লক ডাউনে জন্ম
দেবাংশু সরকার
পকেটমার তপন মহা সমস্যায় পড়ে গেছে লকডাউনের ফলে । কোথা থেকে কি একটা অসুখ এসেছে, তারজন্য রাস্তাঘাট শুনশান । দোকানপাট, ট্রেন, বাস সব বন্ধ । কোথাও মানুষজনের ভিড়, জটলা কিছুই নেই ! বন্ধ হয়ে গেছে মিটিং, মিছিল, মেলা, উৎসব । তাহলে তপন অপারেশন চালাবে কোথায় ? যাও বা সকালে কিছু সময়ের জন্য মানুষজন বাজারে ভিড় জমাতো, তাও আবার কদিন হলো পুলিশ ঘিঞ্জি বাজারটাকে বড় মাঠে সরিয়ে দিয়েছে । বিরাট বড় মাঠ । সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাজার বসছে । ক্রেতারাও আর গা ঘেঁষাঘেঁষি করে জটলা বাড়াচ্ছে না । ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে তপনের পক্ষে সংসার চালানো । অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না । পকেট মেরে খারাপ উপার্জন হত না । কিন্তু বেশির ভাগটাই চলে যেত বিজুর মদের দোকানে । বাকিটা সংসারে খরচ হত । ফলে কিছুই জমতো না । এখন তপন আপশোষ করছে, যদি কিছু টাকা জমিয়ে রাখতো, তাহলে এখন দুতিন মাস চালিয়ে নিতে পারতো । তারপর সবকিছু স্বাভাবিক হলে আবার কাজে নামতো । বেহিসেবি খরচ করে, কিছু না জমিয়ে ভীষণ ভুল করে ফেলেছে সে । কিন্তু পেটতো শুনবে না । তপনকে টাকা জোগাড় করতে হবে যেমন করে হোক ! অন্তত ভাতের ব্যবস্থাতো করতে হবে ! তাছাড়া তার দিকে তাকিয়ে আছে আরো কয়েকজন । তাদের খিদে মেটানোর দায়িত্ব তপনের কাঁধে রয়েছে ।
ছোট থেকে তপন মামার বাড়িতে আশ্রিত । যখন তপনের এক বছর বয়স, তখন তার বাবা তাদের ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় । তারপর তার মা তপনকে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে ওঠে । বাপের বাড়ির আর্থিক অবস্থাও ভালো নয় । তাই তপনের মাকে কাজে নামতে হয় । দুতিন বাড়ি কাজ করে । কিছু টাকা উপার্জন করে নিজেদের চালিয়ে নেয় । তপনকে একটা সরকারি অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করে । কিন্তু সংসারের অভাব অনটন দেখে ক্লাস ফাইভ অবধি পড়ে সে লেখাপড়াকে গুডবাই জানিয়ে একটা চায়ের দোকানে গ্লাস ধোয়ার কাজ নেয় ।
চায়ের দোকানে বিভিন্ন রকমের লোকজন আসে । তারা বিভিন্ন রকমের আলোচনা করে । তাদের কথা শুনে তপন বুঝতে পারে চায়ের গ্লাস ধুয়ে সে বেশি দুর এগোতে পারবে না । অন্য রাস্তা ধরতে হরে । কিন্তু কোন রাস্তা ধরবে ভেবে পায় না !
শিবা নামে এক উড়নচন্ডি মার্কা লোক মাঝে মাঝে তাদের দোকানে চা খেতে আসে । লিকলিকে রোগা আর রোদে পোড়া তামাটে রঙের শিবার চেহারাটা পাঁচ জনের মধ্যে লুকিয়ে পড়ার পক্ষে একেবারে আদর্শ । চা খেতে খেতে সে তাকিয়ে থাকে তপনের দিকে । কথায় আছে জহুরি জহর চেনে । তপনের হাতের আঙুল গুলো দেখে সে বুঝতে পারে এ আঙুল কোনো সাধারন মানুষের নয় । এ আঙুল শিল্পীর । ঠিকঠাক ট্রেনিং দিলে এই ছেলেটা পকেট মারাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে । আস্তে আস্তে সে তপনের সঙ্গে ভাব জমায় । ভাবে একে নিজের দলে ভেড়াতে পারলে একটা সাগরেদ পাওয়া যাবে । নিজের খাটুনিটাও কমবে । সে লক্ষ্য রাখে তপন কখন দোকানে আসে, দোকান থেকে বাড়ি ফেরে । একদিন তপনকে সে প্রশ্ন করে, “তুই চায়ের দোকানে কাজ করে কত টাকা পাস ?”
– “খুব বেশি নয় । প্রথমে পাঁচশো দিয়ে শুরু । বাড়তে বাড়তে এখন বারোশো ।”
– “সে কিরে ! এই টাকায় তোর চলে ? মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা ইনকাম করেও আমি সামলাতে পারি না !”
– “পঞ্চাশ হাজার ! কি কাজ করো তুমি শিবা দা ?”
– “বিজনেস, বুঝলি বিজনেস । এই বিজনেসে টাকা লাগে না । লাগে বুদ্ধি আর হাতের কারসাজি । অবশ্য তারজন্য কিছু দিন ট্রেনিং নিতে হয় ।”
– “এই ট্রেনিং কোথায় হয় শিবাদা ?”
শিবা বুঝতে পারে তপন আস্তে আস্তে লাইনে আসছে । একটু বুদ্ধি খাটিয়ে কথাবার্তা চালালে এ দলে ভিড়ে যাবে । শিবা বলে, “ট্রেনিং আমিই দিই । কত ছেলেকে দাঁড় করিয়ে দিলাম । তারাও মাসে কুড়ি পঁচিশ হাজার টাকা ইনকাম করে । আচ্ছা চলি, এখন আমার অনেক কাজ পড়ে আছে । বিকালে তোদের চায়ের দোকানে যাবো, তখন কথা হবে ।”
কথা শেষ করেই শিবা হনহন করে চলে যায় । তপন গালে হাত দিয়ে শিবার দিকে তাকিয়ে থাকে । আর অবাক হয়ে ভাবে – মাসে কুড়ি পঁচিশ হাজার টাকা আয় !
কয়েক দিনের মধ্যেই তপন ভিড়ে গেল শিবার দলে । সকালে বিকালে চায়ের দোকানে কাজ, দুপুরে ট্রেনিং । ক্রমশ দুআঙুলের সাহায্যে অন্যের পকেট থেকে অনায়াসে পার্শ তোলাটা রপ্ত করে নিলো । তপনের আঙুলের নিপুনতা দেখে অবাক হয়ে যায় শিবা । ভাবে সেওতো এত ভালো লিফ্ট করতে পারে না । তপনের কেরামতি দেখে হাসতে হাসতে শিবা বলে, “তোর আঙুলগুলো ভগবান স্পেশাল ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরী করেছে স্রেফ পকেট মারার জন্য । আর তুই কিনা চায়ের দোকানে গ্লাস ধুয়ে সময় নষ্ট করছিলি ! আর পাঁচ বছর আগে এলে কোথায় পৌছে যেতিস ! এতো দিনে গাড়ি, বাড়ি হয়ে যেত ।”
দিনে দিনে তপনের পকেট ফুলে ফেঁপে উঠছে, সেই সঙ্গে শিবারও লক্ষী লাভ হচ্ছে । তপন অত্যন্ত সৎ পকেটমার । সে গুরু দক্ষিণা দিতে কখনো কার্পণ্য করে না । তাই শিবার খাটা খাটুনিও অনেকটা কমেছে । এখন সে বেশির ভাগ সময়ে বিজুর মদের দোকানে বসে আড্ডা মারে । তপনের পয়সায় মদ খায় ।
এদিকে তপনের মা, মামা, মামীও বেশ খুশি তপনকে নিয়ে । এখন তপনের মা আর কারো বাড়িতে কাজ করতে যায় না । তপনের মামারও ঠাটবাট বেড়েছে । রোজ সকালে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ে । সকালে হেলতে দুলতে বাজারে যায় । কেনা কাটার জন্য আর দরাদরি করে না । যে জিনিসটা পছন্দ হয় সেটা আগে ব্যাগে ভরে, তারপর দাম জিজ্ঞাসা করে । লাল সুতোর বিড়ি ছেড়ে সিগারেট ধরেছে । পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে । ডানপন্থা, বামপন্থা নিয়ে লেকচার দেয় । ট্রাম্প, জিংপিংদের চরিত্র বিশ্লষণ করে । তপনের মামীর মুখের কাঠিন্যটাও আর নেই । এখন আর কথায় কথায় তপনের মাকে মুখ ঝামটা দেয় না । বরং বেশ হেসে হেসে কথা বলে, গল্প করে । অবশ্য তপনের মা মাঝে মাঝে চিন্তা করে, তার পাঁচ কেলাস অবধি পড়া ছেলে কি এমন রাজা, উজির মেরে বেড়ায়, যে হাজার হাজার টাকা আয় করে ? মাঝে মাঝে সে তপনের কাছে জানতে চায়, তপন কি কাজ করে ? তপন হেসে উড়িয়ে দেয় । তবুও তার মা ছাড়ে না । বারে বারে প্রশ্ন করে । তপন বলে, “আমি সার্ভিস করি, একটা এনজিওতে । ম্যান ম্যানেজমেন্ট জব । মানুষকে বোঝাতে হয়, কিভাবে পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হয় । জল সঞ্চয় করতে হয় । পেট্রল বাঁচাতে হয় । ইত্যাদি ।” মূর্খ তপন অবশ্য এই সব ভারি ভারি কথাগুলো জেনেছে চায়ের দোকানে কাজ করতে করতে । সব কিছু শুনেও তপনের মায়ের মন খুব একটা শান্ত হয় না । একটা খচখচানি যেন থেকেই যায় ।
তপনের অপারেশন ক্রমশ বেড়েই চলে । সকাল সন্ধ্যায় অফিস যাত্রী বোঝাই ট্রেনে, বাসে । দুপুরে ডালহৌসি, ধর্মতলায় । কখনো শ্যামবাজার, মানিকতলায় । সারাদিন সে খাটে । উপার্জনও করে বিস্তর । সংসারে টাকা ঢালার ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য নেই । আবার মাঝে মাঝে গুরু শিবার হাত ধরে বিজুর দোকানে যায় । কিছু ইয়ার দোস্ত আসে । মদের ফোয়ারা ছোটে । যে যত ইচ্ছা খায় । দাম মেটায় তপন । তপনের পকেট যেন দুটো কল লাগানো চৌবাচ্চার মত । একদিকে ভর্তি হচ্ছে, অন্য দিকে খালি হচ্ছে ।
বেশ ভালোই কাটছিলো তপনের দিনগুলো । হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত । কোথা থেকে কি যে হলো ! সারা দুনিয়া জুড়ে লকডাউন । তপনের হাতে বেশি টাকা নেই । মাস খানেক চালানোর পর অবস্থা শোচনীয় । এদিকে শিবাও ডাকা ডাকি করছে । চাল, ডাল কেনার পয়সাই তার পকেটে নেই । শিবাকে কোথা থেকে টাকা দেবে সে ? মামাও সিগারেট ছেড়ে আবার বিড়িতে ফিরে এসেছে । লেকচারও বন্ধ । তপন ক্রমশ ছটফট করতে থাকে, হাতে যে একটাও টাকা নেই ! বড় মাঠের বাজারে তিন দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে মাত্র দুবার সফল হয়েছে । তাও একবার চল্লিশ আর একবার পঁচিশ টাকা । এতে কি হবে ?
বাজারে ঘুরতে ঘুরতে একদিন বিজুর সঙ্গে দেখা হয় তপনের । নিজের দূরাবস্থার কথা খুলে বলে । বিজু তাকে পরামর্শ দেয়, “আমার এক পরিচিত ব্যবসায়ী আছে । নাম বনমালি দত্ত । আমি বলে দেব, সে তোকে ধারে ডিম দেবে, ডিম বিক্রি করে তুই দাম মেটাবি । এভাবে কয়েক মাস চালিয়ে নে । তারপর সব ঠিক হলে আবার কাজে নামবি ।
ডিম বিক্রি শুনে প্রথমে নাক সিটকায় তপন । কিন্তু এমুহূর্তে কিছু করার নেই । তাছাড়া কদিনেরতো ব্যাপার । বিজুর কথায় রাজি হয় সে । বড় মাঠে জায়গা না পেয়ে, নিজের গলির মধ্যে এক কোনে এক পেটি ডিম নিয়ে বসে । প্রথম প্রথম বিক্রি না হলেও, আস্তে আস্তে বিক্রি বাড়ে ।
“ডিম জোড়া আট টাকা । বাজারে জোড়া নটাকা, আমার কাছে আট টাকা । আসুন, এখানে আসুন ।” টহল দিতে দিতে গলাটা চেনা চেনা লাগলো থানার মেজো বাবুর ।
“তপন তুই ডিম বিক্রি করছিস ! খুব ভালো । আজে বাজে কাজ ছেড়ে সমাজের মুল স্রোতে ফিরে আয় ।” উচ্ছসিত হয়ে ওঠেন মেজো বাবু ।
“হ্যাঁ স্যার এই কদিন হলো শুরু করেছি। দেখি চলে কিনা !”
-“ঠিক আছে । কোনো অসুবিধে হলে বলবি । কিন্তু তোর মুখ খোলা কেন ? মাস্ক কোথায় ?”
-“এখনতো নেই স্যার। কাল থেকে মাস্ক পরে আসবো ।”
-“দাঁড়া তোকে একটা মাস্ক দিচ্ছি ।” তার পর কনেস্টবলকে নির্দেশ দেন গাড়ি থেকে একটা মাস্ক আনতে । মাস্কটা তপনকে দিয়ে বলেন, “যদি কোনো দিন না পরিস, তোর ব্যবসা তুলে দেবো ।” কথা গুলো বলে জিপে উঠলেন মেজো বাবু ।
গাড়িতে উঠে কনস্টেবল জিজ্ঞাসা করেন, “স্যার, মাস্ক পরতে কোনো দিন ভুলে গেলেও, তপনের ব্যবসাটা তোলা কি ঠিক হবে ?”
-“আরে না, না । আসলে এই কদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কিছু লোক নিজের ভালোটাও বোঝে না । তাই এদের একটু ধমক দিতে হয় ।”
কয়েক দিন পর আবার মেজো বাবু এসে তপনকে বললেন, “শুধু ডিম বিক্রি করে আর কত হবে ? এর সঙ্গে আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুনও বেচতে শুরু কর । চক্রবর্তীর বড় হোলসেল ব্যবসা আছে । আমি বলে দেবো, ও তোকে হেল্প করবে ।”
বিজু, বনমালি, মেজো বাবু আর চক্রবর্তীর সহায়তায় তপনের ব্যবসা এগিয়ে যেতে লাগলো । উপার্জনও বাড়ল । দেখতে দেখতে কয়েক মাস কেটে গেল । উঠলো লকডাউন । তপন কিন্তু তার ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে । প্রায় ভুলেই গেছে পকেট মারার পেশাটাকে ।
ক্রমশ ছন্দে ফিরছে সমাজ । প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে মানুষের কাজকর্ম । এমনি একদিন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে তপনের চোখে পড়লো একজন কোট টাই পরা বাবু মশাই তার জুতো পালিশ করিয়ে দাম দেওয়ার জন্য তার পার্শ বের করলেন । ভারি পার্শটা তপনের নজরে পড়লো । চোখ চকচক করে উঠলো তার । বদলে যেতে লাগলো চোখের ভাষা । সে একবার এগলো, আবার পিছিয়ে এলো । ভাবলো কেন আবার বিপথে যাবে ? অনেক দিন অভ্যাস নেই, যদি ধরা পড়ে যায় ! নতুন ব্যবসাটাও যাবে । আবার ভাবে এতদিনের অভ্যাস, নিপুনতা এই কমাসেই ভুলে যাবে ? কিছুতেই দোটানা কাটছে না । কি করবে ? সেকি পারবে ?
না, শেষ অবধি পারলো না । ডিমওয়ালা তপন বিবেকের লড়াইতে শেষ রাউন্ডে হারিয়ে দিল পকেটমার তপনকে ।
আঙুলের নিপুন ছোঁয়ায় নিমেষের মধ্যে পার্শ তপনের মুঠোয় এলেও আবার ইতস্তত, দোনামনা । তারপর কে যেন তপনের মুখ দিয়ে বলে উঠলো, “স্যার আপনার মানি ব্যাগটা পড়ে গেছে । এই নিন ।”
-“ওহ থ্যাঙ্ক ইউ । জাস্ট এ মিনিট । প্লিজ টেক ইট ।” পার্শ থেকে দুশো টাকা বের করে তপনকে দিতে যান বাবু মশাই ।
যে পুরোটাই নিতে পারতো, সে দুশো টাকা নিয়ে কি করবে ? মনে মনে হাসে তপন । হাসতে হাসতে বলে, “না, না ধন্যবাদ । এটাতো আমার ডিউটি ।” বলেই সে দৌড় লাগায় । দৌড়, দৌড়, দৌড় । প্রাণপণে দৌড়চ্ছে লকডাউনে জন্ম নেওয়া ডিমওয়ালা তপন । জোরে, জোরে, আরো জোরে দৌড়চ্ছে সে, যাতে পকেটমার তপন আর কোনদিন ডিমওয়ালা তপনকে ধরতে না পারে ।