গল্পঃ আমার কথা – নির্মাল্য বিশ্বাস (কলকাতা)

আমার কথা

নির্মাল্য বিশ্বাস

ভুলে যাওয়ার অভ্যাসটা আজকাল রোগের মতো পেয়ে বসেছে। আজকাল বলাটা অবশ্য ভুল।এমন তো নয় ছোটবেলায় সব কাজ ঠিকঠাক মনে করে করতাম। বরং তখনকার ভুলে যাওয়ার তালিকা নিয়ে বসলে আস্ত এক মহাভারত হয়ে যাবে। বেশ মনে আছে তখন স্কুলে হয় পেন্সিল, রাবার নয়তো টিফিন বক্স কিংবা ওয়াটার বটল ফেলে আসার জন্য মা’র কাছে ঠাসঠাস খেতাম। এমন কোনো দিন ছিল না যে স্কুল ব্যাগের সব জিনিস ঠিকঠাক মনে করে নিয়ে আসতাম। ফেলে আসা জিনিসগুলো পরদিন যে সব পেতাম তেমনও নয়। বেশ কিছু জিনিস খোয়াও যেত। খোয়া গেলে বাড়ি ফিরলে আরও এক প্রস্থ মার।
খোয়া যাওয়ার গল্প তো বললাম, এবার অন্য এক কীর্তির কথা বলি। একবার হয়েছে কি স্কুল ব্যাগের মধ্যে মা দু’ দুটো টিফিন বাক্স আবিষ্কার করল। মায়ের তো চক্ষু চড়কগাছ। চিরকাল তার গুণধর পুত্র জিনিসপত্তর ফেলেই এসেছে; সঙ্গে করে তো কিছু নিয়ে আসেনি। আমি সেই নতুন টিফিনবাক্স দেখে আহ্লাদে আটখানা। যাক, মা এবার নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। চিরকাল ঘরের জিনিস রপ্তানিই করেছে ছেলে, এবার কিছু তো না হয় আমদানি হল। হাসিখুশি মুখ নিয়ে মা’র কাছে যেতেই পিঠে দমাদ্দম পালিশ। মারের সাউন্ড অন্যান্য দিনের থেকে অন্তত বিশ ডেসিবেল বেশি। কেন মারছে, কী অপরাধ সেসব কিছুই বুঝলাম না। শুধু জানি মা’র কাছে মার খাওয়াটাই আমার নিয়তি। পরদিন স্কুলে যেতে বাক্স রহস্য উন্মোচন হল। আমার পাশে যে ছেলেটা বসেছিল তার ব্যাগ থেকে টিফিন বাক্স খুলে সেই টিফিনটা দিব্যি খেয়েছি। সাথে নিজেরটাও খেয়েছি। মনে মনে অবশ্য ভাবছিলাম মা আজ হঠাৎ আমার জন্য দু’দুটো টিফিন বাক্স কেন দিয়েছে। সে যাই হোক, টিফিন খেয়ে দু’দুটো টিফিন বাক্সই পরম যত্ন সহকারে ব্যাগে ভরেছি যাতে ভুলে যাবার জন্য মা’র কাছে পিট্টি খেতে না হয়। ওদিকে বেশ মনে আছে পাশে বসা ছেলেটিও খেলে টেলে এসে অনেকক্ষণ ধরে ব্যাগটা হাতড়াচ্ছিল। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ করেনি। কী খুঁজছে, কেন খুঁজছে সেসব কিছুই আমায় জানায়নি। আমিও জানতে চাইনি। সে মনে মনে ভেবেই নিয়েছে তার মা তাকে টিফিন দিতে ভুলে গেছে। সে তো আর জানে না তার টিফিন আত্মসাৎ করে বাক্সটাকে আপন করে নিয়ে ক্রিমিনাল তার পাশেই বসে আছে নির্বিকার চিত্তে। সে বেচারি সারাদিন অভুক্ত থেকে বাড়ি ফিরে তার মা’র ওপর কী হম্বিতম্বি- কেন টিফিন দিতে ভুলে গেছে। তার মা তো শুনে আকাশ থেকে পড়ল। সাতসকালে টিফিন বানিয়ে স্কুল ব্যাগে ভরেছে। সেই টিফিন বাক্স কি ডানা মেলে উড়ে গেল নাকি?
পরদিন স্কুলে যেতেই সবকিছু জানাজানি হল। বাড়ি ফিরেই আবার মা’র ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি।এলোপাতাড়ি গোলাগুলি চলল। সেই গার্জেনের কাছে মায়ের প্রেস্টিজ গ্যামাক্সিন হওয়াতেই নতুন করে গোলাবর্ষণ। প্রিয় পাঠক বন্ধুরা নিশ্চয়ই আমার গুণের কীর্তি শুনে মনে মনে খুব হাসছেন। তাহলে শুনুন বন্ধুরা আমার কীর্তি এখানেই শেষ নয়। ভুলে যাবার যে অনন্য কীর্তি স্থাপন করেছি সারাজীবনে, সেই রেকর্ড আগামী প্রজন্মেও কেউ ভাঙতে পারবে না।
বেশ মনে পড়ে তখন ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ি। স্কুল থেকে ফেরার পর দেখি আমাকে দেখে মা আর দিদার সেকি খিলখিল হাসি। আমিও কৌতুহলী চোখে দুজনের হাসির সম্ভাব্য কারণ খুঁজছি।দু’জনের মুখ দেখেই বুঝলাম তাদের হাসির কেন্দ্রবিন্দু আমার প্যান্ট। নাহ্, উল্টো প্যান্ট তো পড়িনি,।সোয়েটারও না। যদিও এরকম কীর্তি আমার অনেক আছে। সেসব ছুটকোছাটকা কাহিনীর অবতারণা এখানে না করাই ভালো। যাইহোক দুজনের চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝলাম ওদের নজর আমার হাফপ্যান্টের দিকেই। দেখলাম প্যান্টের ভিতর থেকে লালমতো একটা কাপড় উঁকি দিচ্ছে। মা সেটা ধরে টানতেই আসল রহস্য উন্মোচন হল। লাল রঙের কাপড়টা আসলে কিছুই না, আমার গামছা। স্নান করার পর প্যান্ট বদলানোর সময় যেটা ছাড়তে ভুলে গেছি। ভাবুন তো একবার ওইভাবেই সারাদিন স্কুল করে এলাম। তা এইরকম যার ভুলো মন সে কী করে জীবনের এতগুলো বছর কাটাল সেটা ভাবতে নিজেরই আশ্চর্য লাগে।
তবু ছোটবেলার ভুলগুলোকে ক্ষমা করা যায় কিন্তু বয়সকালে ভুল হলে? তার ক্ষমা আছে কী? সবচেয়ে বড় কথা ছোটবেলায় ভুল করলে খুব বেশি হলে মায়ের কাছে বকুনি ছিল, মারের ভয় ছিল। এখন সেই ভয় নেই। শুধু নিজেকেই সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। আমার তো মনে হয় ভুলে যাওয়ার প্রবণতাটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ধরুন একটা গল্প লিখতে বসলাম। বেশ দু’পাতা, চার পাতা কিংবা কখনও সখনও আট- দশ পাতাও লেখা হয়ে যায়। তারপর সেই গল্প লেখা কাগজগুলো কোথায় হারিয়ে ফেলি আর খুঁজেই পাই না। এইভাবে কত গল্প যে হারিয়ে ফেলেছি তার ইয়ত্তা নেই।পরে ওই একই প্লট নিয়ে গল্প লিখতে বসি। পরের গল্পটা আগের গল্পের মূল ভাবনা থেকে অনেকটাই বদলে যায়। নতুন গল্পটা অনেক সময় ভালোও হয়, আবার খারাপও হয়। কিন্তু নতুন করে আবার একটা গল্প লিখতে গিয়ে আমার অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যায়।
আরও কীর্তি আছে আমার, শুনবেন? প্রতিদিন অফিস যেতে আমার লেট হবে, হবেই।এর পেছনেও রয়েছে আমার ভুলে যাওয়ার স্বভাব। অফিস যাওয়ার সময় মা টাইমমতো টিফিন আর জলের বোতলটা ব্যাগে ভরে দেয়। অতএব সেগুলো ভুলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় আমাকে তিনটে জিনিসের খেয়াল রাখতেই হয়। এক চশমা, দুই মানিব্যাগ, তিন মোবাইল। এই তিনটির কোনো একটা ফেলে এলে আমাকে আবার বাড়ি ফিরে আসতে হয়; সে যত রাস্তাই চলে যাই না কেন। আর এই তিনটে জিনিসকে খুঁজে পেতে আমার অনেকটা সময় চলে যায়। একটা পাই তো অন্যটা পাই না। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজার পর মোবাইলটা খুঁজে না পেয়ে অন্য ফোন থেকে আমার মোবাইলে ডায়াল করি। দেখি বুকপকেটের ভিতর থেকে আমার মোবাইলের রিংটোন বাজছে, – ‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু… ভুলে যাইবা যদি’।
অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন মানিব্যাগ খুঁজে না পেলে নিজের পকেট দেখি। চশমা হারালে চোখের দিকে তাকাই। এভাবেই চলে আমার দিনযাপনের চিত্র। এবার একটা সাম্প্রতিক ঘটনার কথা বলি। খুব বেশি দিন হয়নি। খুব বেশি হলে মাস দু’য়েক হবে। হয়েছে কি আমাকে তো পত্রিকার কাজে বিভিন্ন সাহিত্যিকদের কাছে যেতে হয়। সেরকমই পত্রিকার কাজে এক সাহিত্যিকের বাড়ি গেছি। আমার বাড়ি থেকে ওনার বাড়ির দূরত্ব বেশ অনেকটাই। অন্তত ঘন্টা দু’য়েক তো হবেই। কাজ সেরে ওখান থেকে ফিরছি। দেখলাম একটা দোকানে গরম কচুরি আর মালপোয়া ভাজছে। খাবার দেখেই তো আমার রসনেন্দ্রিয় লকলকিয়ে উঠল। বাড়ি থেকে খেয়েই বেরিয়েছি, তবু মনে হল পেটের ব্যাসার্ধটা হঠাৎই কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। সেই স্ফীত ব্যাসার্ধের মধ্যে ইঁদুরছানার ডাকের মতো মৃদু অথচ অথচ স্পষ্ট একটা আওয়াজ ভেসে আসছে। খান চারেক কচুরি আর দুটো মালপোয়া গলাধঃকরণের পর মুখ- হাত ধুয়ে দিব্যি বাড়ি চলে এসেছি। বাড়ি ফিরেই মনে হল এই রে! খেয়েদেয়ে টাকা দেওয়া তো হয়নি। কী করি? দুই দুই চার ঘন্টা পথ উজিয়ে এখন কে টাকাটা দিতে যাবে? একবার ভাবলাম এখন থাক। পরে কোনো এক সময় ওই সাহিত্যিকের বাড়ি গেলে টাকাটা দিয়ে আসা যাবে। পরক্ষণেই মনে হল, মাসখানেকের মধ্যে তো ওই সাহিত্যিকের বাড়ি যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে পরে যে ভুলে যাব না তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? তার থেকেও বড় ব্যাপার এর মধ্যে যদি টসকে যাই তাহলে আমার টাকাটা আর দেওয়া হবে না। ঋণের বোঝা নিয়ে তো মরতেও পারব না। তার থেকে ভালো টাকাটা এখনই দিয়ে আসা। পরদিন ষাট টাকা গাড়িভাড়া খরচ করে ত্রিশটাকা দিতে গেলাম। টাকাটা পেয়ে দোকানদার আমার মুখের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
এই হলাম আমি। ভুলে যাওয়ার স্বভাব আমার জন্মগত। কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে খেতে ভুলে যাই। জিনিসপত্তর কোথায় রাখছি ভুলে যাই। তন্ময় হয়ে কিছু ভাবতে বসলে বাস থেকে নামতেও ভুলে যাই। এরকম অনেকবার হয়েছে নির্দিষ্ট স্টপেজ পেরিয়ে গেছে, উল্টোদিকের বাস ধরে ফিরেছি। ভুলের ভুরিভুরি নমুনা আছে। শুধু ভুলতে পারি না কিছু মানুষ, কিছু স্মৃতি আর কিছু রঙীন মুহূর্ত। মনে মনে ভাবি এত যার ভুলো মন সে এগুলোকে ভুলতে পারে না কেন? কিন্তু এটাই বোধহয় ওপরওয়ালার ইচ্ছা ; যার যত ভুলো মন তার স্মৃতিশক্তি তত সবল করে পাঠান উনি। কিছু মানুষ হারিয়ে যাওয়া গল্পের মতোই আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে যাদেরকে ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারি না আমি। প্রতিদিন কত নতুন নতুন বন্ধু আসে।কত নতুন নতুন লাইক, ভুরিভুরি কমেন্ট। তবু আমার মন সেইসব বন্ধুদের খোঁজে। তাদের নীরব উপস্থিতি নিস্তরঙ্গ নদীর মতো কানের দু’পাশ দিয়ে বইতে থাকে, বইতেই থাকে।

2 thoughts on “গল্পঃ আমার কথা – নির্মাল্য বিশ্বাস (কলকাতা)

  1. জমজমাট অবেক্ষন শারদীয়া। খুব ভালো লাগলো।

Leave a Reply to Nirmalya Biswas Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *