ছোটগল্পঃ “ক্লাসরুমের দেয়াল-লিখন” – অনিরুদ্ধ সুব্রত ( বনগাঁ)

ক্লাসরুমের দেয়াল-লিখন
অনিরুদ্ধ সুব্রত

কিন্তু অনিমেষের শিহরণ আলাদা । আজ এতদিন পরে সে ফিরেছে শিমুলপুরে আবার । একদিন পড়তে এসেছিল, এবার এসেছে পড়াতে । ক্লাস সেভেনে অনিমেষ যখন প্রথমবার মামাবাড়িতে পাকাপাকি ভাবে থেকে পড়াশোনা করতে আসে তখন যে মিশন ছিল, আজ তা নেই । কথায় কথায় দাদুর নিষেধের জালে সে ছিল আটকে । মা বাবাকে ছেড়ে থেকে কষ্টও ছিল অনেক। তবু পরিস্থিতি আর শাসনের মাঝখানে একটু একটু করে অনিমেষ হয়ে উঠেছিল চুপচাপ, শান্ত, নীরব ভালো ছেলে।
কতদিন অনিমেষের ক্লাসের স্থানীয় বন্ধুরা খেলতে ডেকেছে একটু দূরের তালতলার মাঠে। নৌকো চড়তে ডেকেছে পাশের শীর্ণ ধারা নদীতে । কিন্তু যাওয়া হয়নি তার। দাদুর কঠিন চোয়ালের সেই উচ্চারণ , ‘ বললাম তো ,ওসব করলে তোমার চলবে না। মনে রেখো কথাটা । রোজ রোজ যেন এই রকম ভবঘুরে বায়না আমাকে শুনতে না হয়।’ তবে অনিমেষের দাদুর একটা নিয়ম ছিল, খুব ভোরে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তিনি নাতিকে নিয়ে যেতেন কাছের প্রাইমারি স্কুলের মাঠে ।বলতেন, ‘ যাও কয়েক পাক দৌড়ে এসো।’ তাঁর মতে ওটাই শরীর চর্চা । আর রবিবারে ঘোষদের বড়ো পুকুরে অনিমেষকে নিয়ে খানিকটা সাঁতার কাটতে সময় দিতেন। যদিও পাড়ে থাকতেন স্বয়ং । আসলে শিমুলপুরে বাস করলেও সুধীন দাদুর হাত থেকে বেরিয়ে কৈশোরের স্বাধীন ছুটোছুটি অনিমেষের অধরাই রয়ে গেছিল। ক্রমে সে আকাঙ্খা থেকে অনিমেষ নিজেকে যেন সরিয়েও নিয়েছিল।
আর আজকে যখন সে শিমুলপুরে শিক্ষক হয়ে ছাত্র পড়াতে এলো, তখন তার বয়স বেড়েছে অনেকটা । এখন সে যুবক, আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব হয়েছে তার। অথচ এক লহমায়, বিশেষত শিমুলপুরে পা দিয়ে তার সেদিনের সহপাঠীদের কথা যেন হুড়মুড়িয়ে মনে আসছে। দীর্ঘদিন না দেখাশোনার পরেও এমন একটা তীব্র কৌতুহল যেন গোপনে তাতিয়ে দিচ্ছে অনিমেষকে। কিন্তু সে প্রসঙ্গ তো ঐ রাশভারি বৃদ্ধ লোকটার সামনে আনা যাবে না। বরং একটা হবু শিক্ষকের আদর্শ শারীরিক ভাষাই দাদুর পছন্দ— অনিমেষ তারই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ।
হেডস্যারের ঘরে ঢুকে আগেই প্রণাম করতে এগুলো অনিমেষ । স্যার প্রণাম করতে না দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বুকে । বললেন, একদিন যে মুখচোরা ছেলেটা ক্লাস সেভেনে এসে ভর্তি হয়েছিল, আজ সে শিক্ষক হয়ে আবার সেই স্কুলেই এসেছে, একি কম কথা ! ‘ স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক হিসাবে দাদুর সম্মান ও সমাদর নিয়েও হেডস্যার দু’চার কথা বললেন । নিয়ম মাফিক জয়েন হল, জয়েনিং রিপোর্ট হল। হেডস্যার অনিমেষকে নিয়ে গেলেন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বসার ঘরে । আলাপ পরিচয় হল। বেশ কয়েকজন পুরানো শিক্ষক এখনও স্কুলে আছেন । অনিমেষ প্রণাম করতে গেলে তারা প্রায় সকলেই জড়িয়ে ধরলেন । পরিচয় হল সমবয়সী বা অপেক্ষাকৃত অল্প দিন চাকরি করছেন এমন সব তরুণ শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে ।
চতুর্থ পিরিয়ডে সহ প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘চলো অনিমেষ প্রথম দিন তোমাকে ক্লাস এইটের ঘরে নিয়ে যাই। প্রথম দিন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একটু পরিচয় অন্তত হোক ।’ প্রস্তাব মাত্রই অনিমেষ আগ্রহ আর উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো । মনে বয়ে গেল শিক্ষকতার প্রথম পদক্ষেপের আনন্দ । শেল্পের তাকা থেকে চক ডাস্টার হাতে নিয়ে এগিয়ে চলল সে, সহ প্রধান শিক্ষকের পিছন পিছন ক্লাস এইটের ঘরে।
ক্লাসে সহ প্রধান শিক্ষকের প্রাথমিক মুখবন্ধ শেষ হলে অনিমেষ বলল,’ ঠিক আছে স্যার আমি ঠিক সামলে নেব।’ তবু স্যার যাবার সময় ছেলেমেয়েদের বলে গেলেন, ‘শোনো তোমরা, নতুন মাস্টারমশাইকে সহযোগিতা করবে।’ অনিমেষ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলাপ পর্ব শুরু করলো । এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ সহজ হতে পারলো। ছাত্রছাত্রীদেরও বেশ আনন্দ হলো নতুন ভৌতবিজ্ঞানের অনিমেষ স্যারকে পেয়ে ।
শিক্ষক-জীবনের প্রথম ক্লাস , মোটামুটি সহজ হয়ে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায় অনিমেষ । ভালো শিক্ষক হয়ে ওঠার এটাই যে প্রথম পদক্ষেপ । কিন্তু আজ‌ই তো প্রথম পরিচয় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে, অতএব ছাত্রছাত্রীদের নানা কৌতুহলের জবাব দিতে হতে পারে তাকে । ক্লাস ঘরের নির্দিষ্ট চেয়ারে বসা দূরের কথা, অনিমেষ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যায় ক্লাসের মাঝখানের গলি ধরে একেবারে পিছন বেঞ্চের কাছে । ছাত্রছাত্রীদেরও আগ্রহ ফুটে ওঠে চোখে মুখে । খানিকটা কথাবার্তার পর কিছু একটা লিখতে দেয় ও। ছাত্রছাত্রীদেরও তাড়াতাড়ি লিখে নতুন স্যারকে দেখানোর একটা চাপা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় দ্রুত । দুপাশে সার সার বেঞ্চে ছেলেমেয়েরা লিখছে এক মনে আর অনিমেষ হাঁটছে ক্লাস ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা ।
হঠাৎ পিছন বেঞ্চের এক ছাত্রী উঠে নালিশ জানায়, ‘স্যার দেখুন অরিন্দম খাতায় উত্তর না লিখে দেয়ালে কী সব লিখছে ।’ অনিমেষ এবার একটু কড়া, ‘অরিন্দম কী হচ্ছে ? দেয়ালে নয়, যে প্রশ্নটা দিয়েছি তার উত্তর খাতায় লিখে দেখাও আমাকে ।’ ছাত্রছাত্রীরা আবার লেখায় মন দেয়।
‘কোনও একটি ছাত্র ক্লাস ঘরের দেয়ালে লিখছে’—- নালিশটা কানে বাজতে থাকে বেশ কিছু সময় । হাঁটাহাটি করতে করতে অনিমেষ ক্লাস ঘরের পিছনের দেয়ালে তাকিয়ে দেখতে দেখতে যেন হঠাৎ করে কেঁপে ওঠে— ‘ আরে ! এ তো সেই একই ক্লাস ঘর ,যেখানে দশ বারো বছর আগে সে নিজেই পড়ত । এখনও খেয়াল করলেই স্পষ্ট— দেয়ালে কত কী সব আঁকিবুকি, লেখা, ছবি যার অনেক গুলো অনিমেষের সহপাঠী বন্ধুদের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল একদিন । তখনও কেউ নালিশ জানালে স্যারেরা বকাঝকা করেছেন, কখনও বা মেরেছেন, বলেছেন, যা এক্ষুণি মুছে ফেল। অথচ মুছে যায়নি তার অনেক কিছুই , এখনও কত আজগুবি সরল কথা ফুটে রয়েছে ক্লাস ঘরের দেয়ালে ।’ অনিমেষ আগ্রহ নিয়ে দেয়ালের আরও কাছে এগিয়ে যায় নিজের ছাত্র জীবনের পুরানো কোনও দেয়ালচিত্র খুঁজতে । তখনও একমনে ছাত্রছাত্রীরা ভৌতবিজ্ঞানের প্রশ্নের উত্তর লিখছে ।
একদিন শহর থেকে শিমুলপুরের স্কুলে পড়তে এসে অনিমেষ তো একা থাকে নি ক্লাসে, সায়ন,শুভ,অর্ণব,পূজা,শর্মিলা, মেঘা একে একে কত সহপাঠী বন্ধু হয়েছিল তার। কিন্তু কী আশ্চর্য ! শিমুলপুর আদর্শ উচচবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করে শহরের স্কুলে চলে যাওয়ার পর থেকে আজ এই আট নয় বছরে যেন প্রায় ভুলেই গিয়েছিল তাদের কথা !
এই মুহূর্তে অনিমেষের সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে ডানপিটে অর্ণবের কথা। প্রায়ই সে ক্লাসে অনিমেষকে খ্যাপাতো— ‘মেঘা মেঘা বলে।’ বলত,’ তুই শহর থেকে এসেছিস, তোর রেজাল্ট সবচেয়ে ভালো আর তোকে দেখতেও সুন্দর — তাই তো মেঘা আমাকে ভুলে গেছে । তোর দিকেই সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে । তোর কলমে দাগ পড়ছে না শুনলেই মেঘা নিজের কলমটা তোর দিকে এগিয়ে দেয়। এসবের মানে কি আমরা বুঝি না !’
অনিমেষ খুব রেগে যেত এ সব কথায়, বলত— ‘দ্যাখ অর্ণব ওসব বাজে কথা বললে আমার সঙ্গে আর মিশবি না।’ অমনি অর্ণব খুব জোরে জড়িয়ে ধরত অনিমেষকে। বলত ,’ তুই মিশবি না বললেই হলো, আমি তোকে ছাড়লে তো !’ তারপর আরো জোরে জড়িয়ে ধরে প্রায় উঁচু করে তুলে বলত, ‘বল বল পালাবি কোথায় ?’
কখন চোখটা ভিজে ভিজে এসেছে অনিমেষের। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুখটা মুছে নেয় সে। মনে মনে বলে , ‘ ‘দেখেছিস তো অর্ণব, সত্যিই একদিন আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম । কই সেদিন তো আটকে রাখতে পারিসনি । আমরা প্রত্যেকেই যার যার মতো জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে অতীতের ক্লাসরুম থেকে একদিন সত্যিই পালিয়ে যাই রে ।’
অনিমেষের মনে তবু প্রশ্ন ওঠে, ‘ কিন্তু তোরা সব এখন কোথায় ? তুই, সায়ন,দেবাশিস, পূজা আর সেই ঘন কালো গভীর চোখের মেঘা ?’
মনে মনে এই সব স্বগতোক্তি চলতে চলতে অনিমেষ ক্লাসঘরের পিছন দেয়ালের একদম কাছে চলে যায় । একটা জায়গায় গিয়ে নজর আটকে যায় তার। একবার চশমাটা খুলে তাকায় সেখানে । তারপর আবার চশমা পরে গভীর ভাবে দেখে । বড্ড চেনা লাগে অনিমেষের । দেয়ালের ঐ জায়গাটায় হাত ছুঁইয়ে চিনতে চেষ্টা করে । কতগুলো দাগ, পেরেক জাতীয় কিছু দিয়ে দেয়াল খুঁড়ে যেখানে লেখা হয়েছিল বহু দিন আগে— ‘অনিমেষ প্লাস মেঘা ।’ এখনও দেয়ালের সে ক্ষত কিছুটা রয়েগেছে স্পষ্ট, হয়তো গভীর করে লিখিত হয়েছিল বলেই ।
চমক ভেঙে অনিমেষের অনেক কথা আজ মনে পড়ে যায় । সেই দিন এই লেখাটা নিয়ে বন্ধুরা কেউ কেউ অনিমেষকে খুব খ্যেপিয়ে ছিল। আর তাতেই ভীষণ রেগে , ঠোঁট ফুলিয়ে হেডস্যারের কাছে নালিশ জানিয়েছিল অনিমেষ । বলেছিল, ‘ স্যার এটা ঠিক অর্ণবের কাজ ।’
হেডস্যারের বাঘা গোয়েন্দা অফিসার সুলভ অনুসন্ধানে ধরা খেয়েছিল অর্ণব । স্যার অর্ণবকে বেত দিয়ে মেরেওছিলেন খুব । অথচ সেদিন অনিমেষ মেঘার সঙ্গে নিজের মানসিক দুর্বলতাটা ক্লাসের মধ্যে রটে যাওয়ায় গোপনে একটা সুখ‌ও পেয়েছিল— যা কাউকেই সে সেদিন বলেনি।
আর মেঘা বেঞ্চে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছিল সলজ্জ ভঙ্গিতে । কেউ কেউ ভেবে নিয়েছিল, সেই কান্নার গোপনে একটি রহস্যময় আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে । যদিও অনিমেষ সে রহস্যের উদঘাটন করতে অভিযানে নামেনি আর।
কিন্তু মাধ্যমিকের পর মেঘা কোথায় কোন স্কুলে গেছে, অনিমেষ একদিনও সেই খোঁজ করার ফুরসত পায়নি । তার পর তো তার শিমুলপুরের দিন শেষ । নতুন মনোযোগে শহরের নামী স্কুলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার সময় । বাবা যে বার বার মন করিয়ে দিতেন, ‘এখন শুধুই সামনে তাকাবে , পিছন ফিরলেই পরাজয় ।’

এই মাত্র আট নয় বছরের বিরতি, একটা পুরনো চিঠির ধূসর কাগজের মতো । যার অনেকটাই যেন খোদিত হয়ে ছিল শুধু এই শিমুলপুর আদর্শ উচচবিদ্যালয়ের ক্লাসরুমের দেয়ালে ।
অনিমেষের মনে প্রশ্ন আসে, ‘ভালো ছেলেদের অতীতের ক্লাসরুমকে কি কেবল ভুলে যেতে হয় ? এতো আপন করে জড়িয়ে ধরা বন্ধুরা একদিন পড়ে থাকে পিছনে ! ব্যস্ততা, পড়াশোনার ফাঁকে একবারও মনে পড়ে না কারও কথা ? একান্ত মেঘার কথাও না ?’ অনিমেষ যেন মেলাতে পারে না কিছুই, নিজের বুকটা শক্ত শক্ত মনে হয় তার।
এমন সময় হঠাৎ স্কুলের টিফিনের ঘন্টা পড়ার শব্দটা হুড়মুড় করে সব দেয় ভেঙে । ছাত্রছাত্রীদের লিখতে দেওয়া খাতা দেখা হয় না আর। অর্ণব চক ডাস্টার হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে ক্লাস এইট এ সেকশনের ঘর থেকে । স্রোতের মতো ছাত্রছাত্রীদের করিডোর ধরে যেতে দেখে অনিমেষ । যেন সে এক অনন্তের স্রোত । যুগ যুগ ধরে শৈশব কৈশোর আর তারুণ্য এই স্রোতের অগণিত জলরাশি । তার‌ই মাঝে ভেসে ওঠা ডুবে যাওয়া কোনও স্মৃতি, এক একটি আশ্চর্য বুদবুদ মাত্র।
অনিমেষ মনে মনে একটা সংকল্প করে, হেডস্যারকে সে প্রস্তাব দেবে যে ,বহুদিন ক্লাসঘর গুলোর ভিতরের দেয়ালে রং হয় নি — আগামী শিক্ষা বর্ষের আগে সেটা করা সম্ভব হলে ভালো হয় । যেন মনের গভীরে সে বলে ওঠে, ‘একটা নতুন পরিচ্ছন্ন দেয়াল, যেখানে পড়াতে গেলে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকবে না কখনও । শিক্ষা দানে বিঘ্নও ঘটবে না। ‘ আর হঠাৎ করে মনের মধ্যেটা এমন স্মৃতি বাষ্পে ভরে তাকে শ্লথ করে দেবে না কখনও।
শিক্ষকতার প্রথমদিনের সব অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি ঘরে ফিরেই দাদুর সঙ্গে ইনিয়ে বিনিয়ে শেয়ার করতে হলো অনিমেষকে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুধীন সরকার আবারও একপ্রস্থ জ্ঞান দিলেন প্রিয় নাতিকে, শিক্ষকতা পেশার আদর্শ আর রীতিনীতি নিয়ে । অনিমেষ সব শুনল মন দিয়ে । কিন্তু তার ভাবনায় কোথায় যেন রিনরিনে একটা ধ্বনি চলতে থাকল — সেই সেভেন,এইট,নাইন,টেনে পড়ার দিন গুলো । যেন বার বার মনে হতে থাকল, সেই অতীত দিনগুলোতে সে তো এভাবে ভাবেই নি। অথচ আজকে নিজের পড়ে আসা স্কুলে প্রথম পড়াতে গিয়ে ছাত্র বয়সের ক্লাসরুম পরিবেশের স্মৃতি তাকে কেন ভারাক্রান্ত করে তুলছে এতোখানি !
মনে ভেসে ভেসে উঠছে সায়ন, শুভ, অর্ণব, শর্মিলা, মেঘাদের কৈশোরের সপ্রতিভ মুখগুলো । এত দিন পরে হঠাৎ তারা এতোটা চেনা হয়ে উঠছে, অথচ দীর্ঘ আট নয় বছর একবারও অনিমেষ কোনও সহপাঠীর খোঁজ করে সময় নষ্ট করে নি। নিজের কাছে আজ নিজেকেই আশ্চর্য, কিছুটা স্বার্থপর মনে হচ্ছে তার।
শিমুলপুর থেকে মাধ্যমিকের পর ভালো রেজাল্ট করে শহরে নিজের নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছে, উচ্চতর শিক্ষায় সফলতার লক্ষ্যে যে দৌড়ে তাকে নামতে হয়েছে— সেখানে স্কুল-মেটদের প্রসঙ্গ সত্যিই কি অবান্তর ? নিজেকে এমন প্রশ্নই আজ বড্ড ভাবিয়ে তুলছে অনিমেষকে। আজ ভীষণই জানতে ইচ্ছে করছে সেদিনের সহপাঠীরা কে কী করছে। কী কী ভাবে তারাও তাদের জীবনকে সাজিয়েছে । অথবা তাদের মধ্যে কেউ ব্যর্থ হয় নি তো ! আর সেই আশ্চর্য গভীর চোখের মেঘা ? এখনও কি সে তেমনি আছে, হঠাৎ সলজ্জ হয়ে চোখ ভিজে উঠেছে ? মেঘার জন্যে এখনও হৃদয়ে তার এতখানি অনুভূতি !
কিন্তু এতো বছর পরে, এবার যখন সে শিমুলপুরে আবার ফিরে এসেছে, তখন একবার সে মেঘার সামনে দাঁড়াতে চায় । কিন্তু আগে তাকে খুঁজে পাওয়া চাই ! ভাবতে ভাবতে রাতের বিছানায় ঘুম আসতে চায় না অনিমেষের ।
পরদিন যথাসময়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হয়ে বেরয় অনিমেষ। বারান্দা থেকে দাদু যথারীতি মনে করিয়ে দেন , ‘ শোনো দাদু, টিচার যেন প্রতিদিন প্রেয়ারের আগেই স্কুলে উপস্থিত হন। এটা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে।’ অনিমেষ বলে, ‘ মনে থাকবে দাদু’ ।তারপর বেরিয়ে যায় মিনিট পাঁচেকের পায়ে হাঁটা স্কুলের পথে।
আট নয় বছর পর আবার শিমুলপুরের চেনা রাস্তা, পথ ঘাট, কালীমন্দির, বাজার যেন বেশকিছুটা বদলে গেছে বলেই মনে হয় অনিমেষের । দাদুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গলির মুখে বৃন্দাবন মামার মুদি দোকানটার সামনে এক বয়স্ক ভদ্রলোক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাছে ডাকেন। অনিমেষ এগিয়ে যায় । ভদ্রলোক বলেন, ‘ আরে, তুমি সুধীনদার নাতি না ? কী যেন নাম ?’ ‘— আমার নাম অনিমেষ, অনিমেষ দত্ত ।’ ভদ্রলোক চশমাটা একটু ঠেসে নিয়ে বলেন, ‘ তুমি তো কয়েক বছর এখানে ছিলে ? এখন এই স্কুলের মাস্টার হয়ে এসেছো ?’ অনিমেষ উত্তরে শুধু ঘাড় নাড়ল। ভদ্রলোক বললেন, ‘ ভালো ভালো, যাও বাবা তোমার দেরি হয়ে যাবে । অন্যদিন না হয় কথা বলা যাবে।’ আবার ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে অনিমেষ স্কুলের পথে চলল।
অনিমেষের স্কুল তখন আর মাত্র দু’শো মিটারের মতো দূরে, হঠাৎই একটা মোটরসাইকেল তার পিছনে একটু একটু করে শ্লো করতে করতে একেবারে গা ঘেঁষে ব্রেক করল। সামান্য হলেও ব্যাপারটায় হতচকিত হয়ে যায় অনিমেষ । ঘাড় ঘুরিয়ে মোটরসাইকেল চালকের দিকে খানিকটা যেন রেগেই তাকাল। মোটরসাইকেল চালক তখন হেলমেট খুলতে ব্যস্ত ।
হেলমেট খুলে বেশ রসিকতার সুরেই সে বলল, ‘ কী রে চিনতে পারছিস না নিশ্চয়ই ? ‘ অনিমেষ যেন কিছুটা ঘাবড়ে গেছে । বলল, ‘না মানে ঠিক ‘। কিন্তু মুহূর্তে তার স্মৃতি মেলানোর কাজ শুরু হয়ে গেল। ওদিকে মোটরসাইকেল চালক মোটরসাইকেলটা স্ট্যান্ড করল রাস্তার পাশেই।
তারপর অনিমেষের খুব কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘ আরে অনিমেষ, এই যে আমি সেই অর্ণব । সালা, তোমার চেয়ে খারাপ ছাত্র ছিলাম বলে চিনতে পারছো না ?’ অনিমেষ প্রথমে হতচকিত হলেও এটাই সন্দেহ করেছিল যে, হয়তো এটা অর্ণবই হবে। মুখে বলল, ‘ না রে আমি কিছুটা আশ্চর্য হয়েছিলাম, তবে তুই যে এতো মোটা হয়ে গেছিস, আর মুখটা এতোটা ভারী ভারী হয়েগেছে দেখে প্রথমেই চিনতে পারিনি ।’
অর্ণব বলল, ‘ তা কি কম দিন পরে দেখা বল, বছর দশেক হবে মনে হয় । সবার চেহারাই বদলেছে ভাই। আমি তো গতকালই স্কুলের সেক্রেটারির কাছে শুনলাম যে তুই আমাদেরই স্কুলের টিচার হয়ে এসেছিস। শুনে তো হেব্বি গর্ব হলো ।’
অনিমেষ বলল, ‘ তা স্কুলের সেক্রেটারির সঙ্গে মেলামেশা করিস বুঝি?’ অর্ণব কথা শুনে খানিকটা হাসল। অনিমেষ আবার বলল, ‘ বন্ধু তুই এখন কী করছিস ?’
অর্ণব এবার বেশ উৎসাহী, ‘ আরে ভাই, উচ্চমাধ্যমিকের পরে যখন বুঝলাম আমার দ্বারা এই লাইনে বিশেষ কিছু হবে না ,তখন বাবার চালের আড়তেই লেগে গেলাম । তারপর এই বছর দুয়েক হলো নিজের একটা বিল্ডার্সের ব্যবসা শুরু করেছি । তোদের স্কুলের ইঁট ,বালি ,সিমেন্ট এখন আমিই তো সাপ্লাই দিই। ‘ অনিমেষ যেন হা করে তাকিয়ে থাকে আট নয় বছর আগের ক্লাসমেট ডানপিটে অর্ণবের আজকের উপস্থিতির দিকে।
যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া জীবনের পরিবর্তিত সংলাপের একটা স্রোত বয়ে যাচ্ছে । মুহূর্তে হাত ঘড়িতে একবার তাকিয়ে অনিমেষ একটু ব্যস্ত হয়ে উঠলো । বলল, ‘ পরে কথা হবে অর্ণব, অনেক কথা। এখন যে স্কুলে এগোতে হবে।’ অর্ণবও সম্মত হলো । একটু এগিয়ে গিয়ে অনিমেষ আবার চলতে চলতে জিজ্ঞাসা করল, ‘ অন্যরা কে কী করছে রে ? ‘ অর্ণব মোটরসাইকেলে উঠতে উঠতেই বলল, ‘ সায়ন ব্যাঙ্গালোর থাকে, বড়ো ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, মোটা স্যালারি । শুভ তো পুলিশে আছে। আর সব আছে এদিকে ওদিকে। ও হো অনিমেষ একমিনিট দাঁড়িয়ে যা শোন। ‘
অনিমেষ বাধ্য হয়ে দাঁড়ায় । বলে, ‘পরে শুনতে পারতাম, নতুন জয়েন করেছি, প্রেয়ারের আগে স্কুলে পৌঁছাতেই হবে তো।’ অর্ণব বলে, ‘তুই হাঁটতে থাক আমি মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে তোর কাছে আসছি।’ অনিমেষ বেশ ব্যস্ত হাঁটতে থাকে ।
ঐ যে সামনেই স্কুল । এক্ষুণি প্রেয়ারের ঘন্টা পড়বে। অর্ণব মোটরসাইকেল ধীরে চালায় অনিমেষের পাশে পাশে। তার হেলমেটের সামনের দিকটা খুলে বলে, ‘ এক বছর হলো বিয়ে করেছি ভাই। বিকেলে আয় বাড়িতে সারপ্রাইজ দেবো তোকে ।’ অনিমেষ হেসে বলে, ‘ বিয়ে করেছিস সে তো ভালো কথা, কিন্তু সারপ্রাইজের কী হলো ? ‘ অর্ণব হা হা করে হাসল খানিক। তার পর আর ধৈর্য্য রাখতে পারল না। বলল, ‘কাকে বিয়ে করেছি জানিস ? ‘ প্রশ্ন শুনে মুহূর্তে থমকে গিয়ে আবার স্কুল গেটের দিকে পা ফেলে চালাতে থাকল অনিমেষ । মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল , ‘কাকে বিয়ে করেছিস তা কী করে বলব, নিশ্চয়ই একটা মেয়েকেই ।’
অর্ণব এবার ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে বলল, ‘আরে সেই যে মেঘা, হ্যাঁ, সে-ই এখন আমার বৌ। বিকেলে আয় ওর হাতে চা খেয়ে যাবি। ‘ বলে মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে অর্ণব চলে গেল ।
অনিমেষ নিজের মধ্যে আকস্মিক একটা শ্লথগতি অনুভব করল। হঠাৎ করে হৃদয়ে কী একটা কাঁচ পাত্র ভেঙে খানখান । ধীরে ঢুকল স্কুলে সে। ততক্ষণে প্রেয়ার লাইনে দলে দলে সার ধরে দাঁড়িয়েছে ছেলেমেয়েরা ।
অনিমেষ দেখতে পেল যেন ঐ সারিতেই তার পুরনো ক্লাসমেটদের প্রত্যেকে দাঁড়িয়ে আছে । আর তারা যেন সকলেই হাত তুলে টা টা করছে তাকে। যেখানে আশ্চর্য রকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেঘাও । যার ‌আনত মুখের আলোটা যেন অস্পষ্ট, ঘোলাটে। অনিমেষের অন্তঃকরণের মতো কম্পিত এখন।
অনিমেষের মনে হয়, ক্লাসরুমের দেয়াল লিখন চিরকাল উজ্জ্বল ও স্থির নয়। বরং যে সব কালো ও ধূসর কাঁটাকুটি দাগ এতোটা ভার হয়ে ভাবায়, তাকে মুছে দেওয়ার দরকার। নতুন দিনের নতুন সব লিখনের জন্য ।

4 thoughts on “ছোটগল্পঃ “ক্লাসরুমের দেয়াল-লিখন” – অনিরুদ্ধ সুব্রত ( বনগাঁ)

  1. পুরনো দেওয়াল লেখা দেখে যাকে মনে পড়ে সে কি মনের অন্তস্থলে ছিল!!
    খুব ভালো লাগল।

  2. অসাধারণ গল্প। সবটা যেন চোখে দেখতে পেলাম। মন ছুঁয়ে গেল।

Leave a Reply to Mandira Ganguly Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *