অণুগল্পঃ যশোদা মা – ভূমিকা গোস্বামী

যশোদা মা

ভূমিকা গোস্বামী

রত্নমালা ডিনার সেরে ওষুধের বাক্স আর জলের বোতলটা নিয়ে সোফায় এসে বসেছে। সারাদিনে একগাদা ওষুধ খেতে হয় ওকে। মঙ্গলময়েরও এক অবস্থা। ওষুধ খেয়ে ওরা ছাদে ঘন্টা খানেক হাঁটে দুজনে। গল্প করে।
প্রায় মাস ছয়েক হল কর্মজীবন থেকে অবসর পেয়েছে দুজনে। এইসময়ের কত স্বপ্ন ছিল ওদের। নানান দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াবে । করোনার জন্য সে সাধ অপূর্ণ ই রয়ে গেছে।

মোবাইলের নীল আলোয় রত্নমালা দেখল এগারোটা বেজেছে। বাইরের গেটে তালা দিতে নিচে নামছে এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠলো। মঙ্গলময় বলল — এতো রাতে আবার কে এল ? যাও দেখো, আমি ছাদের দরজা বন্ধ করে আসছি।
রত্নমালা সিঁড়ি দিয়ে নেমে দরজা খুলে অবাক ! দীপাবলী ! অস্ফুটে মুখ থেকে বেড়িয়ে এল — এতরাতে ! কি করে এলি ?
সব বলছি – আগে আমাকে একটু বসতে দাও।
এখন শুনশান রাস্তাঘাট । স্বাভাবিক দিনে রাত এগারোটা – মানে এই পাড়ায় সন্ধে। আশপাশের ছেলে ছোকড়ারাদের কলোরবে মুখর থাকে।

বাউন্ডারির গেটে তালা দিতে দিতে মাথার মধ্যে দীপাবলিকে নিয়ে হাজার প্রশ্ন কিলবিল করছে। এত রাতে বড় একটা সুটকেস নিয়ে কোথা থেকে এল ! ছোড়দি বলেছিল , — দীপু নাকি নদীয়ার কোন হাসপাতালে নার্সের চাকরি পেয়েছে । ওদের অবস্থাটা এখন ফিরেছে।
জামাইবাবু , লাং ক্যান্সার ধরা পড়ার বছর খানেকের মধ্যেই মারা গেলেন। ততদিনে জমানো সবটাকা শেষ। মাথার ওপর ছাদটুকু ছাড়া আর কিছুই ছিল না । ছোড়দি সেলাই করে ঠোঙা বানিয়ে কোনরকমে সংসার চালাত। দীপু তখন ক্লাস টেন। প্রতিমাসে রত্নমালা দীপুর পড়ার জন্য টাকা পাঠাত জলপাইগুড়িতে । নিঃসন্তান চাকুরীরতা রত্নমালা দীপুর লেখাপড়ার সমস্ত ভার নিয়ে নিয়েছিল। বছর দুয়েক হবে ছোড়দি ফোনে একদিন বলল — মালা, আর তোকে টাকা পাঠাতে হবে না রে। দীপু চাকরী পেয়ে গেছে সরকারী হসপিটালে।
বাইরের লাইট নিভিয়ে ঘরে এসে দেখল দীপাবলি স্নান সেরে একটা নাইটি পড়ে সোফায় বসে আছে। মঙ্গলময় শুয়ে পড়েছে।

রত্নমালা বলল –কিরে খাবি তো ?
-না মাসি খেয়ে এসেছি।

তা এলি কিভাবে ? ট্রেন তো চলছে না।
— আমার এক ডাক্তার বন্ধু আমাকে ওর গাড়িতে পৌঁছে দিল।

তোমাকে অনেক কথা বলার আছে মাসি। আমি তোমার কাছে কিছুদিন থাকতে চাই। থাকতে দেবে তো ?
কী হয়েছে ? উদ্বেগ প্রকাশ পেল ওর স্বরে।
এরপর যা শুনলো তার জন্য একটুও মানসিক প্রস্তুত ছিল না।

দীপাবলি প্রেগনেন্ট। একই হসপিটালে ওর ডাক্তার বন্ধু এখন কেরিয়ারের শুরুতে বিয়ে করতে পারবে না। তাই কলকাতায় এসেছে ওর এ্যাবোর্ট করাতে। কাল সকালে ওকে নিয়ে যাবে কোন নার্সিং হোমে। তারপর দীপু এখানে কিছুদিন থেকে সুস্থ হয়ে আবার কাজে যোগ দেবে।
সারাটা জীবন একটা শিশুর জন্য ছটফট করা রত্নমালার চোখে জল এসে গেল, দীপুর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে ধরে বলল – একটা প্রাণ এভাবে শেষ হতে পারে না , ওকে তুই আমাকে দিয়ে দে দীপু, আমি ওর যশোদা মা হতে চাই।

8 thoughts on “অণুগল্পঃ যশোদা মা – ভূমিকা গোস্বামী

  1. খুব সুন্দর কাহিনী। এ যেন চলমান জীবনের কথা।

  2. খুব ভাল কাহিনী। লেখিকার গুণে ছোট্ট ফ্রেমে অনেক কথা।

  3. খুব ভাল গল্প। লেখিকার গুণে ছোট্ট ফ্রেমে অনেক কথা।

  4. মন ভরে দেওয়া গল্পটি । বাঁচুক প্রাণগুলি এভাবেই স্নেহের সহস্রধারায়। শুভেচ্ছা বন্ধু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *