ভ্রাম্যমাণ
ভূমিকা গোস্বামী
ও দিদি, দুধ লাগবে? দই? পাউরুটি? কী লাগবে ?
প্রতিদিন সকালে মিতার সাইকেলে ভাম্যমাণ মুদির দোকান দরজায় হাজির।
সকলের হেঁশেলের খবরও নখদর্পনে।
— মালাদি, ফ্রিজে ডিম আছে ?
— আর দু’দিন হবে।
— নিয়ে রাখ। আজকে কিন্তু পাঁচ টাকা ।
— ও সবিতাদি , জিরে-ধনে-পাঁচফোড়ন লাগবে নাকি কিছু ?
— হ্যাঁ হ্যাঁ, মিতাদি পাঁচফোড়ন দাও তো দু প্যাকেট।
মালার বাড়িতে এলে , আম-বকুলের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেয় ও। মালা প্লাস্টিকের টুলটা
এগিয়ে দিয়ে বলে– আগে বসো তো। জল খাও। রোদ্দুরে ঘুরে ঘুরে মুখ চোখের কি অবস্থা
হয়েছে।
ঝড় হোক, জল হোক বা বৃষ্টি , এমনকি আম্ফানের সময়েও এইভাবেই মিতার সাইকেলে
সকলের চাহিদা মত জিনিস হাজির ।
মাঝবয়সী স্থূলকায়া উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মিতা ওর মিষ্টি হাসি আর আন্তরিক
ব্যবহারে সকলের বড় আপনজন।
দশটা বছর- যখন হার্টের রোগ ধরা পড়ল পরমেশের, তখন থেকে এই পেশাতে এসেছে ও।
মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিল পরমেশ। বাইকে ঘুরে ঘুরে কাজ । একদিন রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে বাইক থেকে পড়ে গেলে পথ-চলতি মানুষ বাড়ি পৌঁছে দেয়। হাত-পা ভাঙেনি তবুও মিতা জোর করে পাড়ার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বেশ কিছু টেস্ট করার পর নিশ্চিত হন। পাশাপাশি অকালেই কর্মজগৎ থেকে অবসর।
প্রথমে দুজনেই খুব ভেঙে পড়েছিল। কীকরে চলবে সংসার! তার ওপর প্রতি মাসে প্রচুর টাকার ওষুধ।
তখন এই ভ্রাম্যমাণ দোকান করার কথা মাথায় এল । হাইস্কুলে পড়ার সময় কাকাই ওকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছিল। কষ্ট করে শিখেছে। হাত-পা কেটে বাড়ি ঢুকতো একএকদিন।
শহর থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে গাছপালা ঘেরা বড় বাড়ি ওদের। বাবা-কাকা-জ্যাঠা, জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো ভাইবোন। একান্নবর্তী পরিবার। আত্মীয়-স্বজনের সবসময় আসা যাওয়া। মা,কাকিমা, জেঠিমা তো রান্নাঘরেই বেশী সময় থাকতো।
বাইকটা বিক্রি করে একটা সাইকেল কিনেছিল। বাকী টাকায় ওদের ব্যাঙ্কের এ্যাকাউন্টের কিছুটা স্বাস্থ্য ফিরেছিল।
কমতো দেখল না এই দশ বছরে । কত ধরনের মানুষ।কোনদিন জানতো এত রকমেরও মানুষ হয়, যখন কেবলমাত্র ঘর সামলাতো!
আজ যখন সাইকেল দোকান নিয়ে শিব মন্দিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল , সূর্য তখন মধ্য
গগনে রোষ ছড়াচ্ছে। দেখল, ঘোষ বাড়ির দাদা মন্দিরের চাতালে শুয়ে আছেন। শুকনো মুখে সাদা সাদা দাড়ি। ডেকে বলল – ঘোষদা, এই গরমের মধ্যে এখানে কেন ? শরীর খারাপ করবে তো। বাড়িতে চলুন।
প্রায়ই ঘোষদার বাড়িতে খুব চেঁচামেচি হয় আজকাল। গতকাল গেটের কাছে সাইকেল
রেখে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ওর কানে এসেছিল
— বাবা, এখনও বলছি ভালোয় ভালোয়
বাড়িটা লিখে দাও।
— বুড়ো হয়েছেন। তিনকাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে এখনও বাড়ির মায়া ? ও যখন বলছে
লিখে দিন না। ছেলের বৌ এর ঝাঁঝালো কণ্ঠ ভেসে এল।
কলিংবেলে হাত রেখেও সরিয়ে নিয়েছিল।
কয়েক বছর আগেও ঘোষদাকে অফিস যেতে দেখেছে । বৌদির প্রয়োজনের জিনিস দিতে দিতে কত ধরনের গল্প হত। ভারী মিষ্টি স্বভাবের মানুষ ছিলেন বৌদি। সাধ করে একমাত্র ছেলের বিয়ে দিলেন ধুমধাম করে। মিতাও গিয়েছিল বিয়েতে।
হঠাৎ একদিন সকালে গিয়ে শুনলো বৌদি রাতেই মারা গেছেন। আগের দিনও ডাল, ব্যাসন, সরষের তেল দিয়ে এসেছে । কিচ্ছু বুঝতে পারে নি। বেশ কয়েকদিন মনটা খুব খারাপ ছিল বৌদির জন্য।
–কী হল ঘোষদা, উঠুন।
উঠে বসল ঘোষদা। ঘর্মাক্ত মুখ পাঞ্জাবির হাতায় মুছে নিল। অনেকটা স্বগোতোক্তির মতো ক্ষীণ কণ্ঠে বলল — বাড়িতে এর থেকে অনেক বেশি তাপ। অনেক বেশি। এ তাপ কিছুই না।
সাইকেলটা গেটের কাছে রেখে সটান ভেতরে গেল মিতা। কলিংবেলটা তিনবার বাজানোর পর ঘোষদার ছেলে বাবান দরজা খুলে গম্ভীর হয়ে বলল
— আমাদের কিচ্ছু লাগবে না।
— কিছু দিতে আসিনি। তোমার বাবাকে দেখলাম শিব মন্দিরে শুয়ে আছেন। তাই …
কথা শেষ করতে না দিয়ে অধৈর্য বাবান বলল – তো ? আমি কী করব ?
সময় হলে নিজেই আসবে। আপনি নিজের কাজে যান তো । অহেতুক বিরক্ত করবেন না।
— এটাও আমার কাজ। বাবাকে ঘরে নিয়ে এসো।
— কী ব্যাপার বলুন তো, আপনি কে, আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটারে কথা বলার?
— সেটা পরে বলছি। আগে বলি, তুমি তোমার বয়স্ক বাবার সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার কর।
— বাজে কথা। এই যে, যানতো!
— প্রমাণ ছাড়া কথা বলি না । গতকাল চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তোমার বাবাকে কী কী বলেছিলে সব কিন্তু আমার মোবাইলে রেকর্ড করা আছে। ভালোয় ভালোয় বাবাকে সসম্মানে ঘরে নিয়ে আসবে , না আমি ফারদার স্টেপ নেব।
— মানে
— মানে খুব পরিষ্কার । আমি চলমান দোকান সামলাতে সামলাতে সামাজিক কিছু কাজও
করে থাকি। আমি একটি এন জি ওর সঙ্গে যুক্ত আছি। কোথাও কেউ গৃহ হিংসার শিকার
হলে, বিশেষ করে সিনিয়র সিটিজেন, আমরা তার প্রতিবাদ এবং প্রতিকার করে থাকি।
অতএব বুঝতেই পারছ।
— আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন ?
— না, ভয় নয়, সাবধান করছি।
মাথা নিচু করে সিঁড়ির তলার দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে বাবান।
— দেখ বাবান, বাবা মা ছোটবেলায় তোমাকে কত যত্নে বড় করেছেন। পড়িয়েছেন। মা তো চলে গেছেন। বাবার অবর্তমানে সবটাই তো তোমারই ।
বৃদ্ধ বয়সে বাবাকে আরাম দেওয়া তোমার ধর্ম। যারা এই ধর্ম ভক্তির সাথে পালন
করে না, তাদের শাসন করতে বাধ্য হই আমরা। যাও, বাবাকে আদরের সাথে নিয়ে এস।
ঘোষদা বাবানের কাঁধে মাথা দিয়ে ঘরে ফিরলো।
সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখতে রাখতে তৃপ্তির হাসি হাসলো মিতা। এখনও অনেক কাজ
করতে হবে ওকে। অনেক কাজ।
কি করে এত স্বচ্ছল লেখেন তা আপনিই জানেন। প্লটও অসাধারণ। খুব ভাল লাগলো।
অনেক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
সামাজিক বার্তাসম্পন্ন খুব সুন্দর একটি গল্প । খুব ভালো লাগলো ।
ধন্যবাদ।প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
প্রীতি ও শুভেচ্ছা সহ ধন্যবাদ।
দারুন,অসম্ভব সুন্দর প্লট।
ধন্যবাদ। অনেক শুভেচ্ছা।
অসাধারণ।
পড়ে খুব ভালো লাগলো।