মুক্তগদ্যঃ মার্কণ্ডেয় মুনীর বিশ্বরূপ দর্শন ও যোগমায়া কথা – রাধাকৃষ্ণ(রাধু) গোস্বামী (সোদপুর)

মার্কণ্ডেয় মুনীর বিশ্বরূপ দর্শন ও যোগমায়া কথা
রাধাকৃষ্ণ(রাধু) গোস্বামী

মা দুর্গা আসছেন। শরতের হিমেল বাতাস আর মাঠে মাঠে সাদা কাশ।যেন তাদের মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে মায়ের এসে যাওয়ার খবর জানান দিচ্ছে। এক বছর পর তিনি আসছেন উৎসবের আনন্দ নিয়ে। ভুলে যাবো আমরা যেসব দুঃখ দুর্দশা পেয়েছি নতুন করে বাঁচার জন্য।

এহেন গুরুত্বপূর্ণ দিনের আগমনের আগে মায়ের বিভিন্ন সময়ের আসার কথা প্রাচীন অনেক শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে। এঁদের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্র হল মার্কণ্ডেয় পুরাণ। রচয়িতা মার্কণ্ডেয় মহর্ষি। তিনি ব্রহ্মপুত্র ভৃগুর বংশোদ্ভূত। ভারতের ইতিহাসে ভৃগুর বংশধারা এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা বিশেষ। মহর্ষি ভৃগুর দুই পুত্র। ধাতা ও চ্যবন। ধাতার পুত্র মৃকণ্ডু। তাঁর পুত্র মার্কণ্ডেয়।

জানা যায়, মহর্ষি মার্কণ্ডেয় কঠিন সাধনা দ্বারা তপস্যা করেন এবং সুদীর্ঘ কাল তাঁর অজান্তেই ছয়টি মন্বন্তর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। সপ্তম মানে এই বৈবস্বত মন্বন্তরে দেবরাজ ইন্দ্র যথারীতি তাঁর তপস্যা ভাঙতে পুষ্পভদ্রা নদীর তীরে তাঁর শান্ত মধুর পরিবেশের আশ্রমে নর্তকী সুন্দরী অপ্সরাদের ও মদন দেবকে পাঠিয়েও সফল হতে পারে নি। মার্কণ্ডেয় ঋষির তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে স্বয়ং শ্রীহরি নর-নারায়ণ রূপে দর্শন দিয়ে তাঁকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী বর দিয়েছিলেন। বরটি হল, তিনি ভগবানের মায়া দর্শনের কামনা করলেন।
শ্রীনর-নারায়ণ ‘ তথাস্তু ‘বলে বদরিকাশ্রমের দিকে চলে গেলেন। মুনি মার্কণ্ডেয় তারপর আকাশ বাতাস সূর্য চন্দ্র সর্বত্র, এমনকি নিজের অন্তঃকরণেও শ্রীভগবানের দর্শন পেতে লাগলেন। পুষ্পভদ্রা নদীর তটে নিজের আশ্রমে তন্ময় হয়ে শ্রীভগবানের উপাসনায় রত থাকতেই চারদিকে মুহুর্মুহু বজ্রবিদ্যুতের সঙ্গে ভয়ানক জলধারায় সব ভেসে যেতে লাগল। চারদিকে শুধু জল আর জল। জলজন্তুরা মুখ হাঁ করে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। তাঁর সামনেই প্রলয় সমুদ্রে ঢেউ গুলো আরও স্ফীত হয়ে উঠছিল। চারদিকে স্থল পর্বত দ্বীপ সবকিছু ডুবে গেল। জল আর জলের মাঝখানে জলজ প্রণীদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পেতে তাঁর প্রচণ্ড প্রয়াসের ফলে তিনি ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লেন। এভাবে অনেক দিন চললে
(অযুতাযুতবর্ষাণাং সহস্রাণি শতানি চ।
ব্যতীয়ুর্ভ্রমতস্তস্মিন্ বিষ্ণুমায়াবৃতাত্মনঃ।।
এইভাবে মার্কণ্ডেয় মুনি বিষ্ণু ভগবানের মায়ায় মোহিত হয়েছিলেন। সেই প্রলয়কালীন সমুদ্রে এদিকে ওদিকে ঘুরতে ঘুরতে তাঁর শত সহস্র নয় লক্ষ কোটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। )
হঠাৎ একদিন এক টিলা দেখতে পেলেন। সেই টিলায় একটি ছোট বটবৃক্ষ তাঁর দৃষ্টিগোচর হল। বিস্মিত মুনি দেখলেন একটি ডালে পাতাগুলি একটি পত্রপুটে (ঠোঙ্গা) একটি অপূর্ব মনোহর শিশু শুয়ে আছে আর শিশুটি তার ছোট ছোট দুটো হাতে নিজের একটি পা মুখে পুরে একমনে চুষছিল।
বিস্মিত মার্কণ্ডেয় মুনি তা দেখতে দেখতে শিশুর শ্বাসের সঙ্গে তার দেহের ভেতরে প্রবেশ করে গেলেন আপনাআপনিই। ঐ শিশুর পেটের মধ্যে এই জগতের প্রায় সবকিছুই দেখতে পেলেন। আরও বিস্মিত হতে না হতেই তিনি আবার এই শিশুর প্রশ্বাসে বাইরে প্রলয় সমুদ্রে এসে পড়লেন। তিনি পেছনে ফিরে দেখলেন সেই টিলা পত্রপুটে সেই অনিন্দ্য সুন্দর শিশুটি তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছেন। তার দিকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য এগোতেই দিব্যশিশুটি অন্তর্হিত হয়ে গেলেন। চারদিক আবার আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে গেল। মুনি দেখলেন তিনি আগের মতোই তাঁর আশ্রমে বসে আছেন। সামনে বয়ে চলেছে পুষ্পভদ্রা নদী আগের মতোই।

এই মার্কণ্ডেয় মুনির আশ্রমে এক দিন মা দুর্গা ও অন্যান্য সহচর
সহ এসে উপস্থিত হলেন। মুনি তখন গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। তাই তিনি জানতেও পারলেন না। শিব মহাদেব তাঁর দেহে প্রবেশ করে তাঁর আধ্যাত্মিক শুদ্ধ সুন্দর মগ্নতা দেখে আনন্দিত হলেন। ধ্যান ভেঙ্গে গেলে ঘরণী ও সহচর সহ শিবমহাদেবকে দেখে মুনি তাঁদের দুজনকে যথোপযুক্ত ভাবে পূজা করলেন। সম্ভবত শিব অষ্টভুজ (ভিন্নমত দশভুজ) ও দুর্গা সালংকারা অষ্টভুজা এবং প্রতিটি হাতে আয়ুধ ধারণ করে ছিলেন। মা দুর্গার মুনিকে দেখে বাৎসল্যভাবের উদয় হয়। আমাদের এই সপ্তম বা বৈবস্বত মন্বন্তরে দুর্গাপূজা করার সুযোগ প্রথম এই মার্কণ্ডেয় মুনিই লাভ করেন।
এই জগজ্জননী দুর্গার অনেক নাম। একটি নাম হল যোগমায়া। যোগমায়া শক্তি জগৎ স্রষ্টা পরমব্রহ্ম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অজস্র শক্তির এক প্রধানা শক্তি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের হাতে কোনো কাজ করেন না বা করার প্রয়োজনীয়তাও নেই, তাঁর নির্দেশে বা ইচ্ছায় যোগমায়া শক্তি সব কিছু করে দেন। তিনি মথুরার কংসের কারাগারে বসুদেবের স্ত্রী দেবকীর গর্ভ থেকে সপ্তম গর্ভের সন্তান, বলরামকে রক্ষা করার জন্য শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে ঐ সন্তানের ভ্রূণটিকে বসুদেবের আরেক স্ত্রী, গোকুলে নন্দরাজার গৃহে অবস্থান কারিণী রোহিণীর গর্ভে স্থানান্তরিত করে দেন। এবং যথাসময়ে তিনি নন্দরাজার স্ত্রী যশোদার কন্যারূপে আর অন্যদিকে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানরূপে আবির্ভূত হন। আঁতুরঘর থেকে পুত্রসন্তান ও কন্যাসন্তান দুজনকে বসুদেব পাল্টাপাল্টি করে দেন। এটাও শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় ও যোগমায়ার চমৎকারিতার ফল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বর দিলেন যে তিনি এরপর থেকে দুর্গা, ভদ্রকালী, বিজয়া, বৈষ্ণবী, কুমুদা, চণ্ডিকা, কৃষ্ণা, মাধবী, কন্যা, মায়া, নারায়ণী, ঈশানী, শারদা, অম্বিকা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে বিভিন্ন স্থানে সাড়ম্বরে পূজা পাবেন। সেই থেকে এই জগতে যোগমায়া তথা নারায়ণী বা নারায়ণের শক্তিকে পূজার রীতি চলে আসছে। এমনকি শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করার জন্য গোপ ললনারা পুরো একমাস ধরে কাত্যায়নী ব্রত উদ্ যাপন করতেন। এ ছাড়াও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনন্ত রাস নৃত্য করার জন্য যোগমায়াকে আশ্রয় করেছিলেন। তিনি রাস করেন তাঁর হ্লাদিনী শক্তি শ্রীমতী রাধারানী ও অজস্র গোপরমণীদের সঙ্গে। কিন্তু এই অনন্তরাসের জন্য। প্রয়োজন অনন্ত সক্ষমতার আর তার জন্য লাগবে যোগমায়ার অনন্ত শক্তি।
“ভগবানপি তা রাত্রীঃ শরদোৎফুল্লমল্লিকাঃ।
বীক্ষ্য রন্তুং মনশ্চক্রে যোগমায়ামুপাশ্রিতঃ।।”
(শ্রীমদ্ভা.১০/২৯/১)

যদিও ভগবানের জন্ম বলে কিছু হয়না। তাঁর মৃত্যু বলেও কিছু হবার কথা নয়। তবু তিনি ধরাধামের মানুষের মঙ্গলের জন্য আবির্ভূত হয়ে থাকেন। সে যে কোন রূপে, যেকোনো মানুষের রূপেও সম্ভব।

কংসের কারাগারে বসুদেব ও দেবকীর কাছে তিনি স্বয়ং এবং গোকুলে নন্দরাজার স্ত্রী যশোদার কোলের কাছে যোগমায়া আবির্ভূতা হয়েছিলেন এবং ভগবানের ইচ্ছায় বসুদেব দুই সদ্যোজাত শিশুদের পাল্টাপাল্টি করেছিলেন। ফলে, পরদিন দুরাচার কংস দেবকীর অষ্টম গর্ভের পুত্রকে হত্যা করতে এসে দেখল, এই সদ্যোজাত পুত্র নয় কন্যা সন্তান। কন্যা সন্তান হত্যা করা ভীষণ পাপ মনে করে প্রথমেই দমে গেল। ক্রোধে কংস ন্যায় অন্যায় বোধ হারিয়ে দেবকী মায়ের কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নেয়। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য কংস শিশুটির পা দুটি ধরে এক পাথরের উপর সজোরে আছাড় মারলো। শ্রীকৃষ্ণের বোন হিসেবে জন্ম নেয়া সেই সদ্যোজাতা কংসের হাত থেকে ছিটকে পিছলে পাথরে না পড়ে উঠে শূন্যে চলে গিয়ে তাঁর মহিয়সী দেবী রূপ ধারণ করলেন। তিনি হলেন অষ্টভুজা। তাঁর আটটি হাতে ধনু , শূল , বাণ , ঢাল, তরবারি, শঙ্খ , চক্র ও গদা শোভিত হলো।তিনি দিব্য মাল্য , বস্ত্র , চন্দন ও রত্নালঙ্কার ইত্যাদি দ্বারা নমস্য রূপে শোভিত ছিলেন। অষ্টভুজা দুর্গারূপে চতুর্দিক আলোকিত করে বললেন – আরে মূর্খ, আমাকে মেরে তোর কী লাভ হবে ? তোর পূর্ব জন্মের শত্রু তোকে বধ করার জন্য কোথাও না কোথাও জন্ম নিয়েছেন। তুই আর নিরপরাধ শিশুদের হত্যা করিসনা। “
দেবকী আর বসুদেব ও অন্যান্য ভাগ্যবানেরা অষ্টভুজা মাকে হাত জোর করে প্রমাণ করেছিলেন।

আসুন, আমরাও আমাদের শারদীয় প্রণাম জানিয়ে দশভুজা দুর্গাকে বরণ করি।

4 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ মার্কণ্ডেয় মুনীর বিশ্বরূপ দর্শন ও যোগমায়া কথা – রাধাকৃষ্ণ(রাধু) গোস্বামী (সোদপুর)

    1. ভালো লাগলো‌। জয় রাধারমণ।

  1. কিছু জানার সঙ্গে অনেক অজানা কথা জানলাম।ধন্যবাদ।

Leave a Reply to জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *