ধারাবাহিক উপন্যাসঃ দ্বিতীয় পৃথিবী(পঞ্চম পর্ব) – অনিরুদ্ধ সুব্রত

দ্বিতীয় পৃথিবী– পঞ্চম পর্ব
অনিরুদ্ধ সুব্রত

সকালে ইমার্জেন্সি ফোন পেয়ে অভিক দুপুরে উড়ে গেল গৌহাটি। ওদের ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের ড্রইংএ একটা সিমেন্ট কোম্পানির নতুন প্রজেক্টে কাজ চলছে গৌহাটির কাছেই। সেখানেই কিছু একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার জন্য অভিককে খবর পাওয়া মাত্র যেতে হলো।
অমৃতা ফোনে অভিকের উত্তেজিত কথাবার্তা টের পেয়ে কারণ জানতে চাইলে অভিক শুধু এটুকুই বলেছিল,
” এতো বড় প্রোজেক্ট, তিন তিনটে জুনিয়র প্রেজেন্ট রয়েছে, তবু একটা পোর্শানে গাণ্ডুর দল ড্রইং মেনশন করতে পারছে না ! সব শালা প্রাক্টিক্যালি হোপলেস ! “
উত্তেজনার আঁচ বুঝতে পেরে অমৃতা কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বলল,
” কনস্ট্রাকশনে কিছু ভুল হয়েছে ?
— আরে না , ভুলটা করার আগে অন্তত আমাকে জানালো। তা না হলে…
— তাহলে এখন ?
— এক্ষুণি বেরতে হবে
— এক্ষুণি বলতে ?
— মানে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব, বিকেলের মধ্যে গৌহাটি।”
অমৃতার সঙ্গে কথা ওটুকুই। সঙ্গে সঙ্গে অভিক ফোনে ধরে সল্টলেকে ওর নিজের অফিসের নতুন পিএ কে,
“— হ্যাঁ শ্রাবণী, শোনো, দুপুর দুটোর মধ্যে যে কোনো ফ্লাইট, মানে যেটা পাও। গৌহাটির দুটো টিকিট । আরে হ্যাঁ । বুক করেই আমাকে জানাও । হুম। সমস্ত ইনক্লুডিং পেপার্স আর তোমার ল্যাপটপ।
ও ! বুঝতে এতো লেট হয় কেন ? ওফফ্, আমার মাথায় প্রেসার আছে, বাহানা ছাড়ো। অরিন্দমকে সব বুঝিয়ে দিয়ে সোজা এয়ারপোর্টে চলে এসো, আমি থাকব। হ্যাঁ হ্যাঁ বাড়িতে বলে দাও—দু’তিনদিনও হতে পারে। হ্যাঁ হ্যাঁ, ডোন্ট হেজিটেড ।
ও হো ! বি পাংচুয়াল। হুম। রাখলাম। টাইম ওয়েস্ট কোরোনা।”
অমৃতা কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। অভিকের কথাবার্তা শুনছিল। ব্যস্ততার আঁচ যথেষ্ট টের পাচ্ছিল সে। কিন্তু ব্যস্ত অভিকের কথার মাঝখানে অমৃতা চমকেও উঠেছে।
অভিক তার ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের সল্টলেকের নতুন অফিসে একজন পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্টকে জয়েন করিয়েছে সম্প্রতি। খবরটা একদিন রাতে অভিকই বলেছিল অমৃতাকে। মেয়েটি আগে সেক্টর ফাইভে একটা আইটি সেক্টরে কাজ করত। অভিকের পেপার ওয়ার্কস এখন যথেষ্ট বেড়েছে অমৃতা বোঝে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহরে তো বটেই বেশ কতগুলো রাজ্যে ওদের কনস্ট্রাকশন কনসালটেন্ট কোম্পানির কাজ প্রায় প্রতিদিনই আসছে। বেশ কয়েকজন অফিসকর্মীও আছে ওর অফিসে। তবু আরও এফিশিয়েন্ট হিসেবে শ্রাবণী গুপ্তের নতুন জয়েনিং।
অভিকের ফোনে কথা শেষ হলে অমৃতা বলে,
— দুটো টিকিট মানে ? শ্রাবণীও যাচ্ছে তোমার সঙ্গে ?
— আশ্চর্য ! এতে প্রশ্ন আসার কী আছে ?
— না । শুধু জানতে চেয়েছি, এর বেশি কিছু না।
—- দ্যাখো অমৃতা, আমার চোখে শুধু
কনস্ট্রাকশন, শুধু বিজনেস।
আই উইল রিচ দ্য হাই ক্রেডিট…
— না, আমি ভাবছিলাম, শ্রাবণীর কি খুব দরকার ছিল যাবার, ওরও তো ফ্যামিলি আছে, মানে দু’তিন দিন …?
— হাউ সেকি সেন্টিমেন্টাল ইউ আর ! কারও পার্সোনাল লাইফ নিয়ে ভেবে বেড়ানো আমার কাজ ?
তাছাড়া, এটাই ওর জব। বাট হোয়াই আর ইউ থিংক দ্যাট ?
— না, এমনি
— অযথা ইনভলব হতে চেষ্টা কোরোনা অমৃতা, তুমি এসব বুঝবে না। জাস্ট আমার অ্যাটাচিতে এক্সট্রা দুটো ড্রেস দিয়ে দাও। বাকিটা আমি সামলে নেব।
ওকে ডার্লিং ?
— ইয়েস, ওকে স্যার !
— স্যার ? হা হা হা.. “

অভিক এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলে অমৃতা দরজা ঠেলে দিয়ে ফিরে এসে সোফায় যেন নিজেকে সঁপে দেয়। তখনও সদ্য অভিকের করা নিয়মমাফিক বিদায় হাগটা অমৃতার গায়ে লেগে আছে যেন। চিরদিন দামি পারফিউম অভিকের অভ্যাস। তবু অমৃতা নিজের চোয়ালে টের পায় অভিকের পছন্দের ব্রাণ্ডের সিগারেটের মৃদু গন্ধ।
কলেজের অফ ডে, সপ্তাহে সে তো মাত্র দুটো দিন। পারিবারিক হৈচৈ এর মধ্যে সে আর কাটাতে পারে কোথায়। ছেলেটা সদ্য তারুণ্যে, নতুন চাকরি আর বন্ধুদের নিয়ে সে থাকে তার মতো। তাছাড়া ছেলে অনিকেতের বিশেষ বান্ধবীটি কিছুদিন হলো একটা টিভি সিরিয়াল এ অভিনয় করছে । ফলে বান্ধবীর সময় অনুযায়ী ছেলেকে মিট করতে যেতে হয়। আর অভিক সকালে মাত্র ঘন্টা দুয়েক বাড়িতে থাকে। তাই কলেজ অফ মানে, অমৃতার একার সারাদিন।
সোফায় প্রায় আধশোয়া হয়ে আছে অমৃতা। হঠাৎ তার মাথায় ফিরে আসে অভিককে বলা তার একটা কথা, ” ইয়েস স্যার” যেটা শুনে অভিক হা হা করে হেসে উঠেছিল তখন। প্রসঙ্গ ছিল পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট শ্রাবণী গুপ্তকে গৌহাটি যাওয়ায় বাধ্য করা নিয়ে।
হঠাৎ অমৃতা যে অভিককে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেছে, তা নয়। মুহূর্তে অমৃতার তখন মনে হয়েছিল যে, সে নিজেও যেন অভিকের এক রকম সাবর্ডিনেট। হ্যাঁ, এক ধরনের পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্টও। অমৃতা যেন এক লহমায় অনেকখানি মিল খুঁজে পেয়েছিল জনৈকা শ্রাবণী গুপ্তের সঙ্গে তার নিজের। পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে যে মেয়েটি অভিক সেনের ইচ্ছে আর লক্ষ্যের কাছে শুধুমাত্র একজন নির্দেশ পালনের কর্মী হয়ে থেকে গেছে।
শ্রাবণী গুপ্তের পারিবারিক সমস্যা আছে কি নেই, সেটা না জেনে তাকে গৌহাটি নিয়ে যাওয়ার যে বাধ্য নির্দেশ, তার প্রেক্ষিতে অমৃতার প্রশ্নে অভিক যখন বলে,
” কারো পার্সোনাল লাইফ নিয়ে ভেবে বেড়ানো আমার কাজ ? ” অথবা ” এটাই ওর জব” ।
তখন অমৃতা লক্ষ্য করেছিল অভিকের নিস্পলক একটাজোড়া কঠিন চোখ। যার হালকা বাদামি তারারন্ধ্র গুলো ছায়াহীন ধূ ধূ পাথরের বাগানে মধ্যাহ্নের তীব্র সূর্লোকে তপ্ত। যেখানে মাথা খুঁড়ে মরে গেলেও বৃষ্টি হয় না। অথচ রাত্রির শীতলতায় তীরের ফলার মতো যন্রণা ফুটে ওঠে। কখনও বা একটা শীর্ণকায় ভয়ের শরীর লুকিয়ে থাকে পাথরের আড়ালে। সে হায়নার মতো হিংস্র কিনা অমৃতা জানে না। কেননা সে তার ভয়ঙ্কর শিকার দেখেনি। দেখেছে কেবল রোজ রোজ বেড়ে চলা মানবিকতাহীন এক প্রতিযোগী যন্ত্র-অস্তিত্বের এক দৌড়বাজ মালিককে। যার কাছে স্ত্রী অমৃতা আর পিএ শ্রাবণী গুপ্ত আদতে ব্যবহৃত হওয়া একই নারীর দুটি রূপভেদ মাত্র।
ভাবতে আর ভালো লাগে না অমৃতার। সোফা ছেড়ে ওঠে । ঘড়িতে দুপুর গড়াচ্ছে, শহরের রাস্তায় সেই একই সারি সারি গাড়ির হুস হাস। মানুষ ছুটছে কোনো না কোনো গন্তব্যের দিকে। অমৃতার কি তেমন কোনো গন্তব্য আছে, এই অবশিষ্ট জীবনে ? প্রশ্নটা যেন পাঁচ তলার ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে মার্চ মাসের রোদ্দুরকে ছুঁড়ে দিয়ে ঘরের দিকে মুখ ফেরালো অমৃতা। এখন সে পড়ার ঘরের চেয়ারে বসে হোমথিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের গান শুনবে। কখনও কখনও এইভাবে তার নিজের জন্য কাঁদতে ভালো লাগে।
গান শুনতে শুনতে কখন রিভলভিং চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়েছিল অমৃতা। হঠাৎ জেগে উঠল মোবাইলের রিং টোনে। অনিকেত ফোন করেছে মা’কে অফিস থেকে। ফোন রিসিভ করে অমৃতা। ছেলে বলল,
“— টুকাই, আমার বন্ধু, তুমি ওকে চেনো তো। একটা হেব্বি জব পেয়েছে। আজ রাতে ওর বাড়িতে আমাদের বন্ধুদের জন্য একটা পার্টি অ্যারেঞ্জ করেছে। সেখানে যাবো। অফিস থেকে সোজা চলে যাবো ওখানেই।
— কিন্তু রাতে ?
— আজ রাতে আর বাড়ি ফিরব না মা, ডোন্ট টেক আদারওইজ মা। এমনিই। তিন বন্ধু মিলে জাস্ট আড্ডা। দিনে আর সময় কোথায় বলো।
— হুম, বুঝেছি। সাবধানে থাকিস।
— ডোন্ট ওয়ারি মা, আই রিয়েলি লভ ইউ।
— তোর বাবা গৌহাটি বেরিয়ে গেছে ।
— কেন ?
— জরুরি কাজ ।
—- ও হো , তুমি একা আছো তো, বাট তোমার রবীন্দ্রসঙ্গীত আর বই আছে।
— ঠিক আছে, তুই টাইমলি খেয়ে নিস ।
— কিন্তু মা, তুমি জাস্ট বোরিং অ্যাভয়েড করতে ফ্রেন্ডদের সঙ্গে একটু চ্যাটিং ফ্যাটিং করো।
— বাদ দে, তুই ফিরবি কখন ?
— সে তো কাল অফিস শেষে। কাল সকালে টুকাই আমি দুজনেই ওর বাড়ি থেকে সোজা অফিস চলে যাবো।
— আচ্ছা বেশ। টেক কেয়ার।
— ওকে মম।”

সত্যিই অমৃতার আজ বড্ড একাকিত্ব পেয়ে বসেছে। বুকের মধ্যে কোথায় যেন বিলম্বিত লয়ে একটা তানপুরা বেজে চলেছে সেই দুপুর থেকে। জীবনে মায়া আর শূন্যতা দুই যেন পরস্পর জড়ানো দুটি লতা। যা ঘিরে রেখেছে এই পরিচিত জীবনের দুয়ার। আর তাতে মাঝে মাঝে কুঁড়ি আসে, মাঝে মাঝে ফোটে ফুল। অথচ সে যেন বড় মরসুমী । বৃষ্টির জল পায়ে না পড়লে সে লতারা বড় ধূসর ও রুগ্ন হয়ে কেবল থাকে, খুব জানান দেয় না।
নিজের জন্য এককাপ ব্ল্যাক কফি করে নিয়ে, দক্ষিণের ব্যালকনীতে বেতের চেয়ার টেনে, সামনের বসন্ত-বিকেলি শহরের দিকে তাকিয়ে বসে অমৃতা। কফি মগে চুমুক দিতে দিতে মোবাইলে অনলাইন হয়।
হোয়াটসঅ্যাপ এ চোখ ফেলতেই অবাক। সুমিতের টানা মেসেজ । দুপুর থেকে সুমিত একটার পর একটা মেসেজ করে গেছে।
কোনো উত্তর না পেয়ে, তবু কিছুক্ষণ বাদে বাদে অন্তত কুড়ি পঁচিশ টা মেসেজ। শেষ মেসেজ টা আগে পড়ল অমৃতা,
” এখন কলেজস্ট্রিটে আছি, তুমি হয়তো আসতে পারবে না। কিন্তু খুব ইচ্ছে ছিল তোমাকে কিছু কথা বলতে। তুমি এলে কফিহাউসে একটু বসে না হয় বলতাম।”
অমৃতা মনে মনে বলে, ” তার মানে সুমিত এখনও নিশ্চই কলেজস্ট্রিটে। এই তো মেসেজটা লিখেছে পাঁচটা তেত্রিশে। আর এখন ঘড়িতে পাঁচটা ঊনপঞ্চাশ। তাহলে এখন ফোন তো করা যেতে পারে।”
ভাবামাত্র কাজ, অমৃতা ব্যস্ত হয়ে সুমিতের নম্বরে রিং করে।
বইমেলা শেষ হয়েছে কয়েক দিন। প্রকাশকের ফোন পেয়ে সুমিত আজ কলেজস্ট্রিটে। দু’চার দিন পরে এলেও পারত সে । কিন্তু হঠাৎই সকালে তার মনে হলো আজই সে কলকাতা যাক। এই সাময়িক হাওয়া বদলে তার মনের অস্থিরতা যদি অন্তত একটু বিরতি পায়। আগের দিন তার স্কুল ছুটি ছিল। কিন্তু সারাদিন সে এমন একটি প্রশ্নের কাঁটায় ক্ষত হয়ে সারারাত একফোঁটা ঘুমোতে পারেনি। বেশি রাতে ইচ্ছে হলেও অমৃতার সঙ্গে একটিবার হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করতে পারেনি। অমৃতা সন্ধে থেকে টানা অফলাইন। সুমিত তাই সকালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সারাদিন পথে পথে কাটাবে। সঙ্গে খানিকটা সময় বইপত্রের নিরিবিলি বাজার কলেজস্ট্রিটে।
গত দিন দুয়েক অমৃতার সঙ্গে সুমিতের কোনো কথা নেই। ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জার কোনো ভাবেই না। দিন তিনেক আগে একদিন সন্ধেবেলায়, সুমিত আশ্চর্য এক অনুভূতি শেয়ার করতে চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপ এ মেসেজ পাঠায় অমৃতাকে। অমৃতা তখন অনলাইন ছিল। হয়তো লক্ষ্য করেনি সেই মেসেজটি। সুমিত দ্বিতীয় বার যখন পুনরায় মেসেজ করে, তখন অমৃতা দেখে। কিন্তু সে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে সিন করেও রিপ্লাই দেয় না। কিন্তু পরে সামান্য ফুরসৎ পেয়ে অমৃতা লেখে, এখন সে ব্যস্ত ভীষণ। সুমিত রাত্রে অপেক্ষা করতে থাকে, অমৃতা নিশ্চয়ই সুযোগ মতো সুমিতের শেয়ার করতে চাওয়া অনুভূতি সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করবে। কিন্তু তাও হয় না মধ্যরাত পেরিয়ে যায় । সুমিত মোবাইল অফ করে বিনিদ্র যাপন করে রাত্রি।
ইউনিভার্সিটিতে একটা আমন্ত্রণী বক্তৃতা ছিল অমৃতার। দুটো দিন ধরে নানা বই ঘেঁটে তার তথ্য সন্ধানে সে ছিল চরম ব্যাস্ততার মধ্যে। সুমিতকে সে কথা বুঝিয়ে বললেই যে সে সহজ ভাবে বুঝে যাবে, অমৃতা জানে তা হবেনা। সুমিত ছেলেটাই একটা অন্য টাইপ চরিত্র। সহজ, সরল কিন্তু বড্ড নিঃশব্দ ব্যথাতুর তার ধরণ।
এই যে এতো দিন পরে সুমিত তার প্রার্থীত অমৃতার মনকে পেয়েছে, তবু সে এতটুকু উপেক্ষা বা অনিচ্ছাকৃত অবহেলা পেলে একেবারে চুপ হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। তারপর সেটা বুঝতে পেরে একসময় অমৃতাই যেন তাকে ডেকে আনে। প্রথম প্রথম সুমিতের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অমৃতার কাছে আংশিক বালকসুলভ বলে মনে হতো। কিন্তু ধীরে সে বুঝতে চেষ্টা করেছে, সুমিতের মনের মধ্যে বড় অভিমানী এক কবি বসে থাকে। যার প্রতিটি নিঃশব্দ ঔদাসীন্যের গভীরে আসলে এক একটি অভিমান। যা খুব যে অভিযোগে পর্যবসিত হয় তাও নয়। বরং চুপচাপ আহ্বানের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে সে, একটা কাঙাল-অপেক্ষা নিয়ে।
রণিতার মার্কেটিং বিজনেসে জয়েন করে সংসার জীবন যথেষ্ট সচল ও আয়েসী হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যত দিন গেছে, রণিতা তার লক্ষ্যে দ্রুত উন্নতি করেছে। মার্কেটিং বিজনেসের একেবারে যোগ্য হয়ে উঠেছে সে। রণিতা নিজেও নিজের মধ্যে এতো সম্ভাবনা রয়েছে, দিন দিন তা আবিষ্কার করে চলেছে। সুমিত কখনও রণিতার এই উন্নতিকে ছোটো করে দেখেনি, তেমন স্বভাবও তার নয়। এই যে হঠাৎ হঠাৎ রণিতাকে বিজনেসের কাজে বেরিয়ে যেতে হয়, তাতে সাংসারিক ছন্দ বদলে গেছে বলে সুমিত মেয়ে ঋকে শান্ত হয়ে বুঝিয়েছে। বলেছে,
” — তুই এখন বড় হয়েছিস ঋ, আমাদের সংসারের সমস্যা তুই তো বুঝিস। তোর মা’কে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। তা না হলে সে এতো ভালো পারফরমেন্স করতে পারতো না। দ্যাখ আজ তার কতটা কনট্রিবিউশন এই সংসারে। তোর যখন যা লাগে, আমি তো পারতাম না। কিন্তু আজকে তুই সব পেয়েছিস শুধু ওর জন্য। মা’কে কখনও বিরক্ত করিস না। ওর তো নিজেরও খারাপ লাগে, তোকে সবসময় সময় দিতে পারে না বলে।”
আসলে মায়ের প্রতি ঋর অভিমান বেড়েছে আজকাল। সে সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। বয়স সতেরো পেরিয়েছে সবে। তার কিশোরী মনে নানা আদর আকাঙ্ক্ষা আর বায়নাক্কার স্রোত আসে। মা’কে সবসময় কাছে পেলে সে সবের অধিকাংশটাই যেন মেটে। কিন্তু দুটো জিনিস তো আর একসঙ্গে পাওয়া যায় না। সুমিত মেয়ের কষ্টটা বোঝে। কিন্তু তারও যে খুব কিছু করার আছে, তেমন তো নয়। প্যারাটিচারী থেকে যা আসে তাতে গরম জলে তিনজনের জন্য খানিকটা চাল সেদ্ধ করা হয়তো সম্ভব হচ্ছিল কোনো মতে। কিন্তু আর সবই থাকছিল পড়ে। রণিতা এক প্রকার এই সংসারটা বাঁচিয়েছে– সুমিতের মনে হয়।
সুমিত যে স্কুলে শিক্ষকতা করে, সেখানে পার্মানেন্ট টিচার প্রায় চল্লিশ জন। এই তো গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রায় তেত্রিশ জন টিচার মিলে রাজস্থান ট্যুর করল। ওরা সুমিতকে একবার প্রস্তাব জানিয়েছিল মাত্র। সুমিতও হেসে বলেছিল, ” আচ্ছা, দেখছি ।” তারপর যথারীতি , “– না গৌতম দা, সামনে মেয়ের পরীক্ষা তো, তাই যাওয়া হবে না।” বলে উপসংহার টেনে মনে মনে ব্যর্থতায় কষ্ট পেয়েছিল খুব। কিন্তু রণিতা যে ভাবে উন্নতির শিখরে চড়ছে, তাতে সুমিতের মনে হয়, একদিন নিশ্চয়ই রণিতা ও ঋ অনেক সচ্ছলতার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। সে নিজে তেমন কিছু না পারলেও, রণিতার শক্তিতে তাদের তিন সদস্যের ভবিষ্যৎ বেশ সুন্দর হতে চলেছে— এমন প্রত্যাশা এখন করাই যায়। রণিতার একটা ক্ষোভ হয়তো আছে সুমিতের প্রতি। কিন্তু সে তো আর নতুন কিছু নয়। ধীরে ধীরে সুমিত সে ক্ষোভ অভিযোগ সহ্য করতে শিখেছে। আজকাল অবশ্য রণিতা তা খুব একটা প্রকাশ করে না। সেও হয়তো বুঝেছে, সুমিতের দ্বারা যতটুকু সম্ভব তার চেয়ে বেশি কিছু ভাবাটাই ভুল। সুমিতও তাই কখনো ঘাঁটায় না রণিতাকে।
এই যে মার্কেটিং বিজনেস এর জন্য রণিতার এতোটা স্মার্টনেস এখন, তাতে সুমিতের বেশ লাগে। কথায় কথায় রণিতা বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ সচরাচর বলতে শুরু করেছে। সুমিত নিজে কখনোই তেমন প্রকৃতির না হলেও তার কিন্তু রণিতার আপগ্রেডেশন ভালোই লাগে। বাড়িতে মাঝে মধ্যেই বাইরের খাবার আসে, পেটরোগা সুমিত ওসব খাবার অনেকসময় খায় না। মেয়ে আর মেয়ের মা নতুন কেনা ডাইনিং এ বসে যখন সে সব চামচে তুলে খায়— সুমিতের সে দৃশ্য দেখতে বেশ অন্যরকম লাগে। সেই পুরনো আঁচের কালি পোড়া হাতে কেরোসিন কয়লা জ্বালা অর্ধদগ্ধ রণিতা এখন ডাল ভাতের জায়গায় মাঝে মাঝেই বেশ নতুন নতুন খাবারের নাম বলে। একটা ভালো দামি মোবাইল আছে রণিতার, বিজনেস এর প্রাপ্তি থেকে কেনা। তাতে সময় পেলে রণিতা ইউটিউব খুলে কিছু কিছু রান্নার রেসিপি দেখে। ট্রাই করে তার দু’একটা । কখনও ছবি তুলে সেগুলো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। সুমিতের ফেসবুক একাউন্ট এ রণিতা নেই। রণিতার ফেসবুক প্রোফাইল শুরু হয়েছে এই মার্কেটিং এ নেমে। তাই তার ফ্রেণ্ডরাও প্রায় অধিকাংশ ঐ মার্কেটিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। একদিন রণিতা এই সোশালমিডিয়া সম্পর্কে তেমন আগ্রহী ছিল না। তখন তার কাছে থাকত একটা পুরনো বোতাম দেওয়া ফোন। এখন রণিতা খুব বোঝে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এর গুরুত্ব আর আনন্দ। বিজনেস, সংসারের ফাঁকে রণিতার তৃতীয় বস্তুটি হলো ঐ মোবাইল। সুমিত সামান্য দূর থেকে আজকের রণিতাকে দারুণ ভাবে লক্ষ্য করে। সে দেখা আংশিক অম্ল-মধুর হলেও, সুমিত মনে করে— এটার দরকার ছিল। মনে করে, আজকের রণিতা সত্যিই অনেকটা স্বাধীন ও স্বনির্ভর। মনে মনে রণিতার প্রতি একটা কুর্ণিশ ঠুকে দেয় সুমিত।
গত পরশু রণিতার বিজনেস বস বাপ্পাদিত্য খুব সকালে একটা ফোরহুইলার নিয়ে সুমিতদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। রণিতা নীল জিন্স প্যান্টের উপর একটা প্রিন্ট শার্ট পরে বেরিয়ে যায়। সুমিত তখন ওদের ঘরের দরজার পাশে গোটা কতক জল শুকিয়ে যাওয়া ফ্যাকাশে গাছের গোড়ায় মগে করে জল দিচ্ছিল। রণিতা বাপ্পাদিত্যর ফোর হুইলারে ওঠার মুহূর্তে গেট খুলে সুমিতের দিকে তাকায়। বলে,
“— আজ দুর্গাপুরে প্রোগ্রাম। ফিরতে রাত হতে পারে। স্কুল থেকে ফিরে মেয়েকে দেখে রাখবে।”
উত্তরে সুমিত শুধু বলেছিল,
“ঠিক আছে, সাবধানে যেও।”
কিন্তু সেদিন রাতে যখন রণিতা বাড়ি ফেরে না, তখন সুমিতের মনটা খারাপ হয়েছিল। সারাদিনে দু’তিনবার মেয়ের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছিল রণিতা। কিন্তু সন্ধে থেকে তার ফোন বন্ধ ছিল। সম্ভবত চার্য ছিল না। তারপর রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ রণিতার মোবাইলে সংযোগ করতে পারে ঋ। রণিতা জানায়,
“— প্রোগ্রাম শেষ করে ফিরতে পারতাম না রে ঋ। তাই এখানে একটা হোটেলে রাতে থেকে গেলাম। কাল সকালে একটা ছোট্ট মিট আছে বর্ধমান শহরে, ওটা সেরে সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরব । তুই ঠিকমতো খেয়ে নিস। ফ্রিজে অনেক খাবার আছে। বাবার সঙ্গে বসে খাস। আর বাবাকে বলিস তোর খেয়াল রাখতে, বলবি বাড়িতে যেন থাকে।”
মোবাইল লাউডে দিয়ে ঋ মায়ের বক্তব্য বাবাকে শুনিয়ে ছিল। মনে মনে মায়ের উপর রাগ হয়েছিল ঋর । সুমিত ঋকে বলেছিল,
” ঠিক আছে, এমন তো হতেই পারে। বিজনেস এর ব্যাপার। তাছাড়া দূরত্বটা তো কম না, প্রায় আড়াই শো কিলোমিটার। এক আধটা দিন সমস্যা হতেই পারে। মায়ের উপর রাগ করিস না। তুই বরং মন দিয়ে লেখা পড়াটা কর। তোকে তো তোর মা সব কিছুর সুযোগ করে দিচ্ছে। “
ঋকে হয়তো মায়ের রাতে বাড়িতে না ফেরার ব্যাপারটা সহজ করে বোঝাতে পেরেছিল সুমিত। কিন্তু সে নিজে যে ঠিক কী বুঝেছিল ভাবতে পারে না। তারপর রাতে একা একা বিছানায় জেগে বসে থেকে কিছু খণ্ড খণ্ড অসমাপ্ত কবিতার বিকলাঙ্গ শরীরের জন্ম দিয়েছিল। কেননা যখন সে ভেবেছিল, রাতে অমৃতার সঙ্গে একটু হোয়াটসঅ্যাপ এ লিখে লিখে কথোপকথন হলে, হয়তো ভালো লাগবে। কিন্তু তা হলো না। অমৃতাকে মাঝরাত অবধি পেলই না সুমিত। যতবার মোবাইল অন করে খুঁজেছে, ততবারই সে দেখেছে— অমৃতা অফ।
কাল সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, রণিতা বাড়ি পৌঁছতে পারে নি। প্রায় রাত দশটা নাগাদ রণিতা প্রবল এক ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। সুমিত লক্ষ্য করেছে, রণিতা কোনো ফিরিস্তি শোনায় নি। সুমিতের সঙ্গে বিশেষ কথাও হয়নি তার। শুধু মেয়ে ঠিক মতো জল খেয়েছে কিনা আর ঘরে বাজার কী আছে বা নেই এইসব দু’এক বাক্যে শুনেছে। তারপর ফ্রেশ হয়ে মেয়ের সঙ্গে ঘুমোতে গিয়েছে যথারীতি।
কাল সারারাত সুমিতের তেমন ঘুম হলো না। কেবল তার মনে হয়েছে, অনেকটা পথ তার একা হাঁটা দরকার। কিন্তু সে নির্জনতা কোথায়। আবার মনে হয়েছে, সে নিজেই তো এক সত্যিকারের নির্জন মানুষ। কারণ কাল রাতেও সে খুঁজে পায়নি অমৃতাকে সোশালমিডিয়ার আনাচে কানাচে। লিখতে বসে ব্যর্থ হয়েছে। ভাল্লাগেনি কতগুলো অপুষ্ট কবিতা জন্মাতে। বিছানার আশ্রয়টুকুও কেমন যেন বিস্বাদ। মাথা রাখা বালিশটাও যেন বিপন্ন শক্ত চিমশে। জেগে থাকায় কেবল চোখ ব্যথা। তাই শুধুই অনন্ত অস্বস্তি।
সুমিত এখনও একটা ছোটোবেলাকে মনের মধ্যে পুষে রেখেছে। সে হলো তার নিঃশব্দে কান্না। দুচোখে ঝরঝর করে জল ভেসে যাবে, আর সে শুধু চুপ করে বিবর্ণ দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে থাকবে। কিন্তু গতকাল মাঝরাতে তাও সে পারল না। অবশেষে দুই হাতে
চোখ বন্ধ করে পড়ে থেকে থেকে কখন যেন অচেতন হয়েছিল।
সকালে উঠেই প্রকাশকের একটা ফোন। দু’একদিন পরেই যেতে পারত। তবু সে সিদ্ধান্ত নিল আজই যাবে, কলকাতা কলেজস্ট্রিট। কত বই, জীবন ও যাপনের প্রস্ফূটিত ও ঝরে পড়া ধুলোবালিছাই নিয়ে শুয়ে থাকে দুপারে। একা মানুষ তার মাঝখান দিয়ে পথ হেঁটে যায়। বই বড় নিঃশব্দ। তাদের পাড়া দিয়ে হেঁটে গেলে নির্জনতা পাওয়া যাবে। সুমিতের কী এক নির্জনতা যেন চাই।
কিন্তু কলকাতায় পা দিয়ে আবার তার অমৃতার শূন্যতা ঠেকে বুকে। কলেজস্ট্রিটে ইতিউতি হাঁটতে হাঁটতে সে মেসেজ করে অমৃতাকে। অমৃতা কিন্তু অফ। তারপর সন্ধে হয়ে যাচ্ছে দেখে সুমিত ফিরতে থাকে শিয়ালদহ স্টেশনে। অথচ শিয়ালদহ থেকে ছটা পঞ্চাশের পলাশপুর লোকাল ধরবে বলে স্টেশনে পৌঁছে দেখে প্লাটফর্ম যেন মানুষের মহাসমুদ্র। মাইকে শুনতে পায় বার বার ঘোষণা করা হচ্ছে, পলাশপুর লাইনের কোন এক স্টেশনে ক্ষিপ্ত মানুষ রেল অবরোধ করেছে । যাত্রীদের মুখে মুখে কী একটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ ঘুরছে।
সুমিত যারপরনাই বিধ্বস্ত বোধ করে। বার বার হাতঘড়িতে তাকায় আর কান খাড়া করে শুনতে থাকে পরবর্তী ঘোষণা। প্লাটফর্ম এ অপেক্ষমান যাত্রীর ভিড়ে পায়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে অসংখ্য পা। সুমিত একটা যেন তেন বসবার জায়গা খুঁজছে। ঠিক এমন সময় হঠাৎ পকেটে মোবাইলটা ভাইব্রেট হলে, মোবাইল বের করে দেখে, অমৃতা কল করছে। সুমিত দ্রুত রিসিভ করে।

( এরপর আগামী সংখ্যায়)

2 thoughts on “ধারাবাহিক উপন্যাসঃ দ্বিতীয় পৃথিবী(পঞ্চম পর্ব) – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. চমৎকার এগোচ্ছে। অভিনন্দন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *