মুক্ত গদ্যঃ জীবন কথা – দেবাশিস রায়

জীবন কথা
দেবাশিস রায়

আমি এবং আমার সহোদরা ভগ্নী ছিলাম একদম পিঠোপিঠি। বয়সের তফাৎ
মাত্র দু বছর। ফলে যা হওয়ার তাই হতো। কারো মতের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলেই
প্রবল প্রতিবাদ উঠত অপর পক্ষ থেকে। এই প্রতিবাদ সবসময় অহিংস যে থাকতো
না তা বলাই বাহুল্য। আমার বোন ছিল খুব চালাক। সবার সামনে তার সুন্দর মুখখানা
এমন ব্যাজার করে ফেলত যে মুহূর্তে জনসমর্থন তার দিকে চলে যেত। তার ঐ
চালাকিটা আমি বুঝতে পারতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হাই কম্যান্ডের কর্ণকুহরে তা
কখনো প্রবেশ করাতে পারি নি। ফলে আমি সবসময় সেই লড়াইয়ে প্রথম থেকেই
পিছিয়ে পড়তাম। বোন খুব ভালো করে জানতো দাদা যতই করুক, জিততে পারবে না।
পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পায়ে একটা কসে চিমটি কেটে দিয়ে সেই গোবেচারা মুখ করে
চলে যেত। প্রথম প্রথম আমিও ছুটে গিয়ে চুলে টান দিতাম। বা মাথায় গাট্টা। মুহূর্তে
বোন এমন চীৎকার জুড়ত যে পাড়া মাথায়। ব্যাস। আর যায় কোথায়। আমার ছোট
কাকুকে সেই সময় আতঙ্কবাদী মনে হতো আমার। লাফ দিয়ে আমার ওপর এসে
পড়তেন। সঙ্গে উত্তম মধ্যম। মাও কম ছিলেন না। বাবাও তাই। আসলে আমাদের
পরিবারে মেয়ে বরাবর কম। ঠাকুমা এক মেয়ে। দিদিমা এক মেয়ে। মা এক মেয়ে।পিসিমা
এক মেয়ে। ফলে আমার বোন আমাদের সংসারে তখন বিশেষ মর্যাদা ভোগ করতো।
পুতু পুতু। আমার তখনো বোনের কাটা চিমটির জ্বলুনি কমে নি। পিঁপড়ের কামড়ের
মতো জ্বলছে তখনো। তার ওপরে আমার তখন সেবা হচ্ছে। কাকু র পিঠে চড়। মায়ের
চড় পড়তো গালে। বাবা ঠাকুরদার ফটোর পেছনে লিকলিকে একটা বেত রাখতেন
আমার এই বিশেষ সেবার জন্ন্য। মার খেয়ে যতটা না কাঁদতাম, তার থেকে বেশী
কাঁদতাম পরাজয়ের গ্লানি তে। আর জানতাম এর প্রতিশোধ নিতে পারবো না। নিলে
আবার এই নরনারায়ন সেবা। বোন দূরে দাঁড়িয়ে আমার এই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা
উপভোগ করতো। আর আমি মনে মনে দাঁত ঘষতাম। যখন কানে শুনতাম ……আর যদি
কখনো শুনি বোনকে মেরেছিস। লজ্জা করে না দাদা হয়ে বোনকে মারতে… বুঝতাম
এবারকার মতো থামল পিটুনি। বোনকে দেখলে তখন সূর্পণখা মনে হতো।
সরাসরি লড়াইতে পারবো না দেখে আমি অন্য রাস্তা ধরলাম। তখন কয়লার
উনুনে রান্না হতো বেশীর ভাগ বাড়িতে। সেই কয়লা ঝাঁকায় ভরে বাড়ি বাড়ি দিত যে
লোকটি সে ছিল পাড়ার পাজি ছেলেদের পেছনে লাগার খোরাক। তাঁকে সামনে সবাই
বলত মামু। আর পেরিয়ে গেলেই পেছন থেকে বলতো মুরগিচোর। মাথায় ঝাঁকা থাকায়
উনি পেছন ফিরে ঘুরে দাঁড়াতে পারতেন না। ঐ সামনের দিকেই মুখ করে গালাগালি শুরু
করে দিতেন। সামনে কেউ পড়লে সে হতচকিত হয়ে যেত ……আমি কি করলাম রে
বাবা, যে আমায় এভাবে গালাগালি করছে? পরের দিকে মামু আর ঝুঁকি নিতেন না।
কেউ মামু বললে সামনেই গালাগালি শুরু করে দিতেন। জানতেন, যে মামু বলছে সেই
পেছনে গিয়ে মুরগিচোর বলবে। শেষের দিকে তো কিছু বলতে হতো না। মার্কামারা পাজি

ছেলে দেখলেই কিছু বলার আগে গালাগালি শুরু করে দিতেন। কয়লা টানা পোশাক ছিল
কয়লার মতই নোংরা, কালো হয়ে যাওয়া। ছোট্ট বেঁটে খাটো মানুষ টি। বিড়ি খেতেন
সবসময়। পরাজিত, চূড়ান্ত পরাজিত আমি, বোনের সহিংস অত্যাচার থেকে বাঁচতে
বেছে নিলাম ঐ মানুষটিকে। বোনের বয়স তখন ছয় কি সাত। আমি বোন কে শুনিয়ে
শুনিয়ে মাকে প্রস্তাব দিলাম……মা, বোনের বিয়ে ঐ মামু মুরগিচোর এর সাথে দিলে
কেমন হয়? বুঝিনি আমার রননীতি এভাবে সফল হবে। সেদিন থেকেই বোন আমার
সাথে একদম অন্যরকম ব্যাবহার শুরু করে দিলো। চিমটি, চুল টানা, মিথ্যে নালিশ
করা সব বন্ধ। কখনো কখনো হয়তো পুরনো অভ্যেস মাথা চাড়া দিয়ে উঠত। কিন্তু
শান্ত গলায় আমি শুধু একবার বলতাম……মামু। জাদু কাজ করতো। বোন মুহূর্তে
শান্ত।
আজ আমরা দুজনেই জীবনের আরেক প্রান্তে। এখনো মজা করে বা আদর
করে বোন কে বলি মামু। হা হা করে হেসে উঠি দুজনে। শৈশব পেরিয়ে এসেছি অনেকদিন
কে বলবে। ভাই বোন দুজনে ডুব দেই সেই দিনগুলোতে।
আমার ছেলের জন্য কষ্ট হয়। কষ্ট হয় আরও সেই সব একমাত্র সন্তান
দের জন্য। যারা শৈশবের এই অম্ল-মধুর আস্বাদ পায় নি, একমাত্র সন্তান হওয়ার
কারনে। তাদের জীবন বড্ড সাদামাটা । তেঁতুল জল ছাড়া ফুচকার মতো।

One thought on “মুক্ত গদ্যঃ জীবন কথা – দেবাশিস রায়

  1. বাঃ। খুব সুন্দর মিস্টি স্মৃতি কথা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *