ছোটগল্পঃ ভিন্ন রস (১) – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

ভিন্ন রস (১)
রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

এ রস হয়তো সকলের চিত্তে কোন প্রতিক্রিয়া আনতে পারবে না। হয়তো কেউ এ রসের কথা দেখলেই অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। সকল জগৎবাসীর কিন্তু এ রসে ডুব দেবার প্রয়োজন আছে তবুও মানতে চাইবেন না। তাঁদের অনেকেই হয়তোবা মনে করবেন এসব রসের কথা জানতে আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখলে বা জানতে পারলে লোকের কাছে মাথা নিচু হয়ে যাবে।

এ রসের নাম কৃষ্ণ রস। মধুর থেকে মধুরতম রস। এ রসের নাম ভগবৎ রস। এ রসের নাম সর্বশক্তিমান জগৎ স্রষ্টার রস। জগৎস্রষ্টা তিনি, যে কোনো বিশ্বাসের, যে কোনো দর্শনের (Philosophy) র মানুষ হন না কেন, জগৎস্রষ্টা আছেন, ছিলেন আর থাকবেন অনন্ত কাল ধরে। আমি কৃষ্ণ রস বলি। অন্য জন কৃষ্ণের বদলে অন্য নামে তাঁকে আখ্যায়িত অনায়াসেই করতে পারেন।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু গম্ভীরায় বসে একসময় তাঁর অনুগামীদের জন্য লিখেছিলেন শিক্ষা শ্লোকাষ্টক অর্থাৎ আটটি শ্লোকে পরবর্তী বৈষ্ণবদের শিক্ষার জন্য তাঁর নির্দেশ লিখছিলেন। তার দ্বিতীয় শ্লোকটি ছিল –
নাম্নামকারি বহুধা নিজসর্বশক্তিস্তত্রার্পিতা নিয়মিতঃ স্মরণে ন কালঃ।
এতাদৃশী তব কৃপা ভগবন্মমাপি দুরদ্দৈবমীদৃশমিহাজনি নানুরাগঃ।।
অর্থাৎ, হে ভগবান, তোমার এরকম করুণা যে, বহু নাম সমূহে তুমি তোমার নিজের সর্বশক্তি নিহিত রেখেছ । আর সে সব নাম স্মরণের জন্য অনেক সময়ও দিয়েছ। কিন্তু আমার এমন দূরদৃষ্ট যে, সেই তোমার নামে আমার অনুরাগ জন্মাল না।

এক সময় আমিও এরকমটাই ছিলাম। আমার স্কুলের এক জন প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় মাস্টার মহাশয় আমাদের পড়ানোর ফাঁকে শেখাতেন ওসব মানুষের তৈরী। বাবা যখন শিষ্য বাড়ি ঘুরে বাসায় ফিরতেন তখনই আমি এই অনাধ্যাত্মিক শেখানো বুলিগুলো বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে বলতাম। আমার বাবা সেসব শুনে কোন রাগ প্রকাশ করতেন না। মাঝে মধ্যে দু-একটা যুক্তি দেখিয়ে বোঝাতে চাইতেন আর হাসতেন। কখনও স্কুলের শিক্ষক মহাশয়ের প্রতি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া করে মন্তব্য করতেন না। তবে আমাকে বলতেন প্রতিদিন স্কুলে যাবার সময় তুলসী গাছের তলায় প্রণাম করে বের হতে হবে। কৈশোর কাল থেকে তাই অদ্যাবধি তুলসীতলায় দিনে অন্তত একবার প্রণাম করে থাকি। ব্যস ঐ পর্যন্ত ।

গত শতকের তিয়াত্তর সালে অফিসের কাজে আমায় ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় যেতে হয়েছিল। বাড়িতে মা দাদা বৌদি আর নিজের দশ মাস আগে বিয়ে করা বৌকে রেখে যেতে হয়েছিল। এক মাসের বেশি থাকতে হয়েছিল। এত বেশি সময় থাকতে হবে জানলে হয়তো কারোর মাধ্যমে ভূমিকাকে আগরতলার প্লেনে উঠিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করা যেতো। নিজের সঙ্গে নেবার সুযোগ ছিল না, কেননা অফিস থেকেই আমরা দুই অফিস স্টাফ সহ রেমিট্যান্স-এর জন্য প্লেন চাটার্ড করা হয়েছিল। একজন আমি আগরতলা ও অপর জন দিলীপ চক্রবর্তী উদয়পুর গিয়েছিলাম। দিলীপের উদয়পুর আর আমার আগরতলায় হোটেলে থাকবার খরচ অফিস থেকে আমাদের আগেভাগেই দিয়ে দেয়া হয়েছিল। হোটেলে উঠেওছিলাম, কিন্তু আমার বাবার পরম ভক্ত ও শিষ্য স্থানীয় ব্যবসায়ী বঙ্কবিহারী সাহা জানতে পেরে এক কুলি সহ হোটেলে এসে আমায় তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার কোন আপত্তি তিনি শুনলেন না। আমি গুরুপুত্র মাত্র অথচ আলাদা ঘর, আলাদা রান্নার মাসি যেন এলাহি ব্যাপার।

যাইহোক, আমার অফিসের কাজ মিটলে পরেরদিন সকালের ফ্লাইটে দমদম এয়ারপোর্ট নেমে মনে হল বাড়িতে ফিরবো, তবে সোদপুর যাবার পথে সামান্য ঘুরে একটু থেমে বরাহনগর ন-পাড়ার শশ্বুরবাড়ি থেকে আমার বৌকে তুলে নিলে কেমন হয়? বলা নেই কওয়া নেই শশ্বুর বাড়ি গিয়ে হাজির হওয়া এটা আমাদের বা ওঁদের বাড়ির রীতি ছিল না। তবু, কি মনে হল এয়ারপোর্ট অঞ্চলে থাকতেই গাড়ির চালককে বললাম – ভাই, গাড়ি ডান দিকের মধ্যমগ্রামের দিক দিয়ে না চালিয়ে বাঁদিকের দমদম চিড়িয়ার মোর দিয়ে আগে টবিন রোডের দিকে চালিয়ে নিয়ে চলুন। এখানে বলে রাখা ভাল, মিটারে যা উঠবে তার উপরে কুড়ি টাকা দিতে হবে এই চুক্তি ছিল‌। ফলে পথে আমার দেরী হলে গাড়ির মিটার উঠবে আর আমাকে সেই মতই ভাড়া গুণতে হবে। চুক্তির টাকাটা ছাড়াই।

এবাড়ির ওবাড়ির সবাইকে চমকে দিয়ে সস্ত্রীক সোদপুরের বাড়িতে ফিরে এলাম‌। মা শুধু মুচকি হেসে বলল – আগরতলা গেলি একা আর ফিরলি দোকা ? ভালই করলি, এক গাড়ি ভাড়া আর আনতে যাবার জন্য সময় বাঁচল।”
প্রসঙ্গ ছিল আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের অথচ ব্যক্তিগত কথা বলে অনেকটা সময় নিয়ে নিলাম, কাউকে যদি কোনও প্রকারে কষ্ট দিয়ে থাকি তার জন্য আগে ভাগেই দুঃখ প্রকাশ করে রাখলাম।

দুপুরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একটা বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘরের পাখা বন্ধ অর্থাৎ লোডশেডিং, ফলে চারদিকে নিঃসীম অন্ধকার। সাধারণতঃ , আমার মা লোডশেডিং হলে এক দুই মিনিটের মধ্যে আমার ঘরে হ্যারিকেন জ্বেলে দিয়ে যান, অথচ দিয়ে গেলেন না। সাধারণত, এরকমটা হয় না। মা যতটাই ব্যস্ত থাকুননা কেন সব ব্যস্ততা রেখে আমার জন্য একটা আলোর ব্যবস্থা করে আগে আমার ঘরে দিয়ে যান। মাত্র এক মাসের শেষে মার এইরকম ভুলে যাবার কথাতো নয়। চারদিক অন্ধকারে ভরে আছে, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। অগত্যা একটা টর্চ নিয়ে আলো ছড়িয়ে এদিকে ওদিকে দেখতে চেষ্টা করেছিলাম তবু কোথাও কিছু দেখতে পেলাম না। আমার ঘরের পাশে আমাদের বড় ঘরটায়, চারদিকে বাঁশের বেড়া আর মাথায় টালি লাগানো বড় ঘরটায় আমার মা ও বাড়ির অন্যরা থাকতেন। অথচ সেই ঘরটাই নেই। আমি আমার ঘরের উঁচু ভিত থেকে সোজা আলো চালিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। সব শূন্য, মূহুর্তের মধ্যে আমার বুকটা হাহাকার করতে লাগছিল। অত বড় ঘর সঙ্গে লম্বা বারান্দা উধাও! আমি ভুল দেখছি নাতো ? মাত্র তো এক মাসের উপর কয়েকটা দিন। এইতো দুপুরে এলাম আগরতলা থেকে।

তখন আবার ঝড়ো হাওয়ার দাপাদাপি সঙ্গে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। ঝটপট একটা ছাতা এক হাতে কোনও রকমে ধরে অন্য হাতে নতুন টর্চ জ্বালিয়ে লাফিয়ে যেখানে বড় ঘরটা থাকার কথা পৌঁছে দেখলাম সবশুদ্ধ ঘরটা মাটিতে পড়ে গেছে বা মিশে গেছে।
চিৎকার করে মা মা করে ডাকতে লাগলাম। প্রথম দিকে কোনো উত্তর পেলাম না। ভয়ে বুকের ধুকপুকানি তীব্র হয়ে উঠল। ঘরের মধ্যে মা, বড় বৌদি আর তাঁর কয়েক মাসের শিশু কন্যা থাকার কথা। অথচ কোনো সাড়া শব্দ নেই। তবে কি সবাই ঘরের নীচে চাপা পড়ে – নাঃ আর ভাবা নয়। ঝড় জলের দাপট চলছে তাই ভেঙে পড়া ঘরের আরও কাছে গিয়ে আরও জোরে চেঁচিয়ে ডাকলাম – মা মা মা তোমরা বেঁচে আছ তো ? সবাই ঠিক আছো তো?
পড়ে যাওয়া ঘরের ভেতর থেকে মিহি গলায় আওয়াজ এল – আমরা সবাই ঠিক আছি। তুই মুরারিকে খবর দে।”
মুরারি অর্থাৎ আমার বড়দা, তিনি সে সময় ছোট একটা দোকান চালাতেন, পাড়ার আরেক মাথায় সেই দোকান ছিল।
পাশের বাড়ির এক মহিলা “আমি খবর দিচ্ছি” বলে ছুটলেন। দাদা ভিজতে ভিজতে তক্ষুনি চলে এলেন। দা দিয়ে বাঁশের বেড়া কেটে আমরা দুজনে মা বড় বৌদিদের বের হবার পথ তৈরি করতেই ভূমিকা এসে শিশু মানসীকে কোলে তুলে আমাদের ঘরে নিয়ে গেল।

এটা আমাদের যেমন অবাক করল তেমন ভালোও লাগল যে কারোর গায়ে একটি আঁচড়ও লাগেনি। ঝড়ের আগে হঠাৎ এক দমকা হাওয়ার ধাক্কায় আমাদের বাড়ির কাঁচা ঘরের মত সোজা পূর্ব থেকে পশ্চিম উত্তর অনেক গুলো বাড়ির বেশ কয়েকটি ঘরই ভেঙে গিয়েছিল।
মা প্রথমটায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও একটু পরেই যা বললেন তা শুনে আমরা আরও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। যেমন, আমাদের মা প্রতিদিনের মত বিকেলে তাঁর তক্তপোষে একটু শুয়ে বিশ্রাম করেন, বড় বৌদি বাচ্চাকে নিয়ে শুয়ে থাকেন তাদের নির্দিষ্ট তক্তপোষে, তেমনই এই দিনেও রুটিন মত সব চলছিল। তবে মা নীচে নেমে পানের বাটা বের করে সে সময় পান সাজছিলেন আর বড়বৌদি তাঁর বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য শিশুকন্যাকে নিয়ে নীচে নেমেছিলেন। ফলে, ওরা তিন জনের অবস্থান এমন জায়গায় ছিল যে দুটো বিছানার মাঝখানে তৈরি হওয়া ফাঁকা অংশে যেখানে ঘরের টালির চাল নেমে গিয়ে ঐ অংশটায় আলাদা একটা ছাউনি হয়ে গেছে। নীচে মা বসে বসে নিজের জন্য পান সাজছিলেন আর বড়বৌদি মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে দুধজাতীয় পানীয় খাওয়াচ্ছিলেন। তাঁদের উচ্চতা দুপাশের খাটের চাইতে কম থাকায় চালার টালি বিন্দুমাত্র তাঁদের স্পর্শ করতে পারে নি। ফলে, তাঁরা অক্ষত থেকেছিলেন।

এই ঘটনায় আমার চিন্তা ভাবনায় এক আমূল পরিবর্তন এনে দিল। এক মূহুর্ত আগে ঘটনাটি ঘটলে কি হতে পারত তা সহজেই অনুমেয়। ঘরটা ভেঙে চৌচির হলে কী হতে পারতো সেটা যে ভয়ঙ্কর ঘটনায় রূপ নিতে পারতো তা ভাবাও যায় না। একদিন আগের ঘটনা হলেও আমি ঘটনাস্থলে থাকতাম না, তাহলে হয়তো কয়েক ঘন্টা তিনটি প্রাণ আটকে থেকে কী দশা, হতো কে জানে।
যাইহোক, আমি ঘটনায় এতটাই বিমূঢ় হয়ে গেলাম যে ভাবতে লাগলাম এত অঙ্ক কষে আমার পরিবারের এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা এড়াতে কে সাহায্য করলো। একটা অদৃশ্য শক্তি নিশ্চয়ই আছেন যিনি পুরনো ঘর ভাঙা ছাড়া পরিবারের অন্য কোনো ক্ষতি চান নি। হয়না মৃত্যুর মিছিলে একজন মৃত্যুপথ যাত্রী বিস্ময়কর ভাবে সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন ? এরকম ঘটনাতো মাঝে মধ্যেই ঘটে থাকে বলে শুনেছি বা জেনেছি।
এই ঘটনায় শুরু হলো আমার জ্ঞানের বাইরে ঈশ শক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস, সে শক্তির যে কোনও নাম হতে পারে।
এরপর সারা জীবন ধরে আগে পরে অনেক ঘটনার কথা মনে পড়ে যে সব মানুষী প্রয়াসে কখনোই সম্ভব হবার নয়।

জানি, লেখাটা একটু বড় হলো। সে জন্য পাঠক সাধারণ মার্জনা করবেন, আশা করি।
আজ এ পর্যন্ত ।

2 thoughts on “ছোটগল্পঃ ভিন্ন রস (১) – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

  1. খুব ভালো লাগলো পড়ে।
    অনেক মানুষই বিশ্বাস করেন না কিন্তু অদৃশ্য একটা শক্তি আছে বলেই পূর্বাপর এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে এটা সত্যি।

  2. ঈশাবাস্য মিদং সর্বম্– ঈশ্বর সর্বত্র বিদ্যমান। এটা জানতাম। সেদিন প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম। তারপর অনেক অনেক বার অনুভব করেছি সেই করুণাময়ের কৃপা।

Leave a Reply to ভূমিকা গোস্বামী। Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *