স্মৃতিকথাঃ ছেলেবেলার পুজো – কৃত্তিকা ভৌমিক (বনগাঁ)

ছেলেবেলার পুজো
কৃত্তিকা ভৌমিক

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গাপুজো আমার কাছে অন্যভাবে ধরা দেয়। এখন পুজো মানেই হচ্ছে অমলিন সব স্মৃতি।
ছেলেবেলায়, মানে তখন খুব ছোট্ট ছিলাম, মনে আছে পুজোর মাসখানেক আগে থেকেই বাড়ির সামনের মাঠে বাঁশ পড়ে যেত। মাঠে বাঁশ এসেছে মানেই পুজো এসেছে। প্রতিদিন একটু একটু করে সেই বাঁশ বেঁধে বেঁধে তৈরি হত প্যান্ডেল। খুব সাধারণ প্যান্ডেল তবু সে যে কি আনন্দ বলে বোঝাতে পারব না। স্কুল যাওয়া আসার পথে বা বিকেলবেলায় তখন আর কোনো খেলা ছিল না শুধু সেই বাঁশে ঝুলে ঝুলে খেলা চলত। ছোট ছোট হাতের চামড়া লাল হয়ে যেত, তাতে কী!! মনপ্রাণ দিয়ে সেই খেলার আনন্দ উপভোগ করতাম।
বাড়িতেও পুজো শুরু হয়ে যেত অনেকদিন আগে থেকে। মা খুব ভালো সেলাই করতেন। রেডিমেড জামা কিনে পরার চল আমাদের বাড়িতে ছিল না। কাপড় কিনে এনে মা বিভিন্ন ধরনের জামা বানিয়ে দিতেন।। প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে দেখতাম জামার কতটুকু এগোচ্ছে। সেইসময় সত্যি বলতে পড়াশোনা করতে ইচ্ছেই করত না অথচ পুজোর ছুটির পরেই পরীক্ষা এই একটা ত্রাসে একটু একটু পড়তেও হতো কারণ মহালয়ার দিন থেকে লক্ষ্মী পুজো পর্যন্ত পড়াশোনা সত্যিই শিকেয়তোলা থাকত।
মনে পড়ে আমাদের পুজোর বাজার করতে যাওয়া বলতে মা’ই যেতেন কারণ বাবা কর্মসূত্রে বাইরে থাকতেন, তাই সেভাবে সময় দিতে পারতেন না। রান্নাবান্না সেরে মা যেদিন পুজোর বাজার করতে যেতেন বড়দি বা বড়দা কাউকে সঙ্গে নিয়ে, সেদিন কিন্তু স্কুলের একটা ক্লাসও মন দিয়ে করতে পারতাম না। একদিনেই সব বাজার করা হয়ে যেত। এখনকার মতো রোজ রোজ পুজোর বাজার করার চল আমাদের সময়ে ছিল না। একটা কথা খুব মনে পড়ে। পুজোর বাজার করতে যাওয়ার আগেরদিন রাত্রে পড়াশোনার পরে একটা সাদা কাগজের উপর পা রেখে পেন্সিল দিয়ে চারপাশে এঁকে আমাদের পায়ের মাপ নেওয়া হত কারণ নতুন জুতো আসবে সেই মাপ অনুযায়ী। মনের ভিতর আনন্দ টগবগ করে ফুটত তখন। পুজোর ঢের আগে থেকেই আমাদের বাড়ি পুজো পুজো একটা পরিবেশ তৈরি হয়ে যেত। আকাশের রঙ কালো বা স্লেট কালার থেকে আস্তে আস্তে বদলে নীল হয়ে যেত আর সেই নীল রঙ আমাদের মনেও পুজোর আবেশ তৈরি করে দিত।
মহালয়ার ভোরবেলা সারা পাড়ায় বেজে উঠত রেডিওতে “মহিষাসুর মর্দিনী” মা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন মহালয়ার ভোরে বিছানা ছাড়তে বাধ্য ছিলাম আমরা। শিউলি কুড়োতাম আর পাড়ায় যতদূর যেতাম শুনতে পেতাম “বাজল তোমার আলোর বেণু”
তারপর এসে যেত বহু আকাঙ্খিত সেই পাঁচটা দিন। পঞ্চমীর অনেক রাত্রে ঠাকুর আসত তাই ষষ্ঠীর ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ছুটতাম প্যান্ডেলে। পুজোর মধ্যে অষ্টমী বা নবমীর দিন বাপির অফিসের গাড়িতে করে মা বাপির সাথে আমরা ভাইবোনেরা সারা দুর্গাপুরের ঠাকুর দেখে বেড়াতাম। তখন হাতে গোনা কয়েকটা পুজো হতো আমাদের ওখানে। হৈ হৈ করে কেটে যেত পুজো। মনখারাপ নিয়ে দশমীতে দুর্গামাকে বিদায় জানাতাম প্রণাম করে। সরস্বতী ঠাকুরকে বেশি করে প্রণাম করতাম এমনকি তাঁর হাঁসকেও কারণ পুজোর পরেই ছিল অ্যানুয়াল পরীক্ষা। ভালোভাবে পাশটা তো করতে হবে!!
তারপর সারা পাড়া জুড়ে চলত বিজয়াদশমী পালন। চেনা অচেনা সবার বাড়ি গিয়ে কাকু কাকিমাদের ঢিপঢিপ করে প্রণাম করতাম আর নাড়ু নিমকি খেতাম। সে যে কী আনন্দ!!
পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার পরের কয়েকটা দিন ভীষণ কান্না পেত। প্রকৃতিও বদলাতে শুরু করত। সন্ধ্যার পরে হিম হিম ভাব আর সারা শহর জুড়ে ছাতিম ফুলের গন্ধের মাদকতা। আমরাও ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিতাম অ্যানুয়াল পরীক্ষার জন্য এবং তারপর আবার প্রতীক্ষা শুরু হত পরবর্তী দুর্গোৎসবের।

7 thoughts on “স্মৃতিকথাঃ ছেলেবেলার পুজো – কৃত্তিকা ভৌমিক (বনগাঁ)

  1. সুন্দর স্মৃতি কথা। ভালো লাগলো‌।

      1. ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল । খুব ভালো লাগলো ।

    1. আমার নিজের ছোটবেলা মনে পড়ে গেল। ভাল লাগল।

  2. খুব ভালো লাগলো।অনেক শুভেচ্ছা রইলো।

Leave a Reply to শ্রাবণী বসু Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *