সাম্প্রতিক ১৮ঃ আগুন কথা- অনিরুদ্ধ সুব্রত

আগুন কথা
অনিরুদ্ধ সুব্রত

টানা বারো বছর যজ্ঞের ঘি পান করে অগ্নির ক্ষুধামান্দ্য হয়েছিল। সেই অসুস্থতা থেকে রক্ষা পেতে অগ্নি মান ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা বলেন খান্ডব বন দগ্ধ করে সেখানকার প্রাণীদের চর্বি ভক্ষণ করলে তাঁর অসুখ সেরে যাবে। কিন্তু ইন্দ্রের প্রিয় এই খান্ডব বন অতীতে সাতবার দগ্ধ করতে গিয়ে হাতি ও নাগগণ প্রত্যেকবার এমন ভাবে জলসেচন করে যে অগ্নি প্রতিবারই ব্যর্থ হন। কিন্তু শেষবার অগ্নি তা‍ঁর কাঙ্খিত খাণ্ডবদাহন এর জন্য অর্জুন ও কৃষ্ণের সাহায্য প্রার্থী হন। তখন কৃষ্ণ কে সঙ্গে নিয়ে গান্ডীব ধনুক ,অক্ষয় তূণ প্রভৃতির সাহায্যে অর্জুন পনেরো দিন ধরে অগ্নিকে খান্ডব বন দহনে সাহায্য করেন। এবং দগ্ধ অরন্যের দগ্ধ জীবজন্তুর মেদ ভক্ষণ করে অগ্নির ক্ষুধামান্দ্য শেষ পর্যন্ত সেরে যায়।
এইটি একটি মহাভারতীয় অগ্নিকাণ্ডের খবর । কিন্তু যদি মহাকাব্য থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক ভারতবর্ষে দাঁড়াই, অগ্নিদেবের ক্ষুধা কিন্তু সহজে মেটেনা। বিশেষ করে আমাদের রাজ্যর শহর সভ্যতা এবং অরণ্য সভ্যতা কোথাও আজকের দিনে অগ্নিদেবের প্রবল খিদে বানচাল করে দেবার মতো জলসিঞ্চন কারি হাতি বা নাগগণের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। অথচ পৃথিবীর সমস্ত আধুনিক দেশে অগ্নি নির্বাপনের যথারীতি যথেষ্ট আধুনিকীকরণ হয়েছে। তথাপি বিশেষ করে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রীতিমতো ভরসাহীন। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
পশ্চিমবঙ্গের অরণ্য ভূভাগ‌ এর একটি বড় অংশ পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পাহাড়, গড় পঞ্চকোট, বড়ন্তি, শুশুনিয়া থেকে জয়চন্ডী পাহাড়। প্রায় প্রতি বছরই (গ্রীষ্মকাল নয় অথচ ) অসাধু উদ্দেশ্যে সেখানে ঘটে চলেছে কৃত্রিম দাবানল। হেক্টর এরপর হেক্টর অরণ্য ভূভাগ ছোট ছোট পাহাড়ের গা বেয়ে যে ঘনসবুজ আবরণ, তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। শুধুমাত্র গাছ পুড়ে যাচ্ছে তা নয় তার সঙ্গে পুড়ে যাচ্ছে অগণিত বন্যপ্রাণ। পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক বনজ সম্পদ নষ্ট হচ্ছে একথা যেমন সত্যি তেমনি নষ্ট হচ্ছে এই রাজ্যের প্রাকৃতিক পরিবেশ। তবুও আমরা বসে আছি অগ্নির ক্ষুধামান্দ্য সারাতে। আমাদের খাণ্ডব দহনে যেন কোন দ্বিধা নেই। কেননা রাষ্ট্রব্যবস্থায় অরণ্য সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেবল কথার কথা। ভারতবর্ষের পরিবেশ মন্ত্রক প্রতিবছর নানাবিধ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত। কিন্তু অসাধু অরণ্য নিধনের যে প্রক্রিয়া চলছে শোনা যায় তা প্রশাসনের কাছে রীতিমতো জ্ঞাত। তবুও একমাত্র কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ছাড়া বা বলা যায় হাতেগোনা পরিবেশ প্রেমীদের নিজস্ব উদ্যোগে ছাড়া কোন রূপ আইনগত প্রহরার ব্যবস্থা নেই। যখন পুরুলিয়ার ফুসফুসের মতো অযোধ্যা পাহাড়ে আগুন লেগে যায় তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে কয়েকজন সাধারণ পরিবেশ প্রেমের হা-হুতাশ। সরকারি উদ্যোগ, প্রশাসনিক তৎপরতা শুধুমাত্র খাতায়-কলমে বন্দি। ফলে আমাদের প্রিয় রাজ্যের অরণ্যভূমি হয়তো একদিন সত্যি সত্যি আগুনের গ্রাসে শেষ হয়ে যাবে। শহুরে সভ্যতার ধনী ঘরের শোভা পাবে ওই অরণ্য থেকে পোড়া চোরা কাঠের আসবাবে। তবে কি আগুন লেগেছে সর্বত্র ? প্রাকৃতিক ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অরণ্যে দাবানল লাগে। পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়া দাবানলের জন্য যথেষ্ট নয়। তবু প্রতিবছর চোরাকারবারীদর হাতে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। দুর্ভাগ্যের বিষয় শহরের বহুতলে আগুন লাগলে যেমন আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা হাতের নাগালে নেই, তেমনি জঙ্গলে আগুন লাগলে আমাদের ভাবনা, নিরাপত্তা, অনুসন্ধান কোনটাই সঠিক থাকেনা।
কলকাতা শহর একটি রাজ্যের রাজধানী। একদা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। স্বাধীনতা -উত্তরকালে পৌনে শতাব্দি পার হতে চলল, কিন্তু ঘিঞ্জি কলকাতার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বিন্দুমাত্র আধুনিক হলো না। যার অন্যতম উদাহরণ গত ৯ই মার্চ কলকাতায় পূর্ব রেলের নিউ কয়লাঘাট বিল্ডিংয়ে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। যদিও এই অগ্নিকাণ্ডকে কলকাতার বৃহত্তম অগ্নিকাণ্ড বলা যাবে কিনা জানিনা। কিন্তু যেটা বলা যায়, সেটা হলো সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অগ্নিকাণ্ড।
প্রথমত ভারতীয় রেলের পূর্বাঞ্চলের যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অফিস এইটি। ফলে সেখানে রেলের গুচ্ছ গুচ্ছ প্রয়োজনীয় ফাইল থাকার কথা। রয়েছে টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের চিপ ইঞ্জিনিয়ারদের কার্যালয়। অথচ সেখানে যথাযথ অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা আদৌ ছিল কিনা তা এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি। জানা যায়নি বহুতলে আগুন ধরার পরেও লিফট কি করে সচল ছিল।
দ্বিতীয়ত রাজ্যের দমকল দপ্তর বা অগ্নি নির্বাপক সংস্থা ঠিক কি পদ্ধতিতে বহুতলে আগুন নেভানোর কাজে দক্ষ ? কেননা শেষ পর্যন্ত যে মর্মান্তিক পরিণতি ঘটেছে তাতে পশ্চিমবঙ্গের অগ্নি নির্বাপক সংস্থাকে কোনভাবেই একটি পেশাদার সংস্থা হিসাবে গণ্য করা যায় না। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুসারে কয়লাঘাট বিল্ডিং এ আগুন নেভাতে গিয়ে মৃত চার দমকল কর্মীর মধ্যে তিনজনই অস্থায়ী কর্মী। আহত বা নিহত অস্থায়ী কর্মী দমকলের মুখ্য ভরসা । তাদের শরীরে অগ্নি প্রতিহত করার পোশাক বা প্রযুক্তিগত সুবিধা যেমন ছিল না তেমনি প্রশ্ন ওঠে ওই কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ছিল কিনা। যারা প্রকৃত প্রশিক্ষিত এবং স্থায়ী কর্মী তাদের চেয়ে এই অস্থায়ী কর্মীরা কেন এত দ্রুততায় অগ্নিনির্বাপণে নিজেদেরকে এগিয়ে রেখেছিলেন। কেন তাদেরকে একটি বহুতলের অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে লিফটে উঠতে দেওয়া হল। তাহলে সেখানে বা ঘটনাস্থলে কি দমকলের উচ্চপদস্থ কোনো দায়িত্বশীল পদাধিকারী উপস্থিত ছিলেন না। নাকি অল্প প্রশিক্ষিত এবং অস্থায়ী কর্মীদের দিয়ে এখন এই রাজ্যের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কি বলবেন সরকারি আধিকারিকরা, আমনাগরিক জানতে চায়।
শুধুমাত্র কলকাতা শহর নয় রাজ্যের প্রতিটি শহরে সময়ের সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ছে বহুতল নির্মাণ। শুধুমাত্র সরকারি অফিস নয় আকাশচুম্বী বিশাল বিশাল টাওয়ারের মতো বাড়িগুলোতে হাজার হাজার মানুষ নিরাপদে বসবাস করছে। কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে কোন রকম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে নাগরিকরা কোন ব্যবস্থার প্রতি সাহায্য প্রার্থনা করবে ? যে দমকলের নিজেদের কর্মীদের বাঁচানোর মত ব্যবস্থা নেই। নেই পর্যাপ্ত পরিকাঠামো, আধুনিক যন্ত্রপাতি, সেই দমকল ব্যবস্থা আধুনিক জীবন যাপনের কতটুকু ভরসা দিতে পারে ? এই প্রশ্ন এখন রাজ্যের প্রতিটি নাগরিকের মাথায়।
পাশাপাশি যুক্তিসঙ্গতভাবে উঠে আসে আরো একটি প্রশ্ন, প্রতিটি সরকারি ক্ষেত্রে কেন এত অস্থায়ী কর্মী ? কেন গুরুত্বপূর্ণ কাজ গুলি মেটাতে দক্ষ কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে না ? একদিকে যেমন যেকোনো পেশাদার কাজে কর্মীর দক্ষতা প্রয়োজন। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত অল্প টাকায় অপেশাদার, অদক্ষ, অস্থায়ী কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে আসলে সরকারি পরিষেবা গুলোই প্রতিনিয়ত নাগরিকের প্রকৃত পরিষেবা কে বিঘ্নিত ও গুরুত্বহীন করে তুলছে না কি ?
যার ফলে এইরকম অগ্নিকাণ্ডের যেমন দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তেমনি প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা রয়েছে সবচেয়ে বেশি। প্রত্যেক শহরের ঘিঞ্জি এলাকা থেকে শুরু করে বহুতল কতখানি নিরাপদ বা দুর্ঘটনা প্রবণ তা নিয়ে যথাযথ কোন পরিসংখ্যান সরকারি উদ্যোগে তৈরি রাখার প্রয়োজনীয়তা কবে অনুভূত হবে। কলকাতা লন্ডন হলে আমাদের সুবিধে, কিন্তু লন্ডনের মত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং পূর্ববর্তী সাবধানতা ও নিরাপত্তার ভরসা না পেলে সে দায় কিন্তু সরকারকেই নিতে হবে। অল্প টাকায় কর্মী নিয়োগের প্রবণতা এবং দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব ভুলে থাকা ছাড়তে হবে। ভাবতে হবে উপযুক্ত শ্রমের উপযুক্ত মূল্য একান্ত কর্তব্য। পাশাপাশি আধুনিক পৃথিবীর অগ্নিনির্বাপক সমস্ত রকম প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম পর্যাপ্ত রাখা। তা না হলে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে নাগরিকের জীবন যাপনে চরম বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে।
শহর ও অরণ্যে যে আগুনের দহন শুরু হয়েছে, তা থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা চলবে, নাকি কেবল আমরা মেতে থাকব একদিকে ভোট উৎসবে, আর অন্যদিকে ফাগুনের আগুন উৎসবে ভাবার সময় এসেছে। বসন্তের এই আগুন আমরা চাই না, চাই প্রকৃত নির্বাপন।

—- অনিরুদ্ধ সুব্রত
১১/৩/২১

One thought on “সাম্প্রতিক ১৮ঃ আগুন কথা- অনিরুদ্ধ সুব্রত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *