
‘রাজনীতিতে সৌজন্যের কালচার দরকার ‘
এই সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ লেখার সময় পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল বলেই চিকিৎসকরা জানিয়েছেন । সংবাদ সূত্রে জানা যায় গত ৮ই ডিসেম্বর তিনি অসুস্থ বোধ করায় দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হন। পরদিন বুধবার তাঁর শারীরিক পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছিল, যদিও বর্তমানে স্থিতিশীল আছেন ।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে যান। বুদ্ধদেব জায়া এবং কন্যার সঙ্গে দেখা করে সব রকম সাহায্য সহযোগিতার কথা বলেন। বুদ্ধদেব বাবুর দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন । বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এও বলেন, প্রয়োজনে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে আরও সহযোগিতা করতে সরকার প্রস্তুত ।
অতীতের প্রতি বর্তমানের এই আন্তরিক সহানুভব, দায়িত্ব বোধ , আশ্বস্ত করার সৌজন্য আমাদের কাছে সত্যিই প্রত্যাশিত । শুধু মাত্র সরকার প্রধান হিসেবে নয়, সম্মানীয় প্রবীণ প্রতিপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধাও এতে সুপ্রকাশিত। একজন উত্তরসূরি, যে কোনও ক্ষেত্রেই তাঁর (হোক সে মতাদর্শের প্রতিদ্বন্দ্বী) পূর্বসূরিদের প্রতি আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল হলে, তাতে উত্তরসূরির সম্মানই শ্রীবৃদ্ধি হয়। ভারতীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যার উদাহরণ ধীরে ধীরে তলানিতে । সেখানে এই সাম্প্রতিক বিষয়টি বেশ আশান্বিত করে ।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, সব রাজনৈতিক পক্ষেই এই সৌজন্যের প্রকাশ একমাত্র গুরুতর অসুস্থ বা মৃত্যু পথযাত্রী প্রবীণ প্রতিপক্ষের নির্দিষ্ট দু’একজন ব্যক্তি বর্গের ক্ষেত্রেই কী ? না কি এটা একটা দৃঢ় মানসিক ঔদার্যের পরাকাষ্ঠা হয়ে নেতা নেতৃদের মনে স্থিতিশীল হবে ?
ভারতবর্ষে ভোট মরশুম জাঁকিয়ে আসতে চলেছে। পাহাড় থেকে সমুদ্র উত্তাল হতে খুব একটা বিলম্ব নেই । করোনা পরিস্থিতিকে প্রায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিকে দিকে মিছিল, পাল্টা মিছিল, জনসভা ঢাকে দিয়েছে কাঠি। মাইক্রোফোনের আর ফুরসত নেই, থুথু থেকে নিন্দা সবই তাকে সহ্য করতে হবে।
অনতি অতীতে আমাদের বারংবার উদাহরণের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ জনপ্রতিনিধি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে । ফলাফল ও প্রকাশিত । সেখানেও ঘটেছে ব্যক্তি ও মতাদর্শগত বদল। জনগণ মেনে নিয়েছে তাদের নতুন রাষ্ট্রপতিকে,বিদায় নিয়েছেন পুরাতনী । কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সেখানে গালাগাল ছিল না, ব্যক্তিগত আক্রমণ ছিল না , নিন্দা করতে গিয়ে খাপছাড়া ভাষা প্রয়োগের প্রয়োজন হয়নি তাদের । বরং প্রতিপক্ষ প্রত্যেকেই নিজের নিজের লক্ষ্য, ধারণা, দেশের ভবিতব্য নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন । সাধারণ মানুষ সেই বক্তব্য এবং পূরববর্তী কাজের ভিত্তিতে তাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ক্ষমতার জায়গায় নবীনে প্রবীণে সেখানে সৌজন্যের বিন্দুমাত্র চ্যুতি ঘটেনি। হিংসা, দ্বেষ পারতপক্ষে সে দেশে রাজনৈতিক কারণে বা নির্বাচনের কারণে বিশেষ ঘটেই না।
অথচ এই ভারতবর্ষ, আর তার গুচ্ছ রাজ্যের অন্যতম আমাদের পশ্চিম বঙ্গেও নির্বাচন পরিস্থিতি বা নির্বাচনের পরবর্তী পরিস্থিতি কোনও অবকাশেই রাজনৈতিক সৌজন্যের ছিটেফোঁটাও নেতা নেতৃবর্গের মধ্যে পরিলিক্ষত হয় না। এ দেশে রাজনৈতিক নেতা নেত্রী বাদ রেখেও বিশাল একটা শ্রেণি আছে , ‘যারা রাজনীতি করে’ বলে পরিচিত । কিন্তু তারা সৌজন্যের পাঠ পাবে যেখানে, সেই নেতৃবৃন্দের মধ্যে যদি প্রতি মুহূর্তে সহনশীলতা ও সৌজন্য বোধের অভাব ঘটে, যদি তারা মঞ্চ, মাইকে যাচ্ছে তাই রকমের অপশব্দ আর নিন্দা ,তর্জন চালিয়ে যান ; তাহলে রাজনৈতিক সাবালকত্ব আসবে কবে ?
জীবনের শেষ প্রান্তে পৌছানো নেতা নেত্রীকে সম্মান জানানো অবশ্যই মানবিক ও উত্তরসূরিদের সৌজন্য বোধের পরিচায়ক। পরস্পরের প্রতি সহানুভূতির এই বার্তা যে একটা স্থায়ী কালচারে পরিণত হওয়ার দরকার । এই সত্য ভারতবর্ষ তথা রাজ্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কবে সুপ্রতিষ্ঠা পাবে ?
আমরা কি বুঝি না রাজনৈতিক হিংসা, হত্যা, ধ্বংস, প্রতিহিংসা এমন ঘৃণ্য অপরাধ প্রবণতা গুলো আসলে উপর থেকে গড়িয়ে আসা জলের ধারার মতো নীচের দিকে বেশি ক্রিয়াশীল হয়। মঞ্চ থেকে একটি গালাগাল ছুড়ে দিলে সমবেতর মধ্যে তার সংক্রমণ ঘটে। ধীরে তা একটি মারাত্মক অসুখের সঞ্চার ঘটায় । তাই সৌজন্য, সুভাষা প্রয়োগ এবং সহনশীলতা যদি মাইক্রোফোন বাহিত হয়ে সমবেতর কাছে পৌঁছায়, তবে বহুর মধ্যেও তা ব্যাপক সহ্য শক্তি বৃদ্ধি করে । সাধারণ মানুষই যে ঐ সমবেত, যারা তিলকে তাল করতে বিবেচনা করে না। তাদের মধ্যে একটা সহনশীল সৌজন্যের অভ্যাস গড়ে তুলতে রাজনৈতিক কেউকেটাদের সাবধানী ও সহনশীল হয়ে উঠতে হবে আগে।
একুশ শতকের প্রথম দুটো দশক শেষ হলো, ভারতীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই সহানুভূতিশীল সৌজন্য চিত্রের নিত্য দর্শনের প্রত্যাশা করা কি এতটুকু বেশি চাওয়া !
—- অনিরুদ্ধ সুব্রত ।
সাম্প্রতিক লেখাটির সঙ্গে একমত। মতের ও পথের ভিন্নতা থাকতেই পারে, তাই বলে তার সহবৎ , শিক্ষা, মনুষ্যত্ব খুইয়ে ফেলবে এটা সভ্যতার অপমান।
অনিরুদ্ধবূবু খুব নরম করে বলেছেন। এইসব। ছড়া কাটা পিসি কাকা, দাদাদের এক্কেবারে বয়কট করা দরকার। তলানিতে এনে ফেলেছে এরা বাংলার সস্কৃতিকে। তাই ” বহিরাগত”রা ভুল উচ্চারণে রবিঠাকুরের কবিতা বলার সাহস পাচ্ছে।
লেখাটি পড়ে একদম সহমত হলাম। নেতানেত্রীদের এটা বোঝা দরকার যে তাদের মুখনিঃসৃত কথা তাদের ক্যাডাররা বাণীর মতো মনে করে। তাই তাদের ভাষা সংযম না থাকলে নীচের তলার থেকে এর বেশি আশা করা যাবে না।