নিবন্ধঃ শ্রীমার আশীর্বাদ –

শ্রীমার আশীর্বাদ
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু গোস্বামী)

শ্রীমাকে দর্শন করার একবার সৌভাগ্যের কাছাকাছি থেকে আমি নিজের হাতে সে সৌভাগ্যকে আমার এক কর্মহীন দাদাকে দিয়ে আত্মতৃপ্তি পেয়েছিলাম। সেই দাদা হয়তোবা কোনোদিন এই সুযোগ পাবেন না। যেহেতু আমি অল্প বয়েসে ভদ্রস্থ গোছের চাকরি পেয়েছিলাম তাই পরে আরও সুযোগ পাব ভেবে নীরবে আমার রেলযাত্রার টিকিট দুটোই তাঁকে দিয়েছিলাম। পরে অবশ্য যে আশ্রম শ্রীমা আজও পরিচালনা করে থাকেন বলে আমার বিশ্বাস, সেই পণ্ডিচেরী বর্তমানের পুডুচেরীতে বারকয়েক যাবার ইচ্ছে শ্রীমাই জুগিয়েছেন, অফিসের এল এফ সি যাকে অনেকে বলেন এল টি সির সুযোগে দুবছরে একবার অন্তত পূডুচেরীতে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু হায়, আমার যখন ডাক এল তখন শ্রীমা চলে গেছেন আমাদের জগৎ থেকে বহুদূরে আমাদের নাগালের বাইরে। তবুও অনুভব করি শ্রীমা আমাদের সঙ্গেই আছেন। 

তবে শ্রীমা সেই ১৯৭২ সালে ভূমিকার সঙ্গে আমার বিয়ের সময় তিনি তাঁর আশীর্বাদ পাঠিয়েছিলেন‌‌। সেই থেকে আটচল্লিশ বছর পরও সেই আশীর্বাদ আমার কাছে মহামূল্যবান সম্পদ‌ হিসেবে রেখে দিয়েছি‌।

তবে শ্রীঅরবিন্দের লেখা ‘মায়ের কথা’ গ্রন্থে পেলাম – মায়ের প্রকৃত সন্তান তারাই , মায়ের সন্তানদের মধ্যে সব চেয়ে নিকটতম যারা তাঁর দিকে উম্মীলিত থেকে তাঁর আভ্যন্তর সত্তার নিকটস্থ হয়ে তাঁর ইচ্ছার সঙ্গে এক হয়ে যায়, – কিন্তু যারা বস্তুতঃ তাঁর দেহের খুব কাছাকাছি রয়েছে তারাই সে তুলনায় মায়ের নিকটতম নয়”।(পৃ ১৩৪)        শ্রীঅরবিন্দের এই লেখাটি আমার কাছে একরকম সান্ত্বনা।
শ্রীমা তখন সবেমাত্র কিছুদিন যাবৎ আশ্রমবাসী হয়েছেন, কেউ একজন নানান ফুল আর পাতা তাঁর কাছে নিয়ে আসছেন আর তিনি তাদের চিনে চিনে ফরাসি ভাষায়, কখনো ইংরেজি ভাষায় তাদের কী নাম বলছেন আর শ্রীঅরবিন্দের কাছে বাংলা ভাষায় কী নাম জেনে নিচ্ছিলেন‌। একটা পাতা তাঁর হাতে দিতেই তিনি সামান্য উঁচিয়ে ধরে বললেন, – এটি তো‌ ডিভিনিটির ঘ্রাণ দিচ্ছে, এটা তুলসী পাতা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়”।     

                        শ্রীমা শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় তুলসী পাতা প্রথমে চিনতেন‌ না। আর আমার গর্ভধারিণী মা প্রতিদিন তুলসীপাতা দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের পুজো করতেন। বাবা প্রতিদিন সংক্রান্তি, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, দ্বাদশী তিথি আর রবিবার ছাড়া তুলসীপাতা চয়ন করতেন। তাই, আমার মা তুলসীর ঘ্রাণের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু শ্রীমা অভ্যস্ত না থেকেও কীভাবে তুলসী পাতাকে আলাদা করে চিনলেন ভেবে আমি অবাক না হয়ে পারিনি। সেই থেকে শ্রীমাকে আমি প্রতিদিন দেখি আর মনে মনে বলি – তোমায় শত সহস্রবার নমস্কার,”ভূয়িষ্ঠাং তে নমঃ”। 
আমি আজও আর তিনিও যেন আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন হাসিমুখে অর্থাৎ তিনি বোঝেন আমায়। তিনি বোঝেন আমার সব অতৃপ্তি, তৃপ্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা , নীচত্‌ দয়াহীনতা, দয়া কর্‌ মানবিকতার প্রতি যথাসম্ভব নিষ্ঠা সব জানেন, কেননা তিনি অন্তর্যামী। তাই আমার একটু  ভরসা শ্রীঅরবিন্দের লেখা – ভগবানের সঙ্গে বা মায়ের সঙ্গে যে সম্পর্ক হওয়া চাই তা হবে প্রেম-ভক্তির, শ্রদ্ধার, বিশ্বাসের, নির্ভরতার, সমর্পণের সম্পর্ক; তা ছাড়া অন্যরকম যে প্রাণের তরফের সম্পর্ক যা জগতে খুব সাধারণ, তাতে সাধনাতে বিপরীত রকমের প্রতিক্রিয়া ঘটায়, – যেমন কামনা, অহংঘটিত অভিমান, দাবী, বিদ্রোহ, রাজসিক ও অন্যান্য মানব প্রকৃতির ভিতরকার যত কিছু বিকার, যার থেকে বেরিয়ে আসাই সাধনার বিশেষ লক্ষ্য”। (২৬-৪-১৯৩৩ ঐ গ্রন্থ পৃ ১৩৫) 
ঐ একই গ্রন্থে (পৃ ৫) ঋষি শ্রীঅরবিন্দ বললেন – দিব্য শক্তি একটাই আছে যা বিশ্বেও এবং ব্যাক্তিতেও ক্রিয়া করে আবার ব্যাক্তি ও বিশ্বের উপরেও থাকে। সেই সমগ্র শক্তিটাই হলেন মা, কিন্তু এখানে দেহীরূপে তিনি কাজ করছেন এখানকার বাস্তব জগতের জীবনে রূপান্তরের জন্য এমন কিছু জিনিস আনতে যা আজ পর্যন্ত এখানে দেখা যায় নি –এখানকার মাকে ঐ উদ্দেশ্যে আগত সেই ভগবতী শক্তি রূপেই জ্ঞান করবে। মানবী রূপে যদিও তিনি এই মা-ই বটেন। কিন্তু সমগ্র চেতনাতে তাঁর মধ্যে ভগবানের সব কিছুই বর্তমান।” 
ঐ একই গ্রন্থে মায়ের দেহ ধারণ উদ্দেেশে অধ্যায়ে শ্রীঅরবিন্দ লিখলেন – ভগবান মানুষের আকৃতি ও বাহ্য প্রকৃতি নিয়ে এসে মানুষকে দেখিয়ে দেন যে কেমন ক’রে জীবনের পথে চলতে হবে, কিন্তু তাই বলে তাঁর আসন্ন ভগবত্তাকে তিনি ছেড়ে আসেন না। এখানে এসে তাঁর দিব্য চেতনার ক্রমিক ‘ ও অভিব্যক্তি ঘটান। … মা তাঁর শিশুকাল থেকেই অন্তরে অন্তরে ছিলেন মানুষের চেয়ে বেশি কিছু। … (পৃ ৪)

 
শ্রীমাকে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হয়তো বারবার পুডুচেরী যাবার প্রয়োজন পড়ে না তবু আলমোড়া, যজ্ঞেশ্বর,  নৈনিতাল, কৌশানী, হরিদ্বার ঋষিকেশ, কেদার, বদরীনারায়ণ, গঙ্গোত্রী, এমনকি মথুরা, বৃন্দাবন, বারানসী, পুরী, বিশাখাপত্তনম, তিরুপতি, শ্রীরঙ্গম, ব্যাঙ্গালোর, মাইসোর ঘুরেও মনে হয়েছে আবার আসিব ফিরে। এই ভাবনায় দুবার গিয়েছি তিরুপতি-তিরুমালাই, দুবার কাশি বিশ্বনাথের মন্দিরে, অন্তত আটবার দর্শন করেছি নীলাচলে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবকে। তবুও আশ মেটেনি, আবার যাবো মথুরা বৃন্দাবন আর বারবার ফিরে ফিরে যাবো পূডুচেরীতে শ্রীমায়ের কাছে। সেখানে শ্রীমার নির্দেশে আজও স্নিগ্ধ সকালে একটা রেকাবিতে শ্রীঅরবিন্দ ও শ্রীমার সমাধিতে শীতল জলে ডোবানো থাকে থরে থরে শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় তুলসী পাতা। তুলসী পাতার সমারোহ দেখে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বিস্ময়ে মাথা নত করেন। তাই আবার বার বার পূডুচেরীতে যেতে মন চায়, সেখানে আছেন আজও শ্রীমা।
 ১৯২৮ সালে শ্রীমাকে ও শ্রীঅরবিন্দকে দর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাণী তথা শ্রীমতী নির্মলকুমারী মহলানবীশ যিনি বিশ্বের অন্যতম পরিসংখ্যান বিদ এবং ভারতের প্রথম পরিসংখ্যান বিষয়ে অগ্রণী ডঃ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের স্ত্রী। তাঁর ‘কবির সঙ্গে দাক্ষিণাত্যে’ গ্রন্থে।

 একবার দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে যাবার পথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গী হয়েছিলেন রাণী ও প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। পণ্ডিচেরীতে জাহাজ অনেক দূরে নোঙর করার জন্য জাহাজের কর্তৃপক্ষ কবির অবতরণের নিমিত্তে সিঁড়ির বদলে চমৎকার ও বেশ হাস্য উদ্রেক কারী হলেও একটি বেশ বড় পিপের ভেতরে দুটো মোড়া পেতে তাতে কবিগুরু আর রাণী মহলানবীশকে বসিয়ে পিপেটিকে ক্রেণ দিয়ে দোলায়মান অবস্থায় নীচের অপেক্ষমান ডিঙ্গি নৌকায় নামানো হয়েছিল। সেই ডিঙ্গি করে ওঁরা কবিকে নিয়ে পাড়ে উঠেছিলেন। তখন প্রায় দুবছর হল শ্রীঅরবিন্দ কারোর সঙ্গে দেখা করতেন না অথচ তিনি নিজেই কবিগুরুকে পণ্ডিচেরী যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কবিগুরু আশ্রমের দোতলায় সোজা শ্রীঅরবিন্দের কাছে চ’লে গেলেন। 
রাণী মহলানবীশ আরও জানিয়েছেন যে আশ্রমবাসী অনিলবরণ রায় কবিগুরুর বাকী সঙ্গীদের নিচে সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে একটা ঘরে বসতে দিয়েছিলেন। আর শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে কবিগুরুর কথাবার্তায় প্রায় একঘন্টা লেগেছিল। যাঁরা কবিকে এগিয়ে বিদায় দিতে নিচের দরজা পর্যন্ত এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে “আশ্রমের যিনি “মা” তাঁকেও দেখলাম আসবার সময়; তিনি কবিকে উপর থেকে সঙ্গে ক’রে নিচে নেমে এসে দরজা পর্যন্ত বিদায় দিতে এলেন। পরনে নীলরঙের বেনারসী শাড়ি সোনালী জরির বুটি দেওয়া, অতি আধুনিক প্রথায় প্রসাধন করা মুখ, চোখে কাজল – না দেখলে মনে মনে ধারণা থেকে যেত যে বাকি লোকজনের মতো তিনিও সাজসজ্জা প্রসাধনের প্রতি বিমুখ ও শুধু-হাত, থানকাপড়-পরা মানুষ”।শ্রীমাকে আমিও সেই নীলবসনা মাতৃরূপে ধ্যানে প্রত্যহ দেখে থাকি। শ্রীঅরবিন্দ প্রসঙ্গে এই গ্রন্থের পরের অনুচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাণী লিখছেন – কবি জাহাজে ফিরে এসে বললেন, “অরবিন্দকে দেখে খুব আশ্চর্য লেগেছে। একেবারে উজ্জ্বল চেহারা – চোখ দুটোর মধ্যে কী আছে, বর্ণনা করা যায় না, এমন আশ্চর্য চোখের ভাব। বুঝলুম অন্তরের মধ্যে কিছু একটা পেয়ছেন, তা না হলে চেহারার এরকম দীপ্তি হয় না। বহু দিন পরে দ্যাখা – খুশি হলুম দেখে।” (পৃ৫৪)
শ্রীমাকে যাঁরা দূর থেকে দর্শন করার জন্য আশ্রমে হাজির হতেন তাঁরা বা আমার সেই দাদা শ্রীমাকে দর্শন করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন, তাঁর সৌভাগ্যের ফলের কিছুটা হলেও আমি পেয়েছি। সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। 
আর আজও আমি সর্বক্ষণ শ্রীমার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে চলছি।

7 thoughts on “নিবন্ধঃ শ্রীমার আশীর্বাদ –

  1. পুদুচেরী আশ্রমে গেলে অনুভব করা যায়। সত্যিই আজও শ্রীমা সবসময় সেখানে উপস্থিত আর স্মরণে সব ভক্তের হৃদয়ে।

  2. এমন লেখা বারবার পড়তে ইচ্ছে করে । খুব ভালো লাগলো । অনেক কিছু জানতে পারি ।

Leave a Reply to Soma Sengupta Mukherjee Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *