দ্বিজ
ভূমিকা গোস্বামী
প্রতিদিন ভোরে এলার্মের বিশ্রী শব্দে চোখ মেলেই সংসারের বিভিন্ন দায় মেটাতে হয় ওকে । সকালে ব্রেকফাস্ট বানানো। অর্ণবকে বেড টি। ছেলেমেয়েকে ঘুম থেকে তোলা থেকে স্কুলবাসে উঠিয়ে দেওয়া। ফেরার সময় বাজার করা।
ঘুম থেকে ওঠার পর ছেলেটা এখন অবশ্য নিজেই ফ্রেস হয়ে নেয়। কাব্য এবার ফাইভে উঠেছে।
কিন্তু বন্যা তো ছোট। এবছর নার্সারিতে ভর্তি করেছে বৃষ্টি ওকে। চোখ মেলতেই চায় না । কী কষ্ট করে যে রোজ ওকে স্কুলে পাঠাতে হয় ! তারপর আছে ওদের বাবা। নিজে দেরি করবে অথচ ভাবটা এমন যেন বৃষ্টির জন্যই ৯-৫ এর ট্রেন টা ফেল হয়ে যাবে। কোনদিন ট্রেন ফেল হয় নি , কিন্তু রোজই ট্রেনফেল জুজুর ভয়ে তটস্থ থাকে বৃষ্টি। হাতের কাছে জামা জুতো মোজা মানি ব্যাগ রুমাল টিফিনবক্স সব গুছিয়ে রেখে দেয়। দেরি হবে বলে অর্নবকে খাইয়ে পর্যন্ত দেয়। তবু….।
এরপর আছে সংসারের সাত সতের কাজ। -কাজের মেয়েটা না এলে বাসন মাজা , ঘর মোছাও আছে।
ওয়াসিং মেশিনে কাচতে দিয়ে প্রতিদিন রাতের রান্না সারে ও। সন্ধেবেলা বাচ্চাদের পড়াতে হয় তো । তখন রান্নার সময় হয় না বৃষ্টির।
এছাড়া আছে প্রতিদিন ই নিত্য নতুন সমস্যা। এগুলো কোনটাই ওর সিলেবাসে ছিল না।
এই তো সেদিন হঠাৎ করে দেখলো- সিংকের কলটা বন্ধ হচ্ছে না । ঝরঝর করে জল পড়ছে।এভাবে তো ট্যাংকের সব জল খালি হয়ে যাবে ! কোন রকমে প্লাস্টিক পেচিয়ে জলের ফোর্স কিছুটা কমিয়ে হার্ডওয়্যারের দোকানে ফোন করলো। কেউ ফোন তুলছে না। বাধ্য হয়ে দোকানে গিয়ে একটাকে ধরে এনে সমস্যার সমাধান হল।
একদিন তো দুপুরে টিভি চলছে না। বাচ্চারা খেতে বসে কার্টুন দেখতে না পেয়ে চিৎকার জুড়েছে । মেয়েটাতো কিছুতেই খাচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে জলের গ্লাস টেবিলে উলটে একেবারে …।
ধৈর্য হারিয়ে বৃষ্টি দিয়ে দিল মেয়েটার পিঠের মধ্যে দু ঘা। আরো কাঁদতে কাঁদতে না খেয়েই শেষে ঘুমিয়ে পড়লো বন্যা।
পরে কেবল্ অপারেটরকে ফোন করে জেনেছিল– কেবল্ এর তার নাকি কাঠবিড়ালি কেটে দিয়েছে। সারাতে সময় লাগবে।
খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন ওর। মনে হয়েছিল মেয়েটাকে না মারলেই পারতো। আর একটু সহনশীল কি ও হতে পারতো না।
একেক সময় ওর মনে হয় , সব ছেড়ে ছুঁড়ে যে দিকে দু চোখ যায় চলে যায়। বড্ড ভারী মনে হয় সংসার। শুধু দিনগতি পাপক্ষয়। আনন্দ হীন , একঘেয়ে জীবন। ধৈর্য হারিয়ে ফেলে।ছেলেমেয়েকে বকাবকি করে। পরে খারাপ লাগে। লঘু পাপে গুরু দন্ড দেওয়ার জন্য নিজের ওপর রাগও হয়। অর্ণবের ওপরও রাগ হয়। অফিস করে বলে সংসারের কোন কাজ করতে নেই। সব দায়িত্ব কী একা বৃষ্টির !
এভাবেই হয়তো একদিন জীবন শেষ হয়ে যেত । যদি না ওর জীবনে এমন ঘটনা ঘটতো।
বাচ্চারা সেদিন স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। খাওয়ার পর বৃষ্টি ও বারান্দায় খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছে। শীতের দুপুর। শুলে আর উঠতে ইচ্ছে করে না তাই বারান্দায় বেলা শেষের রোদ পিঠে নিয়ে বসেছে , এমন সময়ই ওকে দেখে বড় ঝুড়ি ভর্তি ফুলের টব মাথায় নিয়ে লোকটা দাঁড়িয়ে পড়লো। ফুলের গাছ নিবেন গো মা। ফুলের গাছ।
বৃষ্টি অবাক হয়ে ভাবলো এমন রোগা ছোটখাটো লোকটা কী করে এতগুলো টবঅলা ঝুড়ি মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি সাহায্য করতে লোকটা ঝুড়িটা মাটিতে নামালো। বৃষ্টি দেখল লোকটির পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি। মাথায় একটা বড় বিড়ে। ঝুড়ি নামিয়ে মাথা থেকে বিড়েটা পাঁচিলের ওপরে রাখলো। বৃষ্টি ভাবলো– এতগুলো গাছ নিশ্চয়ই অনেক দাম হবে।
লোকটি যেন ওর মনের কথা পড়তে পেরেছে -হঠাৎ লোকটা বলে উঠলো– বেশী দাম না মা। মাত্যর পাঁচশো টাকা দিলেই হবি।আমার নিজের হাতে করা গাছ । বেলা শেষ হতি চলল এখন অব্দি বউনি হলনি। মাজননী আপনি রেখে দিন কেনে। আপনের ছাদে আমি সাজায়ে দি যাব।
বছর দুই হল এই একতলা বাড়ি টা কিনেছে অর্ণব অফিসের লোন নিয়ে। গত বছর এপ্রিলে ছাদে আর্টিফিশিয়াল ঘাসও লাগিয়েছে । তাতে ঘরের তাপ অনেকটাই কমেছে। যা গরম! দেখতেও বেশ । তবে ছাদে ওঠার সময় কোথায় বৃষ্টির। বেশী কাচাকাচি করলে কাপড় শুকানোর জন্য ছাদে যায়। অল্প হলে সিঁড়িতে ই মেলে দেয়।
সবগুলো টব ই তো খুব সুন্দর। নিতেও ইচ্ছে করছে খুব। বৃষ্টি গুনে দেখল কুড়িটা টব। গোলাপ , চন্দ্রমল্লিকা,ডালিয়া,নানা রংয়ের নয়নতারা , জবা , টগর, পদ্ম আর নানা রকম শীতের ফুলের গাছ। সেগুলোর খটমট নাম বলছিল লোকটা। বৃষ্টি বলল এ সব নাম আমার মনে থাকবে না। তুমি বরং লিখে দাও। লোকটি একগাল হেসে বলল — আমি তো লিখতি পড়তি জানি না ।
- সংসারের কাজের চাপে আমি এমনিতেই নুয়ে পড়েছি। গাছপালা করার চাপ…. । বলা শেষ হয় না বৃষ্টির। লোকটি বলে — ভাববেন না মা জননী, টবের মধ্যি সব সার টার দেওয়াই আছে। কেবল একটু জল দিলেই হবি। আর সংসার চাপ হতি যাবি কেনে? তাঁর সংসার । আপনি সেই সংসারের সেবা করতিছেন মাত্তর। ভাল মন্দের ভাগিদার সে। দায় অদায় তাঁর। শুধু মুদু নিজের ঘাড়ে দায় নিয়ে নিজের কষ্ট বাড়ান কেনে ?
বৃষ্টি এমন কথা আগে কখনও শোনে নি। অবাক হয়ে মালীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। অমন সাধারণ দরিদ্র একটা মানুষের আরো কথা শুনতে ইচ্ছে করছিল ওর। ভরসা আর বিশ্বাস মিলে মিশে যাচ্ছিল।
সংসারের যে অনেক সমস্যা , আনমনে বলল ও।
লোকটি বলল — মাগো , সংসারের সব ঘটনার সাক্ষী হয়ে যান না কেনে ? বুদ্ধি বিচার তিনি দিয়েছেন। সেটি কাজে লাগান। সমাধান এমনি হইয়ে যাবে। সংসার সাগরে রইয়েছেন মা, ঢেউয়ে ভয় করলি হবি ?
সমুদ্রে মাছ ধরার নৌকাগুলান দেখিছেন ? কেমন ঢেউরে ধরি ধরি চলতিছে। দেখলি মনে হয় জানি ঢেউয়ের সঙ্গি হাত ধরাধরি করি আনন্দে নাচতিছে। কত আনন্দ ! ওই আনন্দই শুধু ধইরে থাকেন মা। সংসারে সুযোগ সুবিধা আবশ্যক। আবার না হলিও চলে। কিন্তুক আনন্দ যে অনিবার্য মাগো। তারে তো খোয়ানো যাবি নি কিছুতেই।
কথাগুলো বৃষ্টির কান দিয়ে হৃদয় ছুঁয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে যাচ্ছিল।
লোকটা ছাদে টবগুলো কার কতটা রোদ লাগবে বুঝে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেছে।
সেই বিকেলের হিমেল হাওয়ার সাথে ফুলের রূপ, রং ,গন্ধ আর মালী লোকটার কথা মিলেমিশে কেমন যেন ভাললাগার পরিবেশ তৈরী হয়েছিল।
বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে ছাদে নিয়ে গিয়ে দেখালো বৃষ্টি। খুশিতে হাততালি দিয়ে নাচতে থাকলো ওরা।
অর্ণব তো অবাক , এতগুলো সুন্দর সুন্দর টবভর্তি গাছ মাত্র পাঁচশো টাকা !
স্বামী সন্তানদের খুশিতে বৃষ্টি ও দারুণ খুশি। কেবল মালীর কথাগুলো কাউকে বলে নি ও। হৃদয়ে সযত্নে রেখেছে , ইষ্ট দেব মন্ত্রের মতো।
অসাধারণ। দারুন লাগলো।
Apoorbo….👌😍
অসাধারণ! সত্যি কত ছোটখাটো বিষয়ে আমরা অসহ্য হয়ে পড়ি অথচ কিচ্ছু না পাওয়া মানুষগুলো কেমন সারসত্য বুঝে যায়।
খুব ভালো লাগলো।