পার্থ সারথি বসু র স্মরণে”সেথা তুমি অগ্রজ আমার” -সুভাষ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়

আজ তুমি চলে গেলে দুই বঙ্গের অগনিত মানুষদের শোক সাগরে নিমজ্জিত করে। আমরা বুঝতে পারিনি, এত তাড়াতাড়ি আমরা তোমায় হারাবো। আমাদেরকে একমুহূর্ত চিন্তা করার সুযোগ না দিয়ে তুমি অস্তলোকে যাত্রা করলে। আমরা দিশেহারা হয়ে পড়লাম। বাংলা ভাষার অপূরণীয় ক্ষতি হল।                                                                                                                                                 আমি যখন মানভূম(বর্তমান পুরুলিয়া ) জেলার ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত তখন তুমি আমায় পুরুলিয়া থেকে বৃহত্তর রাজপথে তুলে আনলে। বৃহত্তর বঙ্গের দায়ে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেলাম। তোমার সেই বানী “যতদুর বাংলা ভাষা বিস্তৃত – ততখানিই আমার স্বদেশ” আমায় অনুপ্রানিত করল। তোমার সঙ্গে মাত্র তিন বছরের যোগাযোগে বুঝতে পারলাম তোমার বঙ্গ ভাষা প্রীতির কথা।                                                                                                                                   সে সময়টা ছিল ২০১৭ সালের জুন মাস। কিভাবে যেন আমার নামটা জোগার করে ফেললে। বঙ্গ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাংলা ভাষার অবস্থা সরজমিনে উপলব্ধি করার জন্য তুমি পুরুলিয়া তে তোমাদের অধিবেশন করলে। উভয়ের দর্শনে আমরা উভয়ে ই মুগ্ধ হলাম। তোমার থেকে আমি বেশ কয়েক বছরের বড়ো হওয়া ও আমাদের বন্ধুত্ত্বে বাধা সৃষ্টি হল না।                                                                                                                                                                                            এরপর হয়েছে আমাদের মধ্যে সহস্র আলাপ-আলচনা ও বার্তালাপ। উদ্দেশ্য যেখানে এক সেখানে বন্ধুত্ব হতে দেরী লাগেনি। ঢাকা (বাংলাদেশ) থেকে পশ্চিমবঙ্গ ও  অসমের যে তিনজনকে ২০১৯ এর বিশ্ববাঙ্গালী শিরোপা দেওয়া হলো তাদের দুজন ছিলাম আমরা, তৃতীয় বিশিষ্ট বাঙ্গালী ছিলেন অধ্যাপক তপধীর ভট্টাচার্য মহাশয়।                                                                                        ২০২০ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী আমাদের ওই পুরষ্কার গ্রহণের দিন ছিল। কাজেই ১৮ই ফেব্রুয়ারী আমরা মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে কোলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হোলাম। ট্রেনে যাবার পরিকল্পনা তোমারই ছিল- সমস্ত বাংলাদেশ দেখতে দেখতে  যাবে এই উদ্দেশ্যে  তুমি এই যাত্রা করেছিলে। ট্রেনে আমি সস্ত্রীক ছিলাম, তুমি তো ছিলেই, আর আমাদের সহযাত্রী হয়ে যাচ্ছিলেন কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দেবাশীষ মজুমদার মহাশয়।                                                                                 বাংলাদেশে প্রবেশ করে ট্রেনটি প্রথমে দাঁড়ালো ঈশ্বরদী স্টেশনে। দেখলাম বাংলাদেশের অতি উৎসাহী জনগণ এবং বাংলাদেশের রেলওয়ে কর্মকর্তারা আমাদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য ফুলের তোড়া ও মিষ্টি নিয়ে দন্ডায়মান। সেখানে সকলের সাথে ফটো তোলা হোল, আমরা অভিভূত হোলাম। ট্রেনটি এসে ঢাকায় পৌঁছাল বিকেল পাঁচটার সময়।                                                                                                                                                      ১৯ শে ফেব্রুয়ারী ছিল আমাদের অনুষ্ঠান কর্মসূচী। এখানে “বিশ্ব বাঙালী ২০১৯” পুরস্কারে আমাদেরকে সম্মানিত করা হোল। উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মহাশয়। সিরাজুল সাহেব ছিলেন আমার পূর্ব পরিচিত। আমি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে ১৯৮৫ সালে তাঁর দায়ে পরিচিত হয়েছিলাম। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল্লা আবু শাইদ এবং শঙ্খাচার্য রাজু আহমেদ মামুন।                                                                                                                                                                          আমাদের অনুষ্ঠান পর্ব শেষ হলে পরদিন ২০ শে ফেব্রুয়ারী। তুমি প্রস্তাব দিলে ঢাকার পার্শ্ববর্তী সোনার গাঁ স্থানটি পরিদর্শনের জন্য। সেইমত আমরা যাত্রা শুরু করলাম – ঢাকা শহরের থেকে মাত্র ১৬ কিমি. দূরে সম্রাট শের শাহের রাজধানী সোনার গাঁ  পরিদর্শনের জন্য। আমরা ৬ জন রওনা দিলাম ,মাসুল শাহ আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন। স্থানটি মনোমুগ্ধকর মাছের এক বিখ্যাত মিউজিয়াম। শের শাহ নির্মিত বিখ্যাত রাস্তা সরক-এ-আজম সোনার গাঁ  থেকে শুরু হয়ে পেশোয়ার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল । ১৮৫৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসী এই সড়কটির নাম পরিবর্তন করে নতুন  নামকরণ করলেন ” গ্রান্ট-ট্রাংক রোড”।                                                                                                ২০শে ফেব্রুয়ারী মধ্যরাত্রি একটার সময় আমরা বাংলাদেশের ভাষা-দিবস অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম ,ছিলাম রাত্রি তিনটি পর্যন্ত ।এখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করেন ।এই অনুষ্ঠানটি ছিল সমগ্র রাত্রিব্যাপী যেখানে ২০ লক্ষের বেশী জনসমাগম হয়েছিল।বাংলাদেশের উৎসাহী জনগণ আমাদেরকে ছাড়লেন না ,যেখানে তুমি ভাষণ দিয়েছিলে এবং আমাকেও ভাষণ দিতে হয় । আমার স্ত্রী সন্ধ্যাদেবীও সেখানে তাঁর বক্তব্য রেখেছিলেন ।                                                                                                                                                                    এরপর বাংলাদেশের জাতীয় বইমেলায় তোমার জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করে অবাক হয়ে গেছি। তোমার জনপ্রিয়তা সকলকে মুগ্ধ করেছিল । ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আমরা মিলেমিশে এক হয়ে গেছিলাম ,মনে হয়েছিল “আমরা তোমাদেরই লোক।”                                                                                     হঠাৎ নিষ্ঠুর মৃত্যু এসে তোমায় আমাদের মধ্য থেকে ছিনিয়ে নিল। রোগশয‍্যায় হাসপাতালে শুয়েও তুমি আমায় জানিয়েছিলে ” সুভাষ দা আমি ভালো আছি “। সেই “ভালো আছি” কথাটা শেষ পর্যন্ত  তুমি রাখতে পারলে না । কেবলমাত্র আমাকে উপদেশ দিয়ে গেলে ” আপনি বাড়ির বাইরে বেরোবেন না ।” এই দুঃখ,এই যন্ত্রণা,এই শোক বহন করার ক্ষমতা আমি পাচ্ছিনা । 

    এক্ষণে মনে পড়ছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ বাণী,যেটি আমি  কৈশরে প্রায়ই আবৃত্তি করতাম-

” ধরণীতে প্রাণের খেলায় 

 সংসারের যাত্রাপথে এসেছি তোমার বহুআগে

তুমি অনুরাগে এসেছিলে আমার পশ্চাতে

বাঁশি খানি লয়ে হাতে ।

আজ তুমি গেলে আগে,ধরিত্রীর রাত্রি আর দিন

তোমা হতে গেল খসি সর্ব আবরণ করি লীন।

চিরন্তন হলে তুমি, মর্ত কবি মুহূর্তের মাঝে।

গেলে সেই বিশ্বচিত্তলোকে

যেথা সুগভীর বাজে অনন্তের বীণা,

যার শব্দহীন সঙ্গীত ধারায়

ছুটিছে রূপের বন্যা,গ্রহে -সূর্যে তারায় তারায়,সেথা তুমি অগ্রজ আমার ।”



বিশ্ব বাংলা পুরস্কার
বাংলা পক্ষের অনুষ্ঠান

4 thoughts on “পার্থ সারথি বসু র স্মরণে”সেথা তুমি অগ্রজ আমার” -সুভাষ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়

    1. লেখাটি খুবই ভালো ও মর্মস্পর্শী হয়েছে। পার্থ বাবুর অকাল প্রয়াণে আমরা সবাই শোকস্তব্ধ। ওনার পরিবারকে ও সমস্ত বন্ধুদের আমার শোকবার্তা এবং সান্তনা জানাই। ভগবানের কাছে উনার আত্মার শান্তি কামনা করি।

  1. মাননীয় সুভাষ বাবু, আপনার আন্তরিক স্মৃতি কথন খুব ভালো লাগল। পার্থ বসু অমর থাকুন।

  2. শ্রদ্ধেয় সুভাষচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের আন্তরিক লেখাটি পড়ে অনেক কিছু জানলাম।ধন্যবাদ জানাই লেখককে।

Leave a Reply to PRABIR GANGULY Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *