গল্পঃ ফিরে দেখা – জয়ন্ত বাগচী

ফিরে দেখা
জয়ন্ত বাগচী

কদিনের ছুটিতে কোথায় যাই কোথায় যাই করতে করতে যখন কোন কিছুই ঠিক করতে পারছিলো না শেখর তখন সবিতা ওকে বলে , ‘ চলো মায়াপুরের ইস্কন মন্দির থেকে ঘুরে আসি । শেখর হেসে বলে , ‘তা মন্দ নয় ।ঠিক আছে ।এবার তাহলে মায়াপুর ,নবদ্বীপ ।’
খুশীতে ডগমগ হয়ে সবিতা বলে, ‘তাহলে তো সব গোছগাছ করে নিতে হবে ।হাতে তো মাত্র সাত দিন !’ শেখর হেসে বলে , ‘ঘরের পাশে তিন ঘনটার পথ যাবো ।সেখানে যেতে সাত দিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে ? সত্যি বাবা ,তুমি পারোও বটে !’
সবিতা কপট রাগ দেখিয়ে বলে , ‘ আহা, ঘরের পাশে বলেই বুঝি প্রস্তুতি নিতে হবে না ?
‘যাক তুমি তাহলে সব ব্যবস্থা করে ফেল ।’ ‘কিসের ব্যবস্থা ?’ ‘বারে কিভাবে যাব,কোথায় থাকবো ।’ ‘ সে আমি বিভাস কে বলবো সব ব্যবস্থা করে দেবে ।’ ‘ বিভাস ? আচ্ছা ওদেরকেও বললে হয় না আমাদের সাথে যেতে ?’ ‘হ্যাঁ , তাও হয় । তাহলে তো খুবই ভাল হয় ।’
শেখর বিভাসকে ফোন করে । ‘ বলছি কি ,সবিতা খুব ধরেছে, এই তিন দিনের ছুটিতে মায়াপুর ইস্কন মন্দির দেখতে যাবে—’
‘এই গরমে ?’ ‘তা কি আছে? নবদ্বীপ তো ,এতো আর রাজস্থান বা বাঁকুড়া নয় রে বাবা !’ শেখর যুক্তি খাড়া করে । বিভাস বলে, ‘ও …তার মানে তোমারও মদত আছে? বেশ চলো, আমরাও না হয় যাব ।’
‘যাবি ? ফাইন । তবে ব্যবস্থা করে ফেল । ’
‘কজনা যাবি ?’
‘কজনা আবার ? আমরা দুজন আর তোরা তিন জন ।ব্যস ।’
‘ঠিক আছে তোকে পরে জানাচ্ছি । ’
ফোন ছেড়ে দেয় ।সবিতা ঘরে আসে ।‘শোন ,বিভাসকে বলেছি , ওরাও যাবে ,আর সব রকম ব্যবস্থা করতেও বলে দিয়েছি ।’ ‘ফাইন ফাইন—- এই না হলে আমার মিষ্টি শেরু ! ’ বলতে বলতে শেখরের গলা জড়িয়ে ধরে সবিতা ।শেখরও সুযোগটা নিতে যায়। ‘অসভ্য’ ………বলে ছিটকে সরে যায় সবিতা ।
ইসকন চন্দ্রোদয় মন্দিরে প্রবেশের বিশাল গেটেই মাথা ঠেকিয়ে নমস্কার করে সবিতা । তাই দেখে শেখর হেসে বলে , ‘আরে এটা তো প্রবেশদ্বার ।ভিতরে মন্দিরে চলো ,তারপরে তো নমস্কার ! ’
সবিতা চোখ দিয়ে শাসন করে শেখরকে ।বিভাস হেসে বলে , ‘আরে না ,বউদি তাঁর ভক্তির ব্যাপারটা শুরু করলো এখান থেকেই।কি বউদি তাই তো ?’
বিভাসের স্ত্রী রমলা তার মোবাইলে ছবি তুলতে তুলতে বলে , ‘ তোমরা এসব ব্যাপারে নজর দিচ্ছ কেন ?আমি কি সুন্দর একটা শট পেলাম !’
অসংখ্য মানুষের ভিড়। দেশী বিদেশী মিলে মিশে একাকার ।ফরসা ধপধপে চেহারা , মুণ্ডিত মস্তক ,সাদা কাপড়ে কি অপরূপ লাগছে ! ভিতরের পরিবেশে মনটা সত্যি অন্যরকম হয়ে যায় ।সবিতার মনটাতো আনমনা হয়েছে অনেক আগেই । সে এখানে আসার নাম শুনেই মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েছে ।গত ছ’বছর হলো তাদের বিয়ে হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত সে মা ডাক শুনতে পায়নি ।প্রথম প্রথম লজ্জা ভেঙে ডাক্তারের কাছে যেতে পারেনি কিন্তু পরবর্তী সময়ে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের পরামর্শে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় ।নানারকম পরীক্ষা হয়েছে তাদের দুজনেরই কিন্তু কোন অস্বাভাবিকতা পাওয়া যায়নি ।অথচ…………
কেউ কেউ সবিতাকে নানা মাদুলি তাবিজ বা জায়গার কথা বলেছে কিন্তু শিক্ষিত মন মাঝে মাঝে টলে গেলেও তা করতে মন চায়নি ।একদিন দুপুরে বাড়ির কাজের মেয়ে অনিমার সাথে কথা বলতে বলতে বলেছিল, ‘হ্যাঁরে , আমি কি সত্যিই মা ডাক শুনতে পাবো না ? ’ বলতে বলতে তার দুটো চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়েছিল । ‘গরীবের ঘরে যারা চায়না তাদের ঘরে বাচ্চা গড়াগড়ি যায় আর আমি এতো করেও একজনকে পেলাম না । ’ তার জল ভরা চোখের দিকে চেয়ে অনিমা বলেছিল , ‘ছিঃ , অমন কথা কেন বলছও বউদি । নিশ্চয়ই পাবে ।দুএকজনের অমন একটু দেরী হয় ।এই তো আমার এক মামার বিয়ের বারো বছর পর ছেলে হল । ’ চমকে তাকিয়ে তার চোখে চোখ রেখে সবিতা বলেছিল, ‘ সত্যি ! বারো বছর পরে ! ’ খুশীতে ডগমগ হয়ে অনিমা বলেছিল , ‘তাহলে আর বলছি কি ! তোমারও হবে দেখো । এইতো সেদিন পূর্ণিমা বলছিল………’
‘ কে পূর্ণিমা ?’ ‘ ঐ তো মোড়ের মাথায় যে লাল দোতলা বাড়িটা আছে ,তাতে কাজ করে ।’ ‘হ্যাঁ , কি বলছিল ?’
‘বলছিল, ঐ বাড়ির বউটার নাকি বিয়ের পাঁচ বছর পরেও কোন বাচ্চা হচ্ছিল না ।তখন নবদ্বীপে ঐ সাহেবদের মন্দিরে গিয়ে মানত করেছিল । তারপর নাকি ফুটফুটে ছেলে হয়েছে ।’ ‘সত্যি ?’ ‘ হ্যাঁ গো সত্যি ।পূর্ণিমা তো তাই বলল ।’ সেইদিন থেকে সবিতার মনে মায়াপুর মন্দির ঘুরছে কিন্তু কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি ।আজ শেখর বেড়াতে যাবার কথা বলতেই সে মায়াপুরের কথাটা তুলেছিল ।
রাধাকৃষ্ণ মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে বিভোর হয়ে যায় সবিতা । মনের অন্তরতম প্রদেশ থেকে একটা কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে ওঠে ।দুচোখ জলে ভরে যায় ।অস্ফুটে বলে ওঠে ,’ ঠাকুর আমি কি মা ডাক শুনতে পাবো না ? ’ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে । শেখর অবাক হয়ে সবিতার মুখের দিকে তাকায় ।শেখরের ডাকে সম্বিত ফিরে আসে ।শেখর তার হাতটা ধরে বলে, ‘কি গো শরীর খারাপ করছে নাকি ?’ কোন রকমে সবিতা মাথা নাড়ে। বলে , ‘না ,চলো ।’ পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় বিভাস , রমলা সবিতারা ।সামনে চোখ পড়তেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শেখর । কিছুটা দূরে ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ও কে ? সে কি ভুল দেখছে ? চোখের পলক পড়ে না ।সামনে দাঁড়িয়ে সুলেখা !
সুলেখা লাহিড়ী । নিমেষে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলে শেখর ।লহমায় সে ফিরে যায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোতে । কফি হাউসে টেবল মাতিয়ে রাখত সুলেখা । কি সুন্দর আবৃত্তি করতো ।শেখরের সাথে তার সম্পর্কের কথা সব বন্ধুরাই জানতো । আর এটাও জানতো এই সম্পর্কটা একটা পরিণতি পাবেই । কিন্তু সেই নির্ধারিত পরিস্থিতিটাই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ।ভুল বোঝাবুঝির ফলটা যে এতদূর গড়াবে তা কেউ আঁচ করতে পারেনি ।দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিঙের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সুলেখা বলেছিল , ‘জীবনে কোনদিন তুমি আমার সামনে আসবে না ।আমি কোনদিন তোমার মুখদর্শন করবো না ।’
‘তুমি ভুল করছ সুলেখা !’ ‘ ভুল ? কিসের ভুল? এতদিন আমি তোমাকে বুঝতে পারিনি এটাই আমার মহাভুল ।আর একটা কথা নয় ।তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও ।’ ‘বেশ যাচ্ছি । তবে একটা কথা বলি। আমার ভালোবাসা যদি সত্যি হয় ,তোমার সাথে আমার দেখা হবেই হবে । ’ সিঁড়ি দিয়ে গটগট করে নেমে গিয়েছিল সুলেখা ।
সময়টা কেমনভাবে কেটে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি শেখর । মাঝে মাঝেই বুকের মধ্যে একটা চাপা যন্ত্রণা পাক খেয়ে উঠলেও তাকে শান্ত মনে দমন করেছে ।সময় তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে ।
সত্যিই কি ভুলিয়ে দিতে পেরেছে ? তার কি মনে পড়েনি সুলেখাকে এই ক’বছরে ? মনে পড়েনি বিয়ের শুভদৃষ্টির সময় ? হঠাৎ করেই সুলেখার নামটা , চোখের দৃষ্টিটা ভেসে উঠেছিল । কিন্তু পরিস্থিতির প্রবাহে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে বেশি সময় লাগেনি । আর তাই বিয়ের পর থেকে সবিতাকে নিয়েই সে সুখী । সুখী না হবার কোন কারণ নেই ।তাছাড়া সে আজও মনে প্রাণে জানে সেদিনের ঘটনায় তার কোন হাত নেই ।তার কোন ছলনা ছিল না । সে সত্যিই ভালোবাসেছিল সুলেখাকে ।শেখর এগিয়ে যায়। বুঝতে পারে সুলেখা তার দিকেই চেয়ে আছে। আজ এতদিন পরে এমন পরিস্থিতিতে তাদের দেখা হবে তা কল্পনাও করতে পারেনি । তবে এটা মনে হতেই তার মনটা খুশীতে ভরে ওঠে ,তার কথাটাই সত্যি হল । দেখা তাদের হলো ।
রাত্রে খাওয়ার পর বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল শেখর । মনে পড়ে যাচ্ছিল সকালে সুলেখার সাথে দেখা হওয়ার মুহূর্তের কথা ।আগের থেকে একটু ভারী হলেও সেই রকমই আছে ।কপালের দুপাশে দুএকটা রুপোলী রেখা মনে হল ।মনে পড়ে গেল জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনটা । বারান্দা থেকে নীচে আম গাছের বাঁধানো চাতালটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে শেখর । ওটা কে ওখানে বসে ? সুলেখা না ! হ্যাঁ তাইতো ।মনের মধ্যে একটা ধাক্কা অনুভব করে । আজ শেষ দেখেই ছাড়বে । নেমে আসে নীচে ।কাছাকাছি হতেই সুলেখা চোখ তুলে তাকায় ।শেখর বলে , ‘কি ব্যাপার এখানে ? একা নাকি?’ ‘ হ্যাঁ. একটু বসে আছি ।তারপর?’
‘তারপর আর কি ? চলছে…।’ ‘তোমরা তো আরো কয়েকজন এসেছ মনে হল ?’ ‘আমার স্ত্রী আর বন্ধুর ফ্যামিলি । পাঁচ জন ।’ ‘ছেলে মেয়ে?’ মাথা নাড়ে শেখর ।বলে, ‘আর তুমি ?’ ‘ আমরা তিনজন এসেছি।আমি ,আমার স্বামী আর ছেলে ।’ ‘তারা কোথায় ?’ ‘গদা ভবনে আছে । আসলে ছেলেটা……… ।’ থেমে যায় সুলেখা । ‘ থেমে গেলে কেন,ছেলেটা কি বল ?’ শেখরের চোখে চোখ রেখে সুলেখা বলে ,আমার ছেলের এস এল ই আছে ,তাই …।
‘সে কি ?’ মাথা নাড়ে সুলেখা । ‘ চার বছর হল । চিকিৎসা চলছে ,কিন্তু……। তুমি নিশ্চয়ই জানো রোগটা ননকিওরেবল । আস্তে আস্তে …’ গলার স্বরটা ধরে আসে সুলেখার ।ফিস ফিসিয়ে বলে , ‘কয়েকজন বলল ,এখানে নিয়ে এসে মানত করতে ,তাই…………’ ।‘তুমি এসবে বিশ্বাস করো ?’ ‘ আমি মা তো আফটার অল ।যদি কোন মিরাকেল ঘটে……ছেলেটাকে আর কিছুদিন ধরে রাখতে পারি…।’ পরিস্থিতি মানুষকে কোথায় নিয়ে আসে ।কলেজের সেই দাপুটে মেয়ের গলায় আজ এ কি শুনছে সে ! এও কি সম্ভব ? নিশীথ রাত্রে সমুদ্র তীরে যেমন নিঃসঙ্গ বাতাস হু হু করে বয়ে যায় তেমনি একটা অনুভূতি তার মনের ভিতর দিয়ে খেলে গেল।পুরনো দিনের হারিয়ে যাওয়া প্রেম যেন গলা তুলে বলে গেল, তুমি কি শোনালে সুলেখা ? আমার তো কিছুই সাধ্য নেই যে তোমার ছেলেকে তোমার বুকে সুস্থ করে ফিরত দেব ! সুলেখা নিচু স্বরে বলে , ‘তোমরা এখানে ক’দিন থাকবে ? ’ ‘ আমরা পরশু চলে যাব।তিন দিন ছুটি পেলাম তাই আরকি !যাক তবু এলাম বলেই তোমার সাথে দেখা হল।’ ‘ এমন দেখাটা না হলেই বোধহয় ভালো ছিল ।’ ‘কেন?’
‘পুরনো দিনের কথাগুলো মনের মধ্যে নতুন করে খুঁচিয়ে উঠত না ।ভুলেই তো গিয়েছিলাম ।’ ‘সত্যিই কি ভুলে গিয়েছিলে সুলেখা ? বুকে হাত রেখে এই মন্দিরের পরিবেশে দাঁড়িয়ে বলতো ?’ ‘ না ভুলে তো কোন উপায়ও ছিল না ! পরিস্থিতি যেভাবে টেনে নিয়ে গেল তাকে তো ঠেকিয়ে রাখতে পারিনি ! তাছাড়া…………’
‘তাছাড়া কি ? থামলে কেন ?’ ‘ তাছাড়া কি একটা জেদের বশে তোমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম ……আমি মনে মনে চেষ্টা করেছিলাম , বিশ্বাস করো , কিন্তু একটা মিথ্যে ইগো আমাকে টেনে রাখল………. তোমায় হারালাম ।এই ইগো জয় করতে পারলে আমাদের জীবনটা কত সুন্দর হতো !’ ‘ সেটা মানো ?’ ‘ কি জানি ! আজকাল নিজেকেই নিজে বুঝতে পারিনা !শরতের মেঘের মত উড়ে চলেছি………কোথাও ঝরে পড়ছি আবার কখনো রৌদ্রতাপে হয়ে উঠছি শুষ্ক মরুর মতো ……………আচ্ছা শেখর , একটা কথা একশো ভাগ সত্যি করে বলবে ?’ ‘কি বল ?’ মন্দিরের দিকে তাকিয়ে হাতের আঙ্গুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে উদাস গলায় সুলেখা বলে , তোমার মনের কোনায় আজও কি আমি আছি ?’
মন্দিরের ভিতর থেকে প্রচণ্ড শব্দে খোল করতাল বেজে উঠলো ।শেখরের মনে হল এ যেন তার বুকের মধ্যের পুঞ্জীভূত বেদনারা একসাথে হাহাকার করে মন্দিরের উঠোন পেরিয়ে গেল ।কানে এলো মন্দিরে কে যেন গাইছে , এমন মানব জমিন রইলো পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা ……………।

One thought on “গল্পঃ ফিরে দেখা – জয়ন্ত বাগচী

Leave a Reply to Soma Sengupta Mukherjee Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *