সাম্প্রতিক ১৮ঃ জিংগেল বেল – অনিরুদ্ধ সুব্রত

জিংগেল বেল
অনিরুদ্ধ সুব্রত

শীত আসলেই সান্টাক্লজ, ব্যাপারটা আর সমুদ্র পারে বাঁধা নেই । বাঙালির শহর কলকাতা, শহরতলি, বা জেলা শহরের পার্কেও দেখা মেলে স্থূলকায়, হাসি মুখ, সাদা চুল-দাড়ি ওয়ালা আলখাল্লা পরিহিত এক স্নেহময় মানুষের । গ্রিস সহ বিভিন্ন দেশের লোককথা থেকে উঠে আসা সেন্ট নিকোলাসের জীবনের উপাদানে এই কিংবদন্তী চরিত্রের উপস্থিতি । আসলে আধুনিক রূপকল্পটি ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের বড়োদিনের ইচ্ছে পূরণের সহজ অবতার । পরনে সাদা কলার ও কাফ যুক্ত লাল কোট আর সাদা কাফ যুক্ত লাল ট্রাউজার, কালো চামড়ার বেল্ট ও বুট জুতো এবং মাথায় লাল শঙ্কু আকৃতির টুপি।
নানান উপাখ্যান মিলিয়ে মোটামুটি, সান্টাক্লজ সারা বিশ্বের শিশুদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে ভালো ছেলেমেয়েদের দিয়ে যান ভালো ভালো উপহার,যেমন খেলনা ,লজেন্স ইত্যাদি । আর দুষ্টু ছেলেমেয়েদের কখনও কখনও দিয়ে যান কয়লা। যদিও সমালোচকদের মতে এই উৎসব আঙ্গিকটি নিতান্তই অবান্তর । তবু এই মজার প্রথাটি প্রায় পৃথিবীর সর্বত্রই দিন বিশেষে চলছে। স্বাভাবিকভাবেই শিশুদের কাছে সান্টাক্লজ এক মজার ও আংশিক জাদু চরিত্র ।
ডিসেম্বরের শীত রাতে বাড়ির দরজায় ঝুলিয়ে রাখা মোজা বা দস্তানায় সকালে যদি কিছু উপহার খুঁজে পাওয়া যায়, শিশুদের কাছে সে এক বিরাট আনন্দের। স্থাবর অস্থাবর সম্পদ, অর্থ সম্পর্কে শিশুরা কিছুই খোঁজ রাখে না। পৃথিবীতে তারা আগামীর নাগরিক । উপহার পেতে তাদের ভালো লাগে । প্রবীণ তাকে উপহার দিয়ে গেলে তারা আহ্লাদে আটখানা । আসলে নতুন প্রজন্মকে আনন্দ দানের এক অঙ্গীকার হিসেবে একে ধরে নেওয়া যায় অনায়াসে । যেখানে ভালো আর দুষ্টু এই পার্থক্যও তাদের শিশুমনে ভালো হয়ে ওঠার বার্তা হিসেবে পৌঁছায়।
অথচ আমরা যারা বয়সে বড়ো, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেউ পদাধিকারী, কেউ বা ধনী,কেউ দায়িত্বশীল শুধুই নাগরিক । আমাদের শিশুদের জন্য আমরা কতটুকু সান্টাক্লজ হতে পারছি ? প্রথমেই মনে হয় স্বাধীনতার দীর্ঘ যাপন হলো, কিন্তু দেশের শিশুমৃত্যু হার আজও শূন্য হলো না কেন ? অপুষ্টির প্রভাব জনিত কারণে প্রতি নিয়ত অসুস্থ শিশুদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা টুকুও এখনও শত শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া যায় নি। সবার জন্যে শিক্ষা বলে এক দশকের বেশি দৌড়ে এখনও দেশের সমস্ত শিশুকে শিক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে আসা যায় নি।
এই তো মাত্র কিছুদিন, দেশের বড়ো বড়ো শহর থেকে দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরছিল, আমরা দেখেছি ক্ষুধার্ত অবসন্ন শিশুরা মা বাবর সঙ্গে পথ চলছে। কোথায় ছিলেন তখন এই দেশের ইয়া বড়ো বড়ো রাজনৈতিক, ব্যবসায়ীক,নীতিবাগীশ সান্টাক্লজের দল ? গত দুদিন আগে শিশু- ধর্ষণ বিষয়ে রাষ্ট্র একটা কঠিন পদক্ষেপ নিতে সহমত হয়েছে । কিন্তু তাও কি ভরসার হাত এখনও প্রকৃষ্ট ও পর্যাপ্ত বলে মনে করা যায় ? একটা সময় শিশু শ্রম নিয়ে অনেক জল ঘোলা করা হয়েছিল, কিন্তু কোথায় সে আইনের প্রয়োগ ? এই সেদিন শহরতলির তেলের গুদামে কাজ করা দুটি তাজা শিশু বিষ্ফোরণে পুড়ে মারা গেল। কতটুকু সচতন হলাম আমরা ? ঘরের কাজ থেকে কারখানার কাজ, বিপজ্জনক থেকে দাহ্য বস্তুর স্তূপ সর্বত্রই শিশুদের রীতিমতো কাজে লাগানো চলছে। খেয়াল করার সময় কোথায় সরকার বা প্রশাসনের।
এরপরও অনেক প্রসঙ্গ থেকে যায়, আজকের ডিজিটালাইজেশনের নামে শিশু মনে যে দূষণ দ্রুত হারে ঢুকছে, কোথায় তার উপযুক্ত দেখভাল । সাইবার ক্রাইম বলে ধুয়ো তুলেই ক্ষান্ত, তার সুরাহার দায়িত্ব কে নেবে ?
ব্যাঙের ছাতার মতো শহর,মফস্বল ছাড়িয়ে এখন গ্রাম দখলে নেমেছে বেসরকারি বিদ্যালয় । রাষ্ট্রের তাতে মহা আনন্দ । ধীরে ধীরে সরকারি স্কুল উঠে গেলে শিক্ষাখাতটাই থাকবেনা একদিন । অথচ দেশের শিশু শিক্ষা কাঠামোর আধুনিকীকরণ , শিক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি কিছুতেই আলোচনায় আসছে না।
শিশুদের কাছে দেশটা সান্টাক্লজ না হতে পারলে, বড়াই করার কিছুই থাকে না। আজকের শিশুরাই কালকের দেশ চালক হবে, কিছু পেলে কিছু দেবার শিক্ষা তাদের আপনা থেকেই হতো । আজ বড়ো দিন বলে অবতার যিশুকে মনে করে বলা যায়, ওরা জানে না ওরা কী করছে। কিন্তু বলা যায় না, ঈশ্বর এদের ক্ষমা করবেন ।
—- অনিরুদ্ধ সুব্রত (২৪\১২\২০)

4 thoughts on “সাম্প্রতিক ১৮ঃ জিংগেল বেল – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. সত্যি , কবে দেশটা কবে হবে সব্বার জন্য সান্টাক্লজ ? প্রতিক্ষায় রইলাম। লেখককে ধন্যবাদ অভিনন্দন।

    1. ভীষণ সুন্দর আর প্রাসঙ্গিক লেখা। আমরা জানি না রাষ্ট্রের হয়ে সান্টা কোনদিন কিছু করবে কিনা। তবু আশায় থাকি।

  2. সান্টা রাষ্ট্র নেতাদের দস্তানায় জ্বলন্ত কয়লা ফেললে সব চেয়ে ভাল হতো। লেখক একেবারে ঠিক কথা বলেছেন।

  3. সুন্দর সময়োপযোগী লেখা।

Leave a Reply to ভূমিকা গোস্বামী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *