ধারাবাহিক উপন্যাসঃ দ্বিতীয় পৃথিবী (নবম পর্ব) – অনিরুদ্ধ সুব্রত

দ্বিতীয় পৃথিবী (নবম পর্ব)
অনিরুদ্ধ সুব্রত

উচ্চ মাধ্যমিকের পাশাপাশি ঋ নার্সিয়ের একটা এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসেছিল। রণিতা, সুমিত এমনকি ঋ নিজেও কখনও মনে করেনি, সেটাতে অনায়াসে সুযোগ পাবে ঋ। সহপাঠীদের অনেকের সঙ্গে ফর্ম পুরন করে দিয়েছিল। যথাসময়ে অ্যাডমিটকার্ড এসে হাজির। তারপর হৈ হৈ করে পরীক্ষায় বসা এবং খানিকটা অবাক করে দিয়ে পড়ার সুযোগ।
ঋকে নার্সিং কলেজে ভর্তি করা হয়েছে কিছুদিন হলো। আজ হোস্টেলে পৌঁছে দিতে এসেছিল সুমিত। ঋ জানে, বাবার এক্ষেত্রে ভূমিকা বড় নিঃশব্দ। কেননা সুমিতের ইচ্ছে ছিল মেয়ে একাডেমিক পড়াশোনা করে অনেক দূর যাক। তাছাড়া ঋ এও জানত, কোনো বিশেষ কোর্সে ভর্তি হতে এবং তা সম্পূর্ণ করতে যে খরচ, বাবার পক্ষে সেটা বহন করা কঠিন বা অসম্ভব বললেও ভুল হবে না। তাই সুমিতের মতো ঋ নিজেও অপেক্ষাকৃত কম বা স্বাভাবিক খরচের সাধারণ একাডেমিক পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চেয়েছ উচ্চ মাধ্যমিকের পর ঋ কম্পিউটারের একটা চলতি কোর্সে ভর্তি হয়ে, একটু কম্পিউটার ব্যবহারে সড়গড় হচ্ছিল। আর সেখানেই পরিচয় হয়েছিল বছর দুয়েকের সিনিয়র গৌতমের সঙ্গে। পড়াশোনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে গৌতম ঋকে তার মতো করে বোঝাতে শুরু করে। যেন ভিতরে ভিতরে গৌতম ঋকে একটা সহানুভব আর সহযোগীর ভালবাসা দিতে চেয়েছিল। ঋ খুব স্পষ্ট করে গৌতমের অন্তর্জগৎ না বুঝতে পারলেও, গৌতমের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে ঋর কাছে জায়গা পেতে শুরু করেছিল। প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন তাদের একসঙ্গে কম্পিউটার ক্লাসে কাটানো। মাঝে মধ্যে ঋকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া এমনকি ঋ গ্রাজুয়েশন- এর সমান্তরালে প্রথাগত চাকরির পড়াশোনা করবে– এটা বোঝানোর একজন নিকট বন্ধু হয়ে উঠেছিল।
রণিতা যেদিন ঘরের দরজা থেকে লক্ষ্য করেছিল, একটি অল্পবয়সী ছেলে ঋকে স্কুটি থেকে গলির মোড়ে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আবার চকলেট উপহার দিচ্ছে, সেই থেকে রণিতার মনে মনে একটা পরিকল্পনা তৈরি হতে থাকে,
“— ঋকে এমন কোনো পড়াশোনার মধ্যে ঢোকাতে পারলে ভালো হয়, যাতে সে একটু দূরে কোথাও পড়তে যায়।”
আজ সুমিত যখন ঋকে হোস্টেলে রেখে এলো, তখন ঋ খুব কেঁদেছিল। বাবা হয়ে সুমিত নিজেও কান্না সম্বরণ করতে পারছিল না। বরাবর ঋ সুমিতের প্রতি একটু বেশিই দুর্বল। ছোটো বেলা থেকে বাবাকে খানিকটা অসহায় ভেবে এসেছে সে। খুব ছোটবেলা থেকেই, ঋ লক্ষ্য করত, বাবার কাছে কোনো কিছু দাবি করলে বাবার মুখের উজ্জ্বলতা কেমন ধীরে ধীরে কমে আসত।
মায়ের সঙ্গে বাবার মধ্যে মাঝেই অর্থনৈতিক কারণে কথাকাটাকাটি, ঋর দৃষ্টি এড়ায় নি। বাবা মাকে কতবার বলত,
“— মেয়ের সামনে এসব নিয়ে কথা বলা বন্ধ করতে পারো না রণিতা ?
— কেন ? মেয়ে যদি শুনতে পায় তো শুনুক। বুঝুক, তার বাবার আয়ত্ত কতটা। তাতে তোমারই সুবিধা সুমিত, ভবিষ্যতে সে চাওয়া পাওয়া থেকে চুপ থাকবে।”
বড় হতে হতে এসব অভিজ্ঞতা কম হয়নি ঋর। বাবার অক্ষমতা সে সব বুঝত। কিন্তু বাবার আলাদা একটা সুন্দর কবিমন আর সেই মনের মধ্যে কোথাও ঋ পার্থিব চাহিদার খোঁজ পেত না। ঋর কখনও কখনও অহংকার হতো তার বাবার বিশেষ এই অন্তঃকরণের জন্য। আবার ঋ এটাও বুঝতে পারত, তার মায়ের কাছে সুস্থ জীবন যাপন নিয়ে একটা স্থায়ী ভরসার চিন্তাটা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। যৌক্তিক দিক থেকে তাই ঋ মায়ের কথা গুলোও খুব যে অমূলক— তাও কখনও মনে করতে পারত না। আর এই জটিলতার মাঝখানে ঋকে প্রতিদিন একটু একটু করে নীরব হতে হয়েছিল।
গৌতমদা ঋকে কত কি বুঝতে সাহায্য করল। বিশেষ করে ঋ নিজের পারিবারিক পরিস্থিতি থেকে যেমন জীবনকে চিনতে পারছিল, গৌতম সেখানে যথার্থ ভাবে ঋর মনে শক্তি সঞ্চার করতে পেরেছিল। ঋ তখন ভাবতে শুরু করেছিল,
“— আমাকে দৃঢ় হয়ে উঠতে হবে। তাতে বাবার এবং মায়ের যেমন অনিশ্চয়তা দূর হবে, তেমনি আমার জীবনকে আমিই সাজাতে পারব।”
কিন্তু একটা জিনিস নিয়ে মন বড্ড খারাপ ছিল তার, মায়ের দিন দিন মার্কেটিং বিজনেসে ইনভলবড হয়ে যাওয়া। যার অবধারিত গতিতে বাপ্পাদিত্য লোকটার সঙ্গে মায়ের অস্পষ্ট একটা সম্পর্ক। কিন্তু বাপ্পাদিত্য যে মায়ের জন্য বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেন এবং তাতে মায়ের বিজনেস পারফরম্যান্স খুব সুন্দর হচ্ছে— এটাও ঋ বুঝতে পারত। ফলে বাপ্পাদিত্য মানুষটাকে মা যে ক্রমশ আপন করে নিচ্ছে— এই সত্য টুকু ঋ বুঝতে পেরে বাবার জন্য ব্যথিত হতো তবু মাকে কখনোই টানতে চায় নি। আসলে খুব অল্প বয়স হলেও ঋ যেন বাবা আর মায়ের মাঝখানে খানিকটা উপর থেকে সুস্পষ্ট দেখতে পাওয়া এক শান্ত চেতনা। যে সব বুঝেও কাউকে কোথাও আটকাতে যেতে চায় নি। কেননা ঋর মনে হয়েছিল, বাবা আর মা দুজনে একই প্রকৃতির মানুষ নয়। তাই তাদের দুজনের আলাদা যুক্তিতে তাদের সহজে প্রতিহত করা যায় না।
তবু ঋ বয়সে সদ্য অষ্টাদশী হতে চলা। সুমিতের আজ মন খুব খারাপ লাগছে। এতো দিন নানা অক্ষমতার মধ্যে দিয়েও সুমিত নিজের হাজার ব্যর্থতায় কখনও মেয়ের মুখে অসন্তুষ্টি লক্ষ্য করে নি। নিজে সে যখনই বাড়ি ফিরেছে, মেয়ে অপেক্ষা করেছে । রণিতা কতবার রেগে গিয়ে কত খারাপ কথা বলেছে, ঋ বাবার কাছে গিয়ে অনুরোধ করেছে,
“— ওসব কথায় তুমি মাথা খারাপ কোরো না বাবা। তুমি তোমার লেখা নিয়ে থাকো।”
এমন কথা শুনে সুমিত নিজেও যেন ঋর কাছ থেকে এক শাশ্বত মায়ের মতো আপ্ত বাক্য পেয়েছে। কতদিন হয়ে গেছে, বাড়িতে রণিতার সঙ্গে সুমিতের খুব বেশি কিছু প্রয়োজন ছাড়া পরস্পরের মধ্যে কথাবার্তা হয়না। কিন্তু সুমিত বাড়ি ফিরে ঋর সঙ্গে কথা বলে, সেটুকু সহজ করে বেঁচে থাকত। মনে করত,
“— তবু তো মেয়েটা সব বোঝে।”
পাশাপাশি রণিতা ভাবত,”— সুমিত নিজে অক্ষম হয়েও আমার এই বিজনেসে যেমন অমত করে নি, তেমনি চরম উৎসাহ কখনও দেখায় নি। তা ছাড়া ওর ঐ এক কবি হওয়ার স্বপ্ন, ওকে চির দায়ীত্ববোধহীন অলস করে তুলেছে। কিন্তু ওর সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলা বৃথা। তবু মেয়েটা আছে বলে বাড়িতে এসে দুদণ্ড কথা বলা যায়। মেয়েটা নিশ্চয়ই আমাকে বোঝে।”
মেয়েকে হোস্টেলে রেখে ফিরছে সুমিত ।ট্রেনের জানালার পাশে বসে, অন্যদিন সে জীবনের গতি আর নিজের ব্যর্থ জীবনের কথা ভাবে। আজকে শুধু ঋর মুখটা ভাসছে তার মনে। বিদায় জানিয়ে ফেরার সময় সুমিত দেখেছিল ঋ নিঃশব্দে কাঁদছে। মুখে শুধু বলেছিল,
“— বাবা মন খারাপ করে থেকো না, মায়ের লড়াইটাও মনে রেখো।”
উত্তরে সুমিত শুধু বলেছিল,
“— তুই ওসব নিয়ে একটুও চিন্তা করিস না ঋ । শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করে যা।”
ঋ জানত, ঋর এই নতুন কোর্সের সমস্ত খরচ মা বহন করতে বদ্ধপরিকর। সে কথা রণিতা মেয়েকে একান্তে বলেছিল। সুমিত যখন শুনেছিল, মেয়ে নার্সিং কোর্সে ভর্তি হচ্ছে তখন তার মন খারাপ হয়েছিল নিজের জন্য। ভাবছিল, এবার তাকে কিছু একটা উপায় করতে হবে। যাতে মেয়ের পড়ার খরচটা সে অতিরিক্ত জোগাড় করতে পারে। কিন্তু তারপর, ঋ সেটা বুঝতে পেরে বাবাকে বলেছিল,
“— তুমি চিন্তা কোরো না বাবা, মা বলেছে, কোনো সমস্যা হবে না। তাছাড়া সরকারি কোর্সে খরচ খুব বেশি নয়।”
তবু ঋর জন্য কান্না পাচ্ছে সুমিতের। ট্রেনের জানলার বাইরে অনেক দূর পর্যন্ত যেন তার দৃষ্টি যাচ্ছে না। বার বার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে।
সুমিত নিজের ব্যর্থতার জন্য কেবল নিজেকেই দায়ী করে। রণিতার বা তার পারিবারিক পরিত্যাগে তার ততটা অভিযোগ নেই। বরং একটা গোপন লজ্জা আছে এই সৃজিত সংসারে এসে ক্লাসের লাস্ট বয় হয়ে পেছন বেঞ্চে লেপ্টে থাকার জন্য। আসলে জীবনে বেঁচে থাকার লড়াইটা তাকে কেন কোনো দিন চরম ভাবে টানল না, সেটাও সে ভাবে।
অথচ সুমিত প্রথম থেকেই ভাবত, একটা শিক্ষকতার কাজ পেলে সে জীবনে বাঁচে। তাতে তার পড়াশোনাটার ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়বে না, আবার সে লেখালিখিটা জড়িয়ে ধরে থাকতে পারবে। কিন্তু স্কুল সার্ভিস পরীক্ষায় সে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে বসল না। বরং সেই সময়ে কয়েক ডজন লিটল ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক হয়ে উঠল। ফল যা তাই, সুযোগ তো আর ফাঁকির বিনিময়ে আসে না। তারপর একটা সময় এলো স্থানীয় হাইস্কুলে প্যারাটিচারের পদে যোগদানের সুযোগ। সুমিত সাদরে তা গ্রহণ করল। আর এই সুযোগ নেবার পর থেকে স্কুল সার্ভিসের জন্য চিন্তা ভাবনাটুকুও ভষ্মের মতো উড়ে গেল।
সুমিতের এই মনের ভিতর থেকে তাড়নাহীন শ্লথ গতি, তাকে সামান্যে বেঁধে দিল। সীমিত অর্থ উপার্জনের কষ্টটাই যেন সে ঠিক ঠাক অনুধাবন করতে দেরি করল। অথচ দিন যত এগিয়ে গেল আয় সেই প্রেক্ষিতে, তেমন হারে বৃদ্ধি পেল না। যার অবধারিত ফল— পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ। টিউশনি করে বেড়ানোতেও তার বড্ড অনিহা। বিশেষ করে টিউশানির বাধ্যবাধকতা তার মেলে না। কথা দিয়ে কথা রাখা হয় না। ছাত্র-ছাত্রীরা সেই খাপছাড়া পাঠ নেবে কেন ? অতএব ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তারা। সুমিতও বাড়তি উপার্জন টুকু দিন দিন হারিয়ে ফেলে।
সুমিতের আজ এসব কথা সহজেই মনে হচ্ছে। ঋকে পড়াশোনা করাতে সে বাবা হিসেবে অনেকখানি ব্যর্থ— যেভাবেই হোক এই সত্য আজ প্রমাণিত। যদিও রণিতার দায়িত্বের প্রতি সুমিতের আন্তরিক শ্রদ্ধা রয়েছে। রণিতা একান্ত গৃহবধূ থেকে আজকে বেশ প্রতিষ্ঠিত মানুষ। সে দৃঢ় ভাবে ঋর সমস্ত রকম খরচ চালাতে সমর্থ হয়েছে— এই প্রকৃষ্ট উদ্দেশ্যকে শ্রদ্ধা না করে সুমিত পারবে কীভাবে। রণিতা যতই রেগে থাকুক সুমিতের উপর, তবু অন্তরে সে যে সার্থক মা। সুমিত সেটা বিশ্বাস করে ।
কিন্তু এতদিন একই বাড়িতে ঋ যেন মাঝখানে ছিল। একদিকে সুমিত, অন্য দিকে রণিতা। দীর্ঘ প্রায় দেড় দুবছরের বিচ্ছিন্ন দাম্পত্য তাদের। ঋকে মাঝখানে রেখে একটি তিন সদস্যের পরিবার শেষ পর্যন্ত সার্থক ত্রিভূজ আকার পেয়েছিল। কিন্তু ঋকে হস্টেলে রেখে এসে আজ সেই ত্রিভূজ কি সমান্তরাল দুটি বাহুর মতো সমদূরত্বে পাশাপাশি বয়ে যাবে ?
সুমিত জানে, রণিতা তাকে ঘৃণা করতে পারে না। তার প্রতি রণিতার বিরক্তি আছে, অভিযোগ আছে কিন্তু একদিন সে তাকে ভালবেসেছিল। সুমিত এও জানে,
“— বাপ্পাদিত্যর প্রসঙ্গ তো রণিতা নিজে থেকে আনেনি, এসেছে আমার অপারগতার সূত্রে। রণিতা একটু একটু করে বাপ্পাদিত্যকে ভরসা করতে শিখেছে। অথচ তা বুঝতে পেরেও আমি রণিতাকে প্রতিহত করতে পারিনি। নিজের অক্ষমতা দিয়ে সে তো সম্ভব নয়। তাছাড়া রণিতার উপর আমারও তো অভিমান হতে পারে। এই পৃথিবীতে কোনো সম্পর্কের উপর জোর যে চলে না, এটা তো অকাট্য সত্যি ।”
সুমিতের বিশ্বাস আর প্রতিক্রিয়া তাই সময়ের ঘাতে ঘাতে শান্ত আর ঔদাসীন্যে ভরে উঠেছে। কিন্তু মৌলিক ধারণা এতটুকু নড়চড় হয়নি। রণিতার চাহিদার প্রশ্নে সুমিত যেমন অসহায় হয়ে চুপ থেকেছে, তেমনি রণিতার নতুন গতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে নি। মনে হয়েছে, রণিতা একদিন পুরনো খাতে ফিরবে।
এই সব ভাবতে ভাবতেই সুমিতের মনে এসেছে অমৃতার প্রসঙ্গ। সুমিত জানে, অমৃতার যে ভালবাসা আজ তাকে এতখানি গভীরে বাঁচিয়ে রাখে, তারও কোনো সুস্থায়ী দীর্ঘ যাপন নেই। অমৃতার বর্তমানের সঙ্গে তার বর্তমানের বিস্তর ফারাক। ভালবাসার মগ্ন মিলনে কেবল স্বপ্ন আর সাধের উল্লসিত আলোচনা হয়, তারপর শীতল পৃথিবীতে আঙুলে শুধু পাথর।
সেখানে যে দ্বিতীয় পৃথিবীর ধারণা জন্মে, ঘুম ভাঙা স্বপ্নের কর্কশে তা পুনরায় ধোঁয়ায় ভরে যায়। সেই রাতের পর থেকে আজ মাসাধিক কাল অতিবাহিত হয়েছে। সুমিত আর অমৃতা মুখোমুখি হতে তো পারে নি। কথা হয়েছে ফোনে। লেখা লিখি চলেছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। কিন্তু হৃদয়, শরীর সে সবে তো রক্তের চলাচল । আঙুল তো স্পর্শ বোঝে, না পেলে তার ভার বৃদ্ধি হয়।
ইতিমধ্যে অমৃতার নানাবিধ ব্যস্ততা বেড়েছে। কলেজের কাজ থেকে শুরু করে একটা প্রজেক্ট ওয়ার্কে ওকে দিল্লি যেতে হচ্ছে। বেশ কিছুদিন ও ভীষণ ব্যস্ত থাকবে, সে কথা সুমিতকে জানিয়েছে অমৃতা। তাছাড়া বিক্রমের হাউজিং বিজনেস এখন চরমে। গৌহাটি থেকে ফিরে বিক্রম অমৃতার সঙ্গে এই মুহূর্তে বেশ আন্তরিক ব্যবহার করছে। একদিন রাতে সে কথা অমৃতা বলছিল সুমিতকে। এমনকি অমৃতা বলছিল,
“— দেখো সুমিত, বিক্রমকে আমি তো সত্যিই ভালবেসেছিলাম । ও হয়তো আমাকে ওর মনের মতো মনে করেনি। তাছাড়া ও মেয়েদের মন নিয়ে বিশেষ ভাবে না কখনও। আর ওর একমাত্র লক্ষ্য হলো ওর অর্থনৈতিক সাফল্য। বাকিটা প্রায় প্রয়োজন মনে করে জীবনের। কিন্তু প্রথম যৌবনে ওকে পেয়েছি, ওকেই ভালবেসেছি। তুমি এসেছ অনেক পরে।”
সুমিত অমৃতার এ সব কথা কেবল শুনে গেছে হ্যাঁ হ্যাঁ করে। ঐ সাড়া টুকু ছাড়া সুমিতের বলার মতো তেমন কিছু ছিলও না। বরং এই সত্যি কথা গুলো শুনতে শুনতে সুমিত সেই রাতের শরীরী সম্পর্কের পর থেকে বয়ে চলা ভারটুকু শুধু কবিতার উপর রেখে দিয়ে চুপ করতে চেষ্টা করেছে। সুমিতের মনে হয়েছে,
“— ভালবাসা, প্রেম এরও কি উত্থান পতন হয় ? ক্রম পর্যায় থেকে যে পরবর্তী তীব্রতা জন্মে, তাকেও প্রশমিত করে ফিরে গিয়ে দাঁড়াতে হয় কি পুরানো জায়গায় ?”
কিন্তু এ শুধুমাত্র সুমিতের মনে বুদবুদের মতো হতে থাকা ঘটনা সে। অমৃতাকে সে কিছুই বলতে চায় নি। শুধু অমৃতার কর্মব্যস্ততার তালিকা পড়ে পড়ে কাটিয়ে দিয়েছে অনেক রাত।
আজ রণিতার ঘরের দিকে ফিরছে সুমিত। সেখানে ঋ নেই। আজ সন্ধে পেরনো রাতে সুমিত কি সেই নিঃশব্দ দেয়ালের সঙ্গে কথা বলতে বলতে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়তে পারবে ? নাকি রণিতা ঋর অনুপস্থিতিতে সুমিতের সঙ্গে আবার নিজস্ব কথপোকথনের পরিবেশে ফিরবে ? যেন কিছুই জানে না সুমিত। অথচ এই পৃথিবী থেকে স্বতন্ত্র পৃথিবীও কেবল অস্পষ্টতায় ভরা।
জানলার পাশ থেকে উঠে পড়ে সুমিত। পলাশ পুর ঢুকছে ট্রেন। সুমিত এগিয়ে যায় গেটের কাছে। গায়ে এসে লাগে ভিজে হাওয়া। হঠাৎ প্যন্টের পকেটে ভাইব্রেট করে ওঠে মোবাইল। পকেট হাতড়ে বের করে দেখে, অমৃতা তাকে ফোন করছে। রিসিভ করে সুমিত।

(এরপর আগামী পর্বে)

— অনিরুদ্ধ সুব্রত

One thought on “ধারাবাহিক উপন্যাসঃ দ্বিতীয় পৃথিবী (নবম পর্ব) – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. বাঃ। সুন্দর এগোচ্ছে কাহিনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *