ছোটগল্পঃ যে তোরে পাগল বলে – অদিতি ঘোষদস্তিদার

যে তোরে পাগল বলে
অদিতি ঘোষদস্তিদার

“টিকিট?”
মাথা নিচু চোদ্দ পনের বছরের ছেলেটার। এরকম সব বখাটে দেখে দেখে চুল সাদা হয়ে
গেছে অভিজ্ঞ টিকিট চেকার মনোজবাবুর ।
“বাড়ি থেকে পালাচ্ছ? না কি সিনেমা পাড়ায়?”
মাথা তুললো এবার কিশোরটি। নিষ্পাপ সরল মুখ।
“খবরের কাগজের অফিসে স্যার।”
“তুমি লেখো? লেখা নিয়ে যাচ্ছ? কই দেখি?” উৎসাহী অপরপক্ষ।
দুপুরের শিয়ালদহ দক্ষিণগামী ট্রেন। মোটামুটি ফাঁকাই। তবুও কৌতূহলী কয়েকজন
সহযাত্রী ইতিমধ্যে এগিয়ে এসেছেন আলাপচারিতার ফাঁকে।
“না স্যার। শব্দছক বানাই।”
“শব্দছক? মানে ক্রসওয়ার্ড পাজল?”
“তুমি বানাও? কোন ক্লাসে পড়?”
নানান প্রশ্নের ঝড়। শিয়ালদহ ঢোকার মুখে ট্রেন এখন দাঁড়িয়ে গেছে সিগন্যালের
আশায়। নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে অন্যদিনের মত বিরক্তি নেই এই কামরার
যাত্রীদের মধ্যে! ছেলেটাকে ঘিরে মত্ত সবাই।
আস্তে আস্তে চারভাঁজ করার একটা কাগজ প্যান্টের পকেট থেকে বের করে ছেলেটি।
“ওরে ব্বাবা! এ তো দেখছি সব ডাইনোসরদের নাম নিয়ে শব্দছক! তুমি বানিয়েছ?
“কী নাম তোমার? থাক কোথায়? সঙ্গে কেউ নেই কেন?”
চেকার এবার অভিভূত।
“শুভেন্দু বসু! ক্লাস টেনে পড়ি। ঢাকুরিয়ায় থাকি। বাড়িতে বকাবকি করে। সামনে
মাধ্যমিক তো!”
একনাগাড়ে অনেকগুলো কথা একসঙ্গে বলে উত্তেজনায় হাঁপায় ছেলেটা। তারপর আবার
বলে চলে।
“ঘটমান পত্রিকার অফিসে যাচ্ছিলাম। পয়সা তো নেই তাই টিকিট কাটতে পারিনি। আ আ
আমার কি জেল হবে স্যার!”
মনোজবাবু হেসে ফেলেন।
“না হবে না। ট্রেন শিয়ালদায় ঢুকছে। আমি কাগজপত্র অফিসে জমা দিয়ে তোমায়
কাগজের অফিসে পৌঁছে দেব।”
ভাগ্যিস মনোজ জেঠুর মত মানুষের সঙ্গে সেদিন দেখা হয়েছিল। নইলে হয় জেল খাটতে
হত বা বাবাকে খবর দিয়ে আনাতেন রেল কর্তৃপক্ষ।
কেউ টের পায়নি সেদিনের কথা। স্কুল ছুটি ছিল কোন কারণে। অথচ সাধারণ সরকারি
ছুটির দিন ছিল না সেটা। এমন একটা দিনেরই অপেক্ষা করেছিল শুভ। কোনরকমে খবরের
কাগজের অফিসে যাতে পৌঁছনো যায় শব্দছকটা। ডাকে পাঠালে হয়ত পৌঁছবেই না।
আখছার তো এমনটি হয়। তাই হাতে হাতে ধরিয়ে এলে মনে শান্তি।
শব্দছকের সমাধান কবে থেকে শুরু করেছিল আজ আর ঠিকঠাক মনে পড়ে না শুভর।
কিন্তু নিজের বানানো প্রথম শব্দছক নাইনের স্কুল ম্যাগাজিনে। রবীন্দ্রনাথের
গল্পের ওপরে। ভীষণ সাড়া পড়ে গেছিল। প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনে শিক্ষাসচিব
এসেছিলেন। আলাদা করে একটি পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন সবার সামনে। কত
প্রশংসা আর হাততালি।
সেই শুরু। এরপর ধরল শব্দ ছক বানানোর নেশা। শুতে বসতে ঘুরতে ফিরতে শুধু শব্দ।
একটা শব্দ দেখলেই মনে হয় কী করে ওর সঙ্গে আর একটাকে ম্যাচ করান যায়। তার
পাশে একটি, আবার সেটির মাথায় হয়ত আরো এক শব্দ রতন। শুধু কায়দা করে বসিয়ে
দেওয়া। পাশাপাশি আর উপর নিচে। শব্দের ট্রাপিজখেলা। রকমারি অর্থ আর ব্যঞ্জনা
নিয়ে শব্দের পর শব্দের কুচকাওয়াজ।
“ওনারা এসে গেছেন ভাই। চুলটুলগুলো একটু আঁচড়ে নে। বিছানায় যে শার্টটা রেখেছিলাম
ওটা পরলি না কেন? ছবিগুলো ব্রাইট হত!”
সুস্মিতা, মানে শুভর দিদি কাল থেকে এসে আছে। দূরদর্শন থেকে লোক আসছেন।
ভাইয়ের ইন্টারভিউ। খবরের কাগজে অনেকবারই ছবি বেরিয়েছে ভাইয়ের, কিন্তু এবার
একেবারে টিভিতে।
“প্রথমেই জিজ্ঞেস করি শব্দছককে কেরিয়ার হিসেবে বেছে নিলেন কেন?”
কেরিয়ার? শব্দছক নিয়ে? কী উত্তর দেবে এখন শুভেন্দু রায়?
ক্লাসের লাস্টবেঞ্চের স্মৃতি ভেসে এলো।
“তুই এখন লাস্ট বেঞ্চে বসিস কেন রে? পড়াশোনাতেও মন নেই একদম আজকাল।
সামনের সারির ছাত্র তুই। টেনে উঠে এমন গোল্লায় গেলি! কী সব নম্বর হয়েছে?”
ক্লাসের মধ্যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বকছেন মাধববাবু। হাফইয়ার্লির রেজাল্ট সত্যিই খারাপ
হয়েছে। ল্যাঙ্গুয়েজ গ্রুপ আর অঙ্কে মোটামুটি। কিন্তু ইতিহাস, ভূগোল আর
জীবনবিজ্ঞানে একেবারে ডুবে গেছে।
গার্জেন কল করিয়েছিলেন মাধববাবু। বাড়ি ফিরে বাবা রেগে আগুন।
“তুমি লাস্ট বেঞ্চে বসে কী কর? একই স্কুল থেকে দিদি পাশ করেছে। এখনো টিচাররা
ওর কথা বলেন। তুমিও তো এতদিন প্রথম পাঁচজনের মধ্যে ছিলে, কী এমন ঘটলো?”
মা জানতেন সবটা। অনেকবার বারণ সত্বেও কথা শোনেনি ছেলে। আজ তাই তিনিও
মারমূর্তি।
“হবে না! বই নিয়ে বসে কি কখনো? সারাদিন কাগজ, কাঁচি, আঠা আর ছক বানানো! সব
টান মেরে ফেলে দিলে রাগ যায়! আমি দেখি আর কোনদিন!”
চেষ্টা কি করেনি শুভ? নিজেই নতুন করে গুছিয়েছিল পড়ার টেবিল। প্রাণপণে মন দিতে
চেয়েছিলো মাধ্যমিকের প্রস্তুতিতে। কিন্তু সবসময় মনে যেন একটা চাপ। কোন কিছুই
যেন ভালো লাগে না।
“কেরিয়ার বা কোনকিছু নিয়েই আমি কিছুই কোনদিন ভাবিনি। শুধু মাথায় সব সময়
শব্দগুলো ঘুরত। ওদের এড়াতে পারতাম না। যে বিষয়ই পড়তাম, মনে হতো সেগুলো দিয়েই
চমৎকার ছক বানানো যায়।”
“বাড়িতে বাধা আসেনি? ক্রসওয়ার্ড পাজল বানানোকে বিদেশে অনেকেই পেশা হিসেবে
নেন, কিন্তু বাংলায় শব্দছক করে জীবন কাটাবেন এই চিন্তা একটু অভিনব নয় কি?”
হাসি পেলো শুভর। মাধ্যমিকের পর সায়েন্স নিলো না বলে বাবা একমাস কথা বলেননি।
আট বছরের বড় দিদি তখন এম এসসি করে দিনে চাকরি, রাতে রিসার্চ করছে। অনেক
বুঝিয়েছিল।
“দেখ ভাই, তোর নেশা ছক বানানো, সেটা রাখ না। লোকে কি পড়াশোনা করার পাশাপাশি
শখ বজায় রাখে না? এই যে রিয়ালিটি শোতে যারা আসে, তার তো গান, নাচ সব কিছুই
করছে, কিন্তু পড়াশোনা তো আর শিকেয় তুলছে না!”
“যারা পারছে, তারা পারছে দিদিভাই! আমি খুব সাধারণ। আমার খারাপ লাগে রে তোদের
মনের মত হতে পারছিনা বলে, কিন্তু আমি যে শব্দ ছাড়া থাকতে পারি না!”
“তাও যদি ইংলিশে করতিস কিছু কাজকর্ম জুটলেও জুটতে পারত!”
“বাংলাই তো আমাদের ভাষা দিদিভাই! তাই ভাবনাগুলো ওটাতেই আসে!”
“ওরে গাধা, দু’দিন পর বাংলা ভাষার দশাও ওই সংস্কৃতর মত হয়ে যাবে। খোদ কলকাতা
শহরে বসে তুই বাংলা শব্দ নিয়ে খেলছিস! ওরে নিজের ভালো পাগলেও বোঝে!”
গুছিয়ে উত্তর দেবার চেষ্টা করে শুভেন্দু বসু। ক’দিন আগেই যার নামের আগে জুড়েছে
তকমা, “শব্দের কারিগর!” সেইটা কভার করতেই টিভির লোকজনের জড় হয়েছেন।
উত্তর দিতে এতো দিন পরেও গলাটা আবেগে ভারী হয়ে উঠছে কেন?
প্রতিদিন লাঞ্ছনা। বাবা, মা, দিদি। আত্মীয়স্বজন। সবাই উঠতে বসতে কথা শোনায়।
ছেলে কোথায় বুড়ো বাপ্ মা কে দেখবে, তা নয় তাকেই বোধহয় সারা জীবন টানতে হবে,
এই ধরণের নানান ভবিষ্যৎবাণী।
শুনতে শুনতে কানের পর্দা বোধহয় গন্ডারের চামড়ার মত হয়ে গেছিল।
একমাত্র আশা যোগাতেন মনোজ জেঠু।
“প্যাশন মানে বোঝ ছোকরা? তোমার যদি সত্যি প্যাশন থাকে, শব্দকে যদি সত্যিই
ভালোবেসে থাক, সেও তোমায় ভালোবাসবে।”
জেঠুর সঙ্গেই যেত খবরের কাগজের অফিসে। সেই প্রথম দিনটা যেদিন শব্দছক নিয়ে
কাগজের অফিসে পৌঁছল, সামনের টেবিলের লোকটি অবাক হয়ে গেছিলেন। তারপর কত
বার গেছে। পরে জেনেছিলো উনিই সম্পাদক।
শব্দ আর শব্দকোষ। এই দুটোই সঙ্গী। বাড়িতে থাকা আর খাওয়া ছাড়া একটি পয়সা
কোনদিন হাতপেতে নেয়নি। অল্প অল্প পয়সা যা মিলত শব্দছকের দৌলতে তাতে নানা
ধরণের অভিধান আর শব্দকোষে ভরে উঠত পড়ার টেবিল।
ক্রমে ক্রমে দুটো তিনটে চারটে পত্রিকার জন্যে শব্দছক বানানো শুরু।
“এবার পরের প্রশ্নে যাই। বাংলায় সবচেয়ে বেশি শব্দছক বানানোর পুরস্কার তো
আপনার ঝুলিতে। আমরা আরো একটা আগাম পুরস্কারের খবর পেয়েছি, যদি একটু বলেন
বিশদভাবে।”
শুভর একটু লজ্জা করল। নিজের ব্যাপারে কথা বলার লোক সে নয়। বেড়ে ওঠার সঙ্গে
সঙ্গে অপদার্থ আর মাথামোটা ছাড়া অন্য কোন তকমা কপালে জোটেনি। কিন্তু
মনোজজেঠু ঠিকই বলতেন। শব্দরা তাকে ভালোবেসেছে। আস্তে আস্তে কখন যে একটু
একটু করে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে শুভ, বাড়ির লোক টেরও পায়নি।
“হ্যাঁ, নিজের মুখে কী আর বলি! বাংলা শব্দমালা অনেক দিয়েছে আমার মত সাধারণ
একটি ছেলেকে, তাই গঙ্গাজলেই গঙ্গাপুজো আমার! বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শব্দছক
করেছি। সেই ক্লাস নাইনে গল্পগুচ্ছ নিয়ে। তারপর শিল্পী,সাহিত্যিক থেকে শুরু করে
ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সবাইকে নিয়ে কাজ করেছি। মহাভারত নিয়েই আমার একশোটার
বেশি ছক। বিজ্ঞান, সাহিত্য, খেলা সব বিষয়েই আছে। সেটাতেই আমার রেকর্ড হয়েছে
পৃথিবীর সব ভাষার মধ্যে। এমন ভাবে এতো বিষয়ভিত্তিক শব্দছক আর কেউ করেননি।”
“প্রথম কোন স্মরণীয় ঘটনা যা আপনার জীবনে জ্বলজ্বল করছে?”
“সেই বিনা টিকিটে যাওয়ার দিনটা কোনদিন ভুলব না । আর একটা দিনের কথা না বলে
পারছি না, যেদিন প্রথম কলকাতার বিখ্যাত সংবাদপত্রের অফিস থেকে একজন
সাংবাদিক বাড়িতে এসেছিলেন ইন্টারভিউ নিতে, বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। মা
আদর করেছিলেন। বাবা মাকে প্রথম খুশি করতে পারার দিনটা আমার কাছে
চিরস্মরণীয়!”
সাংবাদিকরা চলে যাবার পর টেবিলে এসে বসল শুভ। এখন তার টেবিলে আর একটি
সরঞ্জাম যুক্ত হয়েছে, কম্পিউটার। শিখতে হচ্ছে অনেক নতুন নতুন জিনিস।
একটা কথা সাংবাদিকদের কাছে লুকিয়েছে শুভ, এবার টার্গেট গিনেস বুকে নাম তোলা।
কিন্তু তার থেকেও জরুরি কিছু দায়িত্ব আছে জীবনে।
আনতে হবে শব্দছকের অ্যাপ। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে মধুমাখা বাংলা শব্দের
ছক ছড়িয়ে দিতে হবে সারা পৃথিবীতে অন্তর্জালে।
শব্দমালাডোরেই যে বাঁধা পড়েছে শুভেন্দু বসুর জীবন।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

2 thoughts on “ছোটগল্পঃ যে তোরে পাগল বলে – অদিতি ঘোষদস্তিদার

  1. অপূর্ব। চমৎকার একটি গল্প। অভিনন্দন।

Leave a Reply to ভূমিকা গোস্বামী। Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *