নিবন্ধঃ আজও আছো স্বমহিমায় কবি নজরুল – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

আজও আছো স্বমহিমায় কবি নজরুল
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

” মুসলিম আর হিন্দু মোরা দুই সহোদর ভাই
এক বৃন্তে দু:’টি কুসুম এক ভারতে ঠাঁই ॥……..” (ক্র. সং.১)

এরকম কবিতা যে কোনো বাংলা ভাষী মানুষ চোখ বন্দ্ধ করে বলতে পারেন, এই কবিতা বাংলার নজরুলের। তিনি ধর্মে ধর্মে বিভেদ ঘুচিয়ে সকলকে একত্রিত বিদ্বেষহীন দেখতে আশা করতেন। এই কবির পক্ষে তাই অনায়াসে লেখা সম্ভব। তিনি লিখেছিলেন :-

” নমঃ নমঃ নমো বাংলা দেশ মম
চির-মনোহর চির মধুর ।
বুকে ,নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নূপুর।।

শিয়রে গিরি-রাজ হিমালয় প্রহরী
আশিস – মেঘবারি সদা তার ‘পরে ঝরি’
যেন উমার চেয়ে এ আদরিণী মেয়ে,
ওড়ে আকাশ ছেয়ে মেঘ চিকুর।।
…………
………..

এই দেশের মাটি জল ও ফুলে ফলে,
যে রস যে সুধা নাহি ভূমণ্ডলে,
এই মায়ের বুকে হেসে খেলে সুখে
ঘুমাব এই বুকে স্বপ্নাতুর।” (ক্র.সং.৩)

এই নিজ জন্মভূমি বাংলা দেশ (অখণ্ড বাংলা। দেশভাগের আগের বাংলা দেশ।) কবি নজরুলের মাতৃভুখণ্ডকে প্রণাম করলেন নমঃ নমঃ নমো বলে।

শুধু কবি না বলে, বিদ্রোহী কবি নজরুল বলেন অনেকেই। এই স্বনামধন্য কবির জন্ম বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ২৫ শে মে ১৮৯৮ সালে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথঠাকুরেরর চাইতে বয়েসে ৩৭/৩৮ বছরের নীচে নজরুল ইসলামের প্রতি স্বয়ং কবিগুরুর ছিল স্বাভাবিক প্রীতি ও অফুরন্ত স্নেহ।
কাজী নজরুল ইসলামকে বিভিন্ন শ্রমসাধ্য কর্মমুখর জীবন কাটাতে হয়েছে। কিন্তু, গান অন্তঃপ্রাণ নজরুল কবিতা আর গান রচনায় নতুনত্ব এনে দিলেন।
এক সময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মার্গসঙ্গীতের ধারা থেকে বাংলা গানের ধারা দেশী ও বিদেশী সুরের উদার অভ্যর্থনার মধ্যে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন। কাজী নজরুল কিন্তু বাংলা গানে মধ্যপ্রাচ্যের অজস্র শব্দ যেমন সুরা ও সাকী, সওয়েশিসের শ্যামলিমা ইত্যাদি নতুন স্বাদ,বাংলা ভাষায় আমদানি করলেন।

নজরুলের ক্রিস্টোফার রোডের সরকারি বাসভবনের আরেকটি বাসায় বাস করতেন মৈমনসিংহ জেলার…. গৌরীপুরের রাজবাড়ীর কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য (১৮৯০ – ১৯৭৫)।
তুলনায় কম প্রচারিত এই কবি, যিনি লেনিনের মৃত্যুর খবর জেনে সর্ব প্রথম বাংলায় লেনিন কবিতা লিখেছিলেন। সেই যতীন্দ্র প্রসাদ ভট্টাচার্য পঁচাত্তরটি সংস্কৃত ছন্দ প্রয়োগ করে নিজের ভাষা বাংলায় কবিতা রচনা করেছিলেন।
উল্লেখ্য, নজরুল তাঁকে দাদার মত দেখতেন ও প্রণাম করতেন।

নজরুল ইসলাম ছিলেন সত্যিকারের মানুষ । তিনি সকলের প্রতি সমান ভালোবাসা সম্ভ্রম দেখাতে চাইতেন । একটা নিষ্পাপ শিশুর মত ছিল তাঁর জীবন চর্যা ও ভাবনার জগৎ।

‘নজরুল গীতি’ প্রসঙ্গে কবিপুত্র কাজী অনিরুদ্ধ আরও বলেছিলেন – ” বৈষ্ণব যাঁরা তাঁরা রাধাকৃষ্ণের বাল্যলীলা ইত্যাদি সহ গোষ্ঠলীলার সুরচিত্র দর্শনের দুর্লভ সুযোগ লাভ করবেন ;
শাক্ত যিনি তিনি শ্যামামায়ের পায়ের তলায় নিজের মনটিকে একটি রাঙা জবা করে ধরে দিতে পারেন নজরুলের শ্যামা সঙীতের খেয়ায় ভেসে।
মুসলমান যিনি তিনি ঈদ মুবারকের বাঁকা চাঁদ প্রথম দেখার আনন্দে আত্মহারা হবার ভাষা খুঁজে পাবেন এই নজরুল গীতির ভাণ্ডার থেকেই।
প্রেমিক যিনি তিনি প্রেমের বিভিন্ন স্তরের সুখের ও শোকের সাড়া পাবেন নজরুলের গানে । তাঁর হাসির গানের সংখ্যাও কম নয়। (সর্বোপরি) তাঁর দেশাত্মবোধক গান সারা বাংলা তথা ভারতের নিপীড়িত জনগণের অন্তর-মথিত বাণী।”

নজরুল লিখেছেন :-

” উদার ভারত ! সকল মানবে
দিয়াছ তোমার কোলে স্থান।
পার্সী-জৈন-বৌদ্ধ-হিন্দু
খৃষ্টান-শিখ-মুসলমান।।
তুমি পারাবার, তোমাতে আসিয়া
মিলেছে সকল ধর্ম জাতি,
আপনি সহিয়া ত্যাগের বেদনা
সকল দেশেরে করেছ জ্ঞাতি ; …….”(ক্র.সং.৭)

বিমূঢ় হয়ে যাই যখন দেখি তিনি বৈষ্ণবদের জন্য কৃষ্ণ লীলার গান লিখতে গিয়ে শ্রীগৌরসুন্দরের কথা ভুলে যাননি, বরং শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন শচীমাতার কথাও :-
” ……. নদীয়াতে গোরা
ডেকে যেত এমনি সুরে এমনি পাগল-করা
কেঁদে ডাক্ ত বৃথাই শচীমাতা, সাধ্ ত বসুন্ধরা,
প্রেমে গলে যত ন‍রনারী যাচ্ ত পদ-রেণু।।…….” (ক্র সং ৩০৫)
ভাবা যায়! বাংলার নব জাগরণের কর্ণধারকে কবি কী সুন্দর ভাবে কত ভালোবাসায় স্মরণ করেছেন।

কবি নজরুল যেন ভক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব কামনা করেন। তাই তিনি অনায়াসে লিখতে পারেন :-
” বাজিয়ে বাঁশি মনের বনে
এস কিশোর বংশীধারী।
চূড়ায় বেঁধে ময়ূর-পাখা
বামে লয়ে রাধাপ্যারী ॥…..”(ক্র.সং.৩০৪)

কবি নজরুল বাংলার দুর্গাপূজার লৌকিক ভাবে বিভোর হয়ে লেখেন এবং দুর্গার আগমনে সমগ্ৰ দেশের জয় আসবে তাতে বিশ্বাস করেন :-

” অশুর-বাড়ির ফেরৎ এ মা,
শ্বশুর-বাড়ির ফেরৎ নয়
দশভুজার করিস পূজা
ভুলরূপে সব জগতময়?

নয় গৌরা নয় এ উমা
মেনকা যার খেত চুমা,
রুদ্রাণী এ, এ যে ভূমা
…………

অসুর দানব করল শাসন
এইরূপে মা বারে বারে,
রাবণ-বধের বর দিল মা
এইরূপে রাম-অবতারে ……” (ক্র.সং.৩১৩)

কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর রচনা নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে বিভিন্ন বিদগ্ধ জনের লেখায়। আশা করি বর্তমান ও ভবিষ্যতের গুণী জনেরা আরও আরও গবেষণায় যুক্ত থেকে নতুন নতুন আবিষ্কার করবেন। নজরুল এক মহান এবং বিরল ব্যক্তিত্ব। তাঁকে নিয়ে অনেক ভাবনা করার আছে ও থাকবে।
তাঁর জন্মমাসে তাঁকে জানাই প্রণাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *