মুক্ত গদ্যঃ ফাল্গুনের দিনে কাঁদব না আনন্দে আত্মহারা হব ! – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

ফাল্গুনের দিনে কাঁদব না আনন্দে আত্মহারা হব !
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী(রাধু)

ফাল্গুন এলে ছোট বড় প্রায় সকলেরই, এমনকি প্রকৃতিরও আনন্দ যেন আর ধরে না। গাছে গাছে পাতা ঝরার পালা শেষ, আবার নতুন কিশলয়ে ভরে উঠবে প্রায় সব গাছগাছালি। শীত চলে গিয়ে গরম পড়েনি, পড়ছি পড়ছি করে উরু উরু বাতাসে মাখামাখি করে কোকিলের গলার মধুমাখা কুহু তানের সঙ্গে আমের মুকুলের সুবাস কার না ভাল লাগে ?

ফাল্গুনের দিনে কান্নাও পায়, কেননা আমার বাবা মাত্র ছেষট্টি বছরে আধুনিক প্রযুক্তি বা চিকিৎসা না নিয়ে ধরাধাম ত্যাগ করে চলে যান‌। তাঁর কিন্তু যাবার জন্য অত তাড়া ছিল না। আজীবন শ্রীশ্রীগৌরগদাধরের সাধক, আচার নিষ্ঠায় কট্টর, কারোর জল গ্রহণ করে তা ব্যাহত করতে দিতেন না। হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে ভর্তি হয়ে তাঁর শরীরের একটা যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য অপারেশন করালেই তিনি আরও অন্তত কুড়িটা বছর সাধন ভজন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতেন। আগের দিনের মানুষ, তার উপরে সদাচারের কড়াকড়ি নিয়ে আমার প্রিয় মানুষটা, বলা যায় প্রায় বিনা চিকিৎসায় চলে গেলেন নিত্যধামে এই ফাল্গুন মাসেই। কাজেই ফাল্গুন মাস এলেই আমার বুক থেকে কান্না উঠে আসতে চায় আজও।

জেনেছি, তাঁর জন্ম আর বিবাহও হয়েছিল এই ফাল্গুন মাসেই। ফাল্গুন মাস এলে এসব কথা মনে করে একটুতো আনন্দ হতেই পারে, তাই না ?

তবে ফাল্গুন মাস এলে মনে পড়ে মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গও জন্মেছিলেন এই ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যা কালে। সেদিন চন্দ্র গ্রহণ ছিল এছাড়াও ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তাই ছিল হোলি বা দোলযাত্রা উৎসব। সারা দেশের বিশেষ করে নবদ্বীপের মানুষ মেতেছিল আবীর আর রঙের মাখামাখিতে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সাধারণ মানুষ হরিনামে বিভোর হয়ে হোলি উৎসবের শেষে গ্রহণের সময় গঙ্গার ঘাটে ঘাটে হরিনাম ও স্নান করতে ব্যস্ত হয়েছিলেন। সেই হরিনামমুখর নবদ্বীপে জন্মেছিলেন শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু। তিনি এসেছিলেন ধনী দরিদ্র পণ্ডিত মূর্খ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র চন্ডাল নির্বিশেষে সকলকে নিজে যেচে হরিনাম বিতরণ করতে। সর্বাগ্রে তিনি বাংলার মানুষদের মধ্যে চেয়েছিলেন জাত-পাত উঁচু নীচু ভেদাভেদ দূর করতে।
তিনি বলতেন –
“চণ্ডালোহ পি দ্বিজশ্রেষ্ঠঃ হরিভক্তিপরায়ণঃ”

অর্থাৎ যে চণ্ডাল হরিভক্তি পরায়ণ (যিনি হরি বা পরমেশ্বরকে ভক্তি করেন ও সব সময় হরিনাম করেন) তিনি দ্বিজ বা ব্রাহ্মণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। আর সেজন্যই তিনি তাঁর প্রবর্তিত হরিনাম মহা যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। এভাবে তিনি এক হরিনামের ছাতার তলায় সক্কলকে হাজির করিয়ে ছিলেন। দ্বেষ ভেদাভেদ ভুলে তিনি সকলকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছিলেন। আগে একতাবদ্ধ না হলে জাতীয় সংহতির স্বপ্ন সুদূর পরাহত, এটা সর্বাগ্রে প্রয়োজন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। মানুষের মধ্যে একতার প্রয়োজন বুঝেছিলেন শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু। এই একতা বা সংহতির জন্য তাঁর হরিনাম মহাযজ্ঞ তথা ছাতার প্রবর্তন।
শুধু তা-ই নয় শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু যাঁকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলে সারা বিশ্ব প্রণত হয় তিনি কখনও কোন ধর্মের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করেন নি। বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ইসলাম, জৈন প্রভৃতি সকল দর্শনকে মান্যতা দিয়ে সকলের ঈশ্বর এক এবং তিনি সর্ব শক্তিমান । নাম ও নামীতে কোন প্রভেদ নেই। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর শিক্ষা শ্লোকাষ্টকে দ্বিতীয় শ্লোকে সে কথা ব্যক্ত ক‍রেছিলেন :-

“নাম্নাকারি বহুধা নিজসর্বশক্তিস্তত্রাপির্তা নিয়মিতঃ স্মরণে ন কালঃ।
এতাদৃশী তব কৃপা ভগবন্মমাপি দুর্দৈবমীদৃশমিহাজনি নানুরাগঃ।।”

অর্থাৎ হে ভগবান, তোমার এরূপ করুণা যে তোমার নাম সমূহে (যে নামেই ডাকুন না কেন) তুমি বহুধা স্বশক্তি নিহিত রেখেছ এবং সে সকল নাম স্মরণের জন্য অনেক অবসরও দিয়েছ, কিন্তু আমার এমন দুরদৃষ্ট যে, সেই নামে আমার অনুরাগ জন্মালো না।

তাঁকে নিয়ে সমসাময়িক ও পরবর্তী কালের কবি সাহিত্যিকরা হাজার হাজার কাব্য রচনা করেছেন। বৃন্দাবন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, লোচনদাস, জয়ানন্দ, গোবিন্দ দাস, লালন ফকির প্রমুখরা।
লালন ফকির গেয়েছিলেন –

” এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে।”

বিস্ময়ে নতজানু হতে হয় যখন জানি কুষ্টিয়ায় ছেঁউরিয়ায় লালন ফকির দোল পূর্ণিমাকে বলতেন গৌর পূর্ণিমা। তাঁর সময় থেকে আজও ছেঁউরিয়ায় লালন মাজারে এই দিন ‘সাধু সঙ্গ’ উৎসবে হাজার হাজার বাউলরা জমায়েত হয়ে সারাদিন মুখরিত করে তোলেন সমগ্ৰ অঞ্চল।

লালন ফকির গেয়েছেন –
” গৌর এসে হৃদে বসে করলো আমার মন চুরি।”
তিনি গেয়েছেন –
” এনেছে এক নবীন গোরা নতুন আইন নদিয়াতে
বেদ পুরাণ সব দিচ্ছে দুষে সে আইনের বিধান মতে।”

সত্যিই শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বাংলার মানুষের কাছে আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর আহ্বানের কথা জেনে এই অতি আধুনিক যুগেও সাধারণ মানুষ পায়ে পায়ে ছোঁয়া লাগলে পরস্পরের সঙ্গে পরস্পরের মাথায় হাত ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানান, মানুষ হিসেবে ভালবাসা জানান একটু মিষ্টি হেসেই। সবটা না হলেও মানুষ শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আদর্শে সকলকে মানুষের মর্যাদা দিয়ে থাকেন। তাই, ফাল্গুন এলে শ্রীগৌরাঙ্গ বা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে ছাড়া আর কার কথাইবা মনে আসবে ?

3 thoughts on “মুক্ত গদ্যঃ ফাল্গুনের দিনে কাঁদব না আনন্দে আত্মহারা হব ! – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *