তমিস্রা
কাজরী বসু
চারদিকে আজ চাপ চাপ অন্ধকার। মনে হয় অমাবস্যা। কথাটা বলার জন্য এই অন্ধকারটাই আজ বেছে বেছে…
না,ইচ্ছাকৃত নয়। তিথি নক্ষত্র এখন আর খেয়াল করানোর মতো কেউ নেই। সে ছিল ছোটবেলায় মা,পঞ্জিকা দেখে ছাড়া মায়ের কোথাও যাওয়া আসা ছিল না। বাবা যেদিন দীর্ঘদিনের অসুখ থেকে উঠে শেষ কারখানায় গেল, সেবারও মা বলেছিল, “শনিবারের বারবেলায় না বেরিয়ে সোমবার থেকে কারখানা গেলে হয়না?”
শোনেনি বাবা। নড়বড়ে শরীরে বাস থেকে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে বাসের চাকার তলায় চলে গিয়েছিল বাবা সেদিনই।
মায়েরও যে ভিতরে ভিতরে কালরোগ বাসা বেঁধেছিল,তা মা বুঝতে দেয়নি। মা যেদিন চলে যায়, সেই রাতেও এমন ঘুটঘুটে অমাবস্যা ছিল, অযাত্রা কি কুযাত্রা তা জানানোর কেউ ছিলনা। অন্ধকার ছাড়া তপনের জীবনে সেই থেকে আর কিছুই নেই।
মধ্যিখানে এক চিলতে আলোর দেখা মিলেছিল। রেখা। রেখার বাবাও ওর বাবার কারখানাতেই কাজ করত।কারখানা লক আউটের পরে অটোরিকশা চালায় দেবল কাকু। ব্যাঙ্ক থেকে অটো কেনার লোন পেয়েছে পার্টি করার সুবাদে।
মাধ্যমিক পাশ বলে ছাপাখানায় কাজ পেয়েছে তপন। রেখা বাজারের দর্জির দোকানে সেলাই মেশিন চালায়। অন্তত গত পরশু অবধি সেই কথাটাই জেনে এসেছে তপন।
কাল থেকে একটা অন্য কথাও শুনেছে। কথাটা মিথ্যে বলে ভাবার কারণও নেই, সামান্য দর্জির দোকানের মাইনে আর অটোরিকশা চালানোর টাকায় রেখার ভাইয়ের স্কুল আর টিউশন কিভাবে ম্যানেজ করছে ওরা তা ভেবে তপনের আশ্চর্য লাগত। ব্যাঙ্কের ই এম আই দিতে অনেক টাকাই তো বেরিয়ে যায়। ভাইয়ের পড়া নিয়ে খুব সিরিয়াস রেখা।
মাথাটা সেই থেকে গরম হয়ে আছে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করবে। মন থেকে যাকে ভালোবেসেছে তার এই মিথ্যাচার বরদাস্ত হয়না।ও যদি আগে বুঝত তবে তো কবেই…
কথাটা আজই বলবে।বলবে,ও সবই জেনে গেছে। বলবে,এই সম্পর্ক ও আর রাখবেনা।
দেবল কাকা এখন অটো নিয়ে বেরিয়েছে। রেখার মা নেই, দুরারোগ্য অসুখে ভুগে চিকিৎসার অভাবে মারা গিয়েছেন। বাড়িতে রেখা আজ একা, আজ রবিবার, দর্জির দোকানও বন্ধ। রেখার ভাই এই সময়ই টিউশন পড়তে যায়। সময়টা সেই হিসেবেই বেছেছে তপন।
হাতঘড়িতে সময় দেখতে গেল,ওহ মনে ছিল না,ঘড়িটা হারিয়ে ফেলেছে দুদিন হল। তন্নতন্ন করে খুঁজেও পায়নি, কোথাও পড়ে টড়ে গেছে, ব্যান্ডটা ছিঁড়ে গিয়েছিল একটু।
আলতো করে দরজায় টোকা দিল তপন। পুরোনো দিনের কোয়ার্টার, পাশাপাশি সব দু কামরার এল আই জি ফ্ল্যাট। অন্য ফ্ল্যাটের কথা শোনা যায় জোরে বললে।
“তুমি,এই সময়!এসো,চা খাবে?”
“না, থাক।তোকে একটা কথা বলতে এলাম রেখা।”
“বসো।আমি ভাত চাপিয়েছি,জল দিয়ে আসি।”
এক চিলতে রান্নাঘরে ঢুকল রেখা,পিছু পিছু তপন।
ভাত ফুটছে,মগে করে জল দিল হাঁড়িতে রেখা।
“কিছু বলার ছিল রেখা..”
“তপনদা,গত পরশু রাতে , তোমার ঘড়িটা ফেলে এসেছিলে..আমি নিয়ে এলাম..
বসার ঘরে নীচের ড্রয়ারে রেখেছি..
দেখো,পেয়ে যাবে..
আসলে অন্ধকারটা আমিই প্রেফার করি..তাই আমার কথামতোই কেউ কাউকে দেখিনি,পরে দেখলাম ঘড়িটা..আমিই তোমায় গতবছর ভালোবাসার দিনে দিয়েছিলাম..
ওটা আসলে চেনা,ব্যান্ডটা একটু ছেঁড়া,তাই…
না বলতে পারা কথাগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে তপনের। বাড়ি ফিরবে কিভাবে, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা,রাস্তাটা বড্ড অন্ধকার…
ভাল গল্প।