সাম্প্রতিক— ৬
টেকসই জুতো না জীবন ?—-———————————
সম্প্রতি একটা জুতোর দোকানে ক্রেতাদের ভিড় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তা দেখে নেটিজেনরা রীতিমতো আতঙ্কিত । অনেকেরই প্রশ্ন, ‘এই যদি এখনই তবে পুজোতে না জানি কী হয় ?’ প্রশ্ন খুবই সঙ্গত কিন্তু প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। তবে যেটা আছে সেটা এক অপরিসীম ভয়।
নতুন বাহারি জুতো পরে অসুস্থ হওয়ার সখ কী একমাত্র বাঙালিরাই করতে পারে ! বিশ্বে এমন মননশীল জাতি নাকি কম আছে । কেউ আবার নিন্দুক, বলে হ্যাঁ, বিশ্বে এমন হুজুগে জাতিও খুব কম আছে। সে যাই বলা হয়ে থাকুক না কেন বাস্তবে দুর্গাপুজো বলে কথা !
আড্ডা থেকে শুরু করে ফুটবল খেলা আর রাজনীতি থেকে শুরু করে কাব্য চর্চা, এই দুধে-ভাতে জাতিটির কালচার বড়ো উচ্চ মার্গের । তুলনামূলক সম্প্রদায়গত উৎসবের ভেদ বাঙালি করে না । পুরনো বাংলা প্রচলিত প্রবাদ ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ কবে থেকে ইরেজার দিয়ে ঘসে ঘসে তুলে ফেলেছে। তার জায়গায় নতুন করে লিখে নিয়েছে ‘তেরো মাসে তেষট্টি পার্বণ’ ( ডিজিটাল ডিজাইনে আঠাশে মাস যে ! ) । নানা ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রধান প্রধান অনুষ্ঠান গুলো তো থাকবেই, বিশেষ করে দুর্গোৎসবকে ঐ সিরিজের মুখ্য ধরে নিয়ে বাঙালির সে যেন এক ওয়ার্ল্ড কাপ জয়ের লড়াই । নগদ, ধার, ক্রেডিটকার্ড, লোন, ফেসটিভ্যাল অ্যাডভান্স, আরও শত উপায়ে শপিং, ট্রাভেলিং,ডেটিং,মস্তি ইত্যাদি ইত্যাদি চাই ই চাই। এ মিছিল থামার নয়, আমরা বাংলায় গান গাই থেকে শুরু করে আমরা বাংলায় পান করি পর্যন্ত ।
গত ছয়মাসাধিককাল ভারতের করোনা পরিস্থিতি উদ্বেগ বাড়িয়েছে বই কমায় নি। কেন্দ্র, রাজ্য নানা ভাবে লকডাউন থেকে ক্রমে আনলক পর্ব সামলানোর চেষ্টা করছে। সংক্রমণ হারে ইতিমধ্যে টানা অনেকদিন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মুকুট আমরা ছিনিয়ে নিয়েছি। সারা দেশ সহ এই রাজ্যেও পর্যাপ্ত বেড হাসপাতাল গুলোতে নেই। বহু অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা চলছে বাড়িতে থেকে । এমনকি বিশেষজ্ঞরা বলছেন শরতের গুমোট কেটে হেমন্তর শীতলতা এলে সংক্রমণের পরিস্থিতি আদৌ কী হতে পারে এখনও তা হলপ করে বলা সম্ভব নয়। স্কুল, কলেজ,লোকাল ট্রেন এখনও সচলের ছাড়পত্র পায় নি। অথচ এই হেডফোনে রবীন্দ্রসংগীত শোনা বাঙালি ‘পুজোর গন্ধ এসেছে’ বলে এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায় !
গাদাগাদি ভিড়ে সে খুঁজে চলেছে শ্রীচরণ যুগলের জন্য মনের মতো আর টেকসই জুতো ? কিন্তু আসলে কোনটা টেকসই দরকার— জীবন না নতুন জামা জুতো শাড়ি ?
এই মুহূর্তে শহরে,গ্রামে,মফস্বলের রাস্তায় বাজারে জাস্ট একটু মুখ তুলে তাকালেই দেখতে পাবেন দুচারজন ব্যতীত কারও মুখে মাস্ক নেই। সোসাল ডিসট্যান্স তো অলীক । এর পর যত এগিয়ে আসছে ফাইনাল ম্যাচ, তত বাড়ছে নিষেধাজ্ঞা ভুলে যাওয়ার প্রবল এক মৃত্যু তাড়না। যেন সবাই মিলে গলা জড়াজড়ি করে প্রবল সংক্রমণে ঢুকে যাওয়ার মজা আমাদের তীব্র আকর্ষণে হাত নেড়ে ডাকছে।
বাঙালির ভূতে বিশ্বাস ঈর্ষা করার মতো। পেত্নি, শাকচুন্নি থেকে বেম্যদত্যি সবই এরা চেনে জানে। এছাড়া গেছোভূত ,মেছোভূত কম নেই কিছুই। তার সঙ্গে এবার এই সত্যি ভূতের সংযোজন— ‘বাজারি ভূত’। লকডাউনের শুরুতে বহু ভাবে বহু অনুনয় বিনয়ে সরকার নিয়ম বেঁধে দিয়ে ছিল, অনেকেই মানেনি। বাধ্য হয়ে পুলিশ নামিয়ে পিটিয়ে নিষেধাজ্ঞার তাৎপর্য বোঝাতে হয়েছিল । আর আজ এই আনলক পঞ্চমে বাঙালি যেন কনুইয়ের গুঁতো মেরে করোনাকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে ভিড়ের তলায় । কিন্তু সে কি সহজে পদদলিত হওয়ার বস্তু ?
মহালয়ার একমাস পরে পুজো, এমনিতেই বাংলার পাবলিকের গোঁসা হয়েছে । ধৈর্য্য রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে । আপাতত পুজো কমিটি গুলো মেরুদণ্ডে জোর পেয়ে তেড়েফুড়ে লেগেছে । আপামরের গলায় সেই রবীন্দ্রনাথ, আজ খেলা ভাঙার খেলা… ।
কিন্তু সাবধান বন্ধু স্বজন, ঢাকে বাড়ি দিয়ে নেমে পড়বেন না। অনলাইনে পোষাক কেনা শিষ্ট বাঙালি কিন্তু অনলাইনে আরোগ্য কিনতে পাবেন না। কাতারে কাতারের ভিড়ে মিশে গেলে অসুখ কিন্তু কাঁধে চড়ে বাড়িতে চলে আসবে। আনন্দ, উৎসব, উল্লাস, বিশৃঙ্খলা একটা জাতিকে পুরোপুরি পেড়ে ফেলতে এতটুকু ভাববে না। করোনা তো দেবতা নয় যে পুজোর ঘুস দেবেন, ও কিন্তু শয়তান ভাইরাস, আলাদা করে বাঙালির জন্য তার কোনও সমীহ নেই। তাই যতটা পারবেন পথ ভুলে যান, ভিড়ের পথ। খাওয়া দাওয়ার জন্য পাবলিকপ্লেসে নাই বা গেলেন। কেনাকাটা এই বছর না হয় হলোই না, পুরানো শরীরের জন্য পুরোনো পোশাক অনেক সুখের । নতুন অসুখের হাতছানি থেকে দূরে থাকার উৎসবটা এবার জমিয়ে উপভোগ করুন । আপনি তো জানেন বহু মানুষ এই করোনা কালে সম্পূর্ণ বেকার হয়েছেন, যাদের দুবেলা গরম ভাত ঠিকমতো জুটছে না। ভাবুন ভাবুন, ভাবার প্রাকটিজ চালু থাক। —- অনিরুদ্ধ সুব্রত ০৯\১০\২০
খুব প্রয়োজনীয় লেখা। একটাই কথা- মানুষের চেতনা হোক।
খুব প্রয়োজনীয় লেখা।একটাই কথা – মানুষের চেতনা হোক।
এমন সুন্দর করে প্রয়োজনীয় বার্তাটি দিলেন। তবে পাবলিক কতটা বুঝবে বা ভাববে সেটাই দেখার।