গল্পঃ অবদমন – পিন্টু ভট্টাচার্য

অবদমন
পিন্টু ভট্টাচার্য

সকালে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাসে পেস্ট লাগাতে লাগাতে তার সঙ্গে বেড়াতে যেতে
বলায় যে বিচিত্র মুখভঙ্গীটা করেছিল অদিতি সেটা মনে পড়ল অমিতের।আর মুখভঙ্গীটা
মনে পড়তেই ফিক করে হেসে ফেলল সে। তাতেই বিপদটা ঘটল।বেসিনের ওপরে লাগানো
আয়নায় নিজের হাসিমুখটা চোখে পড়তেই চমকে উঠল অমিত,অবিকল বাবার মত।সঙ্গে
সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল সে।জ্ঞান হওয়া ইস্তক যে মুখটা নিজের চোখের সামনে থেকে
মুছে ফেলার নিরন্তর চেষ্টা করছে, সেটা শেষ পর্যন্ত তার মুখেই বসে গেল!কোনরকমে
মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বিরস মুখে বসল অমিত।ঝুমা এক
কাপ চা দিয়ে গেল টেবিলে।চায়ে চুমুক দিয়েই অমিতের মনে হল চাটা বড় বিস্বাদ।এত
খারাপ চা ঝুমা করে না কোন দিন।
হাসলে যে তাকে ঠিক বাবার মত লাগে এই কথাটা সে প্রথম শুনল এ বছর
ভাইফোঁটায়,ছোড়দির কাছে।ওই একটা দিন এ বাড়িতে বড় উৎসব হয়।ভাইফোঁটার দিন
অমিতের চার দিদি,দিদিদের সাত ছেলেমেয়ে,তিন জামাইবাবু সকালেই চলে আসে।শুধু
ছোটো জামাইবাবু আসতে পারে না,তার ভাইফোঁটা আছে বলে।বিগত দশ বছর ধরে এটাই
হয়ে আসছে।দিদিরা এসেই রাঁধতে বসে পড়ে।পনের-কুড়ি জন লোকের রান্না,তায়
ভাইফোঁটা উপলক্ষে।সে এক বিরাট আয়োজন,এলাহি ব্যাপার।সারাদিন ব্যস্ততায় কাটে
সবার,কিন্তু যত কাজই থাক রাত দশটার মধ্যে সব সেরে ফেলে সবাই বসে পরে গল্প
করতে। অনেক রাত অবধি গল্প গুজব ,হাসিঠাট্টা চলে।পরের দিন সকালে উঠে আবার যে
যার বাড়িমুখো হয়।রাত দশটার পরে গল্পের আসর বসানোর রীতিটাও দশ বছরের
পুরোনো।
এ বছরেও আসর বসেছিল যথারীতি।সারা বছর ধরে অনেক দুঃখ, কষ্ট,‌ বেদনা,আনন্দ
জমে ওঠে সবার মনে।অভাব অভিযোগও কিছু কম থাকে না।সে সব বলে হাল্কা হয়
সবাই।মেজোজামাইবাবু হাসাতে পারে খুব।যে গল্পই হোক না কেন তার মধ্যে থেকে হাসির
উপাদান ঠিক বার করে ফেলে।এমন মন্তব্য করে না হেসে পারা যায়
না।মেজোজামাইবাবুর এমনই একটা কথায় হেসে ফেলেছিল অমিত।আর হাসতে হাসতেই
শুনল ছোড়দি সেজদিকে বলছে—“দেখ, দে্‌খ ভাইয়ের হাসিটা ঠিক বাবার মত।”সঙ্গে
সঙ্গে মুখের হাসি মিলিয়ে গেল অমিতের।মুখে কোন কথা উচ্চারণ না করে চলে গেল
পাশের ঘরে।ছোড়দি কথাটা বলেই বুঝতে পারল কি সাংঘাতিক ভুল সে করে

ফেলেছে।কথাটা সে বলতে চায়নি,কিন্তু কিভাবে যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।পাশের
ঘরে গিয়ে সে বারংবার ভাইয়ের কাছে দোষ স্বীকার করে,শেষ পর্যন্ত ছোট ভাইয়ের
কাছে ক্ষমা চেয়ে আবার আসরে এনে বসাল।কিন্তু ততক্ষণে আসরের তাল কেটে
গিয়েছে,আর জমল না।
বিস্বাদ চায়ে অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে চুমুক দিতে দিতে ছোড়দির বলা কথাটাই
মনে আসল অমিতের।সেদিন ছোড়দির চোখে যা ধরা পড়েছিল,আজ তার চোখেও সেই একই
জিনিষ ধরা পড়ল।অথচ আগে কখনও এমনটা মনে হয়নি তার।জ্ঞান হওয়ার পর থেকে
অত্যন্ত যত্নে সে নিজেকে তৈরি করেছে যাতে ওই লোকটার কোনো ছাপ তার ওপর না
পড়ে।মানুষটার মধ্যে যত দোষ ছিল,কোনটাই যাতে তার মধ্যে না আসে তার চেষ্টা
করেছে আপ্রাণ।চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তার ওপরে লোকটার ভালমন্দ কোন
প্রভাবই পড়তে দেয়নি অমিত।মাকে যে সব অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে দেখেছে অমিত
তার কোনোটাই যাতে ঝুমাকে সহ্য করতে না হয় তার জন্য সজাগ থেকেছে
সবসময়।তাহলে আজ হঠাৎ কি এমন হল যে তার হাসিটা একদম বাবার মত হয়ে
গেল?সত্যিই কি হঠাৎ?না কি গত ছমাস ধরে ধীরে ধীরে এই পরিবর্তনটা হয়েছে
তার?সে কি চেষ্টা করেছিল স্কুল জীবনের মত,মেস জীবনের মত পরিবর্তন আসার
আগেই তাকে প্রতিহত করতে?সে চেষ্টা করলে তার হাসিটা আজ বাবার মত হয়ে যেত
না।
বাবাকে নিয়ে কোন ভাল স্মৃতি অমিতের নেই।তার আর পাঁচটা বন্ধুবান্ধব যেভাবে
বাবাকে পেয়েছে,সে তার কিছুই পায়নি।তার ঘুম ভাঙার আগেই বাবা বেরিয়ে যেত
কাজে,বাড়ি ফিরত ঘুমিয়ে পড়ার পর।কোন কোন দিন গভীর রাতে চিৎকার চেঁচামেচিতে
ঘুম ভেঙে উঠে দেখত বাবা-মায়ের মধ্যে তুমুল ঝগড়া চলছে।শেষ পর্যন্ত ঝগড়াটা গড়াত
মারামারিতে।মারামারি মানে শুধুই মার।কখনও মায়ের চুলের মুঠি ধরে গালে পিঠে হাতে
যেখানে পারত কিল চড় ঘুঁষি মারত বাবা,কখনও আবার হাতা খুন্তি দরজার হাঁক যা পেত
হাতের কাছে তাই দিয়ে বেধরক মারত মাকে।ভয়ে জোর করে চোখ বন্ধ করে মড়ার মত
স্থির হয়ে পড়ে থাকত অমিত,যদি জেগে আছে জানতে পারলে তাকেও বাবা মারে।চোখ
বুঁজে থাকলেও বুঝতে পারত ঘরের মধ্যে আরও তিন চারজন এসে সবাই মিলে বাবাকে
ঠেকানোর চেষ্টা করছে।বাবার চালানো এলোপাথারী কিল চড় ঘুঁষি পড়ছে তাদের
গায়েও।আস্তে আস্তে সব থেমে যেত,চোখ বুঁজে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়ত সেও।

অমিতের তখন কতই বা বয়স—চার কি পাঁচ বছর।অথচ ঘটনাগুলো এখনও চোখ বুঁজলে
স্পষ্ট দেখতে পায় সে।একদিন রাত্রিবেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখে মা আর দিদিরা
বাবাকে চ্যাংদোলা করে ঘরে নিয়ে আসছে,বাবার হাত-পা কেমন এলিয়ে পড়েছে।দেখে খুব
ভয় পেয়ে গিয়েছিল অমিত।ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে জিজ্ঞেস করল—“কি হয়েছে
বাবার?” সে যে উঠে পড়েছে মা খেয়াল করেনি।বেশ বিরক্তির সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে
কড়া সুরে বলল—“তুই উঠলি কেন,শুয়ে পড়।”অমিত শুলো না,আবার জিজ্ঞেস
করল—“বাবার কি হয়েছে?”তার কেমন ভয় লাগছিল।বাবা মরে যায়নি তো?মা তার কথার
কোন উত্তর না দিয়ে বড়দিকে বলল—“এক ঘটি জল নিয়ে আয় তো।”অমিতের মনে হল
বাবা অচেতন হয়ে পড়ে আছে।কেমন একটা বাজে গন্ধ নাকে আসছিল তার।
আর একটু বড় হয়ে অমিত বুঝেছিল গন্ধটা মদের,পাতি দেশি মদ খেত বাবা আর তার
জন্যই তাদের যত কষ্ট।সংসারের প্রায় কোন দায়িত্বই বাবা পালন করত না।সরকারি
চাকরি একটা করত বাবা,খুব সাধারণ চাকরি,মাইনে যা পেত সাত-আটজনের সংসারের
পক্ষে তা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর।তার ওপরে মাইনের অর্ধেক টাকাই নষ্ট করে
ফেলত মদ খেয়ে আর হারিয়ে ফেলে।কোন কোন মাসে এমনও হয়েছে মাইনের পুরো
টাকাটাই হারিয়ে গেছে।বাড়িতে ছেলেমেয়েদের দুবেলা খাবার ব্যবস্থা আছে কিনা তা
নিয়েও মাথাব্যথা ছিল না লোকটার।মাইনে পেলে মায়ের হাতে কিছু টাকা দিত,তাই দিয়েই
বহুকষ্টে এতগুলো পেট চালানোর ব্যবস্থা করত মা।এতগুলো মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা
করতে সারাদিন রান্নাঘরেই কাটাতে হত মাকে।রান্না করতে করতেই মা তাদের
পড়াত।আশ্চর্যের ব্যাপার হল মা নিজে প্রাইমারির গন্ডী পেরোয়নি,কিন্তু ক্লাস টেনে
পড়া বড়দিকেও মা পড়া দেখিয়ে দিত।সারাদিন এত পরিশ্রম করত মানুষটা,রাতেও ভাল
করে ঘুমাতে পারত না কোনদিন,তাও তার মুখে কোনদিন ক্লান্তির ছাপ দেখেনি
অমিত।যেটুকু অবসর পেত নানারকম সেলাই ফোঁড়াই করত।সুন্দর সোয়েটার বুনতে পারত
মা।তাদের ভাইবোনেদের জন্য তো করতই,পাড়ার লোকেদেরও সোয়েটার বুনে দিত।তাতে
কিছু রোজগারও হত।
আর্থিক,মানসিক,দৈহিক—সবরকম যন্ত্রণাই ছিল মায়ের নিত্য সহচর।তবুও মায়ের
মুখে হাসি লেগেই থাকত।অনায়াস দক্ষতায় সব রকম কান্নাকে হাসিতে রুপান্তরিত করে
নিত মা।এই মায়ের চোখেও একদিন জল দেখেছিল অমিত।সে তখন আরেকটু বড়
হয়েছে,প্রাইমারি পেরিয়ে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে।তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হওয়ায় সেদিন
দুপুর দুপুর বাড়ি ফিরে দেখে মা ঘরের মেঝেয় কেমন স্থানুর মত বসে আছে,হাতে উলকাঁটা

ধরা আছে কিন্তু চলছে না।মা এত অন্যমনস্ক ছিল যে সে ঘরে ঢুকেছে বুঝতেই
পারেনি।অমিত বইখাতা নামিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি করে মায়ের কাছে গিয়ে দেখে মা কেমন
স্থির দৃষ্টিতে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে আর তার চোখ দিয়ে টপটপ করে
জল ঝরে পড়ছে।সে যে এত কাছে চলে এসেছে মা বুঝতেই পারেনি।অমিত কেমন একটা ভয়
পেয়ে গেল।মাকে ত সে এমন করে কাঁদতে দেখেনি কখনও।মায়ের পাশে বসে ভয়মাখানো
কন্ঠে বলল—“মা তুমি কাঁদছ?”মায়ের যেন এতক্ষণে সম্বিত ফিরল।আঁচল দিয়ে
তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল—না বাবা,চোখটা জ্বালা করছিল।
–আমি যে স্পষ্ট দেখলাম তুমি কাঁদছ।তোমার মনে খুব কষ্ট না মা?
এতক্ষণে মায়ের মুখে হাসি ফুটল,বড় কষ্টের হাসি।সেই বয়সেই অমিত হাসির মধ্যে
লুকিয়ে থাকা কষ্টটা স্পষ্ট পড়তে পারল।মা কিন্তু কষ্টের কথাটা উড়িয়েই
দিল।কষ্টমাখা হাসিটা মুখে ঝুলিয়ে রেখেই বলল—কিসের কষ্ট বাবা?তুমি থাকতে
আমার কষ্ট কি?
মায়ের কষ্টটা যে ঠিক কিসের সেটা স্পষ্ট করে না বুঝলেও মায়ের যে খুব কষ্ট সেটা
সে বুঝত।আর সেই কষ্টের কারণ যে বাবা সেটাও ভাল বুঝতে পারত।তার অন্য বন্ধুদের
বাবাদের সঙ্গে তার বাবার যে বিরাট পার্থক্য,সেটা সেই বয়সেই তার চোখে ধরা
পড়েছিল।কিন্তু এসব কথা মাকে বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল না। তাই
বলল—“আমি বড় হয়ে তোমার সব কষ্ট দূর করব মা।”
এবার মায়ের মুখে যে হাসিটা ফুটল তার মধ্যে কোথাও কষ্টের লেশমাত্র নেই,একটা
আশা,একটা স্বপ্ন যেন চুঁইয়ে পড়ছিল সেই হাসি দিয়ে।অমিতকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে
গায়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মা বলেছিল—“তোকে অনেক বড় হতে হবে বাবা,অনেক
পড়াশুনা করতে হবে।আর জীবনে কোন নেশা করিস না।নেশাতেই সবার সর্বনাশ হয়।”
–নেশা কি মা?
নেশা কথাটা মা বোধহয় বলতে চায়নি,মুখ দিয়ে কেমন বেরিয়ে গিয়েছিল।তাড়াতাড়ি কথাটা
চাপা দেবার জন্য বলল—“সেটা বড় হয়ে বুঝবি।চ, তোকে খেতে দিই।”
মা সেদিন না বললেও আর একটু বড় হতেই নেশা শব্দটার মানে সে বুঝে
গিয়েছিল।বুঝিয়ে দিয়েছিল পাড়ার দাদারাই।তার বাবা যে মদখোর মাতাল এবং সেও বড়

হয়ে বাবার মতই হবে,সে কথা দাদাদের কেউ আরেঠারে আবার কেউ সুযোগমত সরাসরিই
বলত।তাদের মুখের ওপর কোন জবাব দিতে পারত না অমিত,কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা
আরও দৃঢ় হত তার,শুধু নেশা করা থেকেই দূরে থাকা নয় বাবার কোন প্রভাবই সে তার
ওপর পড়তে দেবে না সেটা ভাল বা মন্দ যাই হোক।খুব সযত্নে সে মানুষটার সমস্তরকম
অভ্যাসগুলো থেকে শতহস্ত দূরে রাখত নিজেকে,এখনও রাখে।শুধু একটা ক্ষেত্রেই
সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে গেল।তার চল্লিশ বছরের যাবতীয় প্রচেষ্টা,সাবধানতা,সাধনা
অদিতিকে দেখে কিভাবে যেন ভেঙে পড়ল।কোন প্রলোভনে এমনটা হল?
অথচ সেই নাইনে পড়ার সময়ই নিষিদ্ধ জগতের হাতছানিকে অনায়াসে উপেক্ষা করতে
পেরেছিল সে।নিষিদ্ধ জগতের ডাকটা তার কাছে প্রথম এসেছিল বিকাশ মারফত।বিকাশ
আর অমিত একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত।একই পাড়ায় কাছাকাছি বাড়ি বলে তাদের
বন্ধুত্বটা বেশ গাঢ় ছিল।সেবার সরস্বতী পুজোর দিন সন্ধ্যা-আরতির পর বিকাশ
বলল—আজ একটা নতুন জিনিষ খাওয়াব তোকে।চ আমার সাথে।
–এখানেই দে না।
–এখানে দেওয়া যাবে না সবার সামনে।
সবার সামনে কেন দেওয়া যাবে না সেটা সে বুঝল প্যান্ডেল থেকে একটু দূরে একটা
নির্জন আবছা অন্ধকার জায়গায় গিয়ে।বিকাশ পকেট থেকে দুটো সিগারেট বার করে
একটা তার হাতে দিয়ে বলল—বাবার সিগারেটের প্যাকেট থেকে চুরি করে
এনেছি।দেশলাইও আছে।আজ খেয়ে দেখব কেমন লাগে,অনেকদিনের ইচ্ছে।
ইচ্ছেটা অমিতেরও ছিল।তার বাবা অবশ্য সিগারেট খেত না,খেত বিড়ি।যেটুকু বাড়িতে
থাকত সুস্থ অবস্থায়,একটার পর একটা বিড়ি খেয়েই যেত।দেখে তারও খুব ইচ্ছে করত
দু’একটান দিয়ে দেখতে অনুভূতিটা ঠিক কেমন হয়।সুযোগ যখন এল তার কেমন যেন মনে
হল একবার শখ করে খেতে গিয়ে সে যদি নেশার খপ্পরে পড়ে যায়।সেই ভয়ে অতি কষ্টে
সে ইচ্ছা সম্বরণ করে বিকাশের দেওয়া সিগারেটটা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল—আমি খাব
না,তুই খা।
একটা গোটা সিগারেট হাতে পেয়েও কেউ ফিরিয়ে দিতে পারে এটা বিকাশের ধারণাতে
ছিল না।সহসা তার মুখে কোন কথা জোগাল না।সে বেশ খানি্কক্ষন স্থির হয়ে তাকিয়ে

রইল অমিতের দিকে।আবছা অন্ধকারেও তার সেই স্থির দৃষ্টির ভাষাটা স্পষ্ট পড়তে
পেরেছিল অমিত।
সেদিন যে কথাগুলো বিকাশ মুখে না বলে চোখ দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল ঠিক সেই
কথাগুলোই বলেছিল সুজয়রা আরও পাঁচ বছর পর।অমিত তখন কলেজে পড়ে।পার্ট ওয়ান
পরীক্ষা শেষ হওয়ার দিন সুজয়দের মেসে তারা সাতজন রাতে ফিস্ট করবে ঠিক
করেছিল।সুজয়,নীলেশ ,বসন্ত,বিজয় আর সুভাষ মেসে থাকত।অমিত আর সুকান্ত বাড়ি
থেকেই যাতায়াত করত।কলেজে তাদের সাতজনের একটা গ্রুপ ছিল।নীলেশই প্রস্তাবটা
দিয়েছিল,বলেছিল—শেষ পরীক্ষার দিন তোদের বাড়ি যেতে হবে না।রাতে আমাদের মেসে
থাকবি।সবাই মিলে ফিস্ট করব।
সবাই রাজি হয়ে গিয়েছিল,অমিতও।সেই প্রথম তার ফিস্ট করা।মনে মনে বেশ একটা
উত্তেজনা বোধ করছিল অমিত।সবাই মিলে আড্ডা হচ্ছিল বেশ,কিন্তু সন্ধ্যে একটু
গড়াতেই ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিল।সুভাষ তার ট্রাঙ্ক থেকে দুটো মদের বোতল
বার করে বলল—এসব একটু না হলে পিকনিক জমে না।কাল কিনে রেখেছি।আয় শুরু করি।
অমিত প্রমাদ গুনল।মায়ের মুখটা মনে পড়ল তার।বলল—আমি খাব না,তোরা খা।
সুজয় একটু অবাক হয়ে বলল—খাবি না কেন?আমরা সবাই খাব,একদিন একটু আনন্দ
করে পরখ করা।
অমিতের ইচ্ছে হচ্ছিল খুব কিন্তু উপায় নেই। ও জানে ওর রক্তে নেশার বীজ
আছে।ছোটবেলায় পাড়ার দাদারা একটু সুযোগ পেলেই ওকে বলত সে কথা।অমিত জানে ওই
বলাটা ছিল তাদের একটা নিষ্ঠুর আনন্দের প্রকাশ,অন্যকে অপমান করার ,মানসিক
নির্যাতন করার মধ্যেই থাকে এই আনন্দের উৎস।তবুও কথাগুলো বারবার শুনতে
শুনতে কেমন যেন একটা বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল যে কোন একটা ভুলেই সে নেশার খপ্পরে
পড়ে যেতে পারে।একটা ভয়ও ছিল,সেও যদি মাকে কষ্ট দিয়ে ফেলে।যদি একবার মদ
খেলেই আর ছাড়তে না পারে।না না কিছুতেই খাওয়া যাবে না মদ,চেখেও দেখা যাবে
না।অমিত অনুনয়ের সুরে বলল—আমি খাব না রে, আমার অভ্যাস নেই,তোরা খা।
বাকিরা সবাই অল্পস্বল্প গলায় ঢালতে শুরু করেছে ।সামান্য নেশাও হয়ে গেছে।
বিজয় একটু রাগতভাবেই বলল—তোর অভ্যেস নেই ,আর আমরা রোজ খাই, না?

নীলেশের নেশা একটু জমে গিয়েছিল।ব্যঙ্গের সুরে বলল—ওর জন্যে এক গ্লাস দুধ নিয়ে
আয়, খাক।
সুভাষ জোর দিয়ে বলল—খাবি না মানে,খেতেই হবে।নিজে না খেলে সবাই মিলে জোর করে
খাইয়ে দোব।
কথাটা বলতে বলতেই গ্লাসে খানিকটা মদ ঢেলে খাইয়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল
সুভাষ।বিজয় পাশে বসে ছিল।সে অমিতের হাতদুটো ধরতে উদ্যত হল।বাধা দিল
সুকান্ত—ও যদি খেতে না চায় জোর করিস না।আমরা আনন্দ করতে বসেছি, যে যাতে
আনন্দ পায় করতে দে।
সুকান্তর মধ্যে এমন একটা ব্যক্তিত্ব আছে তার কথায় প্রভাবিত হয় সবাই।সুজয়রা
নেশার ঘোরেও তার কথা মেনে নিল।সেটাই অমিতের প্রথম এবং শেষ ফিস্ট।চাকরি
পাওয়ার পরে অফিসের স্টাফেদের সাথেও কখনও পিকনিকে যায়নি সে।সেদিনের কথা
মনে পড়লে এখনও তার মেরুদন্ড দিয়ে কেমন একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়,এমনকি
তার হাসিটা বাবার মত হয়ে যাবার পরেও।
বাবার যে শুধু বিড়ি আর মদের নেশা ছিল তাই নয়,মেয়েছেলের নেশাও ছিল।অনেক বেশি
বয়স অবধি অমিত এই দোষের কথাটা জানত না।মা হয়ত জানত কিন্তু তাকে বলেনি
কখনও।কি করেই বা বলা সম্ভব?বাবা অন্য মেয়েতে আসক্ত –এ কথা কি কোন মা
ছেলেকে বলতে পারে?এ যে মায়েরই অক্ষমতা,তার জীবনের সবচেয়ে বড় লজ্জা।সেই
লজ্জা থেকেই বোধহয় ছেলে বড় হওয়ার পর নিজের আর সব কষ্টের কথা বললেও এই
কষ্টটা অত্যন্ত সংগোপনে নিজের মধ্যেই রেখেছিল মা।হয়ত দিদিরা জানত,কিন্তু
অমিত জানল অনেক বড় হয়ে।সে তখন এম.এ ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।কোলকাতায় মেসে
থেকে পড়াশুনা করে।দিদিরা সবাই বিয়ে করে নিয়েছে।বাবা দাঁড়িয়ে থেকে কারও বিয়ে
দেয়নি।সব দিদিরাই নিজের ব্যবস্থা করে নিয়েছিল।বাড়িতে থাকত শুধু বাবা আর
মা।দু’তিনদিনের ছুটি পেলে অমিত বাড়িতে আসত।এমনই এক ছুটিতে বাড়িতে এসে
সন্ধ্যায় বাজারে বন্ধুর দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল অমিত একজন কালো শুকনো
চেহারার আধা বয়সী লোক পান চিবুতে চিবুতে তার সামনে এসে বলল—তুমি অনুপদার
ছেলে তো? তোমার নাম তো অমিত?

লোকটাকে আগে কোনোদিন দেখেছে বলে মনে করতে পারল না অমিত।একটু অবাক
হয়েই বলল—হ্যাঁ,কিন্তু কেন বলুন তো?
—একটু কথা ছিল তোমার সাথে।
—আমার সাথে?বলুন।
—কথাটা গোপন।একটু এদিকে আসলে ভালো হয়।
তার সাথে কি গোপন কথা থাকতে পারে লোকটার ভেবে পাচ্ছিল না
অমিত,লোকটাকে তো সে চেনেই না।তবু কথাটা শোনার জন্য কৌতূহল হল
তার।লোকটাকে অনুসরণ করে বাজারের শেষপ্রান্তে চলে এল সে।এদিকে
দোকানপাট প্রায় নেই।আবছা অন্ধকার মত একটা জায়গায় লোকটা দাঁড়িয়ে
পড়ল।অমিতও দাঁড়াল।লোকটা তার ডানহাত তুলে আধো অন্ধকারে ডুবে থাকা
একটা ছোট একতলা বাড়ির দিকে নির্দেশ করে বলল—এই বাড়িতে এক
অল্পবয়স্ক বিধবা মহিলা থাকে একটা বাচ্ছা ছেলে নিয়ে।তোমার বাবা প্রায়
সন্ধ্যায় এখানে আসে,যায় অনেক রাতে।কথাটা তোমার জানা প্রয়োজন মনে হল
তাই বললাম।সংশোধন না হলে কোনদিন মারধর খেয়ে যাবে।
কথাগুলো বলেই লোকটা হনহন করে হাঁটা জুরলো,তাকে কিছু বলার সুযোগ না
দিয়েই।স্থির হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবল অমিত।অনায়াসে সে লোকটার পিছু নিয়ে
ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারত ।কিন্তু ভেবে দেখল,তাতে বিশেষ
লাভ হবে না।কোথাও স্বার্থে আঘাত লেগেছে বলেই লোকটা তাকে কথাগুলো বলে
গেল।বাজারে যে বন্ধুর দোকান রয়েছে তাকে জিজ্ঞাসা করলেই আসল সত্য জানা
যায়। এ ধরণের যাবতীয় ঘটনা তার নখদর্পণে।কিন্তু নিজের বাবাকে নিয়ে এসব
কথা বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করা যায় না।সবচেয়ে ভালো হল সরাসরি বাবাকেই
প্রশ্ন করা।যথেষ্ট বড় হয়েছে সে।বাবার যাবতীয় অপরাধের হিসাব চাওয়ার
অধিকার তার আছে।আড্ডায় আর না গিয়ে সোজা বাড়ি ফিরে এল অমিত।
রাতে বাবার সঙ্গে কথা বলার কোন মানে হয় না। প্রায় কোন রাতেই বাবা
প্রকৃতিস্থ থাকে না।পরের দিন সকালেই বাবার মুখোমুখি হল অমিত। সারারাত
ধরে বাবার সঙ্গে সংলাপের একটা খসড়া মনে মনে তৈরি করেছিল সে। সম্ভাব্য
সমস্ত রকম উত্তর-প্রত্যুত্তর নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে রেখেছিল। কিন্তু সকালে
বাবার মুখোমুখি হয়ে যখন সে সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে জানতে চাইল ঘটনার
সত্যতা,বাবা তাকে কোন উত্তর না দিয়ে রাগে ফেটে পড়ল মায়ের
ওপর—ছেলেকেও বলা হয়েছে সব কথা। আমি তোমাকে পরিস্কার বলে দিচ্ছি
আমার টাকায় খেয়ে পরে থাকবে আবার আমার নামে ছেলেমেয়েদের কাছে লাগাবে
এসব চলবে না।এসব করতে হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে কর।আমার স্বাধীনতায়
বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে আমি কাউকে ছাড়ব না।
বাবার আস্ফালন চলতেই লাগল।কিন্তু বাবার এই নির্লজ্জ আস্ফালনের থেকেও
তাকে বেশি অবাক করেছিল মায়ের নীরবতা। মা তাহলে সব জানত,অথচ
ঘুণাক্ষরেও তাকে কিছু জানতে দেয়নি।মুহূর্তেই বুঝে নিল অমিত বাবাকে তার পথ
থেকে ফেরান অসম্ভব। বাবাকে আর একটাও কথা না বলে মাকে বলেছিল—তুমি
আমার সঙ্গে চল। আমাদের দুজনের ব্যবস্থা আমি করে নিতে পারব। আরও দুটো
টিউশন ধরলেই হয়ে যাবে। এই অসম্মানের মধ্যে আমি তোমায় থাকতে দেব
না। কিন্তু কিছুতেই মাকে রাজি করাতে পারেনি।
সেদিন মেসে ফিরেই পাপড়িকে লেখা চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেছিল
অমিত। পাপড়ি অমিতের সঙ্গে পড়ত। অমিতদের মেসের কাছাকাছি একটা মেয়েদের
মেসে থাকত। একই সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াত করত। পাপড়িকে বেশ ভালো
লাগত অমিতের। অমিত বুঝতে পারত পাপড়িও তাকে পছন্দ করে। দু’একদিন ক্লাস
কেটে ভিক্টোরিয়াতেও ঘুরে এসেছে তারা। কিন্তু ভালোলাগার কথাটা কিছুতেই মুখে
বলতে পারছিল না পাপড়িকে। একদিন রাত জেগে মনের কথাগুলো লিখে ফেলেছিল
সুযোগমত পাপড়িকে দেবে বলে। মেসে ফিরে সেই চিঠিটাই ছিঁড়ে ফেলেছিল
অমিত। মেয়েদের থেকেও দূরে থাকতে হবে । বলা যায় না যদি মেয়েছেলের নেশাও
পেয়ে বসে তাকে।
এর পরে মা আর মাত্র মাস ছয়েক বেঁচে ছিল। দুরারোগ্য রোগে ধরেছিল
মাকে। অসহ্য যন্ত্রণা হত পেটে। ধীরে ধীরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে
আসছিল। ওজন কমছিল দ্রুত। তারা ভাইবোনেরা অনেক চেষ্টা করেছিল,কিন্তু
মাকে কিছুতেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়নি। শুধু একটা কথাই বলত-বেঁচে
আর কি হবে? শেষের দিকটায় বাবাও চেষ্টা করেছিল মায়ের চিকিৎসা
করার,ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য অনেক অনুনয়-বিনয়ও করেছিল কিন্তু মা
কিছুতেই রাজি হয়নি। জীবনে এই একবারই মায়ের জেদের কাছে হেরে গিয়েছিল
বাবা।
মায়ের কাজের পরদিনই চিরদিনের মত বাড়ি ছেড়ে এসেছিল অমিত। কোলকাতা
থেকেই খবর পেয়েছিল ওই বিধবা মহিলাকে ছেলেসহ বাড়িতে এনে তুলেছে
বাবা,মায়ের কাজের সাতদিনের মাথায়। বাবার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নেওয়া
আগেই বন্ধ করেছিল,বাড়ি যাওয়াও বন্ধ করে দিল। দিদিরাও তারপর আর
কোনোদিন ও বাড়িতে যায়নি। অমিত নিজে রোজগার করেছে,পড়াশোনা
করেছে,যথেষ্ট ভালো চাকরিও পেয়েছে। ভাইবোনেদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল
সবসময়েই। জামাইবাবুরা বেশ ভালো,প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পাশে থেকেছে
সবাই। ঝুমার সঙ্গে বিয়ের সব ব্যাবস্থা মেজদিই করেছিল। বিয়ের পরেই বাড়ি
করে অমিত। বাড়ি করার পর থেকেই প্রতি বছর ভাইফোঁটায় সবার মিলিত হওয়ার
ভাবনাটা ঝুমারই। ঝুমার কোনও দাদা বা ভাই নেই। তাই সেও অংশ নিতে পারে সবার
সঙ্গে।
বেশ ভালোই চলছিল সব। বউ ,ছেলে,মোটা মাইনের চাকরি –কোথাও কোনো
অপ্রাপ্তি ছিল না। সবরকম নেশাকে সযত্নে দূরে রাখতে পেরেছিল
সে। মদ,বিড়ি,সিগারেট,মেয়ে এমনকি চায়ের নেশাও নেই তার। কিন্তু সব কেমন
গোলমাল করে দিল অদিতি। আট মাস হল মেয়েটা তাদের অফিসে জয়েন করেছে
তার পি.এ হিসাবে। বছর ছাব্বিশ বয়স,অবিবাহিত। অনেক ভেবে দেখেছে অমিত
আলাদা আলাদা করে দেখলে মেয়েটিার চোখ,মুখ,নাক,ঠোঁট কোনটাই বিশেষ সুন্দর
এমন বলা যাবে না। অথচ সব মিলিয়ে এত সুন্দর লাগে যে চোখ ফেরানো
কঠিন। অমিতকে যেটা সবচেয়ে বেশি টানে সেটা হল ওর ঠোঁটের কোনে সবসময়
লেগে থাকা স্নিগ্ধ হাসি। অদিতিকে এই আট মাসে কখনও বিরক্ত হতে দেখেনি
অমিত। যত কাজই দাও আর যত সময়ই লাগুক সব হাসিমুখে করে দেয় মেয়েটা। তিন
মাসের মধ্যেই কথাগুলো অদিতিকে বলে ফেলেছিল অমিত,সেই কথাগুলো যেগুলো
পাপড়িকে বলতে গিয়েও বলতে পারেনি,মুখে বলতে পারবে না বলে চিঠিতে লিখেও
বাবার মত হয়ে যাওয়ার ভয়ে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলেছিল। অথচ কি আশ্চর্য অদিতির
বেলায় বাবার মত হয়ে যাওয়ার কথাটা মাথাতেই এলো না তার,এমনকি ঝুমার বা
তার সাত বছরের ছেলের কথাও একবার মাথায় এলো না!
“বেরোবে কখন?” ঝুমার প্রশ্নে সম্বিত ফিরল অমিতের।
চা খেতে খেতে এমনভাবে অতীতের চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল যে বেরোনোর কথা
খেয়ালই ছিল না তার। তাড়াতাড়ি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আটটা বাজে।
“ফ্লাইট কটায় তোমার?” ঝুমা জানতে চাইল।
“দুটোয়,বারোটার মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছোতে হবে।” বলতে বলতে বাথরুমে
ঢুকল অমিত। অফিসের কাজে তাকে প্রায়ই বাইরে যেতে হয় বটে,কিন্তু এবার
অদিতিকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে চেরাপুঞ্জি। ঝুমা অবশ্য জানে অফিসের কাজেই
যাচ্ছে।বেড়াতে যাওয়ার কথা বলতে একটা অদ্ভূত মুখভঙ্গী করে রাজি হয়ে
গিয়েছিল অদিতি। চাকরিতে উন্নতি কে না চায়! সকালে সেই মুখভঙ্গীরটা মনে
করেই হেসে ফেলেছিল আর তাতেই যত বিপত্তি। আজই সেই বেড়াতে যাওয়ার
দিন। চান করে ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা আঁচড়াতে গিয়ে নিজেকে
দেখে অবাক হয়ে গেল অমিত। নিজের চেহারাটা আয়নায় ভালো করে দেখল সে। পুরুষ
হিসাবে সে যথেষ্ট সুন্দর—প্রায় ছ’ফু্ট লম্বা,টকটকে ফর্সা,পেটানো
চেহারা। বাবার চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করল অমিত। অনেকটা তারই মত। দীর্ঘ
অনাচারে বাবার চেহারা অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছিল ঠিকই ,তবুও যথেষ্ট সুপুরুষ
ছিল মানুষটা। মা কিন্তু চেহারার দিক দিয়ে খুব সাধারণ ছিল,ছোটোখাটো
চেহারা,গায়ের রঙ কালো না হলেও শ্যামলা। বাবার সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে
রাখতে চাইলেও চেহারাটা যে বাবার মতই পেয়েছে এটা সে কোনোদিন ভেবে
দেখেনি। ভাবতে ভাবতেই বিছানায় শুয়ে থাকা ছেলের দিকে নজর গেল তার। ছেলেটা
এখনও ঘুমাচ্ছে। মাত্র সাত বছর বয়স,এর মধ্যেই অনেকটা লম্বা হয়ে
গিয়েছে,বয়স ছাড়া। ভালো করে খেয়াল করে দেখল অমিত,গায়ের রঙ তার চেয়েও
ফর্সা। ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা তীব্র ভয় চেপে ধরল
অমিতকে। কেমন যেন শ্বাসরোধ হয়ে আসতে লাগল তার। অমিত তাড়াতাড়ি
মোবাইলটা নিয়ে ডায়াল করল অদিতিকে। ফোন ধরে অদিতি কিছু বলার আগেই সে
বলে উঠল—“আমাদের টুরটা বাতিল করতে হল বুঝলে। পরে সব বলব। এখন
রাখছি।”বলে অদিতিকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই ফোনটা কেটে দিয়ে দেখল
ঝুমা দরজার কাছে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঝুমাকে যে কোনও
একটা কারণ বলে দিলেই হবে।

2 thoughts on “গল্পঃ অবদমন – পিন্টু ভট্টাচার্য

  1. বাহ্ …..খুব সুন্দর একটা গল্প পড়লাম । খুব ভালো লাগলো । অনেক শুভেচ্ছা রইলো ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *