ঋণ -শুভ্রকান্তি মজুমদার
শহরে আজ খুব হৈ চৈ, খবরের কাগজে হেডলাইন, “তরুন ও উঠতি স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ অর্ঘ সান্যালের কাছে প্রসব করাতে গিয়ে নার্সিংহোমে সদ্যোজাত শিশুর অপমৃত্যু।” খবরে প্রকাশ, গত রাতে প্রসব করানোর সময় শিশুটির গলায় নাড়ি পেঁচিয়েই শিশুটির অপমৃত্যু ঘটে। এনিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে শিশুটির পরিবার।
শহরের থানার সৎ ও দোর্দন্ডপ্রতাপ ইনেস্পেকটর ইনচার্জ বিতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব সুনাম। তিনি এই শহরেরই মানুষ, এই শহরেই তার বাড়ি। মা নেই , বাবা ও স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে তার ছোট সংসার। আজ সকাল থেকেই তিনি ডাক্তার অর্ঘ সান্যালের বিরুদ্ধে কি ব্যাবস্থা নেয়া যায় ,এই নিয়ে চিন্তামগ্ন।
প্রাক্তন রেলওয়ে কর্মী সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায় বিতনুর বাবা। তিনি সকালে কাগজ পড়ে খবরটা দেখলেন, ভাবলেন, কি দিনকাল পড়ল, জীবনের কোনও দামই নেই। ফুল হয়ে ফোটার আগেই কুঁড়িটি ঝরে পড়ল। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার গেটের সামনে এসে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ির কাঁচে আঁকা চিহ্ন দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো ডাক্তারের গাড়ি। গাড়ি থেকে নামলেন এক ভদ্রলোক, একমাথা উসকো খুসকো কাঁচাপাকা চুল নিয়ে। গেট খুলে ঢুকতেই সুশীল বাবু চিনতে পারলেন তার প্রাক্তন বস ডি আর এম সাহেবকে, তিনি অরুন সান্যাল।
—আসুন আসুন! বসুন স্যার, এই কথা বলে নিজের চেয়ার ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সুশীল বাবু।
— আজ বসতে আসিনি, ভীষণ বিপদ আমার, আজ আপনার কাছে এসেছি, আপনিই পারেন আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। অরুন বাবু বললেন।
ছিঃ ছিঃ এভাবে বলছেন কেন স্যার? আপনি ছিলেন আমার অন্নদাতা,আপনি আমার যে উপকার করে ছিলেন তা কি আমি কোনোদিন ভুলতে পারি? আপনি যে এই শহরে আছেন আমি তো তা জানিই না। একটা খবর পাঠালেই পারতেন, আমি নিজেই চলে যেতাম আপনার কাছে, ছিঃছিঃ আপনি নিজে এই অধমের বাড়ি বয়ে এলেন।
— সুশীল বাবু উত্তর দিলেন।
—–না না তাতে কি হয়েছে আমার ভীষণ বিপদ তাই নিজেই চলে এসেছি। অরুন বাবু বললেন।
— ঠিক আছে আগে বসুন বৌমাকে চা দিতে বলি, এককাপ চা খেয়ে তারপর বলুন আপনার কি বিপদ, কি করতে পারি আপনার জন্য। সুশীল বাবু উত্তর দিলেন।
কোনোরকমে এককাপ চা খেয়েই ,একনিশ্বাসে প্রাক্তন ডি আর এম সাহেব বললেন, আমার একমাত্র ছেলে অর্ঘকে বাঁচান! ও ডাক্তার, স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ, একটা বিশ্রী কেসে ফেঁসে গেছে গতকাল রাতে!
সুশীল বাবুর কাছে সব পরিস্কার হয়ে এল। তাহলে ওই ডাক্তার অর্ঘ সান্যাল, স্যারের ছেলে। এখন নিশ্চয়ই তার ছেলে পুলিশের ইনেস্পেকটর ইনচার্জ জেনে তার কাছে নিজে ছুটে এসেছেন। স্বাভাবিক! স্যারের জায়গায় তিনি নিজে থাকলেও তাই করতেন। সুশীল বাবু ভাবলেন। একটু ভেবে নিয়েই সুশীল বাবু বললেন,
–আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি যান স্যার। আমি সবটা দেখে নিচ্ছি।
এরপর অরুন বাবু বাড়ি চলে গেলে, তিনি বিতনু কে ফোনে বাড়িতে ডেকে পাঠালেন জরুরী তলব করে। বিতনু ও তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এল গাড়ি নিয়ে।
বিতনু বাড়িতে এলে তাকে সুশীল বাবু খুলে বললেন সবটা,যে তার প্রাক্তন বসের একমাত্র ছেলে ওই ডাক্তার অর্ঘ সান্যাল তাকে কিছুতেই ধরা যাবেনা বা থানায় নিয়ে যাওয়া যাবেনা, কারণ একদিন ওই ডি আর এম সাহেব তার চাকরি বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। সব শুনেও বিতনু বাবার কথায় কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না, তখন সুশীল বাবু বিতনু কে বললেন, তাহলে শোন! আমি তখন মালবাজার স্টেশনে বুকিং ক্লার্ক, সংসারের একমাত্র রোজগেরে, তোর দাদু,ঠাকুমা পিসি এদের নিয়ে বড় সংসার আমাদের, ওই তো কটা টাকা মাইনে, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তারপর তোদের সব ভাই বোনদের পড়াশোনা, তখন মালবাজারের কাঠ ব্যবসায়ী সত্যনারায়ন লাখোটিয়ার পাল্লায় পড়ে দুটো এক্সট্রা পয়সার লোভে দুনম্বরী কাঠ এক নম্বরী বলে রেলের পার্সেল ভ্যানে বুকিং করতে শুরু করি, কিন্তু কপাল খারাপ! কিছুদিন পরেই উপরমহল সব ধরে ফেলে, আমাকে শোকজ, সাসপেনশন সব করে, তোরা সব ছোট ছোট তখন, আমি অকূল পাথারে হাবুডুবু খেতে খেতে ওই অরুন সান্যালের শরণাপন্ন হই , একমাত্র তাঁর চেষ্টাতেই আমি বেঁচে যাই ও পরে আমার প্রমোশন ও হয় ওঁর চেষ্টায়। অরুন বাবুই আমাদের পরিবারকে তখন বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। এসব তুই ভাব একবার। এসব বিতনুকে বলতে বলতে সুশীল বাবু নিজেই খেয়াল করেন নি ছেলের সামনে তার মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে।
এবার বিতনু দুই হাত দিয়ে বাবার মাথাটা তুলে ধরে
কতদিন পর যে বাবাকে জড়িয়ে ধরল,তা খেয়াল করতে পারলনা। বাবা ছেলের দুজনেরই চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে। পাশের ঘর থেকে বিতনুর স্ত্রী পর্দার ফাঁক দিয়ে সব দেখছে। বিতনু হাতের আঙ্গুল দিয়ে নিজের চোখের মুছে পকেট থেকে রুমাল বের করে বাবার চোখের জল মুছিয়ে দিলো।
— ঠিক আছে বাবা, আমি সবটা দেখে নিচ্ছি, স্যার কে বলে দিও ,কোনও চিন্তা নেই। একথা বাবাকে বলে বিতনু আবার গাড়ি নিয়ে থানায় রওয়ানা হল, এখন তার অনেক কাজ, সবটা সামাল দিতে হবে।