প্রবন্ধঃ সৃজনশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ – মৌসুমী ঘোষ ( হুগলি)

সৃজনশিল্পীঅবনীন্দ্রনাথ
মৌসুমী ঘোষ

“তোমরা তো নিশ্চয়ই কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের নাম শুনেছ। প্রিন্স দ্বারকানাথঠাকুর ছিলেন আমার প্রপিতামহ অর্থাৎ পিতামহর বাবা। কর্তা দাদামশায় মানে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথঠাকুর ছিলেন আমারপিতামহর বড়দাদা। যাঁর পুত্ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম তো সকল বাঙালিরই জানা। তিনি ছিলেন আমার প্রিয় রবিকাকা। আমারপিতামহ গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সে যুগের নামকরা চিত্রকর।”

অবনীন্দ্র নাথ ঠাকুর

এখানে ‘আমি’বলে যিনি নিজেকে পরিচয় দিলেন৭ই আগস্ট, ২০২১, তাঁর দেড়শততম জন্মদিবস ছিল। ১৯০২ সালে তিনি আঁকেন ‘বঙ্গমাতা’। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ১৯০৫ সালে স্বাদেশিকতা আবহাওয়ায় যা ‘ভারতমাতা’ হিসেবে পূজিত হয়। ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে তাঁর আঁকা ভারতমাতাকে নতুন প্রজন্মের কাছে স্মরণ করানোর দায়িত্ব না নিলে অপরাধ হয়।তিনি তো আমাদেরই অবন ঠাকুর। আমরা বাঙালিরা একটি আপ্ত বাক্যের সঙ্গে পরিচিত যে অবন ঠাকুর তুলিতে ছবি আঁকেন আর কলমে ছবি লেখেন। সুতরাং তাঁর মতো মহান শিল্পীর আঁকার সম্ভারের তালিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁর শিশুতোষ লেখার দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করব।
অবনীন্দ্র নাথ মনে প্রাণে শিল্পী, অস্থিমজ্জায় শিল্পী। তাঁর শিল্প প্রকাশ পেয়েছে যেমন তুলিকায় তেমনি লেখনীতে। ছবি আঁকাতে তার হাতেখড়ি মাত্র ন’বছর বয়সে। তাঁর কাকা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভাল পোর্ট্রেট আঁকতে পারতেন। দাদা সমরেন্দ্রনাথের আবার হাতির দাঁতের কারুকাজের ওপর ঝোঁক ছিল। তাঁর ছোটোবোন সুনয়নী দেবী ছিলেন চিত্রশিল্পী। তার ‘অর্ধনারীশ্বর’ ছবিটি খুবই বিখ্যাত ছিল। শুধু কি তাই তিনি নিজেই বলছেন,
“আমার বাবামশাই গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কলকাতার অন্যতম আদি কলাবিদ্যা শিক্ষায়তনের প্রথম যুগের ছাত্র। আমার মায়ের নাম সৌদামিনী দেবী। আমার বড়দা গগনেন্দ্রনাথের নাম নিশ্চয়ই অনেকে শুনে থাকবে, তিনি ভারতীয় চিত্রকলায় রূপকল্পকে বস্তুর বন্ধন থেকে সর্বপ্রথম মুক্ত করেন।”
অর্থাৎ ছোটোথেকেই তিনি শিল্পচর্চার পারিবারিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের এই পরিচয় আমাদের কার না জানা? বিশেষত তাঁর সার্ধশতবর্ষ জন্মদিবসে আমরা সমাজ মাধ্যমের পোস্টে পোস্টে এই পরিচয়বার বার দেখছি। কিন্তু শুধু এই সার্ধ শতবর্ষেই কেন? মাঝের বছরগুলোয়, বছরের অন্যদিনগুলোয় কেন আমরা এই মাতামাতি জারি রাখব না? তাহলে কি অবনীন্দ্রনাথ বছরের অন্য দিনগুলোয় এই প্রজন্মের কাছে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক নয়? সময় এসেছে নিজেদের এই প্রশ্নটি করার এবং উত্তর খোঁজার। উত্তর খোঁজার আগে নিজেকে জানতে হবে এর বাইরে তার কর্মকান্ডের কথা। সেদিকে নজর দিলে জানা যাবে,
কুড়ি বছর বয়সে তিনি ক্যালকাটা স্কুল অফ আর্টসে ভর্তি হন। ১৮৯২ থেকে ১৮৯৫ পর্যন্ত ওলিন্টো গিলার্দি ও চার্লস পামার এর কাছে তিনি ছবি আঁকা শিখেছিলেন।প্যাস্টেল ড্রইং রীতি সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথ সচেতন হন গিলার্দির মতো প্রথিতযশা বিদেশী শিক্ষকের কাছে। তার আগেই অবশ্য অর্থাৎ ১৮৯০ সালের গোড়ার দিকে সাধনা পত্রিকা, চিত্রাঙ্গদা প্রভৃতি রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য রচনায় অবনীন্দ্রনাথের আঁকা অলংকরণ প্রকাশিত হয়।
প্রথমদিকে তিনি প্যাস্টেল, অয়েল পেন্টিং এবং জলরঙের কাজ শিখলেও পরবর্তীকালে তিনি আইরিশ ইলিউমিনেশন এবং মুঘল মিনিয়েচারের প্রতি আকৃষ্ট হন। বইয়ের পাতাকে নকশা দিয়ে সুন্দর করে তোলার অঙ্কন পদ্ধতিকে বলে ইলিউমিনেশন করা। মূলত রবীন্দ্রনাথের উপদেশেই বৈষ্ণবপদাবলীকে বিষয় করে তিনি চিত্রকলার চর্চা শুরু করেন। কিন্তু আঁকার পর রাধিকাকে পছন্দ হলনা। তাই রাজা রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়িতে এক মিস্ত্রির থেকে সোনা লাগানোর পদ্ধতি শিখে বৈষ্ণবপদাবলীর ছবিতে সোনা রূপার তবক লাগিয়ে এঁকে ফেললেন।
তাঁর জীবনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকার কথা আমরা সবাই জানি, রবি ঠাকুর ছাড়াও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবন ঠাকুর হওয়ার জন্য আরো যাঁদের হাত ছিল তাঁদের মধ্যে ছিলেন তাঁর গুরু ই বি হ্যাভেল -এর ভূমিকা। উনি নিজেই বলেছিলেন, “ভাবি সেই বিদেশী গুরু আমার হ্যাভেল সাহেব অমন করে আমায় যদি না বোঝাতেন ভারত শিল্পের গুণাগুণ, তবে কয়লা ছিলাম কয়লাই হয়তো থেকে যেতাম, মনের কয়লা ঘুচত না, চোখ ফুটত না দেশের শিল্প সৌন্দর্যের দিকে।”
‘শ্বেতভিসারিকা’র ছবিটিই তাঁর কৃষ্ণলীলা সিরিজ এর প্রথম ছবি। এই কৃষ্ণলীলা সিরিজের ছবি দেখতে ১৮৯৭ সালে জোড়াসাঁকোয় এসেছিলেন ইউরোপের শিল্পী কলকাতা আর্ট স্কুলের নবনিযুক্ত অধ্যক্ষ স্বয়ং ই বি হ্যাভেল।আসলে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের একদা বান্ধবী এক মেমসাহেবের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন একটি অনবদ্য উপহার। সেটি ছিল যিশুর ক্রমানুসারিক জীবনচিত্রে ভরা অ্যালবাম। এটির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি দেশীয় পদ্ধতিতে নিজস্ব কল্পনায় এঁকেছিলেন কৃষ্ণলীলা সিরিজ। সেই সময়কার অনুভূতির কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন এইভাবে, ‘রোজই আরম্ভ করতুম ছবি, রাত্রে স্বপনের মতো দেখে রাখতুম। আর সকালে এঁকে শেষ করতুম।’
এই দুজনের যৌথ প্রয়াসে কলকাতায় নব্য ভারতীয় ধারার ভিত্তি স্থাপিত হয়। অবনীন্দ্রনাথকে নব্য বঙ্গীয় চিত্ররীতির জনক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। তিনিই প্রথম অনুধাবন করেছিলেন পাশ্চাত্য শিল্পের চরিত্র অনেকবেশী বস্তুবাদী। তিনি বিট্রিশ ঔপনেবেশিক আগ্রাসন থেকে চিত্রকলাকে উদ্ধার করে ভারতীয় ঐতিহ্যের শিকড়ে যুক্ত করে আধুনিকতার স্বতন্ত্র পথ নির্মাণ করেছিলেন।
হ্যাঁ আধুনিকতা, অবন ঠাকুরের চারুশিল্পে আধুনিকতার ব্যাখ্যা তাহলে বর্তমান প্রজন্ম কিভাবে বুঝবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা যদি আর্ট কলেজের ছাত্রদের কাছে যাই। পেয়ে যাব হয়তো। কিন্তু বাকিরা? বাকিদের জানতে গেলে বই পড়তে হবে। আজকের তরুণ প্রজন্ম যতটা সোশাল মিডিয়ায় সাবলিল বোধ করে ততটা বইয়ের পাতা ওল্টাতে করে না। বর্তমান প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল এবং তাতেই আকৃষ্ট। সুতরাং অবনীন্দ্রনাথকে তাদের সামনে তুলে ধরার জন্য সেই পথ অবলম্বন করা ছাড়া উপায় নেই। আজকের অস্থির সমাজের কাছে তাঁর সৃষ্টিকে অতি অল্পসময়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ডিজিটাল মাধ্যম ছাড়া বিকল্প পথ নেই।
ওকাকুরার সান্নিধ্যে এসে জাপানি প্রকরণের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন ও আয়ত্ব করেন জলরঙের কাজ ও ওয়াশ টেকনিক। পরবর্তীকালে তাঁর শিল্পচর্চার জগতে জীবন্ত প্রেরণা হয়ে হাজির হয়েছেন একে একে টাইকান, হিসিডি, খাৎসুতা, কন্দুকারাই প্রমুখ জাপানী শিল্পী প্রতিভা। জাপানি ছাড়াও একে একে তার আয়ত্ব হয়েছিল তিব্বতী, পার্শিয়ান স্টাইলও। সর্বোপরি,সেই সমস্ত স্টাইলের সঙ্গে তিনি নিজস্ব স্টাইলের যাদুর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক অনবদ্য নান্দনিক শৈলির সৃষ্টি করতেন। ১৯০৬ থেকে ১৯১০ এর মধ্যে আঁকা রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম চিত্রমালায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন সেই একান্ত নিজস্ব আঙ্গিক পদ্ধতি। এরপরের ধারায় তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মুখোশ চিত্রমালা এবং ১৯২০ এর আরব্য রজনী চিত্রমালা। চিত্র বিষয়ক বইগুলির মধ্যে সহজ চিত্র শিক্ষা (১৯৪৬), ভারত শিল্পের ষড়ঙ্গ (১৯৪৭), ভারত শিল্পে মূর্তি (১৯৪৭), একে তিন-তিনে এক (১৯৫৪) এগুলি উল্লেখযোগ্য।
উপরোক্ত চিত্রগুলো ছাড়াও কচ ও দেবযানী (১৯০০, ম্যুরাল), আশোকের রাণী, কাজরীনৃত্য, দেবদাসী উল্লেখযোগ্য। ১৮৮৯ সালে সুহাসিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল তাঁর। তাঁদের পুত্রের নাম অলোকেন্দ্র নাথ আর দুই কন্যা সুরূপা আর উমা। তার ছোটোকন্যা মহামারী প্লেগে মারা যাবার পর তিনি ‘অন্তিম শয্যায় শাহজাহান’ আঁকেন। ছবিটি প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম।’

১৯৩০ সালে কাটুম-কুটুম পর্ব শুরু। পথ চলতে চলতে তিনি জড়ো করতেন, টুকরো কাঠ, বাঁশের গাঁট, নারকেলের মালা, সুপুরি গাছের খোলা। সে সব দিয়েই তৈরি হত চিল, বাঘ, কুকুর, হরিণ, উট এমন কি রবীন্দ্রনাথও।
অবনীন্দ্র নাথের প্রিয় ছাত্ররাও প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, অসিত হালদার প্রমুখ। “ভারতবর্ষকে সত্যিকারের ভালোবেসেছিলেন এমন যে কজন রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সবার প্রথমে নাম করতে হয় ভগিনী নিবেদিতার। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে নানা কাজের মধ্যে দিয়ে। আমার ছাত্রদেরও তিনি ভালোবাসতেন। একদিন নিবেদিতা আমায় বললেন, ‘অজন্তায় মিসেস হেরিংহ্যাম এসেছেন। তুমি তোমার ছাত্রদের ওখানে কাজে সাহায্য করার জন্য পাঠিয়ে দাও।’ … নন্দলাল বসু, অসিত হালদার, আমার দুই ছাত্র গিয়ে ওই অমূল্য শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচিত হন।”

বিখ্যাত ভারতমাতা দেখে ভগিনী নিবেদিতা প্রবাসী পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘এই ছবিখানি ভারতীয় চিত্রশিল্পে এক নবযুগের প্রারম্ভ সূচনা করবে করিবে বোধ হয়।’
সুতরাং ভালোমন্দ বিচারের দায়িত্ব তরুণ প্রজন্মের ওপর তুলে দিতে আমাদের এখন উচিত তাঁর এইসমস্ত সৃষ্টিকে সোশাল মিডিয়ায় তুলে আনা। তাঁর বক্তৃতাগুলির বহুল প্রচার করা। একবার এক ছাত্র তার কাছে আঁকা শিখতে এলে তিনি ছাত্রটির আঁকা দেখতে চাইলেন। সে দুর্গার ছবি দেখাল। অবনীন্দ্র নাথ জানতে চাইলেন সে কিভাবে এঁকেছে দূর্গাটি। ছাত্রটি জানাল, ‘ধ্যানে বসে একটা রূপ ঠিক করে নিয়েছিলাম।’ তিনি সহাস্য জবাব দিয়েছিলেন, ‘ধ্যানে দেখলে চলবে না চোখ খুলে দেখতে শেখো, তবেই ছবি আঁকতে পারবে। যোগীর ধ্যান আর শিল্পীর ধ্যানে এইখানে তফাৎ।’ তার আঁকা শেখানোর এমনই সব মজার মজার গল্প আছে। যা আমাদের তুলে ধরতে হবে বর্তমান শিল্পীদের কাছে। তাছাড়া বাড়িতে কোভিড পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়েরা মাসের পর মাস বন্দী থেকে অস্থির হয়ে উঠছে। তাদের অবনীন্দ্রনাথের কাটুম কুটুমের কথা বলে ফেলে দেওয়া জিনিষ থেকে মজার মজার খেলার জিনিস বানানোর উৎসাহ দিতে হবে।
সাহিত্যের দিকঃ
শৈশব আর কৈশোর এই দুটি নিয়েই আমাদের ছেলেবেলা বা মেয়েবেলা নামক আশ্চর্য সময়টা কাটে। আমাদের মেয়েবেলায়তো কেবল টিভি, নেটফ্লিক্স, ডিজনি হটস্টার, আর ইউ টিউবের মজা কাকে বলে তা জানাই ছিল না তাই প্রতি সন্ধ্যায় কারেন্ট চলে গেলে আমরাদিদিমা ঠাকুমা পিসিমার কোলে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে চলে যেতাম রূপবান রাজপুত্র, কুঁচবরণ রাজকন্যা, সাত সমুদ্র তেরো নদীর রহস্যঘেরা পাতালপুরী, অদ্ভুত দর্শন পক্ষীরাজ, পরোপকারী ব্যাঙ্গমা-ব্যঙ্গমী, সোনারকাঠি-রূপোরকাঠি, ছদ্মবেশী রাক্ষসী রাণীর দেশে। কিন্তু বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলআমাদের সেই শৈশব ও কৈশোরের স্বপ্নপুরী। আমরা শৈশবকে হারিয়ে ফেলি সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য, কিন্তু আমরা কৃতজ্ঞ তাঁদের কাছে যাঁরা লেখণীর অসামান্য শক্তিতে আমাদেরকে ফিরিয়ে দেন সেই হারিয়ে ফেলা সুন্দর জগৎ।
শুধু আমাদেরই নয় অবনীন্দ্রনাথের যখন মাত্র দশ বছর বয়স তখন তাঁর পিতা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যান। তিনি পরবর্তীকালে যখন তাঁর আত্মস্মৃতিকথা মূলক রচনা ‘জোড়া সাঁকোর ধারে’ (বাং ১৩৫০), ‘ঘরোয়া’ (১৩৪৮), ‘আপন কথা’ (১৩৫৩)লিখেছিলেন, (অর্থাৎ প্রায় ৭০-৭৫ বছর আগে) তাতে লিখেছিলেন,‘সেইদিন থেকে আমার ছেলেবেলাটা যেন ফুরিয়ে গেল। সেই ছোট্টবেলা থেকে মনের মধ্যে কত ছবি আঁকা হয়ে আছে। তখনই তার সব কিছু কাজে লাগেনি। কালে কালে সে সঞ্চয় কাজে এলো, ছবি আঁকার কাজে, গল্প বলার কাজে, এমনি কত কি কাজ তার ঠিক নেই।’
একদা বাল্য-শৈশব ছিল রূপকথাময়। এখন একান্নবর্তী পরিবার ভেঙেচুরে একশা। গল্প বলার মানুষজনই বা কোথায়? ফ্ল্যাটবাড়ীর ছোট্ট ঘরে আর যাই হোক রূপকথা নেই। কিন্তু মজার কথা হল, সেখানেও যদি কোনোক্রমে ফাঁকফোকড় গলে রূপকথা ঢোকে, সহসাই ঘরের চেহারা বদলে যায়। রূপকথার এমনই মহিমা। আমরা যদি অবন ঠাকুরের গল্প নিজেরা বাড়ির ছোটোদের না বলতে পারি অন্তত মোবাইলে্র অডিওতে ছোটোদে শোনাই। তাতে তাদের গেম খেলার উৎসাহ থেকে কিছুটা হলেও সরিয়ে রাখা যাবে।
শৈশব বাল্যে মুগ্ধতা নিয়ে রূপকথা শোনেনি এমন কেউ আছে কি? রবীন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথও শুনেছেন। প্যারী ও শঙ্করী দাসীর মুখে রূপকথার গল্প শোনার স্মৃতি রবীন্দ্রনাথের মনে পরিণত বয়সেও জ্বলজ্বলে ঔজ্জ্বল ছিল। অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন তাকে পদ্মদাসী দেখাশুনা করত। তার কাছেই উনি শুনেছিলেন, কন্ধকাটার গল্প।
রবীন্দ্রনাথ নিজে মন দিয়েছিলেন ছড়া-সংগ্রহে, পত্নী মৃণালিনীকে দিয়েছিলেন রূপকথা সংগ্রহের দায়িত্ব। মৃণালিনী দেবী সংগৃহীতরূপকথা নিজের মতো করে লিখে রাখতেন একটি খাতায়। সেই খাতা থেকেই অবনীন্দ্রনাথ ‘ক্ষীরের পুতুল’ এর কাহিনি উৎস গ্রহণ করেছিলেন। এই তথ্যটি অবনীন্দ্রনাথ ‘শিশুদের রবীন্দ্রনাথ’ নামক রচনায় স্বয়ং জানিয়েছিলেন।
অতি সহজ ভাষায় মুখে মুখে চমৎকার গল্প বলতেন অবনীন্দ্রনাথ। তাই রবীন্দ্রনাথ তাকে ঠিক যেভাবে তিনি মুখে মুখে গল্প বলেন তেমনি করেই গল্প লিখতে বললেন। তিনি ছিলেন শিশুদের কাছে কথক ঠাকুর। কেউ কেউ বলতো অবন ঠাকুর। তাঁর ছিল গল্প বলার যাদুকরী ক্ষমতা।
অবনীন্দ্র রচনাবলীর প্রথম খন্ডের ভূমিকা ‘মনের কথা’য় তিনি লিখেছেন, ‘থেকে থেকে যারা কাছে এসে বলে গল্প বলো, সেই শিশু জগতের সত্যিকার রাজা-রাণী বাদশা বেগম তাদেরই জন্য আমার এই লেখা পাতা ক’খানা। ছেঁড়া মাদুর নয়তো মাটিতে বসে আর গল্পের মাঝে মাঝে থেকে থেকে বকশিশ দিয়ে চলে একটু হাসি কিংবা একটু কান্না,হয় একটু দীর্ঘশ্বাস, নয় একটুখানি ঘুমে ঢোলা চোখের চাহনি, কুড়িয়ে পাওয়া পিদিম ঘষে ঘষে যারা খইয়ে ফেলেও কিছুতেই ছাড়েনা সাত রাজার ধন মানিকের আশা, — তোমাদের কাছেই উজাড় করে দিতে চাই আমার গল্পের ঝুলি।’
অবনীন্দ্রনাথ বিদ্যালয় গ্রাহ্য বিদ্যায় অনুরাগী ছিলেন না। উনিশবছর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষার ঠিক আগেই তিনি কলেজ পরিত্যাগ করেন। অর্থাৎ বিদ্যার জাঁতাকলে তিনি বেশিদিন পেশাই হতে চাননি। তার জীবনীতে তিনি তার স্কুল জীবনের খুব মজার একটি গল্প বলেছেন।
“আমায় নর্মাল স্কুলে ভরতি করে দেওয়া হলেও স্কুলে যেতে আমার একদম ভালো লাগত না। তখন আমার বছর পাঁচেক বয়স। বাবামশাই আমাকে স্কুলে পাঠানোর সব ব্যবস্থা করে ফেললেন। নর্মাল স্কুল তখন ছিল জোড়াসাঁকোয় চিৎপুর রোডে হরেন শীলের বাড়ীর পাশে। আমার কাছে ঐ স্কুল যেন বিভীষীকা। স্কুলে যাবার জন্য গেটে গাড়ি এলেই আমি কান্নাকাটি জুড়ে দিতাম। রামলাল আমায় জোর করে গাড়িতে তুলে দিত। আমি তো চিৎকার করে হাত-পা ছুঁড়ছি। এক একদিন ছোটপিসির দয়ায় রামলাল আমায় গাড়ি থেকে নামাত, তখন আমার মহাখুশি। … নর্মাল স্কুলের পন্ডিতমশাইদের চেহারা যদি দেখতে তাহলে বুঝতে পারতে কেন আমার মন বসত না। আমাদের পড়াতেন লক্ষ্মীনাথ পন্ডিত। মস্তো বড়ো মাথা, কালো কুচকুচে গায়ের রং, চোখদুটো টকটকে লাল। আমরা তো তাঁকে দেখলে বলির পাঁঠার মতো কাঁপতাম। আর ছিলেন মাধব পন্ডিত, হরনাথ পন্ডিত। প্রত্যেকেই ভিন্ন ধরনের মানুষ। কিছুকাল পড়বার পর যে ইংরেজি মাস্টারমশায়ের কাছে পড়লাম তাঁর নাম ঠিক মনে নেই। একদিন তিনি পড়াচ্ছেন, ‘p-u-d-d-i-n-g — পাডিং’। আমার মাথায় কি দুর্বুদ্ধি চাপাল কে জানে — উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘এর উচ্চারণ তো পাডিং হবে না, পুডিং হবে, আমরা তো বাড়িতে এ জিনিস খাই’। মাস্টারমশাই ধমকে উঠলেন, ‘বল পাডিং’। আমি বলি, ‘না, পুডিং’। তিনি বহুবার চেষ্টা করেও যখন পাডিং বলাতে পারলেন না, তখন স্কুল ছুটির পরও এক ঘন্টা আটকে রাখার শাস্তি দিলেন। শাস্তিটা কেমন হলো বলি, আমসাকে পাখার দড়ি দিয়ে স্কুল বেঞ্চের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল। … মাস্টারমশাই এক ঘন্টা পর এসে বললেন, ‘বল, পাডিং’। আমি বললাম, ‘না, পুডিং’।… বাবামশাই সব শুনে ও দেখে তৎক্ষণাৎ নর্মাল স্কুল থেকে নাম কাটাবার হুকুম দিলেন। তখন আমার আনন্দ আর কে দেখে।”
এবার আমি তাঁর রূপকথার গল্প লেখার কথায় সরাসরি ঢুকে যাব। তার আগে ছোট্ট করে বলে নিই, রূপকথার গোড়ার কথা।
১৮৬৫ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র ‘রহস্যসন্দর্ভ’ পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’র সমালোচনাকালে এই ‘রূপকথা’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। অনেকের ধারণা ‘উপকথা’ কালক্রমে ‘রূপকথা’ হয়েছে। সুকুমার সেনের ধারণা অনুযায়ী ‘রূপকথা’ এসেছে অপূর্ব কথা থেকে। শব্দটি না থাকলেও রূপকথার গল্প ছিল। রূপকথার গল্পে লক্ষ করা যায় রাজারাজাড়াদের প্রাধান্য, তাদের পরিবার জীবন থেকে রাজ্যপাট। অবনীন্দ্রনাথের রূপকথা পড়লেই বোঝা যায় এর উদ্দেশ্য দুই এক রূপ আর দুই ছবি সৃষ্টি করা। রূপকথাকে ইংরাজীতে বলে ‘Fairy Tale’. রূপকথা মানে কিন্তু পরী নয়, বিষয়টি আরো বিস্তৃত।
এবার আসি খুড়ো-ভাইপোর কথায়। রবীন্দ্রনাথ তখন বাল্যগ্রন্থাবলী প্রকাশের কথা ভাবছিলেন। সালটা ১৩০২ বঙ্গাব্দ। ইংরেজি ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ। অবনীন্দ্রনাথের বয়স তখন ২৫। রবিকাকার কথায় আশ্বস্ত হয়ে অবনীন্দ্রনাথ ছোটোদের জন্য লিখলেন ‘বাল্যগ্রন্থাবলী’র প্রথম বই ‘শকুন্তলা’। প্রকাশিত হল ঐ বছরই। অবশ্যই তাঁরও লেখা প্রথম বই।
সেই শুরু। তারপর থেকে ক্ষীরের পুতুল (১৮৯৬), রাজকাহিনী ( প্রথম খন্ড, ১৯০৯), ভূতপত্রীর দেশ (১৯১৫), নালক (১৯১৬), রাজকাহিনী ( দ্বিতীয় খন্ড, ১৯৩১ ), বুড়ো আংলা (১৯৪১) ইত্যাদি ছোটোদের জন্য লিখে গেছেন একের পর এক। এছাড়াও‘বাংলার ব্রত’ (১৯০৮), ‘পথে বিপথে’ (১৯১৯), ‘বাগীশ্বরী-শিল্প প্রবন্ধাবলী’ (১৯৪৮),ইত্যাদি প্রবন্ধের বইগুলিও লিখেছেন। সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী তাঁর রচনার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘তার সমস্ত রচনা যেন একখানা সুদীর্ঘ মসলিনের থাম; ক্রমে ক্রমে অকুন্ডলীকৃত হয়ে খুলে চলেছে।’
তাঁর লেখা রূপকথা-মিথ-কিংবদন্তী ছাড়াও সংস্কৃত-সাহিত্য-পুরাণ-ইতিহাস-বুদ্ধদেবের জীবন ইত্যাদি অবলম্বনে তিনি ছোটোদের জন্য লিখে গেছেন বিস্তর। তাঁর লেখা ‘শকুন্তলা’ পৌরাণিক কাহিনী, ‘ক্ষীরের পুতুল’ রূপকথা, ‘রাজকাহিনী’ হল ইতিহাস, ‘নালক’ হল গৌতম বুদ্ধের গল্প। ‘খাতাঞ্চির খাতা’ ইংরাজি গল্প পিটার প্যানের ছায়া, ‘বুড়ো আংলা’ সেলমা লাগের লফের রচিত ‘The Wonderful Adventures of Nils’ বইএর উপাদান নিয়ে লেখা, ‘আলোর ফুলকি’ ফরাসি লেখক রোস্তাঁদের গল্পের নতুন রূপ। ভূতপত্রী, খাতাঞ্জির খাতা, বুড়ো আংলাতিন খানি গ্রন্থই কিম্ভুত রসের ভান্ড। এসব দিক বিচার করে সমালোচকরা বলেন অবনীন্দ্রনাথের অধিকাংশ বই মৌলিক রচনা নয়। কিন্তু অবনীন্দ্র সাহিত্য দেশী বিদেশী কোনো গ্রন্থেরই আক্ষরিক অনুবাদ নয়। তাঁর ভাষা বাগরীতি চিত্রময়তা ছাড়াও মূল গল্পের অদল বদল ঘটিয়ে তিনি যে শিশুতোষ গল্প পরিবেশন করেছেন তা তাঁর নিজস্ব। বিষয়বস্তুতে মৌলিক না হয়েও কাহিনী গ্রন্থনে অবনীন্দ্র সাহিত্য মৌলিকতার দাবি রাখে বৈকি! তাঁর লেখা শিশুতোষ কাহিনিগুলো আশ্চর্য চিত্রকল্পের হাত ধরে আমাদের চোখের সামনে আক্ষরিক অর্থেই ছবির মতন বহুবর্ণে মূর্ত হয়ে ওঠে। ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনীর গল্পগুলো আগেও ছিল। তবে অবনীন্দ্রনাথ সেই গল্পগুলোয় সোনার কাঠি আর রূপোর কাঠি ছুঁইয়ে ইতিহাসের ঘুমন্ত পাতা থেকে জীবন্ত করে তুলে এনেছেন চরিত্রদের। ‘পথে বিপথে’র অধিকাংশ গল্পই গঙ্গাবক্ষে স্টিমারে বেড়ানোর গল্প, কিন্তু লেখকের লেখনীর যাদু স্পর্শে এটিও অপূর্ব রূপকথা হয়ে উঠেছে। ‘ঘরোয়া’ ও ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ – এই দুখানি গ্রন্থে অবনীন্দ্রনাথের শিল্প চরম পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে ‘রানি বাগেশ্বরী অধ্যাপক’ পদে যোগদান করেন অবনীন্দ্রনাথ। এই সময়ে তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতাগুলি ১৯৪১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী নামে গ্রন্থ আকারে প্রকশিত হয়। এগুলি মূলত নন্দনতত্ত্বের আলোচনা যা আজো প্রাসঙ্গিকতায় দেশে বিদেশে পূজিত হয়।

ক্ষীরের পুতুল
এটি একটি আশ্চর্য রূপকথা। যদিও এই কাহিনীতে রাজা, রানী, রাজপুত্তুর সবই আছে কিন্তু কোথাও মারদাঙ্গা যুদ্ধ তলোয়ারের ঝনাৎঝন শব্দ ও সবচেয়ে বড়কথা রক্তপাত নেই। অথচ এর পরতে পরতে মিশে আছে আমাদের পরিচিত সমাজের আশা আশাভঙ্গের যন্ত্রণা প্রেম অপ্রেম হিংসা ষড়যন্ত্র সব কিছুই।
কাহিনির শুরুতে এক রাজার দুই রাণী, দুও ও সুও। রাজবাড়িতে সুওরাণীর কত আদরযত্ন। সাতশো দাসী তার সেবা করে, পা ধোয়, আলতা পরায়, চুল বাঁধে। রাজার একেবারে প্রাণ সুওরাণী। আর দুওরাণী বড়োরাণী তার বড়ো আনাদর বড়ো অযত্ন। রাজা বিষ নয়নে দেখেন। একখানি ঘর দিয়েছেন ভাঙাচোরা এক দাসী দিয়েছেন জীর্ণ শাড়ি, শুতে দিয়েছেন ছেঁড়া কাঁথায়। অর্থাৎ কাহিনির শুরুতে আঁকলেন, বহুবিবাহ, বৈষম্য এবং বঞ্চনা। এবার আমরা সেই সময়তে চলে যাব, যখন এটি রচিত। সেই পরাধীন ভারতবর্ষ, শাসক ঘনিষ্ট না হলে রাজ অনুগ্রহের প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি বঞ্চিত মানুষের অভিমান, অভিযোগ ও ক্ষোভ রাজাকে স্পর্শই করে না।
রাজা একদিন দেশ বিদেশ ভ্রমণে বের হওয়ার জন্য জাহাজ সাজাতে রাজমন্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন। বিদায় নেওয়ার আগে সুওরাণী আর দুওরাণীর সাথে দেখা করে রাজা জানতে চাইলেন কার কী প্রয়োজন। সুওরাণী সাথে সাথে আট গাছা মানিকের চুড়ি আগুণ বরণ সোনার দশগাছা মল, পায়রার ডিমের মতো মুক্তোর হার, জলের মতো চিকন শাড়ি চেয়ে বসলেন। অন্যদিকে দুওরাণী তীব্র অভিমানে বলল, ‘মহারাজ, আমার জন্য পোড়ামুখ একটা বাঁদর এনো।’ কিন্তু আশ্চর্য, রাজার আনা মহার্ঘ্য উপহার সুওরানীর ব্যবহারযোগ্য হলনা। অন্যদিকে রাজার নির্দেশে মন্ত্রী যাদুকরের দেশের এক বণিকের জাহাজ থেকে কানাকড়ি দিয়ে কিনে আনলেন দুওরানীর বাঁদর। আর এখান থেকেই অবনীন্দ্রনাথের ক্ষীরের পুতুল গল্পের বাঁকবদল। রূপকথা আর ফ্যান্টাসির স্বাভাবিক ধর্ম অনুযায়ী এই বাঁদরটিও পার্সোনিফায়েড। সে বুদ্ধিমান, বাকপটু, চতুর। এমনকি গল্পের অবশিষ্টাংশের চালিকা শক্তিও এই বাঁদরটিই। অনেকটা রামায়ণের হনুমান চরিত্রের কথা মনে পড়ে যায়।
শেষে রাজা ছোটোরাণীকে শাস্তি দিয়ে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে পাঠককে সদর্থক বার্তা দিয়েছেন। শুধু তাই নয় এই কাহিনির একটি অত্যন্ত আর্কষণীয় দিক দেবী ষষ্ঠী সম্পর্কিত লোকায়ত বিশ্বাসটির অপূর্ব ব্যবহার। মজার ব্যাপার এই কাহিনিতে দেবী ষষ্ঠী যতনা দেবী তারচেয়ে অধিক মানবী হিসেবেই চিত্রিত। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে চুরি করে ক্ষীরের পুতুল খাচ্ছেন – এ কল্পনা একমাত্র অবনীন্দ্রনাথই করতে পারেন। সবচেয়ে মজার ঠাকরুণের কথায়, মাসি পিসি মায়া করলেন, দেশের লোক ঘুমিয়ে পড়ল। ভাবা যায় রাখাল মাঠের মাঝে, মন্ত্রী হুঁকোর নল মুখে, গুরু মশাই বেত হাতে ঘুমিয়ে পড়ছেন। ষষ্ঠী ঠাকরুণ ক্ষীরের ছেলের দশটি আঙুল বেড়ালদের খেতে দিলেন। নিজে ক্ষীরের হাত, পা, বুক পিঠ মাথা খেয়ে দুটি কান মাসি পিসিদের হাতে দিলেন। এখানে লক্ষ্যণীয় খাদ্য ভাগের সূক্ষ্ম দিকটি। নিরপেক্ষ তো নয়ই উপরন্তু ঈঙ্গিতবাহীও। সুতরাং কাহিনীটি শুধু প্রাসঙ্গিক নয় এত বছর পরও শিশুতোষ গল্প হিসেবে বন্দিত।


রাজকাহিনী
রাজকাহিনী হল ইতিহাস আশ্রিত গল্পের সংকলন। রাজকাহিনীর উপাদান সংগৃহিত হয়েছে টড প্রণীত ‘annals and antiquities of Rajasthan’ থেকে। টডের বইটির প্রথম খন্ডের প্রকাশকাল ১৮২৯, দ্বিতীয় খন্ডটি প্রকাশ পায় ১৮৩২। অবনীন্দ্রনাথের রাজকাহিনীর দুটি খন্ডের যাবতীয় গল্প বিভিন্ন প্রকাশ পায় ১৯০৪ থেকে ১৯২১ এর মধ্যে। ক্রমানুযায়ী প্রকাশিত শিলাদিত্য, গোহ, পদ্মিনী ও বাপ্পাদিত্য । তবে বইতে বাপাদিত্য আগে ও পদ্মিনী পরে সংকলিত হয়। বাকি গল্পগুলি অর্থাৎ হাম্বির, হাম্বিরের রাজ্যলাভ, চন্ড, রাণা কুম্ভ, এবং সংগ্রামসিংহ দ্বিতীয় খন্ডেসংকলিত।
সত্যের খাতিরে সমালোচকদের যে কথাটি মানতেই হবে তাহল, টড প্রণীত গ্রন্থের ঐতিহাসিকত্ব অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রাজকাহিনী’র গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বজায় রেখেছেন। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, রাজপুত জাতির শৌর্য বীর্যের কাহিনি যাতে ছোটোদের মনে দেশপ্রেমের সঞ্চার করতে পারে, সেজন্যই নাকি তাঁর এ জাতীয় গ্রন্থের পরিকল্পনা। রাজকাহিনীর প্রথম গল্প শিলাদিত্য বেরিয়েছিল ভারতী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় ১৩১১ বঙ্গাব্দে। ইংরাজীর ১৯০৪। দেশ জুড়ে তখন স্বদেশী আন্দোলনের হাওয়া। সেই হাওয়ার দাপট এসে পৌঁছেছিল ঠাকুর বাড়িতেও। তাছাড়া, তখন সাহিত্যসেবী যাঁরা তাঁরাও সাহিত্য সাধনার মধ্য দিয়ে স্বাদেশিক আন্দোলনকে জোরদার করায় অংশ নেন। সুতরাং নিছক ইতিহাস ও রোমান্সপ্রীতি অবনীন্দ্রনাথকে রাজকাহিনী রচনায় প্রাণিত করেনি, দেশপ্রেম ও স্বাদেশিক কর্তব্য পালনের তাড়নাও তার সঙ্গে যুক্ত ছিল। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট’ এর প্রধান চিত্রশিল্পী যিনি ভারতীয় শিল্পে প্রথম স্বদেশী ভাবধারার প্রবর্তন করেছিলেন। দেশীয় ওপ্রাচ্য ঐতিহ্যের বিস্তারে তিনি গড়ে তুলেছিলেন নব্য-বঙ্গীয় ও নব্য-ভারতীয় ধারা। একাধারে তিনি ‘বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট’ এরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।
‘তোমরা তো জান ইংরেজরা আমাদের পরাধীন করে রেখেছিল। সে সময়ে এদেশের ছেলেরা স্বাধীনতার জন্য নানাভাবে লড়াই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এই যুগটাকে বলা হত স্বদেশি যুগ। তাতে ছেলে -বুড়ো-মেয়ে , বড়লোক-মুটে-মজুর সবাই মেতে উঠেছিল।সবার ভিতরেই একটা তাগিদ এসেছিল।’

রাজকাহিনী বস্তুত মেবার রাজবংশের কাহিনি। শিলাদিত্য, গোহ, বাপ্পাদিত্য, হাম্বির, চন্ড, পদ্মিনী, রাণা কুম্ভ ও সংগ্রাম সিংহের কথা অবনীন্দ্রনাথ বললেও রাণা প্রতাপের প্রসঙ্গ কিন্তু উল্লিখিত হয়নি। অথচ টড প্রণীত গ্রন্থে রাণা প্রতাপের কাহিনি বিস্তৃত ভাবে আলোচনা হয়েছে। অনেকে বলেন, রাণা প্রতাপ বহুল পরিচিত বলে তিনি বর্জন করেছেন। কেউ কেউ বলেন অবনীন্দ্রনাথের লক্ষ্য ছিল ইতিহাস থেকে উপাদান নিয়ে সাহিত্য রচনা করা। তাই তিনি কতটা গ্রহণ করবেন কতটা বর্জন করবেন সেটা তাঁর এক্তিয়ার ভুক্ত। ইতিহাসের সঙ্গে রূপকথা, রাজপুত জাতির বীরত্ব, ত্যাগ, জনশ্রুতির মিশিলে রাজকাহিনী আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠতে পেরেছে ছোটোদের উপভোগ্য।
রাজকাহিনীর প্রথম গল্প শিলাদিত্য ইতিহাসের চরিত্রই নয়। টড জনশ্রুতিকে অবলম্বন করে চরিত্রটিকে কাহিনীতে স্থান দিয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র চরিত্রটিকে অনুসরণ করেছেন। দ্বিতীয় গল্প গোহ। টডের বর্ণনায় গোহ মান্ডলিকের হত্যাকারী রূপে চিহ্নিত। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ শিশুচিত্তে সেই ভয়ঙ্কর কাহিনির অনুপ্রবেশ ঘটাতে চাননি। কুৎসিত ভীষণ নিষ্ঠুর বর্ণনা যতদূর সম্ভব পরিত্যাগ করে শিশুদের মনোজগতের ছবিই তিনি আঁকতে চেয়েছিলেন। এইভাবে দেখলে দেখব, রাজকাহিনির নয়টি গল্পেই অবনীন্দ্রনাথ তার স্বাধীনচিন্তা ও কল্পনাশক্তির প্রভূত পরিচয় দিয়েছিলেন। গোহে গোহের জন্মকাহিনি, বাপ্পাদিত্যে বাপ্পাদিত্যের পিতা নাগাদিত্যের মৃত্যু, পদ্মিনীর আখ্যানে আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণ, হাম্বির গল্পে মঞ্জু ডাকাতের হত্যাদৃশ্য, রাণা কুম্ভে মীরাবাঈএর রূপগুণের খ্যাতি ইত্যাদি অজস্র প্রসঙ্গ উদ্ধার করেই তা প্রমাণ করা যায়। রাজকাহিনী পড়লেই বোঝা যায়, অবনীন্দ্রনাথ শিশুমনের কল্পনাশক্তি বিকাশে প্রভূত নজর দিয়েছিলেন, তাই তিনি অলৌকিক কাহিনী যতদূর সম্ভব বর্জন করতে চেয়েছিলেন। চিত্রময়তা গল্পগুলির অপর একটি বৈশিষ্ট্য। গল্পগুলির বর্ণনায় অবলীলায় মিশে গেছে রূপকথার দুর্লভ গুণ। যে স্বাদু গদ্যে এখানে অবনীন্দ্রনাথ কথক হয়ে উঠেছেন তার শৈলীটিও লক্ষ করার মতো। শব্দ আর ছবির আশ্চর্য দোলায়মানতা যার বৈশিষ্ট্য। স্থানে স্থানে হাস্যরসের উপাদান কাহিনিটিকে শিশুতোষ সাহিত্যের আখ্যা দেয়। এর নাটকীয় মূল্যও কিছু কম নয়। সর্বোপরি শিশুমনের উপযোগী করে কাহিনির কথক হয়ে ওঠায় অবনীন্দ্রনাথের জুড়ি মেলা ভার। শুধুমাত্র শিশু মন বোঝাই নয় নিজে শিশু না হলে যে এমন বই লেখা যায় না তা স্বীকার সকলেই স্বীকার করবেন।
সবচেয়ে বড় কথা রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্রনাথের অতীব ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে বাস করেও তিনি রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত, নিজ বৈশিষ্ট্যে দেদীপ্যমান। আরো একটি মজার কথা অবনীন্দ্রনাথ কে অনেকেই কেবল শিশু সাহিত্যিক হিসেবে মনে করেন কিন্তু তাদের কাছে আমাদের দায়িত্ব নিয়ে তাঁর প্রবন্ধের ডালি আর বক্তৃতার বইটি তুলে দিতে হবে।
যে কথা বলে শেষ করব তা হল, তাঁর যে কোন লেখাতেই চিত্রময়তা উপস্থিত,দেড়শো বছর পরেও একথা মলিন হয়নি আজও। অর্থাৎ সাহিত্যশিল্প ও চারুশিল্প এই দুই সত্তার এক অপূর্ব ও অনাস্বাদিত সংমিশ্রনই অবনীন্দ্রনাথ। তবে রবীন্দ্রনাথের অন্তিম যাত্রার ছবিই অবনীন্দ্রনাথের জীবনের শেষতম ছবির বিষয়বস্তু। ছবিটির নাম দিয়েছিলেন, ‘সম্মুখে শান্তির পারাবার’।

এতক্ষণ আমি আপনাদের বললাম, অবনীন্দ্রনাথ কিভাবে কল্পনার রঙে রসে ভরিয়ে তাঁর জীবনের দেখা বিভিন্ন দৃশ্যগুলো সুন্দর করে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন আঁকা ও লেখার মাধ্যমে। এগুলো যেকোন ভাবে তরুণ ও শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে তবেই ভবিষ্যত প্রজন্ম আরো বেশী বেশী করে মনিষীদের জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকীর গন্ডি ছাড়িয়ে দৈনন্দিন জীবনে অবনীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য মনীষিদের খুঁজে নিতে পারবে।

3 thoughts on “প্রবন্ধঃ সৃজনশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ – মৌসুমী ঘোষ ( হুগলি)

  1. সংগ্রহে রাখার মত বেশ মূল্যবান প্রবন্ধ। ধন্যবাদ।

  2. অত্যন্ত মূল্যবান লেখা। অভিনন্দন….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *