবিতা লিখেছেন। অথচ আজকের পাঠক তাঁকে প্রায় চেনেই না। অবেক্ষণপত্রিকার প্রয়াস এই অসামান্য কবিকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসা দেখে আমরা আনন্দিত। তাঁর মোট একুশ মিনিটের ভাষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছেন উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলী। তিনি যেমন ধন্যবাদ জানিয়েছেন অবেক্ষণপত্রিকা গোষ্ঠীকে তেমনই অবেক্ষণপত্রিকা তাঁকেও অমূল্য সময় দিয়ে অবনীন্দ্রনাথ সভাঘরে এসে এরকম ভাষণ দেবার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন।

কবি অরূপ পান্তী স্বরচিত দুটি কবিতা পাঠ করলেন। কী সুন্দর বললেন – মানুষের জীবনে দুটি ভাগ – এক, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আর দুই, মৃত্যু থেকে বেঁচে থাকা পর্যন্ত। ” অর্থাৎ মানুষের কাজই তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে।

তারপরেই কবি ভারতী বন্দ্যোপাধ্যায় দুটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন।
দুটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবি শম্পা গুপ্ত। এরপর কবি কেকা মল্লিক তাঁর দুটি স্বরচিত কবিতা পাঠের মধ্যে বললেন – একবার প্রেমে পড়ে দ্যাখো।”

এ সময় বহু পঠিত কবি অনিরুদ্ধ সুব্রত স্বরচিত দুটি কবিতা পাঠের সঙ্গে জানালেন আধুনিকতম সোস্যাল মিডিয়া তথা ফেস বুকের কবিতা এখন সহজ লভ্য। পত্রিকা প্রকাশ হবে জেনে অনেকেই কবিতা পাঠিয়ে দেন। চাইলে বা না চাইলেও অনেকেই কবিতা পাঠিয়ে দেন। এই প্রসঙ্গে বলি, আমাদের সময় পত্রিকার জন্য টাইপ সেটিং, শিল্পীদের তৈরী ছবির বা ফটো, কাঠের ব্লক বা তামার ব্লক বা সীসার ব্লক,১/৮ ডিমাই কাগজের পত্রিকা বার করার সময় না চাইলেও অনেকেই কবিতা পাঠিয়ে দিতেন। সম্পাদকদের পছন্দ বা অপছন্দের কোন তোয়াক্কা না করেই এভাবে দপ্তরের ফাইল ভারী হয়ে উঠতো । তবু পরিচিত জনের কবিতা বা অপরিচিত জনের সত্যি পছন্দের কবিতা তখনও আসতো। ছেপে দিলে তো বিচার করার জন্য রয়েছে কাল। কবিতা সময় কালের হাতে ছেড়ে দেয়াই আমাদের কাজ !
অনিরুদ্ধ বাবু আবার কবি ছাড়াও অবেক্ষণপত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর একজন সক্রিয় কর্মী। কবি নিজের দুটি স্বরচিত কবিতা পাঠের মাধ্যমে কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

কবি সুমিতাভ ঘোষাল , কবি রাজীব সিংহ ও কবি সুরঙ্গমা ভট্টাচার্য স্বরচিত দুই বা একটি করে কবিতা পাঠ করেন। কবি সোমা মুখোপাধ্যায় কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের দুটি কবিতা আবৃত্তি করলেন।
কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের ‘ বউ কথা কও’ কবিতা পাঠ করেন কবি তুহিন বন্দ্যোপাধ্যায়।
এরপর যিনি প্রথম থেকেই সঞ্চালনায় ছিলেন সেই কবি ও বাচিক শিল্পী মৌমিতা রাবেয়া স্বরচিত কবিতা ভালবাসার বিনি সূতোয় বাঁধা কবিতা পাঠ করলেন। অপূর্ব কণ্ঠ মাধুর্যের অধিকারী মৌমিতা রাবেয়া।
কবি শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় সুন্দর করে একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন।

এরপর উপস্থিত থাকা কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের তৃতীয় পুত্র শ্রীমনুজেন্দ্র ভট্টাচার্যকে উত্তরীয় পরিয়ে ও যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য স্মারক হাতে তুলে দিয়ে অবেক্ষণপত্রিকার বর্তমান সম্পাদক শ্রীমতী মন্দিরা গাংগুলী প্রণাম জানান।
উল্লেখযোগ্য হল অতিথি বৃন্দদের উত্তরীয় পরিয়ে ও প্রায় সকলেরই হাতে কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য স্মারক উপহার তুলে দেন মন্দিরা গাংগুলী, ঝুলন ভট্টাচার্য, সোমা ভট্টাচার্য, সঞ্চালক মৌমিতা রাবেয়া, ঈশিতা গাংগুলী, সুরঙ্গমা ভট্টাচার্য প্রমুখ জনেরা। সঞ্চালনায় মৌমিতা রাবেয়া ছাড়াও অংশগ্রহণ করেন কবি অনিরুদ্ধ সুব্রত এবং মন্দিরা গাংগুলী।

সভার শেষ পর্যায়ে এই নিটোল সভার সভাপতি সংক্ষিপ্ত ভাষণে শুধু কবিতা পাঠ আর আলোচনার নিটোল ও সমৃদ্ধ সভায় উপস্থিত সকল কবি, আলোচক অংশগ্রহণকারীদের ও যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই টানা চার ঘন্টার আসরটি পুরোমাত্রায় সাফল্যমণ্ডিত হতে পেরেছে শ্রীপ্রবীর গাংগুলী (নিতু), ঈশিতা গাংগুলী, সোমা মুখোপাধ্যায়, নীহার মজুমদার, জয়িষ্ণু ভট্টাচার্য ও অন্যান্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন।
শ্রীমতী ভূমিকা গোস্বামীর পরিচালনায় সমবেত কন্ঠে ‘ আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…..’ গানটি পরিবেশন করে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
তখন রাত নয়টা।

2 thoughts on “সম্পাদকীয়ঃ রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

  1. অনুষ্ঠানের সকলের বক্তব্য এবং কবিতা পুঙ্খানুপুঙ্খ সুন্দর করে তুলেধরার জন্য অনেক ধন্যবাদ জানাই।

  2. অসাধারণ সম্পাদকীয়…..আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানাই 🙏

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *