প্রবন্ধঃ মা তোর মুখের বাণী – ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

মা তোর মুখের বাণী
ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

গত বছর একটু রাতের দিকে লোকাল ট্রেনে বাড়ি ফিরছি মহিলা বগিতে। গেটের কাছে কয়েকটি মেয়েকে দেখলাম হাওয়া খেতে খেতে আর গল্প গুজবে মেতে পথ পাড়ি দিচ্ছে। কানে এলো বাংলার মধ্যে প্রচুর হিন্দি শব্দ মেশানো আছে। যেমন ‘মজাক মত্ করো ইয়ার’,
‘ঘাটিয়া’ ‘ফুলটু মস্তি’, ‘বিন্দাস’, ‘এক ঝাপড়’ ‘বেহদ্’ ইত্যাদি। আরও কিছু শব্দ ছিল এখন আর মনে নেই। ভাবলাম খেটে খুটে ফিরছে, হয়তো অবাঙালি কোন বন্ধুর সাথে কথা বলছে। নামার আগে একজন চিনল আমাকে তার স্কুলের আন্টি বলে। দুজনে একসাথে নামার পর কুশল বিনিময় করে জানতে চাইলাম কী করছে টরছে। জানাল শপিং মলে গেট সামলায়। যে মেয়েটি হিন্দি বলছিল জানতে চাইলাম তার খবরও। সেও একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাউন্টার সামলায়। আমি ইচ্ছে করেই বললাম মেয়েটি তো বেশ বাংলা বলার চেষ্টা করে। আমার ছাত্রী হেসে বলল, ” না না ও তো বাঙালি আর যার সাথে কথা বলছিল সেও বাঙালি।” “তাহলে বাংলায় বললেই তো হতো”, বলি আমি। ছাত্রীটি বলল, “এখন আমাদের খুব হিন্দি চলে আন্টি, সারা দিন নানা রকম কাস্টোমার আসে তো।” আমি আপত্তি করতেই হেসে বলল, “আপনি একই রকম আছেন আন্টি, ক্লাসেও বলতেন রোজ বাংলা পড়তে, গল্পের বই পড়তে। আসলে আমরা ইংলিশ পারিনা তো তাই হিন্দি বললে মনে হয় কিছু একটু এগোলাম।” আমাদের একসাথে চলার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। ও একদিকে যাবে আর আমি একদিকে তাই মরিয়া হয়ে বললাম, ” শোন, সব ভাষা ভাল কিন্তু সব চেয়ে ভাল মাতৃ ভাষা। তুই তো পশ্চিমবাংলায় আছিস। যতক্ষণ তোর ভাষায় কাজ চলবে ততক্ষণ অন্য ভাষার দরকার কি? ” মেয়েটি “হ্যাঁ ম্যাম” আর “গুডনাইট” বলে বিদায় নিল।
ব্যাঙ্কে গেছি গিয়ে দেখি টেবিলের ওপারে যে মহিলা বসেছেন এক বর্ণ বাংলা সহ্য করছেন না। বিধবা ভাতা নিতে এসেছেন এক বৃদ্ধাকে হিন্দিতে কথা বলতে বলছেন। আর সবাইকে ‘তুমি’ বলছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম যে এরকম হতে পারেনা। ওঁর দায় বাংলা শেখার কারণ উনি একটা মফস্বল শহরে সার্ভিস সেক্টরে কাজ করতে এসেছেন। এছাড়া আমার মনে হল বাঙালি যেন বেশ অবজ্ঞার বিষয় তাঁর কাছে। ওখানেও রাগটা হল।
একদিন স্কুলে গিয়ে শুনলাম গুজরাতি শেখানোর জন্য কয়েকজন এসেছিলেন প্রার্থনার সময়ে তাঁরা প্রতিদিনের ব্যবহার্য কিছু শব্দবন্ধ শিখিয় গেছেন। অবাক হওয়া ছাড়া আর কী হতে পারি।
‘স্যোশাল মিডিয়া’ মানে যাকে বলে সমাজ মাধ্যম আর দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যম মানে অডিও ভিশ্যুয়াল মিডিয়া আমাদের এখন সামাজিক,সাংস্কৃতিক এবং অ্যাকাদেমিক শিক্ষাদাতা। কোথায় কোন মফস্বলি দিদিমণির বুক ফাটছে ‘আমরি বাংলা ভাষা’ বলে তাতে এই গড্ডালিকা প্রবাহে বাহিত হয়ে যাওয়া সাধারণ বাঙালির কিছু যাচ্ছে আসছে না। তবে আমি বলি, “ওরম মনে হয়”। তোমার পায়ের তলার মাটি সরছে, তোমার মাথার ছাদে জল চোঁয়াচ্ছে, তোমার রীতি রেয়াজ বাজারি অর্থনীতির লোলুপ ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে বা তুমি নকলবাজি করতে গিয়ে অন্য সংস্কৃতিকে সাপটে নিতে প্ররোচিত হচ্ছো। তুমি বুঝে অথবা না বুঝে মেহেন্দী, সংগীত,ধনতেরাস, ছট,সংকটমোচনে ঢলে পড়ছো।
অথচ এই নিজের ভাষাকে সত্যিই মায়ের মর্যাদা দিয়ে আজকের পৃথিবীকে একটা মাতৃভাষা দিবস দিল যারা সেই ভাষাশহীদদের নাম অধিকাংশ বাঙালি( আমি এপার বাংলার কথা বলছি) জানে না। অনেকে তলিয়ে দেখেন না মাতৃভাষার অধিকারের জন্য শহীদ হবার গুরুত্ব। ১৯৫২ সনের ২১ শে ফেব্রুআরির ঘটনা এখানে বলতে বসার কোনো প্রয়োজন নেই কারণ আমি জানি আমার এই লেখার পাঠকরা তা জানেন। না জানলেও ‘নেটগুরু’ সব অবগত করাতে পারবে। ১৯৬১র ১৯ মে শিলচরের ১১জন বাংলা ভাষাশহীদের কথা, বরাক উপত্যকার বাঙালিদের মাতৃভাষার জন্য সংগ্রামের কথাও এখন অনেকের জানা। প্রচুর তথ্য পাওয়া যাবে আঙুলের ডগায়। তার চেয়ে বরং ভারতের ভাষাচিত্রটা একটু দেখা যাক। অষ্টম তফশিলে ২২টি ভাষা সংবিধান স্বীকৃত। দেখে নিই সেগুলি কী কী-অসমিয়া,বোড়ো,মণিপুরী,বাংলা,ওড়িয়া, নেপালি, হিন্দি,মৈথিলী, ঊর্দু,কন্নড়, মালায়ালাম,তামিল,তেলেগু,কাশ্মীরি ডোগরি,কোঙ্কনী মারাঠি,সিন্ধি,গুজরাতি, পাঞ্জাবী, সাঁওতালি,সংস্কৃত।
২০১১ সালের তথ্য ও নথি অনুযায়ী ১২১ কোটি মানুষের দেশ ভারতে ১২১টি ভাষা আছে যা ১০ হাজার বা তার বেশি মানুষ বলে। আবার ৯৬.৭১% মানুষের ২২টি সংবিধান স্বীকৃত ভাষার কোনো না কোনো একটি মাতৃভাষা। এদিকে আবার দ্য রেজিস্টার জেনারেল অ্যান্ড সেনশাস কমিশনার,ইন্ডিয়ার সমীক্ষা ও রেকর্ড অনুযায়ী ১৯৫০টি মাতৃভাষা আছে এই ভারত ভূখন্ডে। কিন্তু ১২১টি ভাষার মধ্যে এদের অধিকাংশই এল না তার কারণ ভাষাভাষীর সংখ্যা দশ হাজারের নিচে। তবে এই ভাষাগুলি নথিবদ্ধ এটা একটা আশার কথা।
বাংলা যখন একটা সংবিধান স্বীকৃত ভাষাই তখন এই গেল গেল রব কেন? এই কারণে যে শহুরে শিক্ষিত বাঙালি ধনে মানে লোকের টানে ছেঁড়া কাঁথাটি সত্যিই ভুলে যাচ্ছে। আর গ্রামকে গ্রাস করছে আমার ঐ ছাত্রীটির মানসিকতা। এক নতুন ধরণের পরধীনতার ভয় আমার মনে। আমাদেরই অনাদরে আমাদের ভাষা কোনঠাসা হচ্ছে। অথচ বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার, বাঙালি সমাজ সংস্কারকদের অতুল কীর্তি, বাঙালি বিপ্লবী, বাঙালির বিজ্ঞান চর্চা সব আজ রাজনীতির বিষয়। যা লালনের হতে পারতো, গর্বের হতে পারতো, অনুকরণের হতে পারতো তা আজ রাজনৈতিক সার্কাসের খেল হয়ে উঠছে।
আবার একটু ভাষায় ফিরি। একটা ভাষা বিপদগ্রস্ত হয়ে অবলুপ্তির পথে কখন যায়? যখন তার ওপর পারিপার্শ্বিক চাপ বেড়ে যায় অর্থাৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালীর ভাষাকে বা বহুল প্রচলিত, জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কোনো ভাষাকে যখন মানুষ চর্চা করতে বাধ্য হয় নিজের ভাষাটিকে ফেলে রেখে। এই পর্যায়ে ভাষাটির অবলুপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হল। এরপর দেখা যায় তবু কিছু মানুষ নিজের ভাষায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে এবং সন্তানদের মধ্যে ভাষাটিকে রেখে যাচ্ছে। পরের পর্যায়ে দেখা যায় মুষ্টিমেয় কয়েকজনই সেই ভাষাটিতে টিকে আছেন। এর পরে আসে সন্তানদের মধ্যে শুধু বলতে পারাটুকু টিকে আছে।ভাষাটা তারা আর অন্য কোনো রূপে শিখে নিচ্ছে না। ফল স্বরূপ ভাষাটি অবলুপ্ত হয়ে যায়, তার পরের প্রজন্মে পৌঁছয় না।
পৃথিবীতে প্রায় ৭০০০ ভাষা আছে। এই ভাষাগুলির ৫০% থেকে ৯০% ২১০০ সনের মধ্যে অবলুপ্ত হবে। পৃথিবীর ৯৬% ভাষা মাত্র ৪% মানুষ বলে আর মাত্র ০.২% ভাষা পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ বলে। প্রতিদিন কোনো না কোনো ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। থাকছে না কোথাও কোনো চিন্হ। আর এই ভাষা হারানোর বিরাট প্রান্তরগুলি বা ‘হটস্পটস’ হল নর্দান অস্ট্রলিয়া, সেন্ট্রাল সাউথ অ্যামেরিকা, নর্থ অ্যামেরিকার আপার প্যাসিফিক কোস্টাল এরিয়া,ইস্টার্ন সাইবেরিয়া,ওকলাহোমা এবং সাউথ ওয়েস্ট ইউ এস এ। এই সব জায়গায় বিভিন্ন অ্যাবরিজিনাল গোষ্ঠিগুলির বাস। এমনও গোষ্ঠি আছে যেখানে মাত্র তিনজন একটি ভাষায় বা আটজন অপর একটি ভাষায় কথা বলে। কেন এই গোষ্ঠিগুলির ভাষা সংস্কৃতি অবলুপ্ত তা আজকের বাণিজ্যিক ভূবনগ্রামটির চরিত্র এবং আর্থ সামাজিক প্রেক্ষিত একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। আর সব কিছুর মূলে সেই দুর্বলের প্রতি প্রবলের প্রতাপ। এই অবস্থায় আমরা বাঙালিরা মিশ্র ভাষা, মিশ্র সংস্কৃতি চর্চা বাড়িয়ে দিচ্ছি হাতের কুড়ুল আর নিজের পায়ের অবস্থান বিবেচনা না করেই।
এবার আসি পৃথিবীর ১২টি সবচেয়ে প্রচলিত ভাষার কথায় ১। ইংরিজি(১১৩২ মিলিয়ান)২। ম্যান্ডারিন (১১১৭ মিলিয়ান) ৩। হিন্দি(৬১৫ মিলিয়ান) ৪। স্প্যানিশ(৫৩৪ মিলিয়ান) ৫।ফ্রেঞ্চ(২৮০মিলিয়ান) ৬। অ্যারাবিক( ২৭৪ মিলিয়ান) ৭। বাংলা(২৬৫ মিলিয়ান) ৮।রাশান বা রাশিয়ান(২৫৮ মিলিয়ান) ৯। পর্টুগিজ( ১৯৯ মিলিয়ান) ১০। ইন্দোনেশিয়ান(১৭০ মিলিয়ান) ১১। উর্দু (১৭০ মিলিয়ান) ১২।জার্মান(১৩২ মিলিয়ান)
এই তথ্য বাঙালির মনোবল হয়তো বাড়াতে পারে। তার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রতিটি ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষাকে ও সেই ভাষাকে ঘিরে যে সংস্কৃতি তা রক্ষা করার অঙ্গীকার করা উচিৎ। সেই সঙ্গে অন্য ভাষার ওপর আগ্রাসন থেকে সচেতন ভাবে বিরত থাকা উচিৎ।
সব শেষে প্রণাম জানাই ১৯৫২ সনের ২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারির বাংলা ভাষা শহীদ আবুল বরকত,আব্দুল জাব্বার,রফিক উদ্দীন আহমদ, আবদুস সালাম, শফিউর রহমান, আবদুল আউয়াল, মোহম্মদ আহিউল্লাহ আর অজ্ঞাত পরিচয় সেই বালকটিকে। আর প্রণাম জানাই ১৯৬১ র ১৯শে মে ‘র বাংলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য্য, কানাইলাল নিয়োগী,সুনীল সরকার,সুকোমল পুরকায়স্থ,হিতেশ বিশ্বাস,তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র পাল, চন্ডীচরণ সূত্রধর, কুমুদ রঞ্জন দাস,সত্যেন্দ্র দেব,বীরেন্দ্র সূত্রধরকে।
১৯৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারির ও তার আগে পরের যে সংগ্রাম তা কতটা স্মরণীয় ছিল যে ১৯৯৯ তে এসে ইউনেস্কো দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করল। সেই ভাষা আন্দোলণের কারণ যে ভাষাটি তা আমার বাংলা ভাষা আমার মাতৃভাষা ভাবলে হরষে বিষাদে আপ্লুত হই।এই লেখাটির মাধ্যমে যদি কতিপয় বাঙালিকেও নিজের ভাষাকে সব দিক দিয়ে রক্ষা করার কাজে প্রণোদিত করতে পারি তাহলেই আমার লেখক হয়ে ওঠা সার্থক হবে।

2 thoughts on “প্রবন্ধঃ মা তোর মুখের বাণী – ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

  1. আপনার সাথে সর্বৈবভাবে একমত। জানি না , সহনশীল বাঙালি সহ্য করতে গিয়ে কী সর্বনাশ ডেকে নেবে।

Leave a Reply to অমিত সরকার Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *