ব্যক্তিগত গদ্যঃ আড্ডা – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী(রাধু)

আড্ডা – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী(রাধু)

ভেবেছিলাম আড্ডা নিয়ে দুচার কথা লিখলে কেমন হয় দেখা যাকনা ! পরে ভাবলাম আড্ডা নিয়ে আমার লেখা চলে না, কেননা আমি সারা জীবনে আর কতটুকু আড্ডা দিতে পেরেছি, আর তার জন্য যে সময় লাগে তাতো আমার খুব কম ছিল। তা ছাড়া আমি কোন নই যে আমার আড্ডার কাহিনী শোনার জন্য অন্য নিঃসম্পর্কিত মানুষ আগ্রহী হবেন।

আড্ডা জমে ওঠে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে বা খেলার মাঠে খেলা শেষ হলে বা কোনো ক্লাব ঘরে বা যে কোন জায়গায় একাধিক মানুষ এক সঙ্গে হলেই কিছু কথা হবেই। ভীড় গাদাগাদি ট্রেনের দরজায়, মেট্রো ট্রেনের ভেতরে হ্যান্ডেল ধরে, চেনা বা অচেনা লোকের সঙ্গেও সামাজিক অবিচার ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়‌‌।তবে রাজনৈতিক বিষয়ে আড্ডা দেবার সাহস সব সময় যথেষ্ট না থাকায় বাংলার মানুষ এক দলের না হলে রাজনৈতিক কথাবার্তার মধ্যে একেবারেই নাক গলিয়ে নিজের ভবিষ্যত বিপদ ডেকে আনতে পছন্দ করেন না।

তবু আমরা সহযাত্রীদের সঙ্গে কথা বলি, বিশেষ করে নিত্য সহযাত্রীদের সঙ্গে চলার পথে অনেকে কথা বলেন কেউবা নিজের মতামত বিশদে ব্যাখ্যা করে অপরের কথা বা প্রত্যুত্তর দেবার সুযোগ হবার আগেই যাত্রা শেষ হয়ে যায়।
কেউ কেউ ভীড়ে ঠাঁসা ট্রেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাস খেলতে খেলতে যাত্রার সময়টুকু পার করে দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে খেলা গুটিয়ে ভোঁ দৌড় নিজ নিজ কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে।
কথা হচ্ছিল বসে বসে একাধিক লোকের নানান বিষয়ে কথা বলা বা আলোচনা করা অর্থাৎ  আড্ডা নিয়ে। 

আগেই বলেছি আড্ডায় অংশগ্রহণ করে অযথা নষ্ট করার সময় আমার যথেষ্ট ছিল না। যাঁদের পড়াশোনা নেই বা মনোযোগী নন বা যাঁরা বেকার বা ভি আর এস নেয়া বা রিটায়ার্ড তাঁরা ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়ে সময় বইয়ে যেতে দিতে পারেনবা হয়তো। তবে নিজের কথা একটু বলে নিতে ইচ্ছে করছে।
আমাকে পড়াশোনা করে যা-হোক একটা কিছু কাজ যোগাড় করে বাবা মাকে দেখতে হবে তাই আড্ডায় দিন সময়কে বয়ে যেতে দিতে পারিনি। উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ, সময়ের আগেই, আন্ডার গ্রাজুয়েট থাকতে থাকতেই কমপিটিভ পরীক্ষা দিয়ে খুব ভাল একটা চাকরি পেয়ে রোজগার করতে শুরু করেছিলাম। কিছু দিনের জন‍্য মা-বাবাকে মানসিক শান্তি দেবার চেষ্টা করেছিলাম। যাই হোক অফিসে নির্ধারিত কাজ শেষে আমাদের ক্যাশ মেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো, সে সময় টুকু বিভিন্ন জন বিভিন্ন বিষয়ে যেমন খেলাধূলা, সিনেমা, থিয়েটার, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে ভালবাসতেন। আমার বিষয় ছিল সাহিত্য।
সাহিত্য চর্চা করতে পারেন যাঁরা তাঁরা যেমন সঙ্গে থাকতেন তেমনই চর্চায় যাঁরা অংশগ্রহণ করবেন না তাঁরাও আমাদের আড্ডায় এদিক ওদিকে চেয়ার পেতে বসে পড়তেন শোনার জন্য। মাঝে  মাঝেই আমাদের মধ্যে কেউ বা নিজের লেখা কবিতা বা ছোটগল্প পড়তেন। এর মধ্যে কেউ একজন প্রস্তাব দিলেন সবাই মিলে আমরা গল্প লিখবো, যে যার মত লিখবো। কোন দিক থেকে লেখা শুরু হবে ঠিক করার পর প্রতি জনকে  নির্ধারিত আকারের কাগজ দেয়া হল। ঐ কাগজটুকুতেই লিখতে হবে। যাঁর বেশি করে লেখার ইচ্ছে তিনি নিজের লেখার অক্ষর গুলো ছোট রাখবেন‌। সবাই মেনে নিলেন‌‌। তবে একজন রসিকতা করে বললেন –   দাঁড়াও লেখাচ্ছি, আমার ‌‍সময় এলে তোমাদের গল্পের নায়ক বা নায়িকাকে মেরে ফেলবো, দেখি তোমরা কিভাবেই বা গল্পের কাহিনী এগিয়ে নিয়ে যাও‌‌।”

সেই সহকর্মীর কথা শুনে আমি বললাম – ঠিক আছে সবার শেষে আমিই লিখতে চাই, আমি জানি কীভাবে গল্পের নায়িকা বা নায়ককে আবার বাঁচিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়।”  

মজার কথা হল, ঐ বারোয়ারি গল্পটা আমার এক বন্ধু সুনীল দেবনাথ যিনি একটি ছোট পত্রিকার সম্পাদক সাদরে গ্রহণ করে তাতে যথাসময়ে মুদ্রিত করলেন। একেবারে হৈ হৈ কাণ্ড।

ইতিমধ্যে আমাদের অবেক্ষণ সাহিত্য পত্রিকা সোদপুরের ঈগল প্রেসে ছাপানো শুরু হয়।ঐ প্রেসটা সোদপুর স্টেশন সংলগ্ন হওয়ায় অফিস থেকে ফেরার পথে একবার করে প্রেসে হাজির হবার রেওয়াজ প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমাদের পত্রিকা ছাপা চলছে বা ছেপে বের হয়ে গেছে, তা কোনো ব্যাপার ছিল না। প্রতিদিন, এমনকি ছুটির দিনও বিকেলে অন্তত একবার প্রেসে যাওয়া চাই। আমি একা নই। নানান ফ্যাক্টরি, অফিস, স্কুল-কলেজ থেকে ফেরার পথে সোদপুর স্টেশনে নেমেই, সে ট্রেন থেকে নামুন বা এখনকার ব্রীজের আগের লেভেল ক্রসিং-এ অন্য গাড়ি থেকে নামুন  একবার ছাপাখানার মালিক সুবীরদার ভাই সমীরের সঙ্গে দেখা না করে  আমরা প্রায় একদেড় কিলোমিটার দূরের বাড়িতে ফিরতাম না। আমাদের কারোর কোন দমদম বেলঘরিয়া আগরপাড়া খড়দহ এমনকি গঙ্গার ওপাড়ের কোন্নগর থেকে চেনা জানা বা দিদি এলে আমাদের বাড়ি যাবার আগে একবার ছাপাখানায় খোঁজ নিয়ে যেতেন আমরা কেউ রয়েছি কিনা।
এই সমীরকে সঙ্গে পেয়ে আমাদের মতো লেখা গান ছবি আঁকা নিয়ে খুশি থাকা যুবকরা যেন আরও বেশি বলে বলীয়ান হয়ে যেতে লাগলাম। বেশি করে মনে পড়ে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় সবাই মিলে মুড়ি তেলে ভাজা খাওয়া। সমীর মুড়ি কেনার জন্য ওর ছাপাখানার মালিকের চেয়ার ছেড়ে উঠলেই ওর হাতে জোর করে আমাদের মধ্যে কেউ একজন প্রয়োজনীয় পয়সা দিয়ে দিতাম, মুড়ি নাহয় এক মুঠো করে নিলে আমাদের চলতো কিন্তু ওর তো বিকেলের টিফিন আর অন্তত পনের বিশটা তেলে ভাজায় কম পড়তো না।

তবে ঐ ছাপাখানায় আড্ডা দিতে দিতে একদিন
একটা অভিনব প্রস্তাব এল। আমরা সে সময়কার উঠতি বয়সী কবি সাহিত্যিকদের সারাদিন কবিতা পাঠ গল্প পাঠের সম্মেলনের মত সম্মেলন করবো তবে সারাদিন মানে দশবারো ঘন্টার নয় আমরা সম্মেলন করবো চব্বিশ ঘন্টার। সময়টা উনিশশো পঁচাত্তর। নাম দিলাম “সাহিত্য অষ্ট প্রহর” প্রস্তাব মত যোগাযোগ প্রচার চলল কয়েক দিন ধরে। আমাদের এই আড্ডার আসরে আসা অনেকে নিজ ইচ্ছায় তাঁদের চেনা জানা বিশিষ্ট জনদের কাছে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আনলেন। যুগান্তর পত্রিকার দক্ষিণারঞ্জন বসু, রাম বসু,  অমৃত সাপ্তাহিকের বিমল বসু, আকাশবাণীর সত্যেন মিত্র, সাহিত্যিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী  শ্রী পূর্পূর্সু, নবীনতর সন্দীপ দত্ত (লিটল ম্যাগাজিন সমিতির সম্পাদক), স্থানীয় বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়, চিত্ত সমাদ্দার, নির্মল ঘোষ(বর্তমান স্থানীয় বিধায়ক ও মুখ্য সচেতক), বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ, বিশিষ্ট সংগীত সাধক এবং সোদপুরের ও পাণিহাটীর বিশিষ্ট জনেরা আমাদের এইঅভিনব প্রয়াসের সামিল হয়েছিলেন। সে সময় আমাদের সভা করার জন্য “লোক সংস্কৃতি ভবন” তৈরী হয় নি, আমাদের বাংলায় টিভি এসে পৌঁছয় নি, মোবাইল ফোনতো নয়ই। রেল স্টেশনের কাছের সোদপুর স্কুলের হলঘরে জন্মাষ্টমীর দিন সকাল আটটায় শীলা দাস (বর্তমানে গুহ, যে এখন একজন দক্ষ পৌর মাতা)  ও  স্বনামধন্যা শ্রীমতী ভূমিকা গোস্বামীর কন্ঠে উদ্বোধনী সংগীত দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল। কলকাতা, মায় সারা বাংলার শতাধিক কবি সাহিত্যিক উপস্থিত হয়েছিলেন। আজকের দিনে দুজনের কথা মনে পড়ছে, তাঁরা হলেন বিখ্যাত প্রিয় সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের যোগ্য পুত্র স্বনাম ধন্য তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (যাবার সময়ের আগেই চলে গেছেন) আর জয়নগরের বৃদ্ধ পাঁচুগোপাল রায়। 

এ প্রসঙ্গে আমার বড় মামা প্রভুপাদ প্রাণকিশোর গোস্বামীর কথা মনে পড়ল। তিনি সোদপুরের এক শিষ্যের বাড়ি জন্মাষ্টমী উপলক্ষে এসেছিলেন। সমীর, অরুণ উদয় ভট্টাচার্য, শঙ্কর ভট্টাচার্য আর আমার এক দাদা রামকৃষ্ণ গোস্বামীর অনুপ্রেরণা য় সেই শিষ্য বাড়ি গিয়ে তাঁকে প্রণাম করলাম ও আমাদের সাহিত্য অষ্টপ্রহরে আসার জন্য সবাই মিলে আমণ্ত্রণ জানালে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন – এযে দেখছি জন্মাষ্টমীতে সাহিত্যের আসর। এ যে অভিনব ব্যাপার।” উল্লেখ্য প্রভুপাদ প্রাণকিশোর গোস্বামী তখন সারা ভারতের এক গণ্যমান্য আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, অনেক মূল্যবান গ্রন্থের রচয়িতা এবং সুললিত কন্ঠের শ্রীমদভাগবত ব্যাখ্যাতাও ছিলেন। অনুষ্ঠানের সাফল্য তিনি কামনা করলেন।

অনুষ্ঠান ঠিক মত মিটে গেলেও আমাদের আড্ডা আবার চলতে লাগল যথারীতি। বিভিন্ন মানুষ জনের আনাগোনা বেড়েই চলল। বাড়িতে ফিরে আসতে রাত দশটা পর্যন্ত হয়ে যেত। এসব কিছুর নেতা ছিল সমীর ঘটক। এমনকি ঋষি শ্রীঅরবিন্দের বিশ্বভ্রাতৃত্বের মানসিকতা নিয়ে সোদপুরের ওয়ার্ল্ড ইউনিয়নের কর্ণধার এই সমীরকে আমরা নির্বাচিত করেছিলাম। নিখিল ভারত সাহিত্য সম্মেলনের সে বছরের বার্ষিকী হয়েছিল আগরতলায়। ট্রেনে করে নিউ বনগাইগাও-লামডিং-বদরপুর হয়ে বাসে করে বারোমুড়া, আঠারো মুড়া পাহাড়ি পথে সম্বর্ধিত হতে হতে আমরা ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় পৌঁছেছিলাম। তরুণতর সমীর আর বয়স্কতম পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য সঙ্গে থাকায় সাড়ে তিনদিনের ট্রেন বাস পাহাড়ি পথে যেন কোন শ্রম হয়নি বলে মনে হয়েছিল।
এছাড়া  ঐ সময় আমার বাবার শিষ্য বঙ্কবিহারী সাহা তাঁর ছোট ছেলে চন্দন যে আমার অত্যন্ত আদরের ছিল তাকে দিয়ে ড্রাইভার সহ এ্যম্বাসডর গাড়ি সম্মেলনের তিন দিনের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আগরতলার সব দর্শনীয় স্থানে যাবার জন্য গাড়ির কাছে আমরা যেতেই চন্দন বলেছিল – মামা, আপনার যেমন খুশী যেখানে খুশী ড্রাইভারদাদাকে বলবেন। উনি সব চেনেন।”
হায়, আমার প্রিয় চন্দন কয়েক বছর পর অতি অল্প বয়েসে চলে গেল। এ দুঃখ এ শোক এখনও আমায় ব্যথা দেয়।

আমাদের  আমাদের সময় লেখালেখি চাকরি আর আড্ডা নিয়ে আহ্লাদে আনন্দে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। অনেক উৎসাহ ব্যঞ্জক কাজে, নিজের, এর তার বিয়ে বৌভাত, দরিদ্র মানুষের সেবায় দিন গুলো চলে যাচ্ছিল। সমীরও বিয়ে করল চেনা জানা মালাকে। আনন্দ যেন আর ধরে না। কিন্তু কিছুদিন পর পেট ব্যথা নিয়ে সদ্য উদ্বোধন হওয়া পাণিহাটীর হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। দিনের পর দিন যায় অথচ আমাদের সোদপুর-পাণিহাটীর সকলের প্রিয় সমীর ঘটক আর বাড়ি ফিরল না, প্রেসে এল না। আমরা আর ঐ প্রেসের পথে যেতে পারলামনা। সমীর নেই সব শূন্য, শূন্য।

কিছু দিন পরে জানলাম সমীর-মালার একটি মেয়ে হয়েছে। এখন সেও অনেক বড় হয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে ঠিকঠাক আছে। মালাদি মাঝে মাঝেই ফোন করেন। তাঁর ব্যথা আমাদের ও ব্যথা।

আড্ডা নিয়ে লেখাটা আর এগোবে না।

2 thoughts on “ব্যক্তিগত গদ্যঃ আড্ডা – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী(রাধু)

  1. রম্যরচনা- ভালো লাগলো ।
    পুরনো অনেক কথাই মনে পড়ছিল । ভালো থাকবেন রাধুদা, প্রণাম নেবেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *