ধারাবাহিক উপন্যাসঃ দ্বিতীয় পৃথিবী ( ষষ্ঠ পর্ব) – অনিরুদ্ধ সুব্রত

দ্বিতীয় পৃথিবী – ষষ্ঠ পর্ব
অনিরুদ্ধ সুব্রত

ফোন রিসিভ করে সুমিত, —- হ্যাঁ , অমৃতা বলো ?
— কিছু মনে কোরো না প্লীজ, আমি তোমার মেসেজ গুলো দেখিনি। মানে দেখার সময় পাইনি।
— ঠিক আছে । এমন তো হতেই পারে।
— না, তা কেন বলছ ?
— দু’দিন টানা অফ ছিলে, তার পর মেসেজ গুলোও দেখার ফুরসৎ হয়নি যখন। এটা তো
বুঝতে পারছি— নিশ্চয়ই বিশেষ প্রয়োজনীয় ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলে। যা এই সামান্য আমার চেয়ে কিছু অন্তত গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিশ্চয়ই ।
— বাঃ ! বেশ নাক ফুলিয়ে বলতে পারো দেখছি !
— আমি কি নাক ফুলিয়ে বলতে পারি ? বলো, হঠাৎ ফোন করলে যে ..
— এই মাত্র তোমার মেসেজ গুলো দেখলাম।
— আচ্ছা, দেখেছ বলে ভালো লাগছে। কিন্তু এখন তো আমি শিয়ালদহ স্টেশনে ।
— বাড়ি ফিরবে তো ? ট্রেন কটায় ?
— দুর্ভাগ্য আমার ! শুধু আমার নয়, বহু মানুষের। বাড়ি ফেরা আপাত রুদ্ধ।
— কেন ? কী হয়েছে ?
— লোকে লোকারণ্য সন্ধেবেলার শিয়ালদহ স্টেশন। আমাদের পলাশপুর লাইনে ট্রেন অবরোধ চলছে ঘন্টা দেড়েক। তাও নাকি অনির্দিষ্টকালের জন্য শুনছি।
— সে কি ! তাহলে ?
— তাহলে আর কী ! এতো মানুষের যা পরিস্থিতি, আমারও তাই ।
— সত্যিই তো সমস্যা ভীষণ ! কিন্তু…
— আচ্ছা অমৃতা, আমি এখন রাখছি। ফোনে ব্যাটারি চার্জ খুব কম । আপাতত প্লাটফর্মে কোথাও একটা জায়গা নিয়ে বসব। দেরি করলে সেটুকুও হয়তো পাবো না।
— ইস্ ! কিন্তু যদি আদৌও রাতে ট্রেন না চালু হয় ?
— ওসব ভেবে কী করব, পেপার পেতে একটা রাত ঠিক চলে যাবে ।
— সুমিত তুমি কিছু খেয়েছ তো ?
— তুমি চিন্তা কোরো না । সব হয়ে যাবে ঠিক।
— আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি ফোন রাখো । আমি পরে আবার তোমাকে ফোন করছি।”

ফোন পকেটে রেখে সুমিত ওর কাঁধের ব্যাগ হাতড়ে একটা খবরের কাগজ বের করে প্লাটফর্মের কোথায় বসা যায় খুঁজতে থাকে। এতক্ষণে সাত, আট,নয় ,নয়ের এ সব প্লাটফর্ম গুলো কাতারে কাতারে মানুষের
ভিড়ে ছয়লাপ। উদ্বিগ্নতা একটু একটু করে চরমে উঠছে। কোথাও বসবার জায়গা একটুও ফাঁকা নেই। অনেকেই পায়ে হাঁটার জায়গায় দিন শেষের ক্লান্তি নিয়ে বসে পড়েছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে বেশ দ্রুত।
সুমিতের ফোন কেটে গেলে অমৃতা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। জীবনের দৌড়ে এই মাঝখান বরাবর এসে, যখন সে মন থেকে একটা অপূর্ণ সুখ খুঁজে নিয়েছে নিজেরই অতীত জীবনের ফেলে আসা পথ থেকে, তখন সেখানে হঠাৎ হঠাৎ আশ্চর্য অভিঘাত‌ এসে ধাক্কা দেয় কেন। আজকের এই সন্ধেবেলায় সুমিতের কথা গুলো যত সহজ, না অমৃতার কাছে ততটা সহজ লাগছে না কেন ?
অনেক দিন হলো অমৃতা যেন সুমিতের নতুন লেখা কবিতা শোনে নি। শুনতে চায় নি সুমিতের ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবনের টুকরো টুকরো সংবাদ। যা খুব অল্প হলেও সুমিত বলত মাঝে মাঝে। অভাব অভিযোগ সুমিতকে বলতে হয় না। সুমিতও সেসব বলার মতো মনে করে না। অমৃতা কিন্তু সে সবের আন্দাজ করতে পারে। তাই তো সুমিতের কবিতার বই প্রকাশের উদ্যোগ নিজে থেকে নিয়েছিল সে। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে তো, এক নিঃস্ব মানুষের কবিমন। একদিন চরম অবহেলা করে যাকে তীব্র অপমান করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ হয় নি, আজ তার জন্য অমৃতার এতো কষ্ট বোধ কেন। পলাশপুরের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগ, দুর্দশা। কিন্তু অমৃতার মনে কেবল ভেসে উঠছে নিরীহ ছন্নছাড়া একমাত্র সুমিত রায়ের মুখ। অভিজাত ফ্লাটের বিলাসবহুল উপকরণের মাঝখানে অমৃতার কী যেন আকস্মিক উদ্বিগ্নতা আর অস্বস্তি।
সুমিত আট নম্বর প্লাটফর্মের চাতালে একটু জায়গা করে নিতে পারল শেষ পর্যন্ত। খবরের কাগজটা পেতে পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। হঠাৎ তার ইচ্ছে করে একটু ধুমপান করতে। কিন্তু সে তো সম্ভব নয়। চারদিকে অগণিত মানুষের কথাবার্তা চিৎকার চলতেই আছে। সুমিত কাঁধ ব্যাগ থেকে কলেজস্ট্রিট থেকে সদ্য কেনা একটা পত্রিকা বের করে, দেখবে বলে পাতা ওল্টাতে শুরু করতেই হঠাৎ একটা হৈচৈ। কিছু লোক হঠাৎ ছুট লাগায়। হুড়মুড়িয়ে কিছু লোক এসে পড়ে এ ওর ঘাড়ে। ব্যস্ত হয়ে ওঠে প্লাটফর্ম। সুমিত উঠে পড়ে অন্যদের সঙ্গে। কিন্তু তক্ষুণি স্টেশনের মাইকে ঘোষণা হয়, পলাশপুর লাইনে অনির্দিষ্টকালের জন্য সমস্ত লোকাল ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। যাত্রীসাধারণ অপেক্ষা করতে পারে পরবর্তী ঘোষণার জন্য। তৎপরতা আবার বিফল হয়। উঠে দাঁড়িয়ে পড়া যাত্রীরা ফের যে যার দখলের জায়গা খুঁজতে থাকে। সুমিত আবার পায়ের কাছে পেপার টেনে নিয়ে বসে।
সুমিতের বাড়ির কথা মনে হয়। পলাশ পুরের ছোটো দু’কামরার ভাড়াঘর। মনে পড়ে মেয়ে ঋর কথা। মনে আসে দু’দিন বিজনেস প্রোগ্রাম থেকে ফেরা রণিতার কথা। বাড়িতে জানানো দরকার একবার মনে হয় সুমিতের।
” —কিন্তু ট্রেন তো চলবে নিশ্চয়ই আবার। তাছাড়া বাড়িতে জানিয়ে কী লাভ। রণিতা তো সারাদিনে একবারও সুমিতকে ফোন করে নি। বাপ্পাদিত্যর সঙ্গে রণিতার মার্কেটিং বিজনেস এর সম্পর্ক যাই হোক, তা বলে হোটেলে রাত্রিবাস খুবই কি প্রয়োজন ছিল ? অথবা ছিল। কিন্তু তা বলে বাড়ি ফিরে রণিতা কি একবারও সুমিতের কাছে এসে বুঝিয়ে বলার ইচ্ছেটুকুও রাখে না। বিজনেসে নেমে রণিতা দিন দিন অনেক উন্নতি করেছে, কিন্তু তার জন্যে সুমিতের কাছ থেকে ততটাই দূরে সরে যেতে হবে ? এই যে সুমিত দীর্ঘ দীর্ঘ রাত একা একা ঘুমিয়েছে, কোনো কোনো দিন শূন্য বিছানায় ঘুম হারিয়ে শেষে মাঝরাতে উঠে বসেছে লিখতে। কখনও বা খুঁজেছে ভালবাসার বন্ধু অমৃতাকে। কিন্তু সেখানেও তো তার অবাধ প্রবেশাধিকার নয়। কখনও পেয়েছে খোঁজ, কেটেছে কিছু সময় কথোপকথনে। কখনও খুঁজে খুঁজে হতাশ হয়ে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে শূন্যতা আঁকড়ে।”
মেয়েকে তবু জানিয়ে রাখতে চায় সুমিত এই রেল-দুর্ভোগের কথা। কিন্তু আজ তো রণিতা বাড়িতে, সুমিত ঋর ফোনে রিং করতে গিয়েও থামে। মেয়ের সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বললে রণিতাও শুনতে পাবে, সুমিত তা চায় না। রণিতা সুমিতের কুড়ি বছরের পরিচিত স্ত্রী। তার সাম্প্রতিক আচরণ, উপেক্ষা, অনিহা যাই থাক, তার জন্য সুমিতের অভিমান হয় না। সুমিতের কাছে সেটা আর অভিমানের বিষয় বলে মনে হয় না। বরং স্বভাবগত অভ্যাসে সুমিত নিজেই একটু সরে দাঁড়াতে পেরেছে, রণিতার ব্যস্ততম বর্তমানের প্রবল গতির পথ থেকে। অল্প আয়, অক্ষম সচ্ছলতা আর লেখালিখির বদভ্যাস সে তো নিজে বদলাতে পারে নি। হাঁপিয়ে ওঠা রণিতা যেমন করে চায় খুশি ও সুখী থাক। এতো সুমিতের হাতের জিনিস নয়। আজ সকালে সে তো মন খারাপ নিয়ে একা একা পথ হাঁটতে বেরিয়ে ছিল বাড়ি থেকে। তাই পথের বাধাটাও সেও তো তার একান্ত একার পথ। সে খবরে রণিতার কীবা প্রয়োজন। সারাদিন তো তার খোঁজ টুকু কেউ নিতেও চায় নি। অতএব সুমিত মেয়েকে হোয়াটসঅ্যাপ এ একটা মেসেজ করে,
” — ট্রেন অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ চলছে ঋ, আমি কখন বাড়িতে ফিরতে পারব জানি না। তুই কোনো চিন্তা করিস না।” মেসেজ পড়ে ঋ লেখে, ” — তুমি কিছু খেয়ে নিও বাবা। আর যেখানেই থাকো, সাবধানে থেকো।”

অমৃতার মন বড্ড আনচান করছে। কী ঠিক কী ভুল কিচ্ছু বুঝতে পারছে না তার মন। একদিকে সুমিতের জন্য একটা উদ্বিগ্নতা অনবরত মাথায়। আর অন্য দিকে কী এক দুর্বোধ্য সাহসী সহায়তা একটু একটু করে জায়গা নিচ্ছে তার মনে। সুমিতকে কি একটা রাতের জন্য সাহায্য করতে পারে না সে।
এর মধ্যে অমৃতার হঠাৎ মনে পড়ে অভীক গৌহাটির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে দুপুরে। এতক্ষণ পৌঁছে একটা ফোন করতে পারত সে, কিন্তু একবারও তার অমৃতার কথা মনে পড়ল না যে ? অমৃতা মোবাইলে অভিকের নম্বরে রিং করতে শুরু করল। দু’ দুবার রিং হলো। অভিক দ্বিতীয় বার রিং শেষ হতে হতে ধরল,
” — হ্যাঁ, বলো ?
— গৌহাটি পৌঁছে আমাকে কি একবার বলা
উচিত ছিল না ?
— দ্যাখো, আমি ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। তারপর ইম্পর্টেন্ট মিটিং ছিল।
— সে তো থাকবেই। কিন্তু ঠিক ভাবে পৌঁছে গেছো, এটা আমাকে জানানো তো একটা ফর্মালিটি হিসেবেও নিতে পারতে।
— সব সময় প্রফেসরি কোরো না অমৃতা। এ ক’দিন এখানে আমি খুবই ব্যস্ত থাকব। তোমাকে ফোন করতে হবে না। সময় সুযোগ মতো আমি করে নেব।
— আচ্ছা বেশ। কিন্তু তোমার খাওয়া দাওয়া বা দরকারি সবকিছু….
— ধুর ! শ্রাবণী ইজ পারফেক্ট পার্সন ! ও সব দেখে নিয়েছে। সবটা ও-ই হ্যাণ্ডেল করবে।
— ও , আচ্ছা..
— হ্যাঁ, অমৃতা এখন রাখো। কয়েকজন অপেক্ষা করছে, মিট করব। টেক কেয়ার। গুড নাইট।
— গুড নাইট।”
অভীকের সঙ্গে কথা শেষ হতে হতে অমৃতা বেশ বুঝতে পারে তার কপালে ঘাড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম হচ্ছে। এসি অফ। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সন্ধে গুলো বেশ মনোরম আবহাওয়া থাকে। এসির প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া চারতলার ফ্লাটের জানলা দিয়ে হু হু করে হাওয়া ঢুকছে, দখিনা হাওয়া। অমৃতার কপালে তবু যে কীসের ঘাম !
মুহূর্ত বদলে নেয় নিজেই। অমৃতার কেন যে হঠাৎ বুকটা খাঁ খাঁ। অভিকের কাছ থেকে ভালবাসার হিসেব সে গত পঁচিশ বছরে খুব একটা নেয় নি। নিতে ইচ্ছে করে নি। বিয়ের পর প্রথম বছর দুয়েক কাটতে না কাটতেই অমৃতা লোকটাকে চিনতে পেরেছিল।
কিন্তু ততদিনে অনিকেত মাতৃশরীর নিকেতনে আশ্রয় নিয়েছে। তাছাড়া জীবনের পরিচিত পথ একটাই এমন পারিবারিক সামাজিক অভ্যাসকে মেনে নিয়ে হেঁটে এসেছিল সে। কোথাও দাঁড়িয়ে পড়েনি। চাকরি, পড়াশোনা আর সন্তানকে আশ্রয় করে বাঁচা যায়, এমন করেই নিজের আত্ম-জগত তৈরি করে নিয়েছিল ধীরে ধীরে। যেখানে এই মাত্র দু’আড়াই বছরে অনুপ্রবেশ ঘটেছে অবহেলিত এক পুরনো অসুখ, জনৈক কবি সুমিত রায়ের।
না, অমৃতা আজ আর তাকে জনৈক মনে করে না। ফেসবুকে সুমিতের কবিতা গুলো যখন প্রথম অমৃতাকে টানতে শুরু করেছিল, তখনও এই সুমিতের আসল পরিচয় তার জানা ছিল না। প্রোফাইলে কোথাও সুমিতের ছবি ছিল না। ঠিকানা লেখা ছিল কলকাতা। ডিপিতে একটা খোলা ডাইরির ছবি। আর স্ট্যাটাসে মাঝে মধ্যে কিছু কিছু অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট।
তখন নিয়মিত সুমিতের পোস্ট করা কবিতা পড়ত এবং কমেন্ট করত অমৃতা। হঠাৎ একদিন ‘নৌকো জীবন’ কবিতাটা পড়ে, অমৃতার মনে পড়ে ছাত্র জীবনে এক কিশোর কবিকে অপমানের ইতিহাস। সেদিন অনেক ভেবে চিন্তে সে ইনবক্সে সুমিতের সঙ্গে দু’এক কথায় আলাপ জমায়। ধীরে নানান প্রশ্ন করে জেনে ফেলে এইই সেই পলাশপুরের সুমিত রায়। তারপর, তারপর এই আড়াই বছর। জমে থাকা অপরাধ বোধ আজ সম্পূর্ণ শক্তি অর্জন করে নিঃশব্দ প্রেমে পর্যবসিত। যে প্রেমের ঠিক সংজ্ঞা অমৃতা নিজেই জানে না।
কতবার অমৃতার মনে দুম দাম করে এসে পড়েছে, কিছু অভ্যস্ত নৈতিক প্রশ্ন। কিন্তু সে প্রশ্ন যত কঠিনই হোক, সে একবিন্দু পাত্তা পায় নি অমৃতার আবেগ‌ ও যুক্তির আধুনিক সমন্বয়ের কাছে।
কখনও একান্তে, অমৃতা আয়নার সামনে বসে নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছে,

“– কী রে সুমিতকে অনুগ্রহ করছিস ?
— কেন ? তোর তাই মনে হয় ?
— তাহলে হঠাৎ এই বয়সে এসে ?
— কেন ? তোর কী মনে হয়, সম্পর্ক না বয়স কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ?
— হুম , নিশ্চয়ই সম্পর্ক। কিন্তু…
— মানে বৈধতার প্রশ্ন তুলবি !
— না, ওসব সস্তা কথা বলব না।
— তাহলে ? একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষের সান্নিধ্য, তার সৃজন-হৃদয়ে জায়গা পেতে চাওয়াটা কি অযৌক্তিক ?
— এটা তো যুক্তির কথা দিয়ে ব্যখ্যা করতে যাওয়ার মানে হয়না।
— তাহলে ঠিক কী বলতে চাস তুই ?
— বলছি, অসহায় মনে করে সুমিতকে দয়া করছিস না তো ? সুমিতের জন্য তোর ভালবাসাকে, দরকার হলে আর একটু পরীক্ষা করে নিতে পারতিস।
— মানে ? সুমিতকে আমি সত্যিই ভালবাসি।
— আচ্ছা, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু যা বলছিস, তা কতটা বিশ্বাস করিস দেখব।
— আচ্ছা বেশ, সময়ে নিশ্চয়ই তা প্রমাণিত হবে, দেখে নিস।”
সন্ধেবেলার ফোনে সুমিতের গলায় জমে থাকা অভিমান টের পেয়েও অমৃতা খুব কিছু ভেঙে বলার সুযোগ পায়নি। মনে মনে সুমিতের অসহায় মুখটা ভেবেছে বারবার। কিন্তু ঠিক তার পরপরই ট্রেন চলাচল বন্ধ শুনে কেবল উদ্বিগ্নতা ঘিরে ধরেছে তাকে। নিজের একাকিত্ব অমৃতাকে এমনিতেই নষ্ট করে দিচ্ছিল ভিতরে ভিতরে। তার উপর এই উদ্বিগ্নতা যেন আংশিক বিভ্রান্ত করে তুলেছে তাকে।
অভীকের দ্রুতগামী চলার পথ থেকে প্রায়ই তাকে সরে দাঁড়াতে হয়। রুঢ় অশ্বারোহী যোদ্ধা রাজার মতো অভীক, টগবগ খুরে ধুলো উড়িয়ে চলে যায়। ছেলে অনিকেত আজ তার নতুন যৌবনের খেয়াল খুশিতে যখন তখন থাকে মেতে। অমৃতা কেবলই তার দু’হাতে হাতড়ে পায় শূন্য আর শূন্য।
আজ এই মুহূর্তে সুমিতের কথা বড্ড বেশি করে দুর্বল করে দিচ্ছে অমৃতাকে। বিশেষ করে একই শহরে সুমিত এখন রেল-দুর্ভোগে শিয়ালদহ স্টেশনে খবরের কাগজ পেতে উদ্বাস্তু সময় অতিবাহিত করছে। আর অমৃতা এই শূন্য সন্ধ্যায় এতো বড় ফ্লাটে একা একা অশরীরীর মতো। কিন্তু কী পাহারা দিচ্ছে সে ? কাকে বঞ্চিত ও দগ্ধ করে চলেছে অন্তর্গত উত্তাপের ভাপে ?
ঘড়িতে নটা বাজে। অমৃতা আর ধৈর্য ধরতে চায় না। মোবাইলে সুমিতকে রিং করে।
সুমিত শিয়ালদহ স্টেশনের প্লাটফর্মের খবরের কাগজ আশ্রয় থেকে অমৃতার ফোন রিসিভ করে। অমৃতা জানতে চায়, ট্রেন চলাচলের লাস্ট আপডেট। সুমিত জানায়, পরিস্থিতি কিচ্ছুটি বদলায়নি। রেলের তরফ থেকে একই ঘোষণা চলছে। শোনা যাচ্ছে অবরোধকারী মানুষের নাকি দাবী, যতক্ষণ না পুলিশ ঐ রাজনৈতিক মার্ডারের খুনিদের গ্রেফতার করছে, ততক্ষণ এই অবরোধ অনির্দিষ্টকালের।
অমৃতা আর কথা বাড়ায় না। সুমিতের ফোনে চার্জ চরমে ঠেকেছে সে জানে। শুধু বলে,
” — ঠিক আছে তুমি ফোন রাখো সুমিত। আমি দশমিনিট পরে আবার তোমাকে রিং করব। এবং যা বলব তা-ই তুমি করবে।
— মানে ? আমি আবার কী করব ?
— আমি যা বলব, তাই।
— বুঝলাম না ?
— বুঝতে তো বলিনি, কথা মতো কাজ করলেই হলো ।
— আচ্ছা। তুমি যেটা ঠিক মনে করো।
— হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমি এখন রাখছি। মিনিট দশ পরে আবার ফোন করব।”
বলেই ফোন কেটে দেয় অমৃতা। পিছনে ফিরে ঠিক সেই আয়নার সামনে সে থপ করে বসে পড়ে। আয়নায় আবার সেই দ্বিতীয় অমৃতার বিম্ব ওঠে ভেসে। আয়নার ভিতরের অমৃতাকে বেশ উসকোখুসকো, উদ্বিগ্ন লাগে। তার চোখের বিষ্ফার যেন দুর্ঘটনার পূর্বাভাসে আতঙ্কিত। সে হঠাৎ প্রশ্ন করে,
“— এটা কী করছিস তুই ?
— ঠিক করছি।
— কীভাবে ভাবছিস সেটা ঠিক ?
— কীভাবে আবার, যেভাবে মানুষ মানুষের জন্য জীবন বাজি রাখে।
— এটা কি শুধুই মহানুভবতা ?
— আমি কি মহানুভব সাজতে চেয়েছি কখনও ?
— তাহলে কী ? এতোটা বেপরোয়া কেন ?
— তুই আমাকে কি আবার নৈতিক বোরখা পরিয়ে, তারপর আমার প্রশংসা করতে চাস ? গত পঁচিশ বছর ধরে অদৃশ্য প্রেতের মতো যা করিয়ে এসেছিস ?
— তাহলে সত্যিই তুই সুমিতের দোসর হবি ?
— হয়েছি।
— কিন্তু তা বলে কি প্রমাণ করতে উঠে পড়লি ?
— অপদার্থের মতো কথা বলছিস। ভালবাসি,
আমি ভালবাসি সুমিতকে, হ্যাঁ, শোন।
— আচ্ছা ? তা কি সুমিতকে বুঝিয়ে দিবি ?
— অসভ্যের মতো কথা বলিস না। ও অসহায় হয়ে পড়ে আছে, মশা মাছির মধ্যে স্টেশনে, আমি এটা জেনেও নির্বিবাদে আরামে আয়াসে থাকব কীভাবে ?
— তাহলে সুমিতের প্রেমিকা এখন কী করতে চায় ?
— জানিনা। তুই তাকিয়ে দেখ্ অমৃতা কী করে
তার সুমিতের জন্য
— ও ! শুধুই কি সুমিতের জন্য ? অমৃতা বুঝি
নিজের জন্য কেবল নিষ্ঠুর !
— তুই চুপ কর। আর একটা কথাও তোর সঙ্গে নয়। আমাকে এক্ষুনি ফোন করতে হবে অ্যাপক্যাবে।”

রিং করে অ্যাপক্যাব এর কন্ট্রাক্ট করে ফেলে অমৃতা। অ্যাডভান্স বিল মিটিয়ে দিয়ে ফোন করে সুমিতকে। ততক্ষণে সুমিতের ফোনে মেসেজ করে ক্যাবের ফোন নম্বরটা সেন্ড করে দেয়। সুমিত রিসিভ করতেই অমৃতা বলে,
“– সোজা প্লাটফর্ম ছেড়ে বাইরে ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডের কাছে চলে এসো। “
অমৃতার কথা শুনে ঘাবড়ে যায় সুমিত । যারপরনাই আবাক হয় সে। কিন্তু প্রশ্ন করতে গেলেই অমৃতা বলে,
“— তোমার মোবাইলে চার্জ বেশি থাকলে কথা বলতে পারো। শুনব। কিন্তু আগে যা বলছি, সেটা করো। স্টেশনের বাইরে এসে, তোমাকে একটা ফোন নম্বর মেসেজ করেছি দেখো। ঐ নম্বরে রিং করলেই ড্রাইভার পজিশন বলে দেবে। গাড়িতে উঠে, চার্জ থাকলে আমাকে যা খুশি জিজ্ঞাসা কোরো। আর শোনো খুব বেশি হলে মিনিট পঁচিশ লাগবে। ইতস্তত করার দরকার নেই, আমি নীচে থাকব।”
উত্তরে ব্যস্ত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল সুমিত, সম্ভব হলো না। অমৃতা ফোন কেটে দিল।
খানিকটা স্তম্ভিত সুমিত। তবু কেন যেন অমৃতার কথার নড়চড় হতে পারে, এমন সে ভাবতে পারে না। স্টেশন চত্বরে গিজগিজে মানুষের ভিড় থেকে নিজেকে কোনোমতে ছাড়িয়ে বাইরে নিয়ে যায় সে। অমৃতার মেসেজ থেকে পাঠানো নম্বর নিয়ে রিং করে। সিঁড়ির কাছেই ক্যাবটা দাঁড়িয়ে ছিল। ড্রাইভার জোরে কথা বলতেই সুমিত বুঝতে পারে। কাছে এগিয়ে গেলে, ড্রাইভার উঠে বসতে বলে। সুমিতের পা দুটো যেন বড্ড ভারি। গাড়ির ভিতরে উঠে বসতে তার যেন সমস্ত শক্তি ব্যয়িত হয়ে গেল। রাতের কলকাতা শহরের মাঝখান চিরে এক অজানা জগতের দিকে গাড়িটা যাচ্ছে। সুমিত চুপ করে শুনছে তার হু হু শব্দ। সাদা হলুদ আলোর ঝলক লাগছে তার মুখে, ছলকে ছলকে। সুমিতের পেটের ভয়ানক খিদেটা হঠাৎ যেন চুপসে গিয়ে, কেমন বুকের কাছে এসে ভয়ার্ত হরিণের মতো কাঁপছে। সুমিত এই গাড়িতে চড়ে কোথায় যাচ্ছে, হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে। কিন্তু সেই সম্পর্কে এতটুকু ভাববার শক্তি বা সাহস তার নেই। চেনা পৃথিবীতে সুমিত খুবই ক্ষুদ্র ও নীরব। প্রায় পাত্তা না পাওয়া একটা তথৈবচ জীবনে তার ভাসমান পা। মানুষের জীবনে, অনুভবে, স্বপ্নে সত্যিই কোনো দ্বিতীয় পৃথিবী আছে কিনা— সুমিতের ঘন চশমার কাঁচে তাও নিতান্ত ঝাপসা।

(এরপর আগামী পর্বে)

3 thoughts on “ধারাবাহিক উপন্যাসঃ দ্বিতীয় পৃথিবী ( ষষ্ঠ পর্ব) – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. ভীষণ ভাল লাগল। আকর্ষণ বাড়ছে ক্রমশ… 💐💐

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *