সাম্প্রতিক ৯ঃ কবিতার দুঃসময়, কবিরও – অনিরুদ্ধ সুব্রত

কবিতার দুঃসময়, কবিরও
অনিরুদ্ধ সুব্রত

কবি জীবনানন্দ দাশের তিন পংক্তি দিয়ে এই সংখ্যার সাম্প্রতিক শুরু করা যাক,—

” জানো কি অনেক যুগ চ’লে গেছে? ম’রে গেছে অনেক নৃপতি?
অনেক সোনার ধান ঝ’রে গেছে ঝরে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি
আমাদের ক্লান্ত ক’রে দিয়ে গেছে – হারায়েছি আনন্দের গতি; “
(কবিতা- ‘সিন্ধুসারস’)

সদ্য প্রয়াত বাংলা ভাষার দুই কবি- কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে প্রণাম । মৃত্যু মাত্রেই বেদনার, শূন্যতার, অথচ মৃত্যুর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার ভাষ্য কিছু থাকলেও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শক্তি মানুষের নেই। একমাত্র চিকিৎসা বিজ্ঞান দিয়ে এই সভ্যতা একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায় । প্রচেষ্টা চলে আপ্রাণ, তবু মৃত্যু যেন তারই মতো, দুঃশাসন । সব মৃত্যুই সমান, তবু কবির মৃত্যু কবিতা চর্চাকারীর কাছে কিছু স্বতন্ত্র বোধ দেয়। পরিণত বয়সের কোনও নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই, থাকে না । কিন্তু সারাজীবন সত্যোপলব্ধি এবং তার ভাষ্য রচনার যে আত্মগত দায় কবি বা সাহিত্যিক নিয়ে থাকেন, তাতে তাঁদের প্রয়াণ সাহিত্য প্রেমী সব মানুষের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে । পাশাপাশি জীবিত সাহিত্য স্রষ্টারা সকলেই ভালো আছেন, সুস্থ, সুন্দর আছেন এবং সর্বোপরি তাঁর তাঁর মতো সৃজন করে চলেছেন— এমন মানবিক আকাঙ্খা থাকাটাই আমাদের কাছে স্বাভাবিক ।
শুধু বাংলা ভাষা সাহিত্য ক্ষেত্রেই নয়, এই প্রার্থনা পৃথিবীর সকল ভাষা সাহিত্যের সৃজনশীলদের জন্য ।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চার পংক্তি ধার করছি, —

” আমরা কয়েক হাজার প্রজা
বাস করি এ মৌজায়
সবাই মিলে পথ খুঁজছি
কেমন করে বাঁচা যায় “
( কবিতা- ‘ চিরকুট’ )

আজ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে এক অশীতিপর কবি দীর্ঘ দিন
২০১৮ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর থেকে কারাগারের গরাদ বন্দি । যাঁর বর্তমান
শারীরিক পরিস্থিতি এতোটাই সংকটজনক যে যেকোনও সময় জেলের মধ্যেই
তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে পারে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত । গত ১৮ই
নভেম্বর মুম্বই হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে তেলেগু ভাষার এই প্রবীন কবিকে চিকিৎসার
জন্য হাসপাতালে ভর্তি করার।
কবিও রাস্ট্রের চোখে অপরাধী। পৃথিবীর ইতিহাসে তার উদাহরণ অগণিত।
অথচ রাষ্ট্র কবির চোখে কী — তা নিয়ে ভাববার সময় রাষ্ট্র কোনও দিন পায় নি।
তা না হলে ৮১ বছরের একজন সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব ডিজিটালাইজেশনের নব
ভারতে দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় জেলবন্দি? তাঁর অপরাধ তার সৃজন কর্ম?
রাষ্ট্র যদি তা মনে করেও , খুঁজে পায় যদি তাদের মতো যুক্তি, তবু কি সেই অপরাধের
কার্যকারণে একজন প্রবীন কবিকে এই আশি উত্তীর্ণ বয়সে কারাগারে বন্দি করে রাখা মানবিক?
ভারতবর্ষের সাংবিধানিক বিচার প্রক্রিয়ার গতি প্রকৃতি, সমাধানের বা
সিদ্ধান্ত ঘোষণার মেয়াদি দৈর্ঘ্য নাগরিকদের বিন্দুমাত্র আশ্বস্ত করতে
পেরেছে— এ মত শুনি না। কথায় কথায় ব্রিটিশ শাসনামলে বিপ্লবী, কবি, শিল্পী,
সংগ্রামীদের কারাগারে ঢুকিয়ে অত্যাচারের ঘটনা আমরা ইতিহাস প্রসঙ্গে উল্লেখ করি।
আমরা ঘৃণা পোষণ করি সেই অন্ধকারময় সময়ের দুঃশাসন সম্পর্কে ।
অথচ আজকের ভারতবর্ষে যে সত্তর বছর অতিক্রান্তের কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে,
সেখানে একজন কবির অথর্ব বয়সে বন্দিত্ব কোনও আঘাত দেয় না? যাঁর কলমে লেখা হয়েছে, —-

” তোমাদের মাঝে কেউ কি আছো যে বাড়িয়ে দেবে
একটি মানবিক হাত
আর আমার হৃদয়কে করবে অবমুক্ত
সেই বিভৎস দৃশ্যের অসহনীয় বোঝা থেকে? “
( কবি- ভারাভারা রাও)

সংবাদ সূত্রে জানা যায় বিশিষ্ট তেলেগু ভাষার এই কবি ভারাভারা রাও ইতিমধ্যে স্মৃতিভ্রংশ হয়েছেন অনেকটাই । মূত্রাশয়ের সমস্যা রয়েছে, ডায়াপার পরিয়ে ক্যাথেটার লাগিয়ে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী অবস্থায় রাখা হয়েছে জেলখানায় । যেখানে তাকে আলাদা করে দেখার সর্বক্ষণের জন্য কোনও বিশেষ চিকিৎসক বা সহযোগী তেমন কেউই নেই। দীর্ঘ কবিতা লেখা-জীবনের এই পরিণতি ঠিক কতটুকু ভাবাচ্ছে আমাদের ? না কি সব অসহিষ্ণুতার রাজনৈতিক দোহাই দিয়ে এড়িয়ে চলে যাব ? আজ ভারতবর্ষের কবি, সাহিত্যিক সমাজকেই সবচেয়ে বেশি ভেবে দেখতে হবে এটা।
এই দেশে প্রকাশ্যে প্রতিদিন হাজার হাজার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, এক বক্তা তার বিপক্ষ বক্তার বিরুদ্ধে অপশব্দ, হুমকি থেকে ঘৃণ্যতম বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির ভাষা প্রয়োগ করছে অবিরত । চলছে মিথ্যে আর মানুষকে ভুল বুঝিয়ে দখলের মুনাফা সংগ্রহের প্রতিযোগিতা । প্রতিদিন হত্যা আর অপমানের চরম কীর্তি লিপিবদ্ধ হয়ে চলেছে মিডিয়ার পাতায় পাতায় । ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের অধ্যায়।
কিন্তু কবি যখন কোনও মতের বিরুদ্ধে কিছু বলেন বা লেখেন , তখন সেই সব মহা মানবের বাণী রাস্ট্রের মনে থাকে না কেন ? রবীন্দ্রনাথ তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বলতে চেয়েছিলেন সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী কী। তিনি বলেছিলেন ‘ক্ষমা করো’ । আমার রাষ্ট্র একজন বৃদ্ধ কবিকে মার্জনা করতে শিখল না ?
আর আমরা যারা নিজেদেরকে একটুও কম বুদ্ধির, কম বিবেকের মনে করি না ; যারা কবিতা লিখছি, সাহিত্য চর্চা করে যাচ্ছি বলে শ্লাঘা অনুভব করি ; যারা সু সংস্কৃত বলে নাকটা এগিয়ে রাখি , আমাদের কি কোনও সম্মিলিত আবেদন আমরা রাস্ট্রের সামনে সুতীব্র ভাবে রাখতে পেরেছি ? না কি আমাদের চাওয়া গুলো বড্ড নিজস্ব, ছোটো গন্ডিতে আটকে , চেতনা আজ দূর ভারাভারা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না !
কবির মৃত্যুতে যতটা কাঁদব, জীবন্ত কবির মুক্তি নিয়ে আদৌ তার শতাংশ চিৎকার করব না ? তাহলে আমরা কেমন কবি ! কেমন সাহিত্য প্রেমী !

4 thoughts on “সাম্প্রতিক ৯ঃ কবিতার দুঃসময়, কবিরও – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. অন্তর থেকে লেখা এই লেখাটি। সত্যিই তাই। ভালো লাগলো।

Leave a Reply to ভূমিকা গোস্বামী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *