গল্পঃ সাইকেল – পলাশ দাস

সাইকেল
পলাশ দাস

রুই, কত করে?
মাছ কাটতে কাটতেই মাছ ওয়ালা এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে খুব ব্যস্ততার সাথে বললে, কাটা?
না, জলে ছাড়া রয়েছে যেগুলো –
খানিক সময় নিয়ে তারপর বললে, পনেরো টাকা শ।
কম হবে না?
মাছ ওয়ালা একবার তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো।
একশো হবে?
পারব না দাদা। কম হবে না।
অঘোর ঘুরছে বাজারে। যাচাই করছে দাম।

এক – দুই – তিন… দোকান …
এক – দুই – তিন… দিন …
এক – দুই – তিন… মাস … বছর …

২.
খুব ছোটো বাজার বসে কাঠগোলায়। মেরে কেটে একশো পরিবার থাকে এই তল্লাটে। তারাই বাজারে আসে,
অন্য দিক থেকে খুব কম মানুষেরাই আসে। ন-মাসে ছ-মাসে অন্য জায়গা থেকে কেউ কেউ হয়তো এলো।
সুতরাং, ক্রেতা বিক্রেতা সবাই সবাইকে খুব ভাল করে চেনে। অঘোর তাই বিক্রেতার কাছে ধরা পড়ে গেল
দাম যাচাই করতে করতে। রাস্তার দু-ধার দিয়ে বসে জনা দশেক বিক্রেতা, বেলা গড়াতে গড়াতে সব ফাঁকা।
সাইকেলটা রাস্তার পাশে রেখে অঘোর দু-এক পা এগিয়ে গেল মাছের দোকানের দিকে। মাছ কত করে?
মাছ-ওয়ালা দেখল অঘোরকে খানিক পরে বললে, আপনি নিতে পারবেন না দাদা। শুধু শুধু জানতে চেয়ে কি লাভ!
শেষে দাম শুনে চলে যাবেন, নেবেন তো আর না!
মাছ-ওয়ালার কথায় খানিক দমে গিয়েও অঘোর বলল, আমার সাধ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই নেবো। তাই, তো
জানতে চাইলাম।
অঘোর আর মাছের দোকানে দাঁড়াল না, কথা শেষ হতেই ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল।
দুপাশ দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে থাকল।এগিয়ে যেতে যেতেই অঘোরের কানে এলো পাশের মানুষের ক্ষীণ
স্বরের কথা,
এই পাগল মত ময়লা জামা পড়া লোকটা রোজ রঙ ওঠা ব্যাগটা হাতে নিয়ে আসে আর এ-দোকান, ও-দোকান
ঘোরে। কিন্তু, জিনিস তেমন নেয় না। কয়েকটা ঝটতির জিনিস কিনে বাড়ি যায়। বলতে বলতেই যে হালকা
হাসি ফুটে উঠেছে ওদের মুখে, তা ওদের দিকে না তাকিয়েই অঘোর বুঝতে পারে। তারা বলে চলে, কত রকমের
লোক যে এই পৃথিবীতে আছে। এরকম লোকও আছে। এত কিপটে মানুষ হয়! খাওয়ার দরকার কী,না খেলেই তো
হয়! এসব লোক যে কেন আসে, শুধু সময় নষ্ট করে। বাজারটাই খারাপ করে দেয়।

৩.
হালকা রঙের প্যান্ট আর ফতুয়া পরিহিত অঘোর বাড়ি ফিরল। এটা পড়েই অঘোর বাজারে যায়। দিনের
বেশিরভাগ কাজ এই জামা-প্যান্ট পড়েই করে। রঙ ওঠা হলেও জামা কাপড় পরিষ্কার। অঘোর মাঝে মাঝেই
নিজেই নিজেকে বলে থাকে, আমি সাধ্যের মধ্যে চলা লোক, চলতে চাওয়া লোক। আমার কোন দেখন দারী
নেই। সাধ্যের মধ্যে যা হয়, যেটুকু হবে, সেটুকুই। ফ্যাশন দিয়ে তো আর আমার দিন চলবে না। কে, কি করছে,
কি বলছে, তাই দিয়ে আমার কি।
পাঁচিলে সাইকেলটা রেখে সামনের কাদা জলের উঠোন অঘোর পেরিয়ে গেল ইটের উপর পা রেখে রেখে।
উঠোনটা বেশ নিচু। কাল রাতের বৃষ্টিতে জল জমেছে। সেই জল ডিঙিয়ে যাওয়ার জন্য কয়েকটা ইট পাতানো
রয়েছে বারান্দা পর্যন্ত। বারান্দার ধার ঘেঁষে বসে আছে অঘোরের মা। চোখে সব ঝাপসা দেখতে পায়
অঘোরের মা।গ্লুকোমায় দৃষ্টিশক্তি প্রায় ক্ষীণ। ওষুধের ব্যবস্থা অঘোর নিয়মিত করতে পারে না। তবে
চেষ্টার কোনো ত্রুটি করে না। অঘোরের হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিতে এগিয়ে এলো রমা। রমার বয়স
পঁচিশ ছুঁই ছুঁই।পাত্রের চেষ্টা করছে অঘোর, কিন্তু ওই নিজের সাধ্যের মধ্যে হয়ে উঠছে না। তাই বয়স
বাড়ছে রমার। রমা অঘোরের একমাত্র মেয়ে। অঘোরকে দেখে মৃন্ময়ও এবার এগিয়ে এলো। মৃন্ময় অঘোরের
ছেলে।
বাবা, আমার বইটা এনেছ? অঘোর বইটা ছেলের হাতে দিল।
বাড়িতে পাঁচটা পেট, আয়ের মধ্যে অঘোরই সিংহভাগ। অঘোরের আয়ের বেশিটাই ধার। বছরের বেশিরভাগ
সময়,তাই সংসার চালাতে বেশ বেগ পেতে হয়। রমা আর ওর মা কিছু কিছু সাহায্য করলেও, সংসারে তা বিশেষ
সাহায্যে আসে না। অঘোর দোকানে দোকানে কেক,লজেন্স সেল করে…

2 thoughts on “গল্পঃ সাইকেল – পলাশ দাস

  1. একেবারে বাস্তব এক জীবন ও লড়াই ।লেখককে ধন্যবাদ ।

Leave a Reply to মলয় চৌধুরী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *