মুক্তগদ্যঃ আমি পাভেলের মা – ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

আমি পাভেলের মা
ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

(ম্যাক্সিম গোর্কির ১৫৫ তম জন্মদিন স্মরণে)

ও আপনারা সবাই এসে গেছেন? অনেক অনেক দিন পর এমন মুখোমুখি দেখা। চিনতে কি অসুবিধা হচ্ছে? সেই একটু ঝুঁকে আছি, লম্বা ভাঙা একটা মুখ,ডান ভ্রুতে গভীর কাটা দাগ,দুটো শক্ত পরিশ্রমী হাত। এখনোও আমি নি:শব্দে ছায়ার মতো হেঁটে যাই। তাও স্মরণে আসছে না?
আমি পেলাগেয়া নিলভনা ভ্লাসভ। না, এপরিচয়টা আমার কাছে তেমন আর অর্থবহ বা গুরুত্বপূরণ নয়। আমি পাভেলের মা। আমি বিদ্রোহ থেকে জন্মেছি। অন্যায় আর শোষণ আর বঞ্চনা আর দারিদ্রের মধ্যে থাকতে থাকতে আমি ও আমার মতো অগণিত মা মেয়ে বধূরা ভুলে গেছিলাম আমাদের ঘরকন্না ছাড়াও এই পৃথিবীতে আরও অর্থপূর্ণ কাজ আছে। সবসময় মা জন্ম দেয়না সন্তানকে। সন্তানও গড়ে তোলে এক ঋজু, নির্ভীক আপোশহীন মাকে। আমার পাভেল তো তাই করল। পাভেল পাভেলের বন্ধু আন্দ্রেই আমার আন্দ্রেউসা যাকে আমি প্রাণ ভরে ভালবেসেছি। আমার খখল।
যে মহান নভেম্বর বিপ্লব রাশিয়ার শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির বিপ্লব, তার বীজ বোনা হয়েছিল আমাদের ছেলে মেয়েদের হাতে। আহা কত ত্যাগই না স্বীকার করেছে আমার বাছারা। আন্দ্রেই,নাতাশা,নিকলাই ফিওদর সাশা মাজিন ইভান বুকিন রীবিন, সোমভ, ইয়াকফ, সোফিয়া কত নাম বলব। সমাজতন্ত্র পাভেলের স্বপ্ন ছিল। সে কথা সে সোচ্চারে বললে তার বিচারের সময়। আমরা কেউ কি নিছক উপন্যাসের চরিত্র? আমাদের কি শুধু গোর্কিই সৃষ্টি করেছেন? আমরা তো ছিলাম শ্রমক কৃষকের ঘরে ঘরে। ছিলাম ধনী জমিদারের সন্তানের মধ্যে সাহস ও ত্যাগ হয়ে। বুকে হাত দিয়ে বল কমরেডরা আমাদের প্রতিটি কাজ প্রতিটি ভাবনা তোমাদের নাড়িয়ে দেয়নি? প্রণোদিত করেনি মানুষের মতো বাঁচার অধিকারের জন্য সরব হতে? বলেনি কি সংঘবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে? শেখায়নি কি প্রত্যেক বঞ্চিতের অত্যাচারিতের হয়ে আওয়াজ তুলতে? আমরা যে কথাগুলো প্রচার করেছি, পাভেল তার বিচারের সময় যে বক্তৃতা দিয়েছে তার প্রয়োজন কি ফুরিয়েছে? আমি বলছি ফুরায়নি। আমরা আজও প্রাসঙ্গিক। যেখানেই ন্যায্য লড়াই, মনুষ্যতের স্বপক্ষে লড়াই আমরা সেখানেই প্রাসঙ্গিক।
কোথা থেকে শুরু করি? আচ্ছা আমাদের মতো সাধারণ মা মেয়ে বধূদের দিয়ে শুরু করি। এই ভারতবর্ষে কেমন আছে তারা?
শতবর্ষেরও বেশি সময় চলে গেল। পাভেলের বাবা আমায় মেরে মেরে পিঠ বাঁকিয়ে দিয়েছিল। আমার আত্মাটাকেই মেরে এনেছিল প্রায়। আর বাবা বলেছিল বিয়ের আগে, “যা মুখপুড়ী, মুখ বাঁকাচ্ছে দেখ না! নেহাত বেকুব না হলে কোন্ ব্যাটা তোকে বিয়ে করবে? পাস যদি কাউকে তো সাতপুরুষের ভাগ্যি। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, বিয়ে হবে,ছেলে বিয়োবি,নাকের জলে চোখের জলে এক হবে। দুনিয়া সুদ্দু তো ওই হচ্ছে। তুই আবার কোথাকার কে এলি!’
কিন্তু খুব কিছু বদলাল না। এই ইনক্রিডিবল্ ইন্ডিয়ায় তেলেঙ্গানায় ৮৩.৮% মহিলা বউ পেটানোকে সমর্থন করে। কর্ণাটকে আশি শতাংশের ওপর পুরুষ মানুষ বাড়ির মেয়েদের বিশেষত স্ত্রীর গায়ে হাত তোলাকে অপরাধ মনে করে না। আর প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গের ৪২% মেয়ে স্বামীর হাতে পিটুনি খেতে রাজি। হ্যাঁ অবশ্যই অনেক মেয়ের জীবিকা, ও সঙ্গী বাছাইএর স্বাধীনতা পাচ্ছে। কিছু মহিলার পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা হয়েছে। আর এসবই এসেছে শিক্ষার হাত ধরে অথবা বুদ্ধির জোরে। রোজগেরে মেয়েদের সব স্বাধীনতা কি আছে? শতকরা হিসেবে খুব একটা চোখে পড়ার মতো না। অতিমারিতে মেয়েদের জীবিকায় টান পড়েছে সব চেয়ে বেশি। পরিস্থিতি বদলালেও তারা আর কাজে ফিরতে পারছে না। কাজেই তাদের ক্রয়ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তলানিতে। নিম্নবিত্তের ঘরে রোজ মাতলামি,ঝগড়া,মারপিট। শিক্ষা ক্ষেত্র নানা রকম শ্রীতে মুড়ে ফেলার পরও নাবালিকার বিয়ে হয়েই যাচ্ছে। এদিকে আর এক জ্বলন্ত সমস্যা ধর্ষণ করে খুন আর শিশু নির্যাতন আর পাচার। কড়া আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাঘব বোয়াল থেকে চুনোপুটি সব বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঐ যে চক্র না কী যেন বলেন আপনারা।পাচার হওয়া আর উদ্ধার হওয়া মেয়েদের অনুপাতে বিস্তর ফারাক। আবার কদিন আগের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে কর্মরত মেয়েরা প্রয়োজনের তুলনায় কম ঘুমায়। বোঝ! কয়েকটা দিন আগে নাবালিকা মায়ের সন্তান প্রসব করার পরেই পরীক্ষা দেবার খবরে মশগুল ছিল সবাই। খুব সুখ্যাতি হল সেসব মায়েদের কিন্তু এত প্রকল্প আইন আর সচেতনতার প্রচারের পরেও একজন নাবালিকা শিক্ষার্থীকে মা কেন হতে হল? আমি বুঝতে পারছি কেউ কেউ মনে মনে বলছেন ” এই শুরু হল আবার নারীস্বাধীনতা, নারী নির্যাতন সামাজিক বৈষম্য ইত্যাদি ইত্যাদি প্যান প্যানানি।” ভাইরে না শুনবে তো না শোন কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বদলায় না। আমি নিজেকে বদলেছি কারণ নিজের অবস্থাটা কতটা খারাপ তা বোঝা সবচেয়ে জরুরী।
আচ্ছা মেয়েদের কথা শুনবেন না? তাহলে পুরুষদের কথা বলি। কেমন আছে তারা? কত কলকারখানা বন্ধ হয়েছে রাতারাতি স্থান পরিবর্তন করেছে? কত শ্রমীক রোজ কাজ হারায়? কত কৃষক ঋণের জালে জড়িয়ে আত্মহত্যা করে? কত পিতার চোখের সামনে সন্তান বিনা চিকিৎসায় মারা যায়? কিছুদিন আগে দিল্লির প্রান্তে কৃষকদের আন্দোলনের কথাই ধরুন। প্রায়ই যেতাম, চুপ করে বসে থাকতাম পথের ধারে। আনন্দ পেতাম ওদের জেদ দেখে। শাহীনবাগের মায়েদের ভিড়ে বুকে আশা নিয়ে বসে থাকতাম। ন্যায়ের জিৎ হবে।সেরকম কিছু তবুও সারা দেশ জুড়ে তো হল না। আমাদের সময় ছিল জমিদার জোতদার আর জারের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই আর এখন করপোরেটরা দেশ চালায়। তোমাদের এই ভারতে মাত্র দশ বারটা পরিবারের হাতে দেশের অধিকাংশ অর্থ আর প্রতিপত্তি। বিখ্যাত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভাঁড়ারে বিপুল পরিমান অর্থ সোনাদানা আর সম্পত্তি। শ্রমীক কৃষক আজও ভুখা নাঙ্গা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালো গুহামুখে দাঁড়িয়ে আছে। নিম্ন বিত্ত আর ধনীরা শুধু থাকবে সমাজে? মালিক ও সেবক? মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা কাজ পাচ্ছে না। একটা হাস্যকর নাম মাত্র পারিশ্রমিক দেয়া হচ্ছে তাদের। স্কিলের থেকে ক্লাস ম্যাটার করছে। নিজের প্রাপ্ত ডিগ্রি আর ব্যাকগ্রাউন্ডকে নিজেই ধিক্কার দিচ্ছে তারা।।যে ক্লাসটা গাড়িতে অফিসে যায় আর বাইরে লাঞ্চ করে তাদের পারিশ্রমিক অনেক অনেক বেশি। কিন্তু সেই ক্লাসে টিকে থাকতে গিয়ে তারা সব ঋণ ভারে নুয়ে পড়েছে। জীবন তাদের EMI দ্বারা কন্টকিত।এসব আমার বানানো কথা নয়। কয়েকদিন আগে সেক্টর ফাইভে খাবারের দোকানে বসে এসব শুনছিলাম। সারা পৃথিবীতেই প্রায় সব দেশে কাজ খোয়ানোর ভয়ে ভীত তরুণ সমাজ। আর যারা অতিমারিতে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করছে তারা তো একরকম দাস প্রথাতেই আছে। চোদ্দ ঘন্টা কাজ করছে নাওয়া খাওয়ার সময় নেই বাছাদের। এ এক নতুন শোষণ যন্ত্র। ভাবার সময় দেবে না। আর যারা দেশ চালায় তারা ভোট বোঝে।অনুদান আর ভর্তুকি নয় তরুণ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা জীবিকার অধিকার ফিরে পাক। শপিং মলে, হসপিটালে, ট্রান্সপোর্টে ছোট ব্যবসায়, কল সেন্টারে, ক্যুরিয়ারে, টেইলারিং শিল্পে, কমারশিয়াল ফার্মে, মার্কেটিং এ হোম ডেলিভারিতে, রেস্তোঁরাতে, পাহারাদারিতে একটা চলবার মতো চালিয়ে নেবার মতো পারিশ্রমিক পাক। একটা আত্ম সম্মান বজায় রাখার অর্থনীতি থাকুক। চতুর্দিকে প্রলোভন ভোগ বিলাশের জিনিসের উচ্চকিত বিজ্ঞাপন। সততাকে রাজা মন্ত্রী, পন্ডিত পুরোহিতরা সমাজ সংসার থেকে নির্বাসন দেবার খেলায় বহুদিন হল মেতেছে।
তথাকথিত ক্যমিউনিস্ট দের মাথার মধ্যে আবার বাসা বেঁধেছে ভোগবাদ আর পুুঁজিবাদ কূটকচালের রাজনীতি
কে দেখবে এদের? এ সমস্ত অনাচারের কতটা প্রতিবাদ তারা করেছে?
কত কিছু দেখলাম বলতো? মহান নভেম্বর বিপ্লব, দুখানা বিশ্ব যুদ্ধ, নানা দেশে গৃহ যুদ্ধ, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম গ্লাসনস্ত পেরেস্ত্রইকা। সাধের ইউএসএস আরএর উত্থান ও পতন, চরম মন্দা আগ্রাসন। আর এখন রাশিয়া আর ইউক্রেন। রোজ ইউক্রেনে শিশুরাও নিস্তার পাচ্ছে না। সেখানে যা হচ্ছে আপনারা বিদগ্ধ মানুষ সব জানেন। কিন্তু… এই কিন্তুতেই আটকে গেল মানবিকতার পাঠ। সব দেশে দুর্গন্ধ যুক্ত রাজনীতি আর রাষ্ট্রনীতি অন্যায় কে অন্যায় বলতে দেয় না। আপনারা চুপ করে যান। একটা দুটো প্রতিবেদণ আর কবিতা লিখেই প্রতিবাদ শেষ হয়। প্রতিবাদী কন্ঠস্বরের টুঁটি টিপে ধরার কত রকম যন্ত্র আর আইন। নির্ভিক কবি সাহিত্যিক,সাংবাদিক ছাত্র অধ্যাপক সকলেই দেশদ্রোহী নাম পায় দেশের মঙ্গলে কথা বললে। আমার আন্দ্রেউসা ইউক্রেনের ছেলে ছিল। বিকটা কেঁপে ওঠে। আর বলতে পারি না জানেন। গলা বন্ধ হয়ে আসে। গোটা দুনিয়ায় অস্ত্রের খেলা। ধর্মের নামে হানাহানি। ভগবানের নামে পান্ডাপুরুত আর এখন কিছু রাজনৈতিক দল, উগ্রবাদীরা যা করছে সে তো আসলে জুজুই দেখানো। একথা তো বহু আগে পাভেল বুঝিয়েছিল।দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার দেখতে দেখতে চিত্ত অবশ হয়। ক্রোধিত হই। তবু আমি এখনো সাম্যের স্বপ্নটাকে বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সমাজে আর আপনাদের ঘরে ঘরে। আমার পাভেলকে খুঁজি, খুঁজি আমার খখলকে নাতাশাকে শাসাকে সোফিয়াকে নিকোলাই কে রিবীনকে। বিশ্বাস হারাইনি মানুষের প্রতি। আমি জানি রাক্ষস খোক্কস মারার জন্য কোথাও না কোথাও নীলকমল আর লালকমল জাগে। আবার আমি আমার প্রতিবাদী, নির্ভিক নি:স্বার্থ ছেলেমেয়েদের হাতে তিল তিল করে গড়ে উঠতে চাই। আবার আমার অষ্টাঙ্গ আর মন মতি বিপ্লবীর মা হয়ে মাঠে গ্রামে শহরে ইস্তেহার বিলি করতে চায়, শক্ত হাতে তুলে ধরতে চায় শোষণহীন সমাজের জয় পতাকা। কারণ সময় যে আমায় সেই বিশ্বাসে স্থির রেখে গেছে যে বিপ্লবী আত্মার নতুন করে জন্ম হয়েছে তাকে মারতে পারবে না কেউ।
কী সুন্দর করে বলতো আমার আন্দ্রেউসা, বলতো, ” আমরা সবাই বৃষ্টির মতো বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা ফসল ফলাবার কাজে লাগে।” আর পাভেল বলতো, ” শুধু এক পেট খেতে পাওয়াটাই সব নয়। যারা আমাদের ঘাড়ের ওপর বসে আছে আমাদের চোখে ঠুলি এঁটে রেখেছে তাদের দেখাতে হবে আমরা সব দেখছি।” আরও কত অভিজ্ঞতা আরও কত মহান বিপ্লব আমি দেখলাম কিন্তু কিন্তু প্রকৃত সাম্য… আজ আর কথা বলতে ভাল লাগছে না। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীর আর্তনাদ আর সইতে পারছিনা। অনেক কাজ এখন। তাই
কমরেডস আমার অভিবাদন নেবেন। এতক্ষণ আমাকে সহ্য করার জন্য ধন্যবাদ।

2 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ আমি পাভেলের মা – ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

  1. অসম্ভব ভালো উপলব্ধির প্রকাশ এই লেখা। অনবদ্য। পরিশেষে বলি – বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক

  2. খু-ব সুন্দর লেখাটি। শুভেচ্ছা জানাই।

Leave a Reply to ভূমিকা গোস্বামী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *