নিবন্ধঃ শক্তিপদ রাজগুরু : তাঁর প্রথম পথের পাঁচালি – মধুসূদন দরিপা

শক্তিপদ রাজগুরু : তাঁর প্রথম পথের পাঁচালি
মধুসূদন দরিপা

(প্রথিতযশা সাহিত্যিক শক্তিপদ রাজগুরুর জন্মশতবর্ষ স্মরণে)

তখন মার্চ মাস। শীত যাই যাই করছে। বসন্তের আমেজ চারদিকে। সময়টা দুপুর দুটো আড়াইটে হবে। শেয়ালদা ষ্টেশন থেকে খুলনা এক্সপ্রেসে উঠে পড়লেন মফস্বলের এক যুবা সাহিত্যিক। শক্তিপদ রাজগুরু। তখনও পার্টিশন হয়নি। ট্রেনটা ডাইরেক্ট খুলনা যেত। বনগাঁ স্টেশনে নেমে ব্রাঞ্চ লাইনে অন্য ট্রেনে উঠে পড়লেন তিনি। গন্তব্য গোপালনগর স্টেশন এবং সেখান থেকে হাঁটা পথে ছোট্ট এক গ্রাম –চালকে বারাকপুর। উদ্দেশ্য প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যলাভ ।

পড়ন্ত বেলা। গাছের পাতা ঝরছে। বাঁশবনে হলুদ পাতার ঝাড়। আমবাগানের ভেতর দিয়ে পথ। ডালে নতুন বোল এসেছে। সব মিলিয়ে শক্তিপদর মনে হ’ল এ জগতটা যেন তার খুব চেনা, খুব জানা। এ যেন বিভূতিভূষণের ভুবনবিদিত সেই পথের পাঁচালিরই জগৎ।

কাঁচা রাস্তা, ধূলিধূসর পথ পার হয়ে এসে পৌঁছালেন একটা বকুল গাছের তলায় এক তলা বাড়ির সামনে। পুরানো বাড়ি। কোনমতে মেরামতি করে দাঁড় করানো হয়েছে। বাড়ির বারান্দায় দেখলেন মাষ্টারমশাই বসে আছেন। শক্তিপদ বিভূতিভূষণকে মাষ্টারমশাই বলে ডাকতেন। তাকে দেখে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘ এসো এসো। খুব ভালো হয়েছে তুমি এসেছো। জানো, সকাল থেকে মনটা খুব খারাপ। ছেলেগুলো সব চলে গেল। ‘

শক্তিপদ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন। আসলে হয়েছে কি, বিভূতিভূষণ গোপালনগর স্কুলে মাষ্টারি করতেন। সেন্ট আপ ছেলেরা পরীক্ষা দিতে যাবে রানাঘাট সেন্টারে। যাওয়ার আগের দিন দুপুরে বিভূতিভূষণের বাড়িতে তাদের নেমন্তন্ন ছিল। একটু আগে তারা খাওয়া দাওয়া করে চলে গেছে। তাই মাষ্টারমশাই বললেন, ‘ এতদিন ওদের সাথে একসঙ্গে থাকলাম। এরপর কে কোথায় চলে যাবে, তাই মনটা বড়ই খারাপ। একা বসেছিলাম। তুমি এলে, বেশ ভালো লাগছে। ‘

বিভূতিভূষণের স্ত্রী বেরিয়ে এলেন। বাবলু মানে ওদের একমাত্র সন্তানের তখনও জন্ম হয়নি। বাড়িতে পোষ্য বলতে তখন ওঁর ভাগ্নী দুর্গা এবং এক ভাগ্নে, যার নাম শুটকে। এই শুটকেকে নিয়ে পরবর্তীকালে তাঁর অনেক কাহিনি আছে। শক্তিপদ ওঁর স্ত্রীকে এই প্রথম দেখলেন। দু’জনায় কুশল বিনিময় হ’ল । শক্তিপদর মনে হ’ল, ওঁর সঙ্গে এই প্রথম পরিচয় নয়, বরং যেন বহুকালের চেনা।

বিকেলে চা মুড়ি খেয়ে বিভূতিবাবু বললেন, ‘ চলো একটু বেড়িয়ে আসি। তোমাকে ইছামতীর ঘাট, নীলকুঠির মাঠ দেখিয়ে নিয়ে আসি। ‘

সাধারণত গ্রামে গেলে লোকে বলে, ‘ চলো আমার ঘর দেখবে, গোয়াল দেখবে, পুকুর দেখবে। ‘ কিন্তু বিভূতিবাবু যেগুলি সবচেয়ে প্রিয় — সেই ইছামতীর ঘাট, নীলকুঠির মাঠ দেখাবার জন্য তিনি কতো উদগ্রীব। চিরকালের ভালোবাসার মানুষটার প্রতি শক্তিপদর মন যুগপৎ বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে উঠল। দু’জনায় বেরোলেন একসঙ্গে।

ইছামতীর ঘাট । শান্ত, স্তব্ধ তার দুই তীর। লতাপাতায় ঘেরা। ঘাট ছাড়িয়ে পাওয়া গেল নীলকুঠির মাঠ। এক বিরাট প্রান্তর। এক কালে ইংরেজরা সেখানে নীল চাষ করতো, তাই এই নাম। এখন কিছু নেই। কয়েকটা ভাঙা বাড়ি মাত্র। মাঠের মাঝখানে একটা কুল গাছ। তাকে জড়িয়ে সুবর্ণলতা, ঠিক যেন সোনার গুচ্ছের মতো।

শক্তিপদকে সেই গাছটার কাছে নিয়ে এসে বিভূতিবাবু বললেন, ‘ ঢুকে পড়ো । ‘ শক্তিপদ গ্রামের ছেলে। লতাপাতা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন । বললেন, ‘ দুটো বকড়ো আছে দেখ, বার করো। ‘

বকড়ো মানে তাল গাছের পাতার প্রথম দিকটার কিছুটা অংশ, বসার জন্য। শক্তিপদ ভেতরে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, সত্যি সত্যি দুটো বকড়ো রাখা আছে। বের করে এনে বিভূতিবাবুর হাতে দিলেন । উনি একটা বগলে নিলেন, শক্তিপদ একটা । বললেন, ‘ চলো। ‘ অতি সামান্য একটা প্রাকৃতিক উপাদান সেই মুহূর্তে শক্তিপদর কাছে অত্যন্ত মহার্ঘ এক সম্পদ বলে বোধ হ’ল।

নীলকুঠির মাঠ ছাড়িয়ে দু’জনায় চললেন বাঁওড়ের দিকে। সেখানে গিয়ে দুটো বকড়ো পেতে বসা হ’ল। তখন পড়ন্ত বিকেল। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। তার রক্তবর্ণ আভা পড়েছে বাঁওড়ের জলে। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে বাসায়। পরিবেশ শান্ত হয়ে আসছে। বাঁওড়ের জলে নৌকো ভাসছে। সব মিলিয়ে সে এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য।

কতক্ষণ যে বসে আছেন দু’জনায় ঠিক নেই। বিভূতিবাবু ধ্যানমগ্ন । ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হ’ল। অন্ধকার নেমে এল। শক্তিপদ তো মশা মারছে হাত চাপড়ে। কিন্তু মাষ্টারমশাইয়ের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। অনেকক্ষণ পর তাঁর ধ্যানভঙ্গ হ’ল। ধীরে ধীরে উঠলেন।

বকড়ো দুটো বগলে নিয়ে গ্রামের দিকে ফেরা শুরু হ’ল । সেগুলো আবার যথাস্থানে রেখে দেওয়া হ’ল। মাঠের পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাত্‍ দেখা গেল, দূরে বাঁশবনে আগুন লেগেছে। আগুন দেখে বিভূতিবাবু চটে উঠলেন । চিৎকার করে নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। সম্ববত কানাই নামে একটি লোক একটু বাদে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল। বিভূতিবাবু তাকে বললেন, ‘ এ কী সর্বনাশ করেছো তুমি। বাঁশের বনে আগুন লাগিয়ে দিলে। ‘

লোকটি বললো, ‘ শুকনো পাতার ডাল ছিল। পুড়িয়ে ভালো সার হবে। তাই আগুন লাগিয়েছি দা’ঠাকুর। ‘

মাষ্টারমশাই বললেন, ‘ সে না হয় ভালো করেছো। কিন্তু অমন সুন্দর ঘেঁটু ফুল ফুটেছিল সারি সারি। সেও যে পুড়ে গেল। তুমি তো সাংঘাতিক লোক। সামান্য দু’টো শুকনো বাঁশ, তার জন্য অমন সুন্দর ঘেঁটু ফুলগুলো নষ্ট করে দিলে। ‘

মানুষ সোনাদানা, টাকাকড়ি, বিষয়-আশয় হারালে আক্ষেপ করে। কিন্তু বিপুলা এ বসুন্ধরার মাঝে অতি অযত্নে লালিত নেহাতই তুচ্ছ দুটো ঘেঁটু ফুল নষ্ট হওয়ার জন্য এমন অকৃত্রিম আক্ষেপ, এমন হৃদয় নিকষিত-আকুলতা একটা মানুষ কিভাবে পেতে পারে? অনেক অনেক দিন ধরে একনিষ্ঠভাবে প্রকৃতির সেবা না করলে বোধ করি পরমাপ্রকৃতির এমন দুষ্প্রাপণীয় কৃপা, এমন সুদুর্লভ উপলব্ধির প্রাপ্তি জন্ম জন্মকাল ধরেও অর্জন করা সম্ভব নয়। গভীর বিস্ময়ে শক্তিপদর বিমুগ্ধ মানস পরমাপ্রকৃতির সঙ্গে বিভূতিবাবুর এমন একাত্ম সম্বন্ধ, এমন নিগূঢ় বন্ধনের দিব্য দর্শনে এক অপার অনন্ত রূপসাগরে ডুব দিল।

তখন ঘন অন্ধকার হয়ে আসছে। বাড়ি ফিরেই বিভূতিবাবু লিখতে বসলেন। তিনি তখন ‘ দেবযান ‘ লিখছেন। অতীন্দ্রিয় অনুভূতির উপর লেখা। শক্তিপদর মনে হ’ল, তার মাষ্টারমশাই লিখতে নয়, যেন আবারও একবার ধ্যানে বসলেন। বিকেলে যেমন বসেছিলেন বাঁওড়ের ধারে। এক মেরুতে ঈশ্বর, অন্য মেরুতে মানুষ। কেন্দ্রে প্রকৃতি। সেই প্রকৃতি — বিভূতিভূষণের ভাষায় যা তাঁর ‘ বড়ো এক বিশল্যকরণী — মৃত মূর্ছিত চেতনাকে জাগ্রত করতে অত বড়ো ঔষধ আর নাই। ‘

বিভূতিভূষণ ভোজনরসিক ছিলেন। খেতে এবং খাওয়াতে ভীষণ ভালোবাসতেন। সেদিন রাতে মুগের ডাল, লুচি ও অন্যান্য ব্যঞ্জন সহকারে এক অখ্যাত তরুণ সাহিত্যসেবীকে তিনি যেভাবে পরম সমাদরে আপ্যায়িত করলেন, শক্তিপদর কাছে তা ছিল অভাবনীয়। খেতে খেতে এক সময় মাষ্টারমশাই বলে উঠলেন, ‘ মুগের ডালটা খেয়ে দেখো । যেন খাতি ক্ষীরের মতো স্বাদ। ‘ উচ্চারণটা যশোরের মতো। ‘ই’-কার টা বেশি।

রাত গভীর হচ্ছে। বিভূতিবাবু শুয়ে পড়েছেন। শক্তিপদর চোখে ঘুম নেই। সামনের বারান্দায় বসে অগণিত নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে এক অসাধারণ মানবের মাত্র কয়েক ঘন্টা অমৃত সান্নিধ্যলাভের তৃপ্তি উপভোগ করছেন মনে মনে নিবিড় অনুভবে। অবিস্মরণীয় সেই মাহেন্দ্রকালে শক্তিপদর জীবনে অযাচিতপ্রাপ্তি এই ‘ প্রথম পথের পাঁচালি ‘ এক মহাকায় গুরুর আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে যেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা পেল তার মানস। নবচেতনায় নব প্রাণে শক্তিপদ উপলব্ধি করলেন —‘ জীবনসাধককে জীবনানুবর্তী হতে হয়। ক্ষুদ্র-বৃহৎ, তুচ্ছ-মহৎ, বিরোধী-অবিরোধী — সব কিছুকেই সমান প্রসন্নতার সঙ্গে গ্রহণ করতে শিখতে হয়। ‘

পরমাপ্রকৃতির রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ অনুভবে ধন্য গুরু বিভূতিভূষণের উপলব্ধ প্রজ্ঞার ফুল-বেলপাতা দিয়েই শিষ্য শক্তিপদ কৃতজ্ঞচিত্তে নিরন্তর সুধানিস্যন্দিনী সেই মায়াবী নিশীথকালে কায়মনোবাক্যে অর্চনা করলেন লৌকিক-অলৌকিক সৃজনশিল্পের স্রষ্টার পাদমূলে —

‘ নিজেকে দিয়ে বুঝেচি তুমি কতো বড়ো শিল্পী । নিজের দৃষ্টি দিয়ে বুঝেচি তুমি কতো বড়ো স্রষ্টা। ‘


তথ্যসূত্র : এই নিবন্ধটি বিগত 11 নভেম্বর 1994 সকালে কলকাতার দমদমে শক্তিপদ রাজগুরুর বাড়িতে রেকর্ড করা স্মৃতিচারণ অনুসরণে অনুলিখিত ।

5 thoughts on “নিবন্ধঃ শক্তিপদ রাজগুরু : তাঁর প্রথম পথের পাঁচালি – মধুসূদন দরিপা

  1. খুব অসাধারণ স্মৃতিচারণকে আপনিও খুব সুন্দর করে লিখেছেন । অতীত যেন মূর্ত হয়ে উঠল। কোনও ত্রুটি চোখে পড়ল না ; শুধু মাষ্টারমশাই কথাটায় ষ -টা ছাড়া । স হবে। উপস্থাপন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত আমি মন্ত্রমুগ্ধ ছিলাম । বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃতিপ্রীতি সম্পর্কে একবার কথাসাহিত্য পত্রিকায় সম্ভবত স্ত্রী রমা বন্দ্যোপাধ্যায় ( তখন জীবিত ছিলেন ) বলেছিলেন , তাঁদের রান্নাঘরে প্রবেশ-প্রস্থানের মুখে একটি বিছুটিলতার গাছ ছিল ; সেটা যেন তিনি ( বিভূতিভূষণ) কেটে দেন । উত্তরে বিভূতিভূষণ বলেছিলেন , কেন ? বরং একটু গা বাঁচিয়ে চললেই তো হয় !
    আর একটা বিষয় মনে আছে , কাজ থেকে ফিরে বিকেলের দিকে তিনি সমীপস্থ একটা বাঁশ- বাগানের কাছে গিয়ে বসতেন ।
    আপনার এই লেখাগুলি নিয়ে একটা সংকলন করবেন ।

  2. কি অসাধারণ লিখেছেন। জানা ছিল না। আর শক্তিপদ রাজগুরু কে সবাই তো ভুলে যেতেই বসেছে। মেঘে ঢাকা তারা র অসাধারণত্ব নিয়ে কত আলোচনা। অথচ তার লেখকের কথা কেউ বলে না। ভাবা যায়, এই শক্তিপদ রাজগুরু এক সময় কি জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। তাঁর লেখা গল্প নিয়ে হিন্দি সব সুপারহিট ফিল্ম এখনও জনপ্রিয়। এই প্রবন্ধের লেখক কে হিংসে হচ্ছে। তিনি তাঁর সাক্ষাত্কার নেবার সৌভাগ্যে সৌভাগ্যবান।

  3. কি অসাধারণ একটা লেখা। এক সময়ের জনপ্রিয় সাহিত্যিক শক্তিপদ রাজগুরু কে এখন সবাই ভুলে যেতে বসেছে। মেঘে ঢাকা তারা সিনেমার অসাধারণত্ব নিয়ে সবাই আলোচনা করে। কেউ তার লেখকের নাম করেন না। জানেনও না। তাঁর কত লেখা নিয়ে সুপার হিট হিন্দী বাংলা সিনেমা হয়েছে। যা এখনও জনপ্রিয়। তাঁর ছোটদের গল্প বার্ষিকী গুলোতে পড়ার জন্যে ছেলে মেয়েরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। লেখককে হিংসে হয়, তিনি কাছে থেকে তাঁকে দেখে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সৌভাগ্যে সৌভাগ্যবান ছিলেন।

Leave a Reply to Mousumi Mondal Debnath Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *