শীতের খুশী – উপচে পড়া ফুলে / রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

ছবি- সংগৃহীত

শীতের খুশী – উপচে পড়া ফুলে – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

এখন শীত চলছে পৌষের আর দেরী নেই। শীত  এসে গেল, চারদিকে শীতকে উপভোগ করার সব সরঞ্জাম প্রস্তুত। কদিন আগেও করোনার জ্বালায় সবজির দাম আগুনের মত জ্বলছিল দাউ দাউ করে। ফুলকপির দাম ঝপ করে নেমে গেছে, সঙ্গে অন্যান্য সবজির দামও, শুধু আলু, পেঁয়াজ, আদা এসব ছাড়া। লঙ্কার দাম কমে কমে আবার উঠতে চাইছে। সেই ১৯৯৮ সালেও এসময় লঙ্কার দাম খুচরো বাজারে একশ টাকা ছুঁয়েছিল।
যাইহোক, শীতের সময় প্রতিবারের মত সিজন ফ্লাওয়ার ফুটে উঠছে প্রাকৃতিক নিয়মে, করোনা তাদের কিসসু করতে পারে না, পারার কথাও না। বিভিন্ন পুষ্পপ্রেমী মানুষরা আগামীদিনের পুষ্প প্রদর্শনীর জন্য তৈরী হচ্ছেন। গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে-বৌ-মায়েরা তাঁদের বাড়ির গাছ গাছালি নিয়ে যত্ন নিচ্ছেন।
কদিন আগে সোনারপুরে আমার মেয়ে তার ফুল প্রেমী এক বান্ধবীকে নিয়ে কোন এক নার্সারিতে দুপুরের মিঠে রোদে, অবশ্যই করোনা ঠেকানোর মাস্ক মুখে, হাজির হয়েছিল। ওর বর তখন করোনার সাবধানতা মেনে অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলেন, ফিরবেন সেই সন্ধ্যের পর। তাই চুটিয়ে নার্সারির সাজানো হাজার হাজার ফুলের গাছ আর ফুল দেখেছে দুজনে চারটি চোখ দিয়ে। কিনেছেও পছন্দের আর প্রয়োজনের ছোট ছোট চারাগাছ থলে ভ’রে। মোবাইল ফোনে বন্দী করে সেসবের ছবি আমাদের পাঠিয়েছেও।

মেয়ের মা, মানে আমার গিন্নি সারা বছরই বাড়ির ছাদে, বারান্দার ব্যালকনিতে, বাড়ির সঙ্গে সামান্য জমিতে ফুলের গাছের যত্ন ও সমারোহ করেন, ছেলে মেয়ে বৌমাদের দেখান, দূরবাসীকে ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়েও দেন। এবং প্রায়ই।
এবার তিনিও তিন-চার কিলোমিটার দূরে ‘বনবিতান’ নার্সারিতে গেলেন। সঙ্গে প্রায় নির্বাক দর্শকের ভূমিকায়, স্যানিটাইজড্ করে, মাস্ক পরে টোটোয় চললাম। নার্সারির ভেতরে অনেকটা জমি গাছগাছালিতে ভরা। অফুরন্ত অক্সিজেন। প্রথম পদক্ষেপেই ভাল লাগলো। আমার গিন্নি তাঁর পছন্দের গাছগুলো নির্বাচিত করতে লাগলেন আর আমি মাঝে মাঝে পছন্দ গুলো দেখে দেখে দু-একটা অদলবদল করালাম। তবে  বেশির ভাগ সময় এদিকে ওদিকে ঘুরে ঘুরে বাগানটা দেখতে লাগলাম। নার্সারির অনেক কর্মচারী, তাঁরা ফুল-ফলের যত্ন নিতে ব্যস্ত আর নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করতে আরও বেশি দক্ষ। নার্সারিকে অনেক বেশি দর্শনীয় করে তোলার যেন প্রয়োজনই মনে করেন না।

এই প্রসঙ্গে সৌন্দর্যপ্রিয়তার জন্য আমাদের এশিয়া মহাদেশের অন্যতম দেশ জাপানের কথা মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানে গিয়েছিলেন আগের শতকের প্রথম দিকে। মাঝামাঝি সময়ে (১৯৫৭) গিয়েছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় আর তার পরে গিয়েছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্ন্যাল। এছাড়াও অনেকেই গিয়েছিলেন। প্রায় সকলেই জাপানের সৌন্দর্যপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। উপরের দুই সাহিত্যিকের লেখা পড়ে জেনেছি ওদেশের ‘ইকোবানা’র কথা।
ইকোবানা হল ফুল সাজানোর পদ্ধতির নাম। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে জাপানের বিশিষ্ট শিল্প ইকোবানা জন্ম নেয়। ফুলের বহুমুখী ব্যঞ্জনাকে ফুটিয়ে তোলার কাজ একজন শিল্পীর, প্রকৃত শিল্পীর। ডাল, লতা, পাতা, কাঁটা এমনকি শুকনো ডাল দিয়েও ফুল সাজানোর নানান নিয়ম জানতে হয়, উপযুক্ত শিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ ইকোবানা শিল্পনির্ভর জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। জানা যায়, এই শিল্প শেখানোর জন্য অসংখ্য স্কুল আছে সেখানে।
‘ইয়ো’ # ‘ইন’ – এর সামঞ্জস্য বিধান করা ইকোবানার অন্যতম দিক। ‘ ইয়ো ‘ হল ধনাত্মক শব্দ, যার অর্থ আলো। আর ‘ ইন্ ‘ হচ্ছে ঋণাত্মক শব্দ যার অর্থ অন্ধকার। আলো আর অন্ধকারের সামঞ্জস্য করা। অস্তি নাস্তির সামঞ্জস্য বিধান করা।
বাহ্যিক গঠনের মূল সূত্র ‘ শিন্ সো তাই ‘। ‘শিন্’ মানে মানুষ, ‘সো’ মানে স্বর্গ আর ‘তাই’ কথার অর্থ মর্ত‍্য। ইকোবানায় সবার নীচে ‘তাই’ মর্ত‍্য বা পৃথিবী; মাঝে ‘সো’ বা স্বর্গ এবং সবার উপরে ‘শিন’ বা মানুষ – “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” কথাটা জাপান দীর্ঘদিন ধরে মানছেন।
ইকোবানা নিয়ে অন্য একটা বিন্যাস যাকে ওঁরা বলেন ‘ মোরু ‘, ‘ নাগেইবেরু ‘ ও ‘ তাতেরু ‘ – মোরু মানে শায়িত, নাগেইবেরু মানে উপবিষ্ট বা বসা আর তাতেরু কথার অর্থ হলো দণ্ডায়মান বা দাঁড়িয়ে আছে ।
কতটা আধ্যাত্মিকতার বোধ থাকলে ইকোবানার সাজসজ্জা নিখুঁতভাবে করা যায় তা জেনে বিস্মিত না হয়ে পারি নি। ত়াঁদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় ইকোবানার ব্যবহার অর্থনৈতিক, সামজিক ও নান্দনিক দিকে সমান গুরুত্ব বহন করে।
এভাবে ফুলের সৌন্দর্য্যকে আরও সুন্দর করে তোলেন জাপানের মেয়ে-বৌ-মায়েরা, সময় করে কোন কোন ছেলেরাও হাত লাগান। তবে পাত্রী পছন্দের জন্য  বয়স্কদের কেউ কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, মেয়ে ইকোবানা জানেতো ?

আমাদের দেশেও ফুল সাজানো গোছানোর গুরুত্ব কিন্তু কম নয়। সাজানো হয় ফুল দিয়ে ঠাকুর, ঠাকুর ঘর, ধর্মস্থান, উৎসবস্থল কত কী !

‘ মাতা আইমাসো ‘ – আবার দেখা হবে।

3 thoughts on “শীতের খুশী – উপচে পড়া ফুলে / রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

  1. বেশ অন্য রকম লেখা। ভাল লাগলো।

  2. খুব ভালো লাগলো পড়ে। ইকোবানা কথাটা জানতাম। শুনেছিলাম ফুল সাজানোর পদ্ধতিকে ইকোবানা বলে। এতো সুন্দর করে ইকোবানার বিশ্লেষণ জেনে ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *