শক্তিপদ রাজগুরু : ঔপনিবেশিক উত্তর বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তি কথাশিল্পী
মধুসূদন দরিপা
ঔপনিবেশিক উত্তর বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তি কথাশিল্পী শক্তিপদ রাজগুরু। বাঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম গোপবান্দী থেকে শুরু করা তাঁর জীবনের চলাপথ অজ পাড়া গাঁয়ের জল কাদা মাটি মাখতে মাখতে উঠে এসেছিল মহানগরের ঘেরটোপে। বাংলা সাহিত্যের তিন বিখ্যাত বাঁড়ুজ্জের কুশলী হাতে তুলে আনা গ্রাম বাংলার মাটির গন্ধ গায়ে মেখে নিয়ে পথে নেমেছিলেন তিনি। দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ মানুষের টুকরো টুকরো সুখ দুঃখ আনন্দ বিষাদের কথা তিনি সমাজের বিবিধ ক্ষেত্রে বহু বিচিত্র রূপে শত সহস্র চরিত্রের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলে আশ্চর্য সব কাহিনির ছবি এঁকেছেন তাঁর গল্পে উপন্যাসে। পাটোয়ারি বুদ্ধির লোকেরা অমূল্য সেই সম্পদকে পুঁজি করে ব্যবসায় নেমেছেন। সিনেমা করেছেন। থিয়েটার করেছেন। চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েছেন। রাজ্য স্তরে জাতীয় স্তরে সম্মান পেয়েছেন। সম্মান দক্ষিণা পেয়েছেন। কিন্তু এসবের পিছনে মূল কারিগর হিসেবে শক্তিপদ রাজগুরু আজীবন রিক্ত হস্তে শুধু কলম পিষে গেছেন। তথাকথিত বিখ্যাত সব ধ্বজাধারী রথী মহারথীদের মাঝে তিনি চিরটা কাল এক বঞ্চিত অবহেলিত শিল্পী হিসেবে জীবন কাটিয়েছেন। ‘ মেঘে ঢাকা তারা ‘ -র মতো।
শক্তিপদ রাজগুরুর গল্পগুলি সহমর্মিতার গর্ভে জন্ম নিয়ে বাঁক খেয়ে খেয়ে পথ হেঁটেছে বহু বিচিত্র পরিবেশে। কখনো কয়লা খনির নিচে, কখনো সুন্দরবনের গভীরে, কখনো বা দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তু কলোনীতে। প্রায় প্রত্যেকটি গল্পে বাস্তব জীবনের ছবি। কোন পরাবাস্তবের অবকাশ নেই। টানটান চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। ‘ ঘরে ফেরা ‘ গল্পের নায়িকা কমলি আর পাঁচটা ছাপোষা গেরস্ত বাড়ির মেয়ের মতোই স্বপ্ন দেখতো প্রিয় মানুষটির সঙ্গে ঘর বাঁধার । কিন্তু স্বপ্ন আর বাঁচার মধ্যে নিয়ত বিস্তৃত হয় সমুদ্র। সেখানে হাঙরের বাস। এই গল্পে মাস্টারস্ট্রোক কমলের মা কুসুমবালা। পেট জানে না বুকের কথা । সে চেনে শুধু খিদে। আর খিদে বড়োই বালাই। বাঁচার জন্য টাকা চাই। টাকা। সেই টাকার জন্য সন্তান সেন্টিমেন্ট ভুলে নিজের মেয়ের ভরা যৌবন নিয়ে বেসাতি ফাঁদে সে। মালা চন্দন বদলের ছলাকলায় বিক্রি হয়ে যায় কমলি বৈষ্ণব আখড়ার বাবাজীর কাছে। তিনদিনের সংসার ভেঙে ফিরে আসে মেয়ে। মঞ্চে আসে জুয়াড়ি নীলু। কমলি কিন্তু এবার সত্যি সত্যি ভালবেসে ফেলে তাকে। যৌবনের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে সে ফের ভাবতে শুরু করে এই বুঝি তার সুখের ঘরের স্বপ্ন পূরণের পালা শুরু হল। কিন্তু ভাবনাই সার। বাস্তব বড়োই কঠিন। নীলুর মধ্যে সততার আভাস দেখিয়ে লেখক পাঠকের মনে একটু আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে ছিলেন । কিন্তু গল্পে প্রাণসঞ্চারের খাতিরে রক্তের নেশায় ঝুমুর দলের মেয়েদের ভিড়ে নীলুর সততার পরাকাষ্ঠা হারিয়ে যায়। পশুতে পরিণত হয় সে। সুখের সংসার গড়ার স্বপ্ন ভেঙে চৌচির হয়ে যায় কমলির। ফিরে আসে মায়ের কাছে। অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করে হাঙরের মায়ের কাছে পুনরায় কারো শিকার হতে। জীবন যন্ত্রণায় জ্বলে পুড়ে মরা অভাগী মেয়ে প্রতিবাদে চিৎকার করে ওঠে : ” তুমি ফের যদি এই খেলার নাম করেছ তার আগেই আমি কালীসায়েরের জলে গলায় কলসী বেঁধে আত্মঘাতী হব। ” শক্তিপদ রাজগুরুর অমর সৃষ্টি “চেনা মুখ” এর নীতার আকুতিই যেন প্রতিধ্বনিত হয় কমলির গলায় : ” দাদা। আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম …। “
‘ঘরে ফেরা ‘ গল্পের নায়িকা কমলির মতোই ‘ চেনা মুখ ‘ উপন্যাসের নায়িকা নীতাও স্বপ্ন দেখতো ভালোবাসার মানুষ সনতের সঙ্গে ঘর বাঁধার। কিন্তু বাধা সংসারের নিত্যদিনের অভাব। বাধা অসহায় বৃদ্ধ পিতা বৃদ্ধা মাতা বেকার ভাই বোন। নীতা পাহাড় ভালোবাসে সনতের প্রেমের মতোই সে ভালোবাসার টান। পাহাড় এই গল্পে অনবদ্য এক ব্যঞ্জনার প্রতীক। পাহাড় সকলকে গ্রহণ করে, আশ্রয় দেয়। কিন্তু নিজে দাঁড়িয়ে থাকে স্থির, অটল হয়ে। নীতা দরিদ্র সংসারের জন্য আত্মসূখ বিসর্জন দেয়, নিজের যাবতীয় আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নকে নির্বাসন দেয়। শক্তিবাবুর কথায় ‘ মনের গভীর দুঃখকে হাসি দিয়ে ঢেকে রাখতে চায়। ‘
দাদা শংকর কথার ফাঁকে নীতাকে মজাচ্ছলে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলে, ” তুই একটা আস্ত ইডিয়ট। দেখবি তোর ঘাড়ে পা দিয়ে অনেকেই উঠে যাবে উপরে, পড়ে থাকবি তুই। পরের দুঃখে যারা কষ্ট পায় তাদের দুঃখ কোনদিনই ঘোচে না –ঘুচতে পারে না। জীবনে তুই কষ্ট পাবি নির্ঘাত। “
কষ্ট নীতাকে পেতেই হবে। এটাই নিয়ম। তা নাহলে যে গল্প লেখা মিথ্যে হয়ে যাবে। ট্রাজেডি শব্দটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ঘটনাক্রমে এক সময় একে একে সবাই সরে যায় নীতার কাছ থেকে। দিদির ভালোবাসাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে নিতান্ত স্বার্থপরের মতো বোন গীতা রূপের মোহে ভুলিয়ে সনতকে হাতিয়ে নেয়। কী অব্যক্ত এক তীব্র বেদনাকে জাগিয়ে তোলেন লেখক গীতার এই স্বার্থপরতাকে নীরব সমর্থন জানিয়ে। সমকালীন সহায় সম্বলহীন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে কোনোক্রমে নামমাত্র অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে বেচেঁ থাকার নিদারুণ যন্ত্রণার আর্তনাদ শোনা যায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক পিতা মাধববাবু এবং মা কাদম্বরীদেবীর আচরণে। চরম দারিদ্রের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে স্বার্থপরের মতো সংসারে অচলাবস্থা আসার আশঙ্কায় বড়ো মেয়ের ভালোবাসার পাত্রের সঙ্গে ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। একজন আদর্শবাদী শিক্ষক পেটের দায়ে খিদের স্বার্থে নীতি বিসর্জন দিতে বাধ্য হন। একজন মা স্বয়ং মেয়ে একজন। ব্যর্থ প্রেমের জ্বালা বুক ফেটে গেলেও মুখ বুজে বড়ো মেয়েকে আত্মত্যাগের আগুনে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করেন। বড়ো মেয়ের আগে ছোট মেয়ের বিয়ে হচ্ছে তার সাফাই গাইতে আত্মীয়স্বজনদের বলে, ‘ ও মেয়ের ধনুকভাঙা পণ, এম. এ. পাশ না করে বিয়ে করবে না। কি করি এদিকে এমন ছেলে হাতছাড়া হয়ে যাবে, গীতার সঙ্গেই ঠিক করলাম বাধ্য হয়ে। ‘
কী আশ্চর্য মুন্সীয়ানায় কী আশ্চর্য কুশলতায় শক্তিপদ রাজগুরু তাঁর শ্রেষ্ঠ কালজয়ী উপন্যাস ‘ চেনামুখ ‘ এর নিদারুণ বাস্তব প্লটগুলি সাজিয়েছেন । পাঠক রীতিমতো মুগ্ধ বিস্মিত হয়ে যায়। নীতার যক্ষ্মা রোগ শংকরের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ায় বিব্রতা নীতা হাসে, হাসতে পারে সে এবং হাসতে হাসতে বলে, ‘ এবার বোধ হয় সব কাজ থেকে ছুটি পাবো রে বড়দা! আমার কাজও ফুরিয়েছে, সেই সঙ্গে প্রয়োজনও।
সংসার থেমে থাকে না। নীতা যে স্যানিটারিয়াম থেকে আর ফিরল না, তাতে সংসারের গতি থমকেও থাকেনি । নীতাদের দোতলা পাকা বাড়ি হয়েছে, তবে বাইরের শংকরের যে ঘরে নীতা থাকতো, শংকরের ইচ্ছায় সেই ঘরখানি পাকা করা হয়নি, কথা ছিল নীতা ভালো হয়ে ফিরে এলে তার পছন্দমতো ঘরখানি তৈরি করা হবে। নীতা ফিরে আসেনি। .
” এতদিন পর সেই কাঁচা ঘরের চিহ্ন মাত্র অবশিষ্ট নেই। সেখানে জমেছে ঘন সবুজ গাছ -গাছালি, পাখি ডাকে পত্রাবরণ থেকে। “
শক্তিপদ রাজগুরু বিভূতিভূষণের প্রতি ভীষণ অনুরক্ত ছিলেন। যুবা বয়সে প্রায়শই ছুটে ছুটে যেতন তাঁর কাছে। কলকাতার মেসে, মিত্র ঘোষের আড্ডায়, বনগাঁর কাছে চালকে বারাকপুরে তাঁর দেশের বাড়িতে । বার বার পাঠ করেছেন আদ্যোপান্ত বিভূতিভূষণের সাহিত্য —- ‘ আরণ্যক, পথের পাঁচালী, অপরাজিত. ইছামতী, দেবযান, দৃষ্টিপ্রদীপ…….। লেখকের সান্নিধ্যে পাঠ নিয়েছেন কিভাবে জীবনের চলাপথে নিত্যদিন দেখা হওয়া চরিত্রগুলি ফুটিয়ে তুলতে হয় সাহিত্যের পাতায়। ফলতঃ খুব স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁর লেখার মধ্যে ছাপ পড়েছে বিভূতিভূষণের । তবে শক্তিপদ রাজগুরু অনুকরণ করেননি, অনুসরণ করেছেন। কৌশল করে তাঁর বিভিন্ন গল্পে উপন্যাসে বিভূতিভূষণের বিচিত্র সব চরিত্রের মানুষকে ছোট মাঝারি আকারে বসিয়েছেন। এখানেই তাঁর মুন্সীয়ানা।
‘বাঘিনী ‘ গল্পে মানিকজোড় দু’টি চরিত্র বনকাটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক পতিতপাবন এবং বসন্ত
লোহারপাড়ার এক নিরক্ষর নাগরিক বসন্ত । প্রকৃতি পাগল। যত্রতত্র গাছ লাগিয়ে বেড়ায়। রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনায় । ‘আরণ্যক ‘-এর যুগলপ্রসাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। যুগলপ্রসাদ বিভিন্ন স্থান থেকে নানা ধরনের লতা গুল্ম সংগ্রহ করে সরস্বতী কুণ্ডীর জলাশয়ের চারদিকে রোপণ করত। বসন্তের বউ মালতী সংসারের প্রতি উদাসীন স্বামীকে গালমন্দ করে। মালতী নিজে শালপাতার থালা বানায়। কাঠের আড়তদার কানাই ঘোষ তার চেরাইকলে কাজ করাতে বসন্তকে ডেকে পাঠায় । মালতী চায় বসন্ত সে কাজ করুক। কিন্তু বসন্ত চায় না। সে যে যুগলপ্রসাদের উত্তরসূরী। রবীন্দ্রনাথের মতো বৃক্ষ তার কাছে ‘ মানবের বন্ধু ‘। বসন্ত তাই মালতীকে খরগোস, হরিণ শিকার করতে বারণ করে। বন কাটতে নিষেধ করে। সন্তানসম্ভবা মালতী ভাবে ভবিষ্যতের কথা, সংসারে অর্থের প্রয়োজনের কথা। মালতীর ভাবনা সত্য, কিন্তু তার থেকেও বড়ো সত্য প্রকৃতির বেড়ে ওঠা, প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে তোলা।
‘ আরণ্যক ‘ উপন্যাসের শেষভাগে সত্যচরণ যুগলপ্রসাদকে বলে, ‘এ জঙ্গলে কিছু গাছপালা লাগাও নতুন ধরনের। পাহাড়ের বন কেউ কাটবে না।
লবটুলিয়া তো গেল –সরস্বতী কুণ্ডীর ভরসা ছাড় —
উত্তরে যুগলপ্রসাদ বলে, ‘ ঠিক বলেছেন হুজুর। কথাটা মনে লেগেছে। কিন্তু আপনি ত’ আসছেন না, আমাকে একাই করতে হবে। ‘
সত্যচরণ বলে, ‘–আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে যাব। তুমি লাগাও ।
অনুরূপ ছবি দেখি ‘ বাঘিনী ‘ গল্পে, যখন প্রাইমারি শিক্ষক পতিতপাবনের কাছে সত্য জ্ঞান উপলব্ধি করে বসন্ত সমব্যথী, সহানুভূতিশীল হয়ে মৃতবৎসা মালতীকে বলে ওঠে, ‘ মা বসুমতীর বুকের থেকেও গাছকে কেটে নিলে মা বসমতীর কত কষ্ট হয় বুঝ তাহলে। ‘
‘ আরণ্যক ‘-এর একদিকে মানুষ, অন্যদিকে প্রকৃতি । মানুষের কথা অন্তহীন নয়, কিন্তু প্ৰকৃতির কথা অনন্ত । শক্তিপদ রাজগুরু বিভূতিভূষণের সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ সত্ত্বেও এক ভিন্ন স্বাদের সাহিত্য নির্মাণ করছেন । তাঁর প্রকৃতি প্রেমকে আত্মস্থ করে প্রকৃতির রূপ বর্ণনা করেছেন সম্পূর্ণ নিজের স্টাইলে । বিভূতিভূষণের বর্ণনা আধ্যাত্মিক চেতনার কথা বলে ।
” কতবার এই ক্ষান্ত বর্ষণ-মেঘ-থমকানো সন্ধ্যায় এই মুক্ত প্রান্তরের সীমাহীনতার মধ্যে কোন দেবতার স্বপ্ন যেন দেখিয়াছি–এই মেঘ, এই সন্ধ্যা, এই বন, কোলাহলরত শিয়ালের দল, সরস্বতী হ্রদের জলজ পুষ্প, মঞ্চী, রাজু পাঁড়ে, ভানুমতী, মহালিখারূপের পাহাড়, সেই দরিদ্র গোড়-পরিবার, আকাশ ব্যোম সবই তাঁর সুমহতী কল্পনায় একদিন ছিল বীজরূপে নিহিত — তাঁরই আশীর্বাদ আজিকার নবনীলনীরদমালার মতই সমুদয় বিশ্বকে অস্তিত্বের অমৃতধারায় সিক্ত করিতেছে — এই বর্ষা-সন্ধ্যা তাঁরই প্রকাশ, এই মুক্ত জীবনানন্দ তাঁরই বাণী, অন্তরের অন্তরে যে বাণী মানুষকে সচেতন করিয়া তোলে । ” ( আরণ্যক : পৃষ্ঠা ১৭১)
শক্তিপদ রাজগুরু তাঁর ‘অনিকেত’ উপন্যাসে একটি চা-বাগানের বর্ণনা দিচ্ছেন, যেখানে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটেছে, আধ্যাত্মিক গন্ধ নেই ।
” ঢালু পাহাড়ীর বুকে স্তরে স্তরে নেমে গেছে সবুজের পুঞ্জ । গাছগুলো এর মধ্যে নূতন পাতার সাজে সেজে উঠেছে আর উপরের দিকে মাথা তুলেছে হলুদ নতুন দুটি পাতা একটি কুঁড়ি । ……সরেস চা ! “
” নির্জন উপত্যকার বুকে সবুজ খেতে বলটিয়া পাখীর কলরব জাগে । ধানের মঞ্জরীতে এসেছে সোনালী আভা । মকাই ক্ষেতের সবুজ দীঘল পাতা কাঁপে হিম হাওয়ায়, বাতাসে ওঠে কমলালেবু ফুলের মদির সুবাস । এ এক রূপ রস বর্ণ গন্ধময় জগৎ । ছোট্ট ঝোরাটা কলরব তুলে নুড়ি পাথরের বুকে নাচের ছন্দ তুলে চপলা মেয়ের মত ছুটে চলেছে । “
স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্যে অন্ত্যজ মানুষদের নিয়ে যেসব গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে, বলা বাহুল্য যে শক্তিপদ রাজগুরুর উপন্যাসেও তার প্রত্যক্ষ প্রভাব স্পষ্ট প্রতীয়মান । তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, নাগিনী কন্যার কাহিনী, বিভূতিভূষণের ইছামতী, সমরেশ বসুর গঙ্গা, উত্তরঙ্গ, মহাকালের রথের ঘোড়া, মহাশ্বেতা দেবীর কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু, অরণ্যের অধিকার, অদ্বৈত মল্লবর্মনের তিতাস একটি নদীর নাম, সতীনাথ ভাদুড়ির ঢোড়াই চরিত মানস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য এই প্রসঙ্গে । গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখনীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত । শক্তিপদ রাজগুরুর গল্পগুলিতে উঠে এসেছে সমকালের বিচিত্র সব অনুষঙ্গ । ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী জীবন, সামাজিক বৈষম্য, আর্থিক বৈষম্য, ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কার । এছাড়া উঠে এসেছে দেশভাগের সমস্যায় জর্জরিত ছিন্নমূল মানুষের কথা এবং কয়লাখনি কিংবা সুন্দরবন কিংবা অনুরূপ সব স্থানের প্রান্তিক মানুষের জীবন । এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সমকালীন গল্পকার হলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, মনোজ বসু, সমরেশ বসু, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, দেবেশ রায়, মহাশ্বেতা দেবী, রমাপদ চৌধুরী প্রমুখ ।
শক্তিপদ রাজগুরু তাঁর গল্প উপন্যাসে মানুষের মনের গভীর রহস্যকে নির্মমভাবে, কঠিন যন্ত্রণা ও মর্ম বেদনার তাগিদে নেড়ে চেড়ে বার বার পরখ করেছেন । বাংলা সাহিত্যের তিন বিখ্যাত বাঁড়ুজ্জের মতো জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনকে দেখেছেন । তাঁর জীবন অনুসন্ধানের তীক্ষ্ণ শলাকা কেবল জীবনের চালচিত্র নয় , তার আত্মাকে, তার মনকে, তার শরীরকে ভেদ করেছিল । জীবন রহস্যকে তিনি কোনদিন উপেক্ষা করেননি । বরং তাকে নিত্যদিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অত্যন্ত সচেতন ভাবে পরীক্ষা করেছেন। এবং অগ্রজ সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের সৎ পরামর্শ অনুসরণ করে সতর্ক শিল্পীর মতো করে তাদের জীবন চিত্র এঁকেছেন অণু-পরমাণুতে ।
আশ্চর্য তাঁর উপযোগী ভাষার ব্যবহার । ‘ গৌড়জনবধূ ‘ উপন্যাসের সময়কাল ষোড়শ শতক । বৈষ্ণব, শাক্ত, সুফী প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সমকালের ডায়ালেক্ট অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন তিনি । সেই সময়ের মানুষের মুখের ভাষা তুলে ধরা কম মুন্সীয়ানা নয় ।
যেমন —
” চতুষ্পাঠীর আচার্য বলতেন,– মস্যাধার, পুঁথি আর লেখনী স্পর্শ করা ভোলানাথের ইষ্টদেবের নিষেধ । তুমি ব্রাহ্মণের ঘরের কুলাঙ্গার। কূলধর্ম, বিদ্যাভ্যাস, ত্রিসন্ধ্যা জপের বদলে তুমি হলকর্ষণ করগে । ” (পৃ: ৯ )
আচার্যের মুখে তৎসম শব্দের প্রাচুর্য লক্ষ্যনীয় ।
তুলনায় গোপাল বাউলের মুখের ভাষা অনেক সহজ সরল ।
” —তাই নাকি গো ।”
“–ও কি ! এই বৃষ্টির মধ্যে যাবে কোথায় ? বৃষ্টি একটু ধরুক । ও রাধারাণী দিদি ।”
‘গো’, ‘ রাধারাণী দিদি’ ইত্যাদি সম্বোধন বাচক শব্দের ভিতর দিয়ে বৃদ্ধ বৈষ্ণব গোপালের অন্তরঙ্গ বাচনভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ।
মোল্লাপাড়ার সুলতানী মক্তবে মৌলভী সাহেবের ভাষায় উর্দু ও ফারসি ভাষার প্রভাব ঘটিয়েছেন দক্ষতার সঙ্গে ।
” —বদনা লাও, এ্য।ও বেতমিজ । ওজু করনেকা বখ্ত আ গিয়া । পড়তে রহো এ বাচ্ছা, আলেফ জব্ র অ, বে জব্ র ব, তে জব্ র ত। ” (পৃ : ৭৭ )
সুফী সাধক নকীব শেখ যখন সুর করে গায় —
” মোঁকো কহা ঢুঁঢ়ে বন্দে, মৈ তো তেরে পাসমেঁ ।
নামেঁ দেবল নামেঁ মসজিদ, না কাবে কৈলাস মেঁ । “
(পৃ : ১৭৮ )
এখানে ফারসি বহুল শ্লোকের ব্যবহার লক্ষ্যনীয়।
আবার মাঝি বিলাত আলির ভাষায় মুসলমান মাঝির ভাষারূপ ব্যবহার দেখে বিস্মিত হতে হয় ।
” আসো পটুয়া, তা নৌকায় যে ছোডমা দিদিঠানরা রইছে গো। ” ( পৃ : ১৬৫)
ভাষা হল ভাবের বাহন । রবীন্দ্রনাথ তাই তাঁর লেখায় ভাবের ভাষার ওপর অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছিলেন । শক্তিপদ রাজগুরুর একটা নিজস্ব ভাষাভঙ্গি ছিল, তা খানিকটা তারাশঙ্কর অনুসারী হলেও আবার অনেক ক্ষেত্রেই ভাষা প্রয়োগে তাঁর একান্ত নিজস্ব স্টাইল পাঠকের চোখে ধরা পড়ে । তাঁর ভাষা ছিল ভাবনার ভাষা । পাঠক তাঁর সাহিত্য পড়তে পড়তে তাঁর ভাষা নিয়ে ভাবনায় মগ্ন হয় , চিন্তা করে গভীরভাবে ।
এই স্বল্প পরিসরে শত শত কালজয়ী গল্প উপন্যাসের জনক এমন একজন কিংবদন্তি কথাশিল্পীর একাধিক গল্প উপন্যাস নিয়ে আলোচনার অবকাশ থাকে না ।
তাই কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গল্প-উপন্যাসের কিছু ব্যতিক্রমী চরিত্রের কথা বলি । ‘খলসেখালির গঞ্জ ‘ উপন্যাসে কামিনী মালোপাড়ার জেলেঘরের মেয়ে । কাহিনির খল চরিত্র রূপলাল মান্না । কাঠ আর মাছের আড়তদার। আর এক মাছ আড়তদার গোবর্ধন বারিকের কাছে ধারে মাছ নিয়ে বিক্রি করে।
কামিনী বলে, ‘ মাছ কেনার টাকা কে দেবে গো? ‘
গোবর্ধন বারিক হেসে বলে, ‘ পরে টাকা বুঝিয়ে দিবি ।’
কামিনী হালকা সুরে বলে, ‘ যদি না দিই ? ‘
গোবর্ধন বলে, ‘ গামছাটা কেন রাখি জানিস তো ? গলায় ফাঁস দিয়ে টাকা আদায় করি ।’
কামিনী খিলখিলিয়ে হেসে বলে, ‘ গামছা লাগবে না গো, তোমার ফাঁসে এমনিতেই বাঁধা পড়ে গেছি ।’
গোবর্ধনের মতো রূপলাল মান্নাও পেতে চায় কামিনীকে । খুন করে প্রতিদ্বন্দ্বী গোবর্ধনকে ।
কিন্ত বিধবা কামিনী নিজেকে বাঁচাতে ছোটবেলার পরিচিতি রতনের কাছে চলে যায় । একটি সহজ সরল নারী বিপদে পড়ে পুরুষের লালসা থেকে উদ্ধার পেতে চাটুকারিতা, উপস্থিত বুদ্ধি ও কৌশল অবলম্বন করে নিজের জীবনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছে ।
‘ দূরের মানুষ ‘ উপন্যাস ঘর থেকে পথে এবং দেশের নানা অঞ্চল পার হয়ে প্রবাস গমন এবং প্রত্যাবর্তন ও আবার প্রবাসে প্রতিগমন করার এক আশ্চর্য কথকতা । বিজয়-কমল-সাথীর সম্পর্কের টানাপোড়েন, নানা রাজনৈতিক ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন, জীবনের পথ চলায় ক্লান্ত শ্রমিক ছুটি চাইলেও ছুটি পায় না, তাই চরম হাহাকার নিয়েই ফিরে যায় বিদেশে, ফেলে যাওয়া পিছুটানকে অগ্রাহ্য করতে ।
‘চেনা মুখ ‘ -এর পর শক্তিপদ রাজগুরুর সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস ‘নয়া বসত ‘ । শক্তি সামন্ত যে উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা করেন ‘ অমানুষ ‘ । সুন্দরবনের পটভূমিকায় লেখা এই কাহিনি । প্রেমের গল্প । মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম, মিলন বিরহ ….. সব মিলিয়ে এক জমজমাট চিত্রনাট্য । কিন্তু এরই মধ্যে লেখক সুন্দরবনের অধিবাসীদের জীবন সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর উপন্যাসে । শক্তিপদ রাজগুরু লিখছেন, ‘ বাঁওয়ালির জীবন এমনিই । ওরা বাদাবনে বাঘের মুখে যায় মহাজনের কাঠ কাটতে । মারমুখী গাঙ আর ওই বনেই বাস করে নৌকায় । ….দিনরাত কেবল সেই গাঙ আর বাঘের হাত থেকে বাঁচার ফিকিরই ভাবতে হয় । বাঁওয়ালিরা ভুলে যায় তাদের ঘরের কথা । ……ওদের চারিদিকে মৃত্যু । …..তাদের ঘর মিথ্যা, মিথ্যা তাদের বউয়ের স্বপ্ন । ওসব যেন হারানো জগৎ তাদের কাছে । বাঁওয়ালির বউ একাই নয়, আবাদের এমনি বসতে আছে অনেক বউ—যাদের স্বামী আছে নামমাত্র । তারা থাকে ওই বাদাবনে না হয় গাঙে — আবার কোনও দিন কে হারিয়ে যায় তারা ফেরে না । সেই ফেরারি মানুষগুলোর জন্যে বউগুলো দুদিন কাঁদে —- আউল হয়ে থাকে । তারপর নিজেদের বাঁচার তাগিদে আবার ওই জীবনকে মেনে নেয় । ওদের চোখের জলে গাঙের জল লোনা হয়ে যায়, তবু মন মানে না । ‘
এইসব কথা, এইসব ছবি সিনেমাতে নেই । দেখানো হয়নি । তাই বাংলার কোটি কোটি মানুষের কাছে সে অধরা রয়ে গেছে । তারা ‘ নয়া বসত ‘ জানে না । ‘ অমানুষ ‘ জানে । ‘ চেনা মুখ ‘ চেনে না । ‘ মেঘে ঢাকা তারা ‘ চেনে । তারা শক্তিপদ রাজগুরুর লেখা পড়ে শক্তি সামন্তের সিনেমায় । জনগণের দোষ নেই । তাদের স্বভাবই এমন । কিন্তু জনগণের সরকার ? তাঁরাও শেষ পর্যন্ত তেমনটাই ভাবলেন । এটাই সবচেয়ে বড়ো ট্র্যাজেডি ।
অত্যন্ত মূল্যবান একটি লেখা। শক্তিপদ রাজগুরুকে তাঁর অমূল্য লেখার মাধ্যমে স্মরণ — খুবই ভাল লাগল।