ছোটগল্পঃ লোকলজ্জা – ভূমিকা গোস্বামী

লোকলজ্জা
ভূমিকা গোস্বামী

অফিসে আজ কাজের চাপে মুখ তোলার সময় ছিল না ওর। লাঞ্চ তো দূর। চারটে বাজে। ব্যাগ থেকে কুকিজের প্যাকেট বের করে মুখে দিতেই টেবিলে রাখা মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে ওর মায়ের হাসি মুখের ছবি । মা সচরাচর হাসেন না। সেই দিক থেকে দুর্লভ এই ছবিটা। মা ফোন করছে। প্রতিদিন ই এই সময় মা ফোন করে । ও অফিস থেকে বেরিয়েছে কি না জানতে। কুকিজ খেতে খেতেই বলে — বল মা।

—- মিঠি, তোর বাবা এই মাত্র আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

থার্ড ব্রেন স্ট্রোক হয়ে প্রায় ছ টা মাস বিছানায় বাবা। গতকাল ও মিঠি বাড়িতে গিয়েছিল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ডেকেছে। বলেছে বাবা , শুনতে পাচ্ছো? আমি তোমার মিঠি।

ঘোলা চোখটা একটু খুলে আবার কেমন ঘোরের মধ্যে। জড়িয়ে জড়িয়ে একটাই কথা– বড় ভুল হয়ে গেছে।

বাবার বিছানার পাশে বসে নিরবে চোখের জলকে বয়ে যেতে দিয়েছে মিঠি।

পাঁচ বছর আগে এই নভেম্বরেই বিশাল ধুমধাম করে মিঠির বিয়ে হয়েছিল তুহিনের সাথে।ঝকঝকে ছটফটে হ্যান্ডসাম ইন্জিনিয়ার তুহিনকে প্রথম দেখাতেই ভাল লেগেছিল মিঠির। ও নিজেও ইন্জিনিয়ার।অন লাইনে দুপক্ষের বাবা মার পছন্দের পর ওরা নিজেরাও কয়েক বার বাইরে ঘুরতে গেছে। দামী রেস্তোরাঁয় খাইয়েছে তুহিন। সামান্যই কথা হয়েছে। মিঠি সবথেকে বেশি আকর্ষিত হয়েছিল তুহিনের হাসি দেখে। তুহিনের এই ভূবন ভোলানো হাসিতে মোহিত হয়ে থাকতো মিঠি। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলছিল ও। নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হত।
পাঁচ বছর হয়ে গেছে , এখনও আত্মীয় স্বজন থেকে পাড়া প্রতিবেশী কারো বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই মিঠির বিয়ের কথা চলে আসে। তখন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অমলবাবু । তার জীবনের প্রথম কাজ । তার আদরের মিঠির বিয়ে। খরচ করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন নি। বিয়ে থেকে বৌভাত — শাড়ি ,গয়না , সাজগোজ, আলো, লোকজন, ক্লান্তি, সব মিলিয়ে স্বপ্নের মতো ,কেটে গেল।

তারপর মিঠির কেমন অদ্ভূত লাগতে শুরু হল তুহিনের আচরণ। আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের মাঝে মিঠির সাথে স্বাভাবিক কথা বললেও, সবাই চলে গেলে ওরা যখন দুজনে থাকে তুহিনের মুখে কোন কথা নেই । হয় খবরের কাগজে নয়তো কোন বইয়ে অথবা কম্পিউটারে মুখ গুঁজে বসে থাকে। হানিমুনে ওরা দার্জিলিং গিয়েছিল। আর ওখানে গিয়ে ওর আর বুঝতে কিছুই বাকী থাকেনি । শিক্ষিত রুচিশীল মিঠি কথা বলে তুহিনের সাথে। আর তখনই জানতে পারে – নারী শরীর তুহিনকে আকর্ষণ করে না।

ওর এতদিনের একটু একটু করে গড়ে ওঠা স্বপ্নকে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেতে দেখল ও ।

তুহিনের সাথে কথা বলে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েই দার্জিলিং থেকে ফিরে আসে মিঠি। মাকে সবটা জানিয়েছিল। ওর সিদ্ধান্তের কথাও গোপন করে নি। অমলবাবুর কানে যেতেই প্রথমে অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। বারবার বলতে থাকেন– লোকে কী বলবে । লোকে তো হাসবে ! মেয়েকে কাছে ডেকে অত্যন্ত আদরের সাথে বললেন — তুমি আমার একমাত্র সন্তান হয়ে আমার মান সম্মান সব নষ্ট করতে চাও ? মিঠি বোঝাতে চেষ্টা করেছে , লোকে কী ভাবল, বা বলল তার থেকে জীবন অনেক বড়। এটা ওর আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। বলেছে — বাবা, তুহিন শুধু আমাকে নয় তোমাদেরকেও ঠকিয়েছে। ওর শাস্তি পাওয়া উচিত।

চোখের জলে বুক ভাসিয়ে তবুও প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন অমলবাবু ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত থেকে মিঠিকে সরে আসতে। এবং তুহিনের বাড়ি ছেড়ে না আসতে। প্রথম স্ট্রোকটা তার কয়েকদিন পরেই হয়।

বাবাকে খুশি করতে মিঠি পাঁচ পাঁচটা বছর ধরে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রতারক তুহিনের বাড়িতে আছে। যদিও এক ঘরে নয়।
উইক এন্ডে দুজনে বেড়াতে যাচ্ছে। সেজেগুজে সেলফি তুলছে । দুজন দুজনকে দামী গিফ্ট উপহার দিচ্ছে মিথ্যে বিবাহ বার্ষিকীতে। সেটা ফেসবুকে প্রচুর লাইক আর কমেন্ট পাচ্ছে।
আত্মীয় স্বজনের অন্নপ্রাশন থেকে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে দামী শাড়ি আর প্রচুর গয়নায় নিজের অপমানকে ঢেকে হাসি হাসি মুখ করে সুখী দম্পতির অভিনয় করছে।

বয়স্ক মহিলারা আদর করে বলেছে — অনেক দিন তো দুজনে ঘুরে ফিরে আনন্দ করলি । এবার পুচকেকে নিয়ে আয়।সম বয়সীরা ওর উপচেপড়া সুখ দেখে জ্বলে পুড়ে মরেছে।
পরে বাবার দেওয়া বিরাট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দক্ষ অভিনয়ের জন্য মূল্যায়ন করেছে। নিজেকে প্রসংশিত করেছে । মনে মনে বলেছে—দেখেছো তো বাবা , কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারে নি।
অফিসটা ওর একমাত্র মুক্তির জায়গা। প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়ার জায়গা। যেখানে ও নিজেকে খুঁজে পায়। তাই মন প্রাণ দিয়ে আনন্দের সাথে কাজ করে মিঠি।
সামনে বাবার চিতা জ্বলছে। মিঠি দেখল পাড়ার অনেক লোক, আত্মীয় স্বজন, মিঠি মনেমনে বলল — এই আগুনে তোমার লোক লজ্জাকেও পুড়িয়ে ফেল বাবা। তুমি চিন্তা কোরো না। তোমার মেয়ে তোমার বড় ভুল এবার সংশোধন করে দেবে।

One thought on “ছোটগল্পঃ লোকলজ্জা – ভূমিকা গোস্বামী

  1. খুব ভালো লাগলো গল্পটা।
    এই লোকলজ্জার ভয়ে কত সম্পর্ক হয়ত এরকমভাবে জীবন্মৃত হয়ে রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *