ছোটগল্পঃ পুনশ্চ – সৌমিত্র ঘোষ

পুনশ্চ

সৌমিত্র ঘোষ

হয়তো ১৫ বছর হবে । ফেলে আসা দিনগুলো সত্যি যেন পিছু ডাকছে নীলাদ্রীকে । কেমন আছে পূর্বাশা ? আমাকে কি একবারও মনে করে ! যেন সেদিন, কলেজের পাঠ শেষ । পার্ট টু পরীক্ষার তোরজোড়, একসাথে প্রায় সাতজন আ্যকাডেমিতে নাটক দেখতে যাওয়া, ফেরার পথে প্রথম প্রোপোজ করলাম । মুখে কিছু না বললেও ওর স্মিত হাস্যে উত্তর জানা হয়ে গেছিলো । তারপর আমার ব্যাবসা পূর্বার বিশ্ববিদ্যালয় । মাঝখানে চুড়ান্ত প্রেমে পথ চলা ।

শ্রাবন্তী, নাথ সাহেবের মেয়ে । সুজিত নাথ এক্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, পি ডব্লিউ ডি (ইলেক্ট্রিক্যাল) । আমাকে স্নেহ করতেন, এয়ারকণ্ডিসনার মেসিন সাপ্লাইতে সাফল্য  অর্জন করতে উনি যথেষ্ট  সাহায্য করেছিলেন । শ্রাবন্তীর কাছাকাছি আসা এটাও একটা কারণ ।

স্বল্পভাষী পূর্বাশা কোনোদিন কিছু চায়নি, একটি কলম উপহারে ওর খুশী হওয়াটা ও বুঝিয়ে দিত । প্রায় তিনমাস পর দেখা হলো অনাদীতে । চামচ দিয়ে মোগলাই কাটতে কাটতে বলে ফেলল, ” আমায় বিয়ে করবি ?

আমি ওর চোখের দিকে বিহ্বলতায় তাকিয়ে ছিলাম । উত্তর দেয়ার আগেই আবার একই প্রশ্ন করে বলল, -“দেখ বাবা অসুস্থ, চাইছেন আমরা …. মানে তোর সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন ।

-কেন কি ব্যপার ! বেশ সামনের রবিবার যাব ।

সেই রবিবার শ্রাবন্তীকে নিয়ে মন্দারমণি । লাল  কাঁকড়া, নীল লোহিতের আপন স্রোতে কোথায় ভেসে গেলাম, স্রোতে ভেসে গেল পূর্বাশা । বালুচরে শুধু আমি আর শ্রাবন্তী, ঢেউ পূর্বাশাকে ভুল করেও ফিরিয়ে দেয়নি ।

নীলাদ্রী ভাবতে ভাবতে  উঠে বসল, বুকের কোথায় যেন তীক্ষ্ণ যন্ত্রনায় চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে । পূর্বাশার সঙ্গে নীলাদ্রীর আর দেখা  হয়নি, তবে ত্রিপুরার কোথায় যেন বিয়ে হয়েছে । নীলাদ্রীর মন বড় উতলা হয়ে উঠেছে । কলেজ লাইব্রেরিতে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকা, প্রেমপত্রে নীলাদ্রী সুপ্ত আবেগের কতো বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে । তবু কখনো ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হয় নি, ইন্ট্রোভাট ছিল । কেন জোর করেনি ! তাহলে কী শুধু বন্ধুত্ব ছিল ? অপরদিকে উচ্ছল নদীর মতো জীবনটাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল শ্রাবন্তী । পূর্বাশা, হারিয়ে গেলেও নীলাদ্রীর জীবনে অধঃক্ষেপ হয়ে অবস্থান করেছে ।

কোনো একদিন ১৩ নং আটাপাড়া বাইলেনে  নীলাদ্রীকে টেনে নিয়ে গেল অদৃষ্ট, খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল পূর্বাশার বাবা মারা যাবার পর বাড়ীর অংশটুকু বিক্রি করে মাকে নিয়ে বাংলাদেশে সম্ভবতঃ চলে গেছে । অতঃপর ওদের শরিকদের কাছে জানা গেল, ত্রিপুরার মগিয়াবারি অঞ্চলে ওরা গেছে । সঠিক ঠিকানা জোগাড় করে সেদিন বাড়ী ফিরেছে নীলাদ্রী । মনে অসংখ্য  প্র্শ্নের ভীড়ে আপনমনেই বিব্রত ছিল । যা শ্রাবন্তীরও চোখ এড়িয়ে যায়নি ।

১১ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫ ব্যাবসার কাজে নীলাদ্রী ত্রিপুরা যাচ্ছে, এমনটাই সকলে জানল । ১২ তারিখ গন্তব্যে পৌঁছালো । মগিয়াবারিতে আধাশহরে অমরেশ মজুমদারের স্বপ্নালয় ।  বাড়ীতে ঢোকার মুখেই বিভিন্ন ফুলসম্ভারে সজ্জিত বাগান । দরজায় টোকা মারতেই অল্পবয়সি মেয়ে দরজা খুলে দিল, ষাটোর্ধ এক বয়স্ক ভদ্রলোক আশ্চর্য হয়ে নীলাদ্রীকে সমীক্ষন করতে লাগলেন । কিছু বলার আগেই স্বপ্রনোদিত হয়ে নীলাদ্রী বলল, ” আমি অমরেশবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই । আমি নীলাদ্রী বসু, পূর্বাশার ক্লাসমেট ।”

ভদ্রলোক কিছু না বলে ইশারায় ভিতরে আসতে বললেন । পদানুসরন করে বামদিকের বসার ঘরে প্রবেশ করে দেখল সুসজ্জিত ঘর, দেয়াল আলমারীতে সুনীল, রবীন্দ্র, মানিক সম্ভারে খচিত । ভদ্রলোক নীলাদ্রীর প্রতি কোনো উৎসাহ না দেখিয়ে বেরিয়ে গেলেন । ইতঃস্তত করে দরজার পাশের সোফাতে বসে পড়ল । টেবিলের যুগের সাথী পত্রিকাটির পাতা ওলটাতে ওলটাতে একটি বড় খাম হাতে ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করতেই নীলাদ্রী উঠে দাঁড়ালো । খুব শান্তভাবে বসার অনুরোধ করে বললেন, -“আমি অমরেশ, পূর্বাশার হাসবেন্ড । পূর্বাশা যাওয়ার আগে কতকগুলি চিঠি আপনার জন্য রেখে গেছে । কিন্তু আমার কলকাতা যাওয়া হয়ে ওঠেনি ।” 

বিষ্মিত হয়ে নীলাদ্রী জিজ্ঞাসা করল, ” কো..
কথা শেষ হওয়ার আগেই অমরেশবাবু বললেন, ” ৯৩ সালে সাডেন কার্ডিয়াক এ্যরেস্টে  মারা গেছে  । আপনার  জন্য চিঠিগুলো রেখে গেছে । নমস্কার ।

নীলাদ্রীর আর কোনো কথা বলার সাহস হয়নি, চিঠির খামটি নিয়ে ধীরে ধীরে স্বপ্নালয় পরিত্যাগ করল ।

2 thoughts on “ছোটগল্পঃ পুনশ্চ – সৌমিত্র ঘোষ

  1. মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু গল্পটা খুব ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *