মুক্তগদ্যঃ গ্রামের রবীন্দ্রনাথ – ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

গ্রামের রবীন্দ্রনাথ
ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

আামার শৈশব কৈশোর কেটেছে হুগলী জেলার বাজুয়া গ্রামে। আমার মা সেখানকার গার্ল স্কুলের “বড়দিদিমণি” হয়ে আমাদের নিয়ে বসবাস করতে এলেন। আমরা তিন ভাইবোনই ঠাঁই পেলাম “গাছতলার” “পেরাইমারি ইস্কুলে”। গাছ তলায় বলার কারণ স্কুল চলতো “বয়েজ ইস্কুল” এর হোস্টেলের বারান্দায়। আর “থিরি” “ফোওর” এর ক্লাস বসত বারান্দার সামনে আম গাছতলায়। সামনে ছিল বিশাল ‘পাতাল দিঘি’। বেশ মনোরম পরিবেশ। এখন বুঝি আশ্রমের মতো খানিকটা। শুধু পিঁপড়ে কামড়ে অস্থির করতো। সেই স্কুলের শিশু শ্রেণীতে আমার , দাদার ওয়ানে আর দিদির থ্রি বা ফোরে পড়াশোনা শুরু হল। মাস্টারমশাইরা যদিও বেত্রাঘাত করার সামান্য সুযোগও ছাড়তেন না। কিন্তু রবীন্দ্র জয়ন্তী হতো। ক্লাস থ্রির আগের স্মৃতি বিশেষ নেই। তবে এরকমই এক রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আমার দিদি( আট
বছর বয়স হবে) নেচে ছিল। আর আমরা দু’বোন ‘আমরা সবাই রাজা’ গেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা নতুন তায় দিদি দেখতে একেবারেই সায়েবী।মাস্টার মশাই রসিকতা করে বলে বসলেন ” নাচিয়ে ভালুক”
ক্লাসের অন্য বাচ্চারাও খুব জ্বালাতন করল ক’দিন। দিদি সার ছেলেবেলাটাই ঐ মানুষটার ওপর রেগে থাকতো। সেই প্রত্যন্ত গ্রামে রবীন্দ্র চর্চার সাথে পরিশীলনের সম্পর্ক শিক্ষকই বোঝেননি তার আবার ছাত্রছাত্রীরা। ওই স্কুলেই প্রত্যেক সপ্তাহে ছুটির একটু আগে বসত সাহিত্য সভা। প্রতি শনিবার নাটিকা হতো আবৃত্তি হতো। এক শনিবার “গেছোদাদা” তো পরের শনিবার “অমল ও দইওয়ালা”। আমার সমবয়সী পাঠক নিশ্চয় “কিশলয়” পড়েছেন। এই নাট্যাংশ গুলো তাই তাঁদের চেনা হবার কথা আবৃত্তি হতো প্রার্থনা,তালগাছ, দামোদর শেঠ। ‘বর এসে বীরের ছাঁদে’ আবৃত্তির সময় ‘মাথায় মারলে গাঁট্টা’,’শালীর সঙ্গে ক্রমে ক্রমে আলাপ যখন উঠল জমে’ বললেই কিছু ছেলে হাসতো। এ ছাড়াও কয়েকটা কবিতা বা ছড়া ‘বলা’ হতো। প্রার্থনা আবৃত্তির সময়ে হাত জোড় করে বুকের কাছে রেখে সামনে পেছনে দুলতে হতো। আবার তালগাছ বলার সময় এক পা তুলে অন্য পায়ের হাঁটুর পাশে ঠেকিয়ে রাখতে হতো। বর এসেছে বীরের ছাঁদে তো পুরেটাই অভিনয় করে দেখাতে হতো শুধু গাঁট্টা টা মাঠে মারা যেত বাতাসে মারতে হতো বলে। একই অনুষ্ঠান দিনের পর দিন হত বলে কারো উৎসাহের কোনো কম ছিল না। গাছের জবাফুল, কল্কে ফুল, নয়ন তারা, কাঠচাঁপার ‘গোরের মালা’ গন্ধরাজ,অপরাজিতা মানে যার বাড়িতে যা আছে তাই দিয়ে সেজে উঠতো বেঁটে ডেস্ক, আর রবি ঠাকুরের ছবি। “গার্লস”আর “বয়েজ”এর বড়দিদিমণি( আমার মা) আর ‘হেডস্যার’ আসতেন মাঝে মাঝে। রবি ঠাকুর সম্বন্ধে কিছু বলতে অনুরুদ্ধ হতেন দুজনেই। কোনো কোনো শনিবার স্কুলের সেক্রেটারি আসতেন। তিনি আবার ” কর্ণ কুন্তি সংবাদ” আবৃত্তি করে তবেই যেতেন। এখন ভাবি সেই সাহিত্য সভার সব আয়োজনই ছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। একবার রবীন্দ্র জয়ন্তীতে নাইন/ টেনে পড়া একটি মেয়ে (গ্রামেরই গানের শিক্ষকের কাছে গান শিখছে) “চাঁদের হাসির (হাঁসি বলেছিল মনে আছে) বাঁধ ভেঙেছে” গাইতে গিয়ে ভুল করে বললে ‘ও রজনী গন্ধা তোমার গন্ধ দুয়ার খোল।’ কেউ ধরতেই পারল না। আমার মা পরে মেয়েটিকে যখন বলেছিল সে তো বিশ্বাসই করতে চায়না যে মাস্টারমশাই ভুল গান তুলিয়েছেন। তার খাতায় লেখা আছে যে। আমি যখন এসে আমার মায়ের স্কুলে ভর্তি হলাম ততদিনে আমার মায়ের পরিচালনায় “লক্ষ্মীর পরীক্ষা” অভিনীত হয়ে গেছে। সেই নাটকের আবার পুনরাভিনয় হয়েছিল স্কুলের বাইরে গ্রামের কোন একটা ফাংশানে। এই স্কুলজীবনে ধীরে ধীরে নাটকে আমার বেশ নাম হতে থাকে। বাইরের গ্রাম থেকেও অনুরোধ আসতো মায়ের কাছে যাতে তাদের নাটকে অথবা যাত্রায় আমি অভিনয় করি। আমাদের সেই গেছোদাদা, অমলের পাঠের সাথে ‘দুইবিঘা জমি’, ‘বীরপুরুষ’, ‘দেবতার গ্রাস’ ‘পুরাতন ভৃত্য’ ‘নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ’ যোগ হয়েছে অনেক আগেই। গান আবৃত্তি আর অভিনয়ে আমরা দুইবোন তখন বেশ মজে আছি। সন্ধেবেলা আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে গানের আসর বসতো। আমার মা হারমোনিয়াম বাজানোয় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বাবা থাকলে সমবেত কন্ঠে ‘আমার সোনার হরিণ চাই’ ‘ ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বাল’, ‘ এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে ‘ ইত্যাদি গান হতো। বাড়ির বারান্দায় বেশ কয়েকজন প্রতিবেশি আর পথ চলতি মানুষ এসে জড়ো হতেন।আমার তখন পরিচিতি হচ্ছে ‘বিরাট ভাল পার্ট করে’ বলেও। তবে গ্রামের মাস্টার মশাইরা কেন ভুল সুর ভুল কথায় গান শেখাতেন বুঝতাম না। মোর বীণা উঠে কোন সুরে বাজি গানটা আমি নিজের চোখে দেখেছি লেখা আছে মোরবিনা ওঠে আর কোন নব ছন্দন ছন্দে। । একবার বিট এডের প্র্যাকটিস টিচিং এ একজন মাস্টার মশাই এলেন। গলার আওয়াজ বেশ ভরাট। ‘ মলিন মুখে ফুটুক হাসি’ গানটার বেশ কয়েক জায়গায় নিজের মতো সুর করে নিয়েছেন। মনে নেই বলেই হয়তো। মা তাঁকে কিছুতেই ঠিক সুরটি তোলাতে পারলেন না কারণ মায়ের ওই গানটা শেখা নেই। রেডিওতে তক্কে তক্কে থেকেও শোনা গেলনা। শেষটায় যেটুকু ঠিক আছে সেটুকুই গাইলেন ঐ মাস্টারমশাই আমাদের সেই প্রায়শ্চিত্ত নাটকে।হয়তো রেডিওই একমাত্র ভরসা ছিল বলে তখন তাই এমন হতো। নইলে মানুষগুলোর চেষ্টার কোনো ষভাব ছিল না।
তবে আমার মায়ের হাত ধরে আর আমার বাবার পরামর্শে আমাদের সেই গ্রাম জীবনে প্রবেশ করল রবীন্দ্র নাটক আর ঠিক সুরে ঠিক কথায় রবীন্দ্রগান। বাংলাদেশ গঠনের পর আর মুক্তি যুদ্ধের সময় আমি ও আমার দিদি বেশ কয়েক জায়গায় ‘ আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে বেড়ালাম। অনেকে সে গান শিখেও নিয়েছিল। আমাদের বাড়ির রবীন্দ্র রচনাবলী আর তিন খন্ডের গীতবিতান থেকে গান, কবিতা আর নাটকের পার্ট লিখতে আসতো আশেপাশের গ্রামের মেয়েরাও। কারণ হাইস্কুল সব ঐ আমাদের গ্রাম বাজুয়ায়। স্কুলে মেয়েদের অনেক দেশাত্মবোধক গান শেখানো হয়ছিল।
একবার ‘ প্রায়শ্চিত্ত’ নাটক আমরা অভিনয় করলাম স্কুলের সরস্বতীপুজোয়। আমি ধনঞ্জয় বৈরাগী। শেষ দৃশ্যে দর্শক উঠলো না। বলল ‘আবার কর।’ আবার অভিনয় হল। হাত তালি আর থামে না। আমার মা বললেন ” কে বলেছে গ্রামের মানুষ ভাল জিনিস বোঝে না?”
পরে আবার আমরা এলাম কলকাতার কাছের এক গ্রামে। সাউথ গড়িয়া বেশ উন্নত গ্রাম। ভুল সুর ভুল কথার কোনো বিপত্তি এখানে নেই। পুরনো অভিনেতা দুর্গাদাস ব্যানার্জির গ্রাম।এখানে দুর্গা দাস স্মৃতি সংঘের উদ্যোগে ‘বিসর্জন’ অভিনয় হল। রাণী গুণবতীর অভিনয় করেছিলাম। সবার খুব ভাল লেগেছিল।
থাকি সোনারপুরে গ্রাম নয় তবে গ্রামের পরিবেশ এখনো আছে। বছর পঁচিশ আগের কথা, কয়েকজন বেড়াতে এসেছেন আমাদের বাড়ি। সতের / আঠার বছরের একটি মেয়েকে তার দিদি, মা আর জামাইবাবু মিলে গান শোনাতে বললেন। সে তার দিদির মুখে চেয়ে জানতে চাইল “দিয়ে গেনু টা করব নাকি সহচরী”? তার পর সে নিজেই বললে, “দুলেছিনু টা করি।”
শেষ করি এই করোনা কালের আগের একটা ঘটনা দিয়ে। একজন সংগীতজ্ঞ স্যারের কাছে আমরা ক’জন একটু গানবাজনা শিখি। আমরা সহকর্মী একে অন্যের। গানের ক্লাসে অনেক মজা হয়। একজন মহিলা খুবই উৎসুক হয়ে শোনেন আমরা কী শিখছি, কী গাইছি, কে কী পারছি না ইত্যাদি। স্যার আমাকে আর একজনকে রবীন্দ্রসংগীতই শেখান। ভাল পারলে খুব প্রশংসা করেন। একদিন ঐ ভদ্রমহিলা অনুযোগ করলেন, “স্যার আপনি আমাকে ঐ ডালপালা গানটা এখনো দিলেন না, ওদের কব্বে দিয়েছেন।” স্যারতো বুঝতে পারছেন না। আমার কিনা এসব অভিজ্ঞতা বিস্তর তাই বললাম, “সহসা ডালপালা তোর উতলা যে?” মাথা জোরে ঝাঁকিয়ে তিনি সম্মত হলেন। স্যারও ততটাই মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন “ওটা তুমি পারবে না। ওর জন্য গায়কী লাগে। আগে ক’বছর আমি যেমন দিচ্ছি সেগুলোই শেখো। ভদ্রমহিলা একটু রেগেই গেলেন। বললেন, “রবীন্দ্র সংগীতগুলো বড্ড শক্ত।”

5 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ গ্রামের রবীন্দ্রনাথ – ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

  1. খুব ভালো লাগল। সত্যি ছোটবেলায় কত ভুল শব্দের গান বুঝতাম আমরা। পরে আবার ঠিক করে দিত বড়রা।

  2. খুউব ভালো লাগলো । ছোটবেলা রবিবেলা অত্যন্ত সহজভাবে তুলে ধরেছেন লেখিকা । শুভেচ্ছা জানাই

  3. পড়লাম। আপনার লেখা নিয়ে আসলে সেভাবে বলার কিছু থাকে না। প্রত্যেকটি লেখাই অত্যন্ত মনগ্রাহী। বিষয়টা বেশ সুন্দর। সত্যি তো গ্রামের রবীন্দ্রনাথ, ছেলেবেলার রবীন্দ্রনাথ, এবং স্কুলের রবীন্দ্রনাথকে আমরা যেন অন্যভাবে পাই। সে পাওয়া যেন হৃদয়কে অন্যভাবে দোলা দিয়ে যায়। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। কত ঘটনাই না ঘটে রবীন্দ্রজয়ন্তী কে ঘিরে। এখনকার ছেলেরা আর সেভাবে রবীন্দ্রনাথকে পায় না। জানি না গ্রামের দিকে কিভাবে পালন করা হয়।

  4. ভালো লাগলো । নির্ভেজাল জীবনের ছবি । বিশ্বস্ত সুন্দর ও আন্তরিক।

    1. ভাবতে অবাক লাগে এখনকার শৈশব করোনার যাঁতাকলে এই নির্ভেজাল আনন্দ থেকে বিরত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *