ছোটগল্পঃ মন – ভূমিকা গোস্বামী

মন
ভূমিকা গোস্বামী

বিকেল পাঁচটা বাজলেই চেম্বারে গিয়ে বসেন ডঃ মিত্র। রিটায়ারমেন্টের পর পৈতৃক বাড়ির নিচের তলার একটি ঘর তাঁর কর্মভূমি। আগে দুবেলাই বসতেন। আশিতম জন্মদিনের পর বিকেলে একবেলাই বসেন ।
অকৃতদার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ মিত্রর কাছের মানুষ বলতে ঐ সুমন। সেই দশ বছর বয়স থেকে ওঁর কাছেই আছে। সুমন একাধারে ঘর চেম্বার সব সামলায় দারুণ দক্ষতার সাথে।
দশ বছর আগে একদিন শীতের সকালে মর্নিওয়াকে গিয়ে ওকে খুঁজে পেয়েছিলেন ডঃ মিত্র। ব্রীজের নিচে শুয়ে জ্বরে কাতরাচ্ছিল ও। সারা শরীরে এত ধুলো ছিল, যে চোখ মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না। নিজের শালটা দিয়ে জড়িয়ে ওকে তুলে এনেছিলেন বাড়িতে।
শীতের বিকেল । পাঁচটায় অন্ধকার নেমে এসেছে। ডঃ মিত্র চেম্বারে এসে বসেছেন। আজ পরনে শীতের নীল শ্যুট। মাথায় টুপি। সুমন বাড়ির ভেতরে গেছে ডাক্তার বাবুর জন্য কফি বানাতে। এমন সময় ঝড়ের বেগে কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকল একজন মধ্যবয়সী ছোটখাটো চেহারার মানুষ,এলোমেলো চুল,চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। চেম্বারে ঢুকতে ঢুকতে বলল–
— ডক্টর আমার নাম সুজন। আমি বোধহয় সুস্থ নই। আপনি আমার চিকিৎসা করুন।
ডঃ মিত্র বললেন — আপনি শান্ত হোন। কী হয়েছে বলুন।
সুজন বলল — আজ আমার স্ত্রীকে হসপিটালে এ্যডমিট করেছি বাড়িতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারবাবুরা বললেন , সিভিয়ার এ্যনিমিয়া, তার ওপর অস্বাভাবিক ব্লিডিং।
সবজি কাটতে গিয়ে ডান হাতের তর্জনী কেটে ফেলেছে।
— আহা, এতে এত চিন্তা করার কী আছে । ডাক্তার বাবুরা দুবোতল রক্ত দেবে , তারপর নিয়মিত কিছু ওষুধ খেলেই আপনার স্ত্রী ভাল হয়ে যাবেন। আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন ডঃ মিত্র।
— জানেন ডক্টর, ও কতদিন হাসে নি। সাজে নি। যন্ত্রের মতো কাজ করে শুধু।
এবার কান্নায় ভেঙে পড়ে লোকটা।

–আমার স্ত্রীর এ অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। বিশ্বাস করুন ডক্টর। আমি সেই কথা বলতেই ছুটে এসেছি। প্লিজ, আমার কথাটা শুনুন। আমি রোগী ডক্টর। আমি নিশ্চয়ই রোগী।
— আচ্ছা আচ্ছা । আপনি শান্ত হোন। আমি শুনব। সব কথা শুনবো। আপনি বলুন।
আমি শ্রেষ্ঠা কে ভালবাসি হয়তো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশী। ও এত সুন্দর যে ওর তুলনায় নিজেকে ভীষণ কুৎসিত মনে হত।
যখন দেখতাম ও খুব খুশিতে আছে , গুণগুণ করে গান করতে করতে আয়নায় নিজেকে সাজাচ্ছে , তখন কেমন অদ্ভূত খেলা আমার মাথায় চাপতো । সদ্য ফোটা গোলাপের মতো মুখটা দুহাতের পাতায় নিয়ে বলতাম — তোমার স্কিনটা কেমন রুক্ষ্ম রুক্ষ্ম লাগছে। চোখের নিচেও তো বেশ কালি পড়েছে দেখছি। কি চিন্তা করো সারাদিন ?
আমি দেখতাম , আমার দুহাতের মধ্যে ধরা গোলাপটা কেমন মলিন হয়ে যেত সঙ্গে সঙ্গে। ও আমার হাত ছাড়িয়ে ছুটে আয়নার সামনে যেত। নিজেকে দেখত। আমার কথার সত্যতা পরখ করতো।
সত্যি বলছি ডক্টর , আমার কেমন একটা তৃপ্তিবোধ হতো।
গতবছর জানুয়ারীতে আমার মাসতুত বোন কুহুর বিয়েতে গিয়েছিলাম। শ্রেষ্ঠাকে সেদিন দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছিল। লাল বেনারসী আর সোনার গয়নায় ঝলমল করছিল ও। প্রত্যেকে ওকে দেখছিল। ও সকলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল। সবাই ওকে ডেকে ডেকে কথা বলছে।
এসব কিছুই আমার ভাল লাগছিল না। গম্ভীর হয়ে বসেছিলাম এক কোণে। সেদিন আমাদের বিয়েবাড়িতে থাকার কথা। আমি কাজের ছুতো দেখিয়ে, ওলা ডেকে ওকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। সারা রাস্তা ওর সাথে একটাও কথা বলি নি।
রাতে ও, হঠাৎ ডিসিশন চেঞ্জ করার কারণ জিজ্ঞেস করলে, মিথ্যে মিথ্যে এক অবৈধ প্রেমের কাহিনী ওকে শুনিয়ে ছিলাম , আমার আর কুহুর।
ও কিছুই বলে নি। শুধু শুনেছে। আমি আশা করেছিলাম, ও কাঁদবে, চেঁচাবে। না, কিছুই ও করে নি। আমার কেমন রোখ চেপে গিয়েছিল। অফিসের এক ডিভোর্সি কলিগকে নিয়ে নানান মিথ্যে রোমান্সের গল্প ওকে বলি। বানিয়ে বানিয়ে তার রূপের ,শারীরিক গড়নের বর্ণনা করি।
শ্রেষ্ঠার খুঁত বার করার চেষ্টা করি। ওর গুণের মধ্যে দোষ খোঁজার চেষ্টা করি। ইকনমিক্সে এম- এ করা শ্রেষ্ঠা কেমন চুপ হয়ে যায়।
ও যত চুপ করে থাকে আমার রোখ ততই বেড়ে যায়। ভাবতাম ওর কি ধারণা আমাকে দেখে মেয়েরা আকৃষ্ট হতে পারে না।
এক সর্বনাশা খেলায় আমি মেতে উঠলাম। ইচ্ছে করে এদিক সেদিক ঘুরে রাত করে বাড়ি ফিরতাম। দেরীর কারণ জিজ্ঞেস করলে, মনগড়া মেয়েদের গল্প শোনাতাম। ও কিছুই বলত না তবে ও আর আগের মতো হাসত না। কথাও বলত না। সবসময় চুপচাপ থাকতো। সাজগোজ করাও ছেড়ে দিয়েছিল। দু- তিন দিন চুলে চিরুনী পর্যন্ত ছোঁয়াত না। বেশ কিছদিন ধরে দেখছি ওর খাওয়া খুব কমে গিয়েছিল। বললে বলত ক্ষিদে নেই।
গতকাল অফিস থেকে ফিরে ওকে দেখে মনটা কেমন মুচড়ে উঠল। এলোমেলো চুল। রং ওঠা পুরোনো শাড়ি পরনে। আগে কখনও এমন শাড়ি ও পরত না। আমাকে দরজা খুলে দিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল। বিছানার সাথে যেন মিশে গেছে।
আমার নিজের ওপরই ভীষণ রাগ হল– চেঁচিয়ে উঠলাম।
— পেত্নীর মতো মুখ করে শুয়ে আছ কেন ? সারাদিন খেটেখুটে ফিরে এমন ক্যাটাবেরাস চেহারা দেখতে কারো ভাল লাগে।
— ও বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলেছিল , আর বেশিদিন তোমাকে দেখতে হবে না।
আজ অফিসে গিয়ে বারবার ওর কথাই মনে হচ্ছিল। আত্মগ্লানি, বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়ে দুপুরেই বাড়ি ফিরে এলাম। দরজা ভিজানো ছিল। ভেতরে এসে দেখি , সবজিগুলো ছিটানো, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আঙ্গুলের তর্জনী দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে সাদা পাথরের মেঝে লাল হয়ে গেছে।
কাদছে সুজন। চোখের জলে ওর সোয়েটার ভিজে গেছে।
ডঃ মিত্র চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। শীতের রাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম তার কপালে।কোটের পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল টা মুছে টেবিলে রাখা চশমাটা পরলেন।
সুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন–আপনি তো নিজেই নিজের রোগ ধরে ফেলেছেন।

7 thoughts on “ছোটগল্পঃ মন – ভূমিকা গোস্বামী

  1. সুন্দর গল্প। অনুতাপ সুস্থ হয়ে ওঠার লক্ষণ।

Leave a Reply to Soma Sengupta Mukherjee Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *