ঘর বাঁধার স্বপ্নেও আদালত ?
অনিরুদ্ধ সুব্রত
গত ২৪ শে নভেম্বর দিল্লি হাইকোর্ট -এ সুলেখা-বাবলু মামলা প্রসঙ্গে একটি রায়ে বিচারপতি বিপিন সঙ্ঘী এবং বিচারপতি রজনীশ ভাটনগরের বেঞ্চ জানান, ” যেকোনও ব্যক্তির সঙ্গে নিজের ইচ্ছানুসারে বসবাসের স্বাধীনতা প্রত্যেকেরই আছে।” স্বাভাবিক ভাবেই এই রায়ে সুলেখা এবং বাবলু দুজনেই ভারতবর্ষের তরুণ নাগরিক হিসেবে অনেকখানি ভরসা পাবে আশা করা যায় ।
রায় ব্যাখ্যায় বিষয়টিকে দেখা হয়েছে এই ভাবে, একজন পূর্ণ বা প্রাপ্ত বয়স্ক নারী তার নিজের ইচ্ছায় যে কোনও জায়গায়, যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে থাকার স্বাধীনতা পাবে। অতএব এই রায় নিশ্চিতভাবে পরবর্তী কালে ভারতবর্ষের যে কোনও রাজ্যের যেকোনও বিচারালয়ে একই বিষয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।
ডিজিটাল ভারতবর্ষ জাত পাতের বৈষম্য হ্রাস হওয়া দূরে থাক, ভিন জাতে বিবাহ দেখলেই রে রে করে তেড়ে আসায় অভ্যস্ত । পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে যুবক যুবতীকে খুন, অত্যাচার বিন্দুমাত্র কমেছে বলে হলপ করা যায় না । তার সঙ্গে নবতম সংযোজন ‘লাভ জেহাদ’, আসলে ঐ একই ধ্যান ধারণারই এক ধারাবাহিক মোড়লগিরি। অতি সাম্প্রতিক কালেও এই জাত ধর্ম নির্ভর সামাজিক নিষেধাজ্ঞা ভারতীয় তরুণ নর নারীদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে দিয়েছে । এখন দেখা যাক দিল্লি হাইকোর্টের এই রায়ে তথাকথিত স্বঘোষিত সমাজ রক্ষকদের আদৌ লজ্জা হয় কি না।
কথায় কথায় ইউরোপ আমেরিকার উন্নততর জীবন যাপনের সুবিধা ও শিল্প সংস্কৃতি আমাদের আকর্ষণ করে । স্বাধীনতার পর সত্তর বছর অতিক্রম করায় কিছু স্বাজাত্য শ্লাঘা আমারা অর্জন করেছি। বৃহত্তর সংবিধান তৈরির অহংকার একেবারে কম করি না আমরা। রোজই নতুন করে লিখছি স্বদেশের বীর গৌরব গাথা। দেশীয় সংস্কৃতির গভীর তাৎপর্যের রকমফের আমরা কয়েক ডজন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি । অথচ একবিংশ শতাব্দীতে এই রামায়ণ মহাভারতের দেশে একটি কুড়ি বছরের প্রাপ্তবয়স্ক তরুণী কাকে বিয়ে করবে, কোথায় কার সঙ্গে থাকবে— এটা অন্যের মর্জির উপর নির্ভরশীল হবে ?
দেশকে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার পথ যদি উদার অর্থনীতি হয়, যদি পদে পদে আত্ম নির্ভর দেশ গঠনের ডাক দেওয়া হয়, বেসরকারীকরণে যদি জাতীয় নানান বিষয়কে তুলে দেওয়া যায়, তাহলে নাগরিকের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছা কেন আদালতের রায় ব্যতীত মর্যাদা দাবী করতে পারবে না ?
পূর্ণ বয়স্ক মানুষের বৈবাহিক সম্পর্ক আজকের পৃথিবীতে নানান ধরণের । আজ নারী পুরুষ ছাড়াও সমাজ এবং সরকারি ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্ব ও পূর্ণ নাগরিক অধিকার স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে । মানুষ এও মেনে নিতে চলেছে লিঙ্গ পরিবর্তনকারীর স্বতন্ত্র পরিচয়।
অথচ চরম আশ্চর্যের বিষয় ভারতবর্ষের প্রাচীন বৈবাহিক সামাজ তত্ত্ব ! যেখানে সাধারণ তরুণ নর নারী তাদের নিজস্ব ইচ্ছা, পছন্দ, রস , রুচি অনুসরণ করতে রীতিমতো বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে চলেছে। কখনও পারিবারিক সম্মানের অছিলা, কখনও বা চেনা ছক বহির্ভূত সম্পর্কে পরিবার ও সমাজ হয়ে উঠছে একেবারে মারমুখী । ফলে হাতের নাগালে পেলে অত্যাচার থেকে হত্যা বাদ যাচ্ছে না কিছুই ।
এই দেশে উদার অর্থনীতির ধ্বজা উড়লেও ,উদার সামাজিক রীতি এখনও অধরা। প্রাচীন উচ্চ, নীচ সামাজিক অবস্থান নিয়ে প্রতি নিয়ত জল ঘোলা করার খেলা চলছে। ভিন্ জাতি ধর্মে হৃদয় ঘটিত সম্পর্কের মূল্য তো অবনমিত হচ্ছেই, পরন্তু উত্তেজনা পৌঁছে যাচ্ছে খুনখারাবি পর্যন্ত লজ্জা তখনই লাগে, যখন দেখা যায় একই দেশের বিজ্ঞান মঙ্গল গ্রহে পাড়ি জমাচ্ছে আর নীচু জাতে বিবাহ করার জন্য তরুণীকে খুন করা হচ্ছে । প্রতি মুহূর্তে যুব সমাজকে সবক শেখানোর জন্য একদল উন্মাদ মানবিক পরিচয় উপেক্ষা করে বিচার করতে এগিয়ে আসছে জাতি,সম্প্রদায়ের, বর্ণের পরিচিয়কে প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ শর্ত দেখিয়ে । অথচ দুটি মানব মানবীর স্বাভাবিক মিলন হিসেবে দেখা এক্ষেত্রে আদৌ অভ্যাস-এ পরিণত হচ্ছে না ।
সকলের সার্বিক বিকাশের গ্যারান্টি পাবার আগে , সবার সঙ্গে সরকারি সকল মঙ্গলময় উদ্যোগ রয়েছে বলার আগে ভারতীয় তরুণ প্রজন্মের জন্য একটা মানবিকতার গ্যারান্টি কী আজকের ভারতবর্ষ দিতে পারে না ? সব যদি আদালত বললেই মিটে যেত, তবে নিয়ত ধর্ষণ, খুন হয়তো এতো দিনে নিশ্চিহ্ন হতো । কোন মানুষটা কোন মানুষকে আপন করে নেবে, কাকে বিবাহ করে কে ঘর বাঁধবে তা কি সমাজের কুতসিৎ নীতিবাগীশদের মর্জির মাফিক ? আজকের রাষ্ট্র ব্যবস্থার হাল যাদের হাতে , এই মানবিক প্রশ্নে তাদের কাছেই সরকারি প্রচেষ্টার প্রত্যাশা । দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের আহ্বান নানা সময়ে নানান মহত ব্যক্তি বর্গ রেখেছেন, খুব কিছু কাজ হয়নি তাতে। কারণ এই সমাজ রক্ষার নামে অত্যাচারের পিছনে অর্থ ও রাজনৈতিক শক্তিও একটা প্রধান কারণ । সুতরাং আদালত যদি চোখে আঙুল দিয়ে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির নির্দেশ করে, রাষ্ট্র ব্যবস্থার উচিত তার প্রচার প্রসার ও সেই যৌক্তিক পথ নির্দেশের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ।
তা না হলে অচিরেই আত্ম নির্ভরশীলতার স্বপ্ন দেখার সাধ ভেঙে খানখান হয়ে যাবে । নাগরিকের মানবিক মূল্যায়ন না হলে, ইচ্ছের স্বাধীনতা না থাকলে কোনও আত্ম নির্ভরতার কাহিনীই তার কাছে বিশ্বাস যোগ্য হবে না। বরং সংস্কারাচ্ছন্ন, পিছিয়ে থাকা জাতির পঙ্গু নাগরিকত্ব তাকে আত্ম হত্যার সমতুল মনে করবে। সেখানে দাঁড়িয়ে আধুনিকতার প্রসঙ্গ গাঁজাখুরে গল্প মনে হবে।
ভীষণ প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করলেন। অভিনন্দন ….💐💐
“লাভ জেহাদ” শুধুমাত্র বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োগ। ভারতবর্ষের সামাজিক পরিকাঠামোর আজও মেয়েদের যেখানে ফ্যামিলি ফটো তে স্থান পেতে বিশাল আয়তনের পন দিতে হয় সেক্ষেত্রে শতকরা কতো জন মেয়ে অন্য ধর্মের সাথী খোঁজে? সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে মৌলিক বিষয় থেকে জনগনের দৃষ্টি ফেরানো একমাত্র উদ্দেশ্য !
আলোচনাটা ভালো লাগলো।
খুব ভালো আলোচনা।
খুব ভালো।
যথাযথ বিচার। ভালো লাগল।