ভোটার
অলকানন্দা ঘোষ সেনগুপ্ত
ও সমু, সমু রে ! তোর ভাত কি ফুটল রে বাপ ! দুদিন দানাপানি পাইনি। যন্ত্র টা যে আর চলে না রে ! সমু, কোথায় গেলি বাপ?
সকাল থেকে এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে চলা কবিরুল গাজীর বাড়িতে গেট খুলে ঢুকে একটু থমকালো ইয়াস্মিন ! উঠোনের উনুনে আঁচ পড়েনি বেশ কদিন হল, বোঝা যাচ্ছে ! তবে যে গাজী চাচা সমুকে ডেকে চলেছে সকাল থেকে ভাতের আশায়? পুকুরঘাট, বাগান আর কুয়োতলা ঘুরেও সমু কে দেখা গেল না। আশ্চর্য! এই বুড়ো মানুষটা কে রেখে গেলই বা কোথায়? সমুর ঘরও তো তালা দেওয়া ! দাওয়ায় উঠে চাচার ঘরে উঁকি দিয়ে দরজা ঠেলতেই একটা গন্ধ এসে নাকে লাগল। বেশ কয়েকদিন ঘরের থেকে বেরতে পারেনি মানুষটা, ঘরের মধ্যেই সব কাজকর্ম হয়ে গেছে, গন্ধেই মালুম হচ্ছে! প্রথম চোটে গা টা গুলিয়ে উঠলেও এভাবে মানুষ টাকে ফেলে যাবে কি করে? সমু টাতো চিরকালের কাজ পালানো ছেলে। আঁচল টাকে গাছকোমর করে পেঁচিয়ে গাজী চাচার কাছে এসে দেখল, একটা পাত্রে নেতিয়ে যাওয়া কবেকার মুড়ি, বোতলে প্রায় শেষ হওয়া জল কাত হয়ে আছে। তারই মাঝখানে চাচা পেচ্ছাপ, পায়খানা করে পড়ে আছে। তাকে দেখে মনে করল সমু এসেছে,
আবার শুরু হল ভাত খাবার বায়না ! ডেকে ডেকে সাড়া পেল কিন্তু চোখে ভাষা নেই, অবস্থা সুবিধের নয়, ইয়াস্মিন চট করে বাড়ি থেকে একটু নুন চিনির জল নিয়ে এল। গাজী চাচাকে ধরে বসালো চৌকির ওপর। সমুর হাত থেকেই মনে করল কিনা বোঝা গেল না, এক নিশ্বাসে জল শেষ করে বলল, বেঁচে থাক বাপ! তার নিজেরই বমি পাওয়ার জোগাড় ! তাড়াতাড়ি হাতে কুয়ো থেকে জল এনে পরিষ্কার করে দড়িতে টাঙানো লুঙ্গি জড়িয়ে নামিয়ে আনল সেখান থেকে। দাওয়ায় রাখা শুকনো নারকেল পাতা পেতে বসিয়ে দিতে মনে হল, দুর্বল খুবই কিন্তু তবুও একটু হয়তো বল পেয়েছে।
আজ আমারে চিনতে পারতেচ না চাচা, কি হল তোমার? তোমার পাশের চালের ইয়াস্মিন? সাবির মণ্ডলের মেইয়ে? সম্বিত ফিরে পাবার মত হল বটে, তবে গাজী খোঁজ করে সাবিরের। হায় কপাল! সে তো কবেই কবরে ফুল হয়ে ফুটেছে গো চাচা ! মাটি দেওয়া তো তোমাদেরই হাতে ! এত ভুল হল কি করে হয় তোমার? কথা বলে, আর ঘরের চৌকির ময়লা ঘাটের চাতালে রেখে রেখে আসে। ঘর পরিষ্কার তো হল, তবে কোন কিছুই পাওয়া গেল না চৌকিতে বিছানোর মত। অগত্যা ঘরের কোণে ভাঁজ করে রাখা দুটো চটের বস্তাই বিছিয়ে দিয়ে আবার ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিল চৌকির ওপর। এবার তো কিছু খাওয়াইতে হয় মানুষ টা রে ! তার নিজের ভাতে ভাত ফোটানো বাকি আছে, তার সাথেই আজ চাচার চাল নেবে। গাজী কে সেকথা বলে উঠোনে নেমে এল, গুলঞ্চ লতার বেড়ার পাশ দিয়ে পাশের চালা ঘরটায় ঢুকে পড়ল। কি জানি, কবে থেকে এভাবে আছে পড়ে ! একসময়ের হাঁকডাক করা ডাকাবুকো মাঝি, সাহস আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য তাকে এই তল্লাটের নেতা মানত সবাই – আজ দেখলে বোঝার উপায় নাই।
সকাল থেকেই চাচার একটানা সমুকে ডেকে যাওয়ার আওয়াজ পেয়েই না সে গেছে ও বাড়িতে। যাক, তবু তো সে গিয়ে পড়েছে সেখানে সময়মতো !
. যত তাড়াতাড়ি পারে একটু ভাত , আর গাছের থেকে পাড়া আনা কাঁচকলা সিদ্ধ, কলমি শাক ভাজা একটু নুন থালায় বেড়ে নিয়ে পাশের চালার দাওয়ায় উঠতেই, ভটভট শব্দে ভ্যান রিক্সায় চারিদিকে ধোঁওয়া আর আওয়াজ তুলে প্রায় জনা পনরো লোকজন হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল কবিরুল গাজীর উঠোনে। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, চোঙা প্যাণটরা সব দাওয়ায় ওঠার জোগাড়, কবিরুল গাজীর নামও নিল কে যেন ওদের মধ্যে। আর সবার পিছনে মুখে পান দিয়ে সমু। হাবভাব পালটে গেছে । প্রথম চোটে ভেবেছিল চাচার ঘরে ওদের ঢোকা আটকাতে হবে , কিন্তু সমুকে দেখে থেমে গেল।
দলবল ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে গাজীচাচার ঘরে। দুদিনের অভুক্ত মানুষটা রে অনেক কিছু বোঝায় ওরা, সপ্তাহ দুয়েক বাদে সবাই যখন ভোট দেবে তাতে যে তারে হেঁটে যেতে হবে না, তার কুঁড়ে ঘর থেকে ওরা ভ্যান রিক্সা করে আগেই নিয়ে যাবে, লাইন তো দিতেই হবে না, তাও ভাল করে বোঝানো হল। কোন চিহ্ণে ছাপ দিতে হবে তা বারবার করে তা দেখানো হল। দরজার ফাঁক দিয়ে ইয়াস্মিন পষ্ট দেখল কাকার ফ্যালফ্যাল চোখে এদিক ওদিক তাকানো, হয়তো ভাতেরই আশায় ! আদাব করে সকলে বেরিয়ে যাবে, সেইসময় গাজীচাচার চোখে পড়ে গেল সমু, আবার তাকে দেখেই গাজীচাচা বলে উঠল দানাপাণি কিছু দে রে বাপ ! এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না সে। বলে উঠল উনি দুদিন কিছু খাননি, খুব দুর্বল, আপনারা যদি দাওয়ায় বসেন তো ওনারে দুটো খাওয়াই।
ইয়াস্মিনের গলার তীক্ষ্ণতায় মূহুর্তের জন্য থেমে গেল সব আওয়াজ , সবাই বড় অবাক হল, সমুকে কেউ জিজ্ঞাসাও করল কেন ওনার খাওয়া হয়নি, হাল্কা বকাবকিও হল সমুর প্রতি। সমু জানালো সব ব্যবস্থা নাকি করেই সে বাইরে গেছিল, এর বেশি করতে গেলে দলের কাজ করা যাবে না। সবাই জানে পরিবারের থেকে দল বড়, ইত্যাদি …. ! সবাই অস্ফুটে সমর্থনও করল, কিন্তু দলের পাণ্ডা লম্বা চওড়া মত লোকটা সমুকে বলে দিল আপাতত রোজ যেন পেটভরে ভাত দেওয়া হয় তার আব্বাকে। সমু বোবার মত চুপ করে মাথা নিচু করে রইল। সামনে তার নিজের নাওয়া খাওয়ারই কি ঠিক থাকবে যে বুড়ো বাপজানরে খাওয়াইবে? সবার দৃষ্টি গেল ইয়াস্মিনের দিকে। ততক্ষণে গাজীকাকা কে ভাত, জল খাইয়ে দিয়েছে। দুদিনের অনাহারে চেটেপুটে খেতে সময় বেশি লাগেনি যে !
ইয়াস্মিনের কাছে দলের পাণ্ডা এসে বললে, তোমারেই দায়িত্ব নিতি হবে বোন, আমরা গেরামে থাকতি বড়রা নাখেইয়ে থাকবে তাকি হয়? পেটের ভিতর অনেক কথা গুড়্গুড় করে, খিদা তো জোয়ান বুড়া সবারই পায়, গাজী কাকা দুদিন না খাওয়া, সেবার তার আব্বা যখন যায় সেই সময়ও বাপ বেটির অনেকদিনের না খাওয়ার ইতিহাস ছিল। তবে কিনা তখন ভোট ছিল না, তাই গেরামের এক কোণে থাকা তাদের খোঁজ কেউ নিতে আসে নাই ! এসব প্রকাশ করে বলার নয়, তাই সে বলে, ওসব নিয়ে ভাবনা কি? আজও তো গু মুতের মধ্যে কাকা পড়েই ছিল, সে এসে যখন পড়েছে তখন কারোর বলার ধার ধারে না ! তার কথার ধারেই কিনা কে জানে, কেউ আর কোন কথা বাড়ায় না। চোরের মতন সমু আর একবার ঘরে ঢুকে কিছু বলার চেষ্টা করলেও ইয়াস্মিনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচল।
আমফানের ঝড়ে সমু যথারীতি বাড়ি ছিল না। সে, আব্বা আর গাজী কাকা দুহাতে আগলতে চেয়েছে তাদের গরীব সংসারের জিনিস পত্র। খড়কূটোর মত উড়ে গেছে সেসব। রাত যত বেড়েছে ঝড়ের তাণ্ডব বেড়েছে। রাত তিনটের সময় তারা খোলা আকাশের নীচে। ঘর বলতে শুধু জলের ওপর জেগে থাকা বাঁশের খুঁটিগুলো। আর সীমানা? তা তো ছিলইনা দুটো পরিবারের মধ্যে কখনো। সে দুইদিন তারা একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসেই ছিল ঠায়। নড়বার উপায় ছিলনা। একটা জলের বোতল সম্বল করে তিনটে মানুষ বাঁচার জন্য লড়ছিল ! তিন দিনের দিন নৌকা করে তাদের নিয়ে যাওয়া হল প্রাইমারি স্কুলে। অনেক লোক আসছিল সাহায্য নিয়ে , গ্রামের লোকজন কে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ওরা। তারা সব কলেজে পড়া দাদা, দিদি , ডাক্তার স্কুলের মাস্টারমশাই । ওষুধপত্র, জামা প্যাণ্ট, খাবার সব তারাই দিল। আস্তে আস্তে জল নামলে তার আব্বা আর চাচা মিলে ভাঙা ঘর আবার খাড়া করল। আর ইয়াস্মিন রোজ নদীবাঁধের কাছে যে ইস্কুলে রোজ রান্না হত সেখান থেকে তিনজনের খাবার টেনে আনত। দুই গরীব বুড়া বাপ আর বেটির সংসারে সে ছিল রাণী, কিন্তু রাজ্যপাট ছিলনা তেমন। কই তখন তো একজন বি.ডি.ও বা সরকারী লোক ওরা দেখেনি সেসময়? আজ ও আব্বা চলে যাওয়ার পর যে ঘরে বসে চাটাই বুনে নিজের পেট চালায়, তাও ‘ইঞ্জিও’ র দুজন দিদিরই ব্যবস্থা করা। ভালমানুষ জন যারা এখনও আছে তারাই মানুষ কে দেখে। দেশ বিদেশের খবর তো সে রাখে না, এই দেশে, জন্মে ইস্তক দেখে আসছে, সরকারের কাছে তাদের দাম বাড়ে ভোটের সময়। সত্যি বলতে কি সরকার রে তাদের তেমন দরকার লাগেও না।
বিকাল হতে না হতে আবার ভটভটির আওয়াজ। এবার গাজীচাচা নয়, তার দাওয়াতেই প্রায় উঠে আসে লোকজন। সাথে একটা ব্যাগে চাল, ডাল, তেল আরো কত কি ! ব্যস্ত লোক সব। ফেলে দিয়েই চলে যায় আর কি ! ইয়াস্মিন শান্তস্বরে বলে, এসব কি হবে গো? ভটভটিরা উত্তর দেয়, তোমার ওপর সমিরুদ্দিনের বাবা কবিরুল চাচার খাওয়া দাওয়ার দায়িত্ব রয়েছে না? একজন বলে তাদের পার্টি নাকি মানুষের কথা ভাবে, তাই পাঠিয়েছে। আরো শান্ত হয়ে কোমরে হাত দিয়ে ইয়াস্মিন উত্তর দেয়, কবিরুল চাচার বাড়ি হইল পাশের টা, সেইখানে নিয়া যাও। আর যে কদিন সমু না থাকবে, তার রান্না হইলে সে গাজী কাকারেও খাওয়াইবে। তার জন্য এসবের দরকার নাই। ভটভটিরা কি মনে করে সব জিনিসপত্র তুলে দেয় কবিরুল গাজীর দাওয়ায়।
দুদিন পর সকাল বেলা আবার শোরগোল। কবিরুল গাজীর বাড়ির উঠোনে ! গেরামের কিছু মানুষও জড়ো হয়েছে। ইয়াস্মিন নীলপুকুরের ঘাটে কাপড় চোপড় কেচে একটু গা ভাসাচ্ছিল জলে। তার মধ্যে এত কাণ্ড? তাড়াতাড়ি কাপড় ছেড়ে এসে,দেখে বি.ডি.ও সাহেব, পুলিশ আরো জনা পাঁচেক সরকারী লোকজন গাজী কাকার উঠোনে। এবার থেকে নাকি নিয়ম হয়েছে সরকারী ভোটকর্মী এসে বয়ষ্ক অশক্ত লোকজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আগেই ভোট নিয়ে নেবে। সেসব কথাই বলতে নাকি এসেছে আজ – গেরামের লোকজনের থেকে জানতে পারে । এলাকার বি.ডি.ও কে এই প্রথম দেখল তারা। লিস্টি দেখে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করে সমুকে। তারপর ঘরে ঢোকে চাচার সাথে কথা বলতে, সেখানে আর কাউরে ঢুকতে দেয়না তারা। তবে, ইয়াস্মিনের সন্দেহ হয় যার জন্য এতকিছু সে কতটুকু বুঝেছে!
দূর থেকে দেখল সমু অত্যন্ত গম্ভীর মুখে তার দলের সাথে কীসব আলোচনা করছে। কান পেতে বুঝতে পারে বাড়িতে এসে ভোট নিয়ে যাওয়ার এই নতুন নিয়মে বেশ অসুবিধায় পড়েছে তারা। যাই হোক, সমু কিন্তু আঠার মত লেগে আছে ওদের সাথে। নিজেকে কেউকেটা ভাবছে, এত লোক ওর বাড়িতে জড়ো হয়েছে। আঙুলে কালির দাগ পড়লে এইসবের দাম যে ফুটাকড়িও নয় তা ওই বোকাটা বোঝে না ! ওর হাবেভাবে খুব হাসি পেলেও মুখে তো কিছু বলা যায় না ! চিরকালই কাজ পালানো, তাই বউ ও তার পালিয়েছে। কোন কাজই করেনা, নিজের না হয় চালচুলো নেই, বুড়ো বাপ টা রে পর্যন্ত কষ্ট দেয়। এবার এদের সাথে যে ভিড়েছে, নিজের জন্য কিছু করে নেওয়ার এলেম আছে বলে তো মনে হয় না !
সমুদের দাওয়ায় এসে দেখল এত সব ধুন্ধুমার কাণ্ডকারখানা যাকে নিয়ে সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে এত ধকলে। দরমার জানালার ফাঁক দিয়ে যে কোথায় তাকিয়ে আছে তার হদিস নেই কারোর কাছে।
সবাই চলে গেছে, আবার শান্ত চারিদিক। ইয়াস্মিন দুপর বেলা গরম ভাত নিয়ে চাচার দাওয়ায় উঠে দেখল চাচা উঠে বসেছে বিছানার ওপর। দেখে খুশি হয় সে, তবু এই কদিন পেট ভরে ভাতটা পাচ্ছে বলে একটু বল পেয়েছে মনে হয়। আব্বা নেই তার কতদিন হল,আহা, কাকা ভাল থাক। তবু একটা নিজের মানুষ !
কাছে এসে পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করে, বি.ডি.ও এত কী বোঝালো। এতদিনে মুখে হাসি দেখল চাচার ! জড়িয়ে জড়িয়ে বলল ভোট দেব। যাক, তাহলে যতটা সে ভাবছিল ততটা নয়, আসল কথাটা বুঝেছে। তা এবার কারে দেবা চাচা? নাম জানো কারোর, কোন্ পার্টি? অদ্ভুতভাবে দুপাশে হাত নেড়ে কী যে বলতে চাইল চাচা তা অবশ্য বোঝা গেলনা ! এর মধ্যেই সমু এল ঝড়ের মত, ভাত আছে কি না জিজ্ঞাসা করায় ইয়াস্মিনের রাগ হয়ে যায় খুব। বলে, বাড়িতে চাল, ডাল সবই তো আছে, নিজের বাপের জন্য না করে নিজের রান্নাটা সে করুক ! ইয়াস্মিন দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ দেখতে পারে না। তাই ইচ্ছে করেই বলল একথা, কারণ সে জানে আজ যদি সমুকে রান্না করে খাওয়ায় তাহলে ভবিষ্যতে ও তার ঘাড়েই চেপে বসবে। গাজীচাচা ছাড়া আর কারো দায়িত্বই ইয়াস্মিন আর নেবে না!
নিষ্কর্মা দের রাগ থাকে খুব- সমু চেঁচিয়ে বলে, আর যেন সে তার আব্বার জন্যও না রান্না করে। ইয়াস্মিন সমুর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, সে তার চাচার জন্য রোজ রান্না করবে, কারোর বারণ শোনার তার দরকার নাই।
দুদিন পর ভোর হতে না হতেই ইয়াস্মিন গেছে নদীর কাছে, একটু মাছ ধরবার আশায়! শান্ত নদীজলে ঘাটের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো মাছগুলো ধরা খুব সহজ। প্রথমে খেয়াল করেনি, হঠাৎ দেখল ঘাটের কাছে একটা লঞ্চ থামলো। আবার সরকারী লোক ! তবে আজ একটু অন্যরকম। জংলা ছাপা পোষাক পরা বন্দুক হাতে চারজন, আর খাকি পোষাকে তিনজন মোট সাতজন পুলিশ, সিনেমা তোলার মত ক্যামেরা নিয়ে একজন, এছাড়াও আরো পাঁচজন লোক নামল তাদের ঘাটের কাছে। ইয়াস্মিন বুঝতে পারছে যাবে তাদের বাড়ির দিকেই। সে ভাবে, এ তো মজা মন্দ না? সাতজন্মে যাদের কথা কোন সরকার শুধোয় না তাদের দুয়ারে এখন রোজ রোজ আসা যাওয়া, হল টা কি? তাড়াতাড়ি গিয়ে তাদের ধরে ফেলল, ওদের সঙ্গে সঙ্গেই চলতে থাকল সে। ওদের কথার উত্তরে সে জানায় ওরা যে বাড়িতে যাবে, সেও সেই বাড়িরই মেয়ে। বাড়িতে পৌঁছে তাড়াতাড়ি একটা বেঞ্চ নিয়ে আসে সে ওদের বসতে দেওয়ার জন্য। ওরা অবশ্য বসে না। ক্যামেরাওলা তো ঢুকেই সিনেমা তুলতে লাগল, কে জানে তার ছবিও নিল কিনা! ওরা ঘরে ঢুকতে যেতে একজন ভোটের লোক তাকে বলল ওনাকে একটু ঠিকঠাক করে দিন, ওর ছেলেকে খবর দিয়েছিলাম, তিনি কোথায়? আজ ওনার ভোটটা নিতে এসেছি। এখনো তো ইয়াস্মিনদের ভোটের এক সপ্তাহ বাকি, তার আগেই চাচা ভোট দেবে? ইয়াস্মিন দের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে ঝটপট চাচার মুখ ধুইয়ে তাকে বসিয়ে দেয়। তারা চা খাবে কিনা জিজ্ঞাসা করে। চাচাকেও এবার চা খাওয়াবে সেটা বলতেই ওরা বলে ভোট টা নিয়ে ওরা চলে গেলে ওসব কাজ করা যাবে। ইয়াস্মিন দেখে গাজিচাচার চৌকির ওপর ততক্ষণে খাটানো হয়ে গেছে একটা বাক্স মত ঘর, শক্ত কাগজের। বাব্বা, কি আয়োজন ! তার মানে চাচা ওইটার মধ্যে মাথা চুকিয়ে ভোট দেবে, কারোরে দেখতে দেবে না! বি.ডি.ও অফিসের লোক একটা কাগজআর পেন নিয়ে চাচাকে সব বোঝাতে লাগল। কিন্তু তখন আর তার নিজের সে ঘরে থাকার অনুমতি নেই। নিজের চালায় এসে চাচার জন্য একটু চা বসায় সে।
আধ ঘণ্টা পর আর যখন কারোর আওয়াজ শোনা যায় না, চায়ের কাপ আর মুড়ির বাটি নিয়ে সে গেল চাচার ঘরে। কেমন বেঁকেচুরে শুয়ে আছে মানুষটা, হঠাৎ দেখলে বুক টা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। ডাকাডাকিতে সাড়া দিল বটে, তবে ইয়াস্মিনের ঠিক ভাল লাগল না। তবে শরীরে বল না থাকলেও আজ চাচার কথা বেশ পরিষ্কার বুঝতে পারল। চা খাওয়াতে খাওয়াতে সে চাচাকে জিজ্ঞাসা করে, তা কারে ভোট দিলা? চাচাও মনে হল বেশ খুশি। তাকে আরো কাছে ডেকে কানে কানে বলল, সমু রে বলিস, দুখী মানুষের ভোট নিয়া ওরা বড়লোক হয়, দুখীর অবস্থা পালটায় না। তাই কোন শালারেই দিই নাই। কেউ তো আমাদিগের কথা শুনব না, তাই এইভাবেই বললাম আমার কথা। একটানা কথা বলে হাঁপাতে লাগল চাচা, তবুও ওটুকু করতে পেরে যেন তৃপ্তি পেয়েছে, শীর্ণ মুখে এক অপূর্ব হাসি ভেসে রইল।
ইয়াস্মিন অবাক হল চাচার বিবেচনা দেখে। তার মানে এতদিনের কাণ্ডকারখানা, রাজনৈতিক দলের আসা যাওয়া, সরকারী মানুষজন সব কিছুই মাথায় রয়েছে, শূণ্য দৃষ্টির আড়ালে সব হিসাব নিঃশব্দে কষেছে চাচা। নাঃ! আজ বড্ড দুর্বল মনে হচ্ছে চাচা কে। ভাল করে মাছের ঝোল ভাত খাওয়াতে হবে । একটু মাছ না খেলে শরীর সারবে কী করে?
জামাকাপড় কাচাকাচি, ঘর উঠোন, দাওয়া সব নিকোনো, এসব করতে আজ অনেক বেলা হল। তারপর আাবার ‘ইঞ্জিও ‘ দিদিরা এল মাল নিতে, টাকা পয়সার হিসাব বুঝতেও তো খানিক সময় লাগে ! তবে কাঠের উনুনের সুবিধে হল একবার ধরালে আঁচ এত ভাল ওঠে যে ঝপ করে রান্না হয়ে যায়। ধোঁওয়া ওঠা ভাতের ওপর মাছের ঝোল টা ঢেলে নিয়ে গাজী চাচার ঘরে ঢোকে ইয়াস্মিন। কেমন নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে মানুষ টা। মায়া হয় ডাকতে। ভাতটা চাপা দিয়ে দাওয়ায় গিয়েও আবার ফেরে ঘরের মধ্যে। একেবারে খেয়ে দেয়েই না হয় ঘুমাক। ডাকবার জন্য গায়ে হাত দিতেই কেমন অদ্ভুত শীতলতা অনুভব করে। ডাকতে গিয়েও ডাকা হয়না আর! হাত দিয়ে চিৎ করে শুইয়ে দিতে দেখে মুখের সেই হাসিটা লেগে আছে, আর বাঁদিকে ঠোঁট টার কোণ দিয়ে একটু ফেনা মতন। গা একেবারে বরফ ঠাণ্ডা ! সমু, ভাই রে…..উদভ্রান্তের মত সমুর খোঁজ করতে দৌড়ে বাইরে আসে ইয়াস্মিন, পিছনে কে যেন বলে ওঠে, সমুরে বলিস, এইভাবেই বললাম আমার কথা।
তবু সে এমনভাবে কোন স্পর্ধা করে বলে যায় …. যে
তার কাছে তোমাদের নত হতেই হবে ….
একদম জীবন থেকে নেয়া।
এ গল্পের চাচার সাথে আমার নিজের একটা তফাত আছে–ওরা চাচার ভোটটা নিতে এসেছিল;
আমি না পৌঁছলেও,খোঁজে না।
সেটাই হয়েছে, অভিজ্ঞতা যার যেমনই হোক দেশের পরিচালনার গলদ মানুষ কে সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর আস্থা হারানোর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
🙏🙏🙏
ভোটের আবহাওয়ার খুব সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছেন
লেখিকা।জনগনের উপর যে রাজনৈতিক নেতাদের
সবকিছু নির্ভর করে ভোটৈর পর সেকথা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। ধন্যবাদ দিদিকে সহজ ভাষায়
গল্প লেখার জন্য।
ভোটের আবহাওয়ার খুব সুন্দর ছবি একেঁছেন লেখিকা।
রাজনৈতিক নেতাদের ভবিষৎ নির্ভর করে জনগনের সিধান্ত র উপর।সুচারুরূপে লেখিকা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে
তুলেছেন।ধন্যবাদ দিদি কে।
আমার ভালবাসা আর ধন্যবাদ রইল
খুব ভালো লাগলো।দিদি,আপনি সত্যি কথা খুব সুন্দর করে বললেন।
জীবন যে অতুলনীয়, তার প্রকাশ এই গল্পে।স্বল্প পরিসরে বলা বিরাট মনের জোর এর জয়।বাস্তব।
বর্তমান সময়ে ভোটের আবহাওয়ার চিত্র খুব সহজ সরল ভাবে বলছেন দিদি ।আমাদের খুব ভাল লেগেছে।আমরা আপনার কাছ থেকে আরো ছোটো গল্প উপহার হিসেবে পেতে চাই ।খুব ভালো থাকবেন দিদি।
🙏🙏🙏
ভাল লাগল। এই সময়ের বাস্তব ছবি। অভিনন্দন লেখিকাকে।
সত্যিকারের সাহিত্য তো তাই, যা মানুষের কথা বলে! অসম্ভব ভালো একটি লেখা! গূঢ় সামাজিকতার বোধ কখনও গুরুগম্ভীর লাগেনি লেখিকার ঝরঝরে সুখপাঠ্য লেখনীর গুনে। মুগ্ধ হলাম।