স্মৃতি কথাঃ জীবন সংগ্রাম -সাধক মুকুন্দলাল গোস্বামী – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

জীবন সংগ্রাম -সাধক মুকুন্দলাল গোস্বামী
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

গত ১৫ই আগস্ট ২০২১ এর আগের লেখাটায় এক নীরব জীবন যুদ্ধের সংগ্রামী মানুষের নানান কথা লেখার সুযোগ ঘটেছিল। তখন তাঁর নাম বলা হয়নি। অনেকেই নাম জানতে এবং আরও বেশি তথ্য জানতে আগ্রহী হওয়ায় এই লেখা, সকলের জন্য।
জানাই তাঁর নাম ছিল মুকুন্দলাল গোস্বামী। ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পঞ্চসারের বিনোদপুরে তাঁর জন্ম গত শতকের প্রথম দিকে ১৯০১ সালে বা ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ১১ই ফাল্গুন শনিবারে। মাত্র ১০ বছর বয়েসে পিতৃহারা হন। সেই থেকে বিধবা মা দুই বোন আর এক ভাইকে নিয়ে শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। একদিকে পৈতৃক শিষ্য রক্ষা, নিজের স্কুলের পড়া সামলে ভাই ও বোনেদের বড় করে তোলা, বোনদের যোগ্য পাত্রে পাত্রস্থ করা আর আদরের ভাই অমৃতলালকে পড়িয়ে মানুষ করে তোলা সব কিছু সামলে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। তিনি আমার বাবা ছিলেন, আমি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র।
এতদিন তাঁকে নিয়ে লেখার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ হয় নি। ইচ্ছেটা বাড়তে দিই নি, কেননা সাধকের মূল কর্মকাণ্ড ছিল আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের। আর অনেক মানুষ আধ্যাত্মিক শব্দটায় অস্বস্তি অনুভব করে থাকেন। অর্থাৎ, লেখাটি সর্বসাধারণের গ্রহণযোগ্য বিষয়ের নাও হয়ে উঠতে পারে।
এক সাধারণ গ্রামের (বর্তমানের বাংলাদেশের) অনাড়ম্বর অথচ আধ্যাত্মিক চেতনা সমৃদ্ধ পরিবারের উচ্চ মানসিকতার এই মানুষটির কিছু কিছু জীবনের কথা বলা যাক। ছোট বেলায় অসাধারণ মেধাবীর ছাত্রটিকে খুবই স্নেহ ও সমীহ করতেন শিক্ষক মহাশয়রা। পরবর্তীকালে আমাদের ছাত্র অবস্থায় আমরা যখন বাড়িতে স্কুলের কথা পাড়তাম, তখন তিনি বলতেন – স্কুলের মাস্টার মশায়দের প্রতি সবসময় শ্রদ্ধা রাখতে হয়। প্রণাম করতে হয়। তিনি হিন্দু বা বৌদ্ধ বা মুসলিম বা খ্রিষ্টান বা আদিবাসী যা-ই হোন না কেন তিনি তোমাদের শিক্ষা গুরু। গুরু সব সময় প্রণম্য।”
অবাক হয়ে শুনতাম তাঁর কথা। একজন কট্টর সদাচারী ব্রাহ্মণ তার উপর আবার বৈষ্ণব এরকম কথা নির্দ্বিধায় আমাদের শেখাতেন !
শুনেছি, নৌকায় এখানে সেখানে যাতায়াত করার সময় আরোহীদের মধ্যে বসে থাকা কোনো মৌলভী সাহেব সাদরে তাঁকে ডেকে পাশে বসিয়ে দুজনে গল্প করতে করতে পদ্মা বা ধলেশ্বরী বা মেঘনা পারাপার করতেন। যাত্রা শেষে সালাম আলয়কোম বা নমস্কার বিনিময় করতেন।
বাড়িতে প্রত্যেকদিন দুধ দিয়ে যেতেন জলিল মোল্লা। তাঁকে বাবা মাঝে মাঝেই বলতেন – ভাইরে, আগামী দিনে পাঁচ সের দুধ বেশি লাগবে, ভোগ হবে রাধারমণের। পারবি দিতে না হারু গয়লাকে বলতে হবে !”
সঙ্গে সঙ্গে জলিল ভাই উত্তর দিতেন – না কত্তা, কাউকে বলতে হবে না। যেখান থেকে পারি, আমিই এনে দেব। এক কথার মানুষ। “
সত্যিই, বাবার সঙ্গে পরিচিত সাধারণ মানুষ প্রায় সকলেই কথার দাম রাখতেন।
বাবা যে শুধু সাধারণ মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন , তাই নয় অসাধারণ ধীমান পণ্ডিতদের সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। বিশেষ করে, সম্ভবত ওপারে থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাঁর কথা মেনে অধ্যাপক মহাশয় একাধিকবার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পাঠকজনের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস পেয়েছেন। এমনকি তাঁর আবিষ্কৃত বজ্রযোগীনির কাছে এক দীঘি সংস্কারের সময় প্রাচীন বিশাল কাঠের মূর্তি পেয়ে তা অধ্যাপকের দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়ামে রাখানোর ব্যবস্থা করান। এপারে এসে আসানসোল থেকে কলকাতায় যাতায়াতের অসুবিধা ও ব্যয়সাপেক্ষ হলেও প্রায়শই ডঃ রমা চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
তিনি মাঝে মাঝেই যেতেন সদ্য পরিসংখ্যান শাস্ত্র নিয়ে গড়ে ওঠা ইন্ডিয়ান ষ্টাষ্টিক্যাল ইন্সটিটিউটে যদি পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ কলকাতায় থাকতেন, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। কেননা অধ্যাপক মহলানবীশ ছিলেন তাঁর ঢাকা জেলার পঞ্চসারের মানুষ। গ্রামের মানুষের খোঁজ খবর আদান প্রদানের মাধ্যমে হয়তো কোন কোন অপরাহ্ন কেটে যেত।
মাঝে মাঝেই রবীন্দ্রভারতীর রেজিস্ট্রার ভবরঞ্জন দের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে ছুটে যেতেন। উভয়েই পরস্পরকে পেয়ে খুশি হতেন আর অনেক শাস্ত্রকথা, বিশেষ করে শ্রীগৌরাঙ্গের, শ্রীগদাধর ও অন্যান্য বৈষ্ণব কথায় অপরাহ্ন কেটে যেত। তিনি চা খেতেন তবে বাড়ির বাইরে কোনো দিন চা পর্যন্ত গ্রহণ করতেন না।
তৎকালীন বিখ্যাত বৈষ্ণব পণ্ডিত আচার্য প্রাণকিশোর গোস্বামীর সঙ্গেও সেই দেশভাগের আগেই ঢাকা নবাবপুরে থাকতেই আলাপ ছিল। দুজনের মধ্যে যথেষ্ট সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। শ্রীনিত্যানন্দ বংশোদ্ভূত পণ্ডিত প্রাণকিশোর ছিলেন তাঁর দাদার মত, কেননা তাঁদের ঘরের একমাত্র কন্যা আশারাণীকে বিবাহ করেছিলেন। আচার্য প্রাণকিশোর পুরীর টোটা গোপীনাথ মন্দিরে এক সময়ের শ্রীচৈতন্য-গদাধর-নিত্যানন্দ মিলনের স্মৃতিকে মনে রেখে গ্রামের ছেলে মুকুন্দলালের সঙ্গে ঢাকা মহানগরে বড় হওয়া নিজের ভগ্নীর সম্বন্ধ স্থাপন করেছিলেন।
কলকাতায় থাকলে তিনি অনঙ্গমোহন হরিসভা, শতবার্ষিকী হরিসভা প্রভৃতি নানান সংস্থার আসরে নিমন্ত্রিত হয়ে আলোচনা বা পাঠে অংশ গ্রহণ করতেন। কখনও বা তাঁর লেখা বইয়ের কাজে ছাপাখানায় যেতেন।
তাঁর লেখা ‘ তুলসী অর্পণ বিধি ‘ গ্রন্থটি বৈষ্ণব ও ভক্ত মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এক সময় অধিকাংশ বৈষ্ণব ও ভক্তবৃন্দ মুকুন্দলাল গোস্বামীর যুক্তিগ্রাহ্য মতগুলোকে মান্যতা দিতে থাকেন।
তাঁকে এই সময় নিজের বাগবাজারের ভাড়া বাসায় থাকতে দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ছিলেন যিনি, তিনি বৃন্দাবন ধামের সাধখ বিনোদ বিহারী গোস্বামীর পুত্র বিজনবিহারী গোস্বামী।
তিনি আবার সংস্কৃতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ছাড়া বৃন্দাবনের সংস্কৃত শেখানোর টোল থেকে ছয়টি বিষয়ে স্বর্ণ পদক ও ছয়টি তীর্থ উপাধিতে ভূষিত হন। কলকাতার সংস্কৃত কলেজের বিশাল গ্রন্থাগারের দায়িত্ব আজীবন সম্মানের সঙ্গে পালন করেছিলেন। সাধক মুকুন্দলালের ব্যবহার ও নিষ্ঠার প্রতি প্রেমবশত তিনি নিজের সদ্যোজাত তৃতীয় পুত্রের নামও রেখেছেন মুকুন্দ।
সাধক মুকুন্দলাল প্রায়ই বলতেন শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ও শ্রীগদাধর পণ্ডিতদের জন্মস্থান গঙ্গা নদীর প্রায়ই পার ভাঙনের ফলে গঙ্গার বক্ষে হারিয়ে গেছে। সেসব সন্ধানে তাঁকে যথেষ্ট পড়াশোনা করতে হয়েছে। কলকাতায় এলে সব কাজ ছেড়ে জাতীয় গ্রন্থাগার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ বা এসিয়াটিক সোসাইটিতে যাতায়াত করতেন। এমনকি
দিনের পর দিন কলকাতার এসিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরীতে গিয়ে প্রাচীন কালের নবদ্বীপের ম্যাপ গুলো দেখে বছর হিসাবে গঙ্গা নদীর ভাঙন ও ম্যাপের পরিবর্তন গুলো দেখে এই বিষয়ে বিচার করতেন ও অনেককে বোঝাতে চেয়েছেন।
আমরাও জানি স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ দেবও একবার নৌকায় পারাপার করতে গিয়ে গঙ্গার উত্তাল ঢেউয়ে ‘ ঐ ঐখানে মহাপ্রভুর বাস ‘ বলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। ভাগ্যিস রাণী রাসমণির জামাই মথুরবাবু ধরে ফেলেছিলেন। না হলে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটতে পারতো।
তবে আমার মনে হয়, সে ভাঙন শেষ পর্যন্ত চর হিসাবে আবার জেগে উঠেছে আর সেই সব জায়গায় এখনও জমিতে সূক্ষ্ম বালির উপর পথ ঘাট এমনকি বাড়িঘর তৈরী হয়ে গেছে। সেখানে শ্রীগৌরাঙ্গের জন্ম স্থানের স্মরণে মন্দিরও তৈরী করা হয়েছে সঙ্গে একটি নিম গাছও লাগানো হয়েছে যার নীচে ছিল শচীমায়ের আঁতুরঘর।
সাধক মুকুন্দলাল সব সময় লেখা পড়া নিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। অর্থের প্রয়োজনে কখনো শিষ্য বাড়িতে গেলেও বেশিরভাগ সময় কাগজ কলম নিয়ে আর মধ্যাহ্নে নিজের সাধনা পূজা আহ্নিক ,সেরে স্বপাকী সাধক মুকুন্দলাল ঈষ্ট দেবতার জন্য রান্নার আগে সম্পন্ন বা অস্বচ্ছল পরিবারের প্রতি নির্দেশ দিতেন ভাল মন্দ কোনো রান্না করার তাঁর সময় হবে না। কিছু আতপ চাল সঙ্গে সামান্য মুগডাল আর ঘি বা দুধ হলেই হতো। তাই দিয়ে রাধারমণের ভোগ সারতেন, গৌরগদাধর ও নিত্যানন্দ-অদ্বৈত-শ্রীবাসকে সেই প্রসাদ নিবেদন করে প্রসাদ পেতেন। শিষ্য বাড়ির লোকদের সংগ্রহ করা সব শাকসব্জি তাঁদের অন্দরে ফেরৎ পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর শিষ্যভক্তরা যা খুশি প্রণামী দিতেন। তিনি তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন। কে কম কে বেশি দিল তার জন্য তাঁর মনে কোন প্রতিক্রিয়া হতোনা। সবাইকে সমান চোখে দেখতেন। এমনকি কোনো শিষ্যবাড়ি উপস্থিত হয়ে হয়তো বুঝলেন তাঁদের ঘরে আতপ চাল নেই। কেনার মত অর্থও নেই। তিনি জোর করে সেই পরিবারের কারো না কারোর হাতে নিজের পকেট থেকে বেশ কিছু টাকা বার দিয়ে বলতেন – তোদের এতে হবে তো ? না হলে আগামীকাল সকালে বেরিয়ে নিয়ে আসবো।”
শিষ্য বা ভক্ত হাত জোর করে বলতেন – গুরুদেব, আপনি যা দিয়েছেন তা-ই যথেষ্ট। আমাদের আর কিছু লাগবেনা। আপনার কৃপা থাকলেই চলবে। আমাদের প্রণাম গ্রহণ করুন।”
গত ১৯২৫/২৬ সালে এক কাঠের ব্যবসায়ী তাঁর রেঙ্গুনের দোকান ও কাঠের গোলায় গুরুদেবের উপস্থিতি প্রার্থনা করলে তিনি তাঁর মা ও সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে রেখে ছুটলেন তখনকার রেঙ্গুনের দিকে। তিনি যথারীতি চট্টগ্রামের বন্দর থেকে নির্দিষ্ট জাহাজে চড়ে বসলেন। তবে জাহাজের খানাপিনায় যোগ না দিয়ে নিজের সঙ্গে নেয়া শুকনো খাবারের উপর ভরসা করতে লাগলেন। দেখা গেল, প্রথম দিনে জাহাজ সমুদ্রের গভীরে যেতেই জাহাজ আরও বেশি দুলতে লাগলো আর তা সামাল দিতে দিতে অধিকাংশ যাত্রীই বেদম বমি করতে লাগলেন। সাধক মুকুন্দলাল কিন্তু অবিচল ছিলেন। তাঁর পেটে তো সামান্য শুকনো খাবার, তাতে মাঝে মাঝে ‘ ওয়াক ‘ ‘ ওয়াক ‘ করলেও কিন্তু তাঁর বমি হলনা তিনি অন্যদের মত অসুস্থ হলেন না। চারদিকে শুধু জল আর জল দেখতে দেখতে একসময় রেঙ্গুনের নিকটবর্তী বন্দরে পৌঁছেছিলেন।

4 thoughts on “স্মৃতি কথাঃ জীবন সংগ্রাম -সাধক মুকুন্দলাল গোস্বামী – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

  1. আকর্ষণীয় স্মৃতিচারণ,ইতিহাস মিশে আছে।খুব ভালো লাগলো।

  2. খুব ভালো লাগলো এই স্মৃতিচারণ । আরও জানার ইচ্ছে রইলো ।

  3. আদর্শ বলিষ্ঠ চরিত্র। প্রণাম।

Leave a Reply to ভূমিকা গোস্বামী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *