প্রবন্ধঃ দেবীপক্ষের দর্পণে -অনিরুদ্ধ সুব্রত (বনগাঁ)

দেবীপক্ষের দর্পণে –  অনিরুদ্ধ সুব্রত

————————–

শোনা যায়,রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে দেবী রূপে পূজা করেছিলেন।কিন্তু তা নাকি নিতান্তই একজন নারী জ্ঞানে নয়, বিশেষ ষোড়শীজ্ঞানে। কারণ, এ হল কুমারী পূজার দার্শনিকতত্ত্বের প্রভাব। নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। ব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে—সেই ত্রিশক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। ব্যাখ্যায় বলা হয়,এই সাধন পদ্ধতিতে সাধকের নিকট নারী ভোগ্যা নয়,পূজ্যা।

        কিন্তু সেই নারীই পূজিতা হবে যে অনধিক ষোড়শ বর্ষীয়া এবং অরজ:স্বলা কুমারী। আরও একটু প্রাসঙ্গিক তথ্য হল, দেবীজ্ঞানে যে কোনও কুমারী পূজিতা হওয়ার(বেশ্যাকুলজাত হলেও)কথা থাকলেও সাধারণত সর্বত্র ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যারাই পূজিতা হয়ে থাকে। দেবীপুরাণ থেকে শুরু করে তন্ত্রসাধন তত্ত্ব মোটামুটি ব্যাখ্যা বিশ্বাস প্রায় একই। নারী দেবী কিন্তু কুমারী হতে হবে। এবং দুর্গাপূজায় কোথাও কোথাও পূজার অঙ্গ হিসাবে যে কুমারীপূজা হয়ে থাকে, সেখানে দেবীদুর্গার আর এক নাম ‘কুমারী’। আবার  তিনিই  রীতিমতো স্বামী সন্তান সহ মন্ডপে বিরাজ করেন। কথিত, ১৯০১ সালে বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ মাতৃজাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কুমারী পূজার প্রচলন করেন। কিন্তু   রজ:স্বলা যেমন কুমারী নয়, তেমনি তারা পূজ্যও নন— এই যুক্তি কেন ? অন্তত স্বামী বিবেকানন্দের দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই এই সরল ধারণা সমর্থন পেতে পারে পারে না । কেননা নারী মুক্তি থেকে নারী শক্তি জাগরণে যত বক্তৃতা তাঁর,  সেখানে কোথাও নারীর কুমারীত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না।

              ১৯০০ সালের ১৮ই জানুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ার শেক্সপিয়র ক্লাবে স্বামীজি ‘ভারতের নারী’ সংক্রান্ত এক বক্তৃতা মালায় উল্লেখ করেন , “ভারতীয় নারীর আদর্শ হলো মাতৃত্ব । মাতৃত্বই ভারতীয় নারীর প্রথম এবং শেষ কথা। নারী বলতে ভারতীয় হিন্দুর মনে মাতৃরূপই প্রষ্ফুট হয়ে ওঠে। এমনকি ঈশ্বরকেও হিন্দুরা মাতৃ সম্বোধন করে থাকে ।” কিন্তু সেই ঈশ্বর বোধে কুমারীত্বের যুক্তি তেমন চোখে পড়ে না । 

                 এই বিষয়ে ইন্টারনেট থেকে  প্রাপ্ত একটি প্রবন্ধে উল্লেখ দেখি, ” শ্রী রামকৃষ্ণের মতে ,অল্প বয়সী মেয়েরা যখন কুমারী থাকেন সেই বয়সে জগতের নেতি বাচক শক্তি থেকে  তারা দূরে  থাকেন ।” 

         গত ২৮শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বলল, কেরলের শবরীমালা মন্দিরে সব বয়সের মহিলাদের প্রবেশাধিকার থাকবে। অর্থাৎ ঋতুময়ী অজুহাতে ১০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যবর্তী  বয়সী নারীদের মন্দিরে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা এবার থেকে উঠে গেল। যা দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যাশা করে আসছিল অগণিত ধর্মপ্রাণ মহিলারা। এখানেও প্রশ্নটা কিন্তু সেই কুমারীত্বের বা অরজ:স্বলার। যদিও প্রকৃত অর্থে শবরীমালা মন্দির এখনও কৌমার্যের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল।  এমনকি মহিলা  সাংবাদিক, পুলিশ প্রবেশের ক্ষেত্রে ও যথারীতি ঐ নিয়মের ব্যত্যয় হয় না।

        এখনও প্রায় প্রতিটি হিন্দু পরিবারে(ব্যাতিক্রম হলেই ভালো ) বিশেষ ঈশ্বরভক্তি ,পূজা-পার্বণে অথবা কোনও সামাজিক পারিবারিক শুভ অনুষ্ঠানে ঋতুস্রাব চলছে এমন শারীরিক অবস্থার কন্যা বা বধূকে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ স্বীকৃত নয়। এবং নির্দেশটা মেনে চলতে চলতে এমনই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে  যে, মেয়েরা নিজেরাই তাকে দৃঢ় প্রথা হিসাবে বিশ্বাস করে চলেছে। 

     সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের অন্যতম মহিলা বিচারপতি ইন্দু মলহোত্র নিজে বাকি চারজন পুরুষ বিচারপতি থেকে এই ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পথে হেঁটেছিলেন। শবরীমালা মন্দিরে সব বয়সের মহিলাদের প্রবেশাধিকার দেওয়া নিয়ে শ্রীমতী মলহোত্রের মত ছিল, “ধর্মের ব্যাপারে যুক্তির ধারণা চাপানো যায় না।” অর্থাৎ একজন নারী হয়েও তার মত ছিল, ‘বিশেষ কোনও ধর্মীয় আচরণ বা নিষেধাজ্ঞা বৈষম্যমূলক মনে হলেও আদালত তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।’ এবং বিচারপতি মলহোত্রের যুক্তি, সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায় নাগরিকদের ধর্মাচরণের মৌলিক অধিকারের কথাকে, সমানাধিকারের প্রশ্নে তা অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। কিন্তু ধর্মাচরণের মৌলিক অধিকারের দোহাই দিয়ে ছুতমার্গ মেনে নেওয়াই সর্বোচ্চ আদালতের একজন বরিষ্ঠ বিচারপতির প্রচ্ছন্ন নিদান ? 

         আদালত দেশের সাধারণ থেকে পদাধিকারী সকল নাগরিকের অধিকার, অধিকার রক্ষার দায়, নিরাপত্তা, অন্যায়ের প্রতিকার এবং মানবিকতার দিক বিবেচনা করবে এটাই দস্তুর। সাম্প্রতিক কালেই মুসলমান ধর্মের ক্ষেত্রে যখন মৌখিক তালাক প্রথা নিয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন আদালতে গড়ায়, তখনও সাধারণ মানুষ (বিশেষ করে নারী) আদালতের কাছে মানবিক অধিকার প্রত্যাশা করেছিল। নারীকে পারিবারিক, সামাজিক বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখাতে সক্রিয় হয়ে উঠতে হয়েছিল বিচার ব্যবস্থাকে। যদিও সেখানেও ধর্মীয় রীতির দোহাই কম ছিলো না।

         হ্যাঁ, অবাক হওয়ার বিষয় তো থাকবেই ; একুশ শতকে যদি সাধারণ শারীরিক পরিচিত একটি প্রক্রিয়ার কারণে মন্দিরে প্রবেশাধিকার না দেওয়া হয়, এবং বিষয়টা যদি ১৯৯১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আদালত থেকে আদালতে দৌড়তে থাকে। আশ্চর্য হওয়ার মতো সংবাদ হল, ২০১৬এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলার বিরুদ্ধে কেরলের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকার মত দেয়, ‘দীর্ঘদিনের ধর্মীয় প্রথা রক্ষাই সুপ্রিম কোর্টের কর্তব্য।’ ২০১৮-এর ‘২৫জুলাই নায়ার সার্ভিস সোসাইটি জানায়,শবরীমালা মন্দিরের বিগ্রহ আয়াপ্পার কৌমার্য সংবিধানে রক্ষিত করা হয়েছে’ ?

      অথচ সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত তুলে বিরোধীরা জানাল স্বাগত আর সরকার  নিল মৌন। তাহলে ভিতরে ভিতরে বিচারপতি মলহোত্রের মতোই ধর্মীয় আচরণে, রীতিতে নীরবতা ? পক্ষান্তরে নারীর বঞ্চনার প্রসঙ্গটা শূন্য ! কুমারীই পূজ্যা, কুমারীত্বের প্রবেশাধিকার, ঋতুময়ী এক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ?

      শোনা যায় আধুনিক ভারত নাকি চাইছে নারীদের স্বাভাবিক শারীরিক প্রসঙ্গকে সহজভাবে নিতে । কলেজ স্কুলে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণের যন্ত্রও প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। বিজ্ঞাপনে কিশোরীকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে। বাজারে হাজার একটা স্যানিটারি ন্যাপকিন কোম্পানি তাদের প্রোডাক্ট বিকোচ্ছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রীড়াক্ষেত্রে ঋতুময়ী স্বাগত। পরিবারে কন্যা, স্ত্রী, মা প্রত্যেকেই নারী—আধুনিক ভারত নারীর অবমাননা মানবে কেন। 

      কিন্তু সে কি কেবল আদালত বলে দেবার পর ? আর সেখানেও থাকবে দ্বিমত ? দুর্গা, কালী,লক্ষ্মী, সরস্বতী ইত্যাদি নারীরূপে পূজিতা হবেন। অথচ কুমারী পূজা হবে একান্ত কুমারী হিসাবেই ,ঋতুময়ী নয়। তবে যে একটা প্রশ্ন ওঠেই, ভারতীয়রা এতো যে দেবীর পূজায় নিয়োজিত—তা সেই সব দেবী যদি নারীরূপী হন তবে তাঁরা কি কেউ রজ:স্বলা হন না ! পুরাণ সাহিত্য কী বলে ? নাকি এখনও দোষটা শুধু মনুষ্যভূক্ত ! এমন একপেশে দেববাদী ভক্তি আদালত ব্যতীত সুসংস্কৃত হবার সম্ভাবনা কোথায় ? আসন্ন দেবীপক্ষে অকালবোধন উদযাপনী বাঙালি উৎসবে আর হৃদয়ে কতটা যুক্তিবাদী হবে সেটাই দেখার। রজ:স্বলা বাঙালি নারী পাবে তো অষ্টমী-অঞ্জলীর অবাধ অধিকার ?

                    আসলে ভারতীয় নারীকে যেনতেন প্রকারে পুরুষের ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করতে হয় এই ২০২০ তেও। কেরলা,উত্তর প্রদেশ,পশ্চিমবঙ্গ সব জায়গাতেই নিয়ত নারীর উপর অত্যাচারের খবরে ছয়লাপ । দরিদ্র,  দলিত, নানা প্রসঙ্গে তাদের উপর অবমাননার শেষ  নেই। কোথাও খাপ পঞ্চায়েত করে নারীর অপরাধ বিচারে সিদ্ধহস্ত সমাজ,  কোথাও মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলাকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে চলছে এলাকা ছাড়া করার সমবেত প্রক্রিয়া । আর নারী পাচারের ধারাবাহিক সংবাদ তো মিডিয়ার আনাচেকানাচে ।

            মহালয়ার চণ্ডী পাঠে যে নারীরূপ শক্তির আরাধনা দিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা, ভারতীয় তথা বাঙালির সমাজ ও পারিবারিক জীবনে তার প্রকৃত প্রশ্নহীন পুজো কোথায়  ? দৈনন্দিন জীবন উপেক্ষা করে, নারীর প্রতি বৈষম্য বজায় রেখে এই আরাধনা অনেকটাই হাস্যকর মনে হয়। ধর্মীয় উৎসব শুধু  উদযাপনে সমীহ আদায় করতে গেলে তা হয় মিথ্যে । নারীকে ঈশ্বর রূপে পুজো করার আগে তাদের সম মর্যাদার মানুষ হিসেবে গ্রহণ করার একটা সহজ পরীক্ষা দিতে হবে ভারতীয়দের। যতক্ষণ না সেই সম্মান আমরা দিতে পারছি, ততক্ষণ আমাদের এই নারীশক্তির উৎসব আদতেই ফাঁকির অনুষ্ঠান হয়ে থাকবে। এক্ষেত্রে ভাবা প্রাকটিজ বন্ধ করে গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলতে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। উৎসব তখন বিস্তৃত ও বিশ্বস্ত সত্য হয়ে উঠবে, না হলে সব ফাঁকা আড়ম্বর মাত্র ।

                                                                       —- অনিরুদ্ধ সুব্রত 

4 thoughts on “প্রবন্ধঃ দেবীপক্ষের দর্পণে -অনিরুদ্ধ সুব্রত (বনগাঁ)

  1. বাহ্ । বিষয়বস্তু দারুন। আলোকপাত করেছেন ও খুব সুন্দর। আমরা সমৃদ্ধ হলাম।

  2. দারুণ লাগলো লেখাটা। এই যে দেবী দুর্গার বোধন হচ্ছে আজ তা তিনিও তো হিসেব মতো চার সন্তানের মা!

  3. খুব প্রাসঙ্গিক লেখাটি।
    নারীর স্বাভাবিক অসুস্থতার সময় বিশ্রামের প্রয়োজন। তাই মা , ঠাকুমা, পরবর্তী সময়ে শ্বাশুড়ী মা তিনদিন কোন কাজ করতে দিতেন না। বরং তাঁরা খাওয়া দাওয়ার প্রতি বিশেষ যত্ন নিতেন।কোন জিনিস পাতে বেশি পড়ত। আবার সবাই খেলেও কোন কোন জিনিস পাতে অনুপস্থিত থাকত। এইসব যারা মেনে চলতো সেই মেয়েদের অনেক সমস্যা কম হতো ।
    অনেক পুরোহিত মেয়েদের ওঁ বলতে দেন না। সত্যি বলতে — অনেক পুরোহিতের থেকে অনেক মেয়ে শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ করে। তাছাড়া দুর্গা পুজোয় যাঁর মন্ত্র দিয়ে শুরু তাঁর নাম বাক্ দেবী।

    1. অসাধারণ চিন্তনের প্রকাশ দেখলাম। বলিষ্ঠ লেখনী পড়ে ভাল লাগল…💐🙂

Leave a Reply to PRABIR GANGULY Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *