ধারাবাহিকঃ জীবন কথাঃ যে টেলিফোন আসার কথা

যে টেলিফোন ৩ / পার্থ বসু
যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলেফোন আসে নি। পংক্তিটি কবি চিত্রকর চলচ্চিত্রকার প্রাবন্ধিক এমনকি সাংবাদিক পূর্ণেন্দু পত্রীর। তাঁর সাথে আমার প্রথম আলাপ কিন্তু সম্ভবত ক্লাস এইটে। বাবা বাড়িতে দেশ পত্রিকা রাখতেন। তাতেই সেই বয়সেই বুঝি না বুঝি পড়ছি জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর বারো ঘর এক উঠান। মনোজ বসুর নিশিকুটুম্ব। বনফুলের ত্রিবর্ণ। বিভূতি ভূষণ মুখোপাধ্যায়ের বালিকা বধূ। তরুণ ভাদুড়ী-র সান্ধ্যদীপের শিখা। কবিতার পাতা গুলি পড়তাম আর মাথায় গেঁথে যেতো। সব কবিতার সব লাইন বা সব কবির নামও এই বয়সে এসে ভুলে গেছি। আমি ঢোল ডগরে বাজাই— এইভাবে শুরু হয়েছিল একটি কবিতা। বাবা ডেকে বলেছিলেন — পড় কবিতাটা। বাবা এভাবে অনেক কবিতা বেছে রাখতেন। পড়াতেন। কিন্তু মাস্টারি করতেন না। বোঝার ব্যাপারটা আমার বোঝা করে তুলতেন না। আর একটি কবিতা সেই কোন কাল থেকেই অন্তত পঞ্চান্ন বছর স্মৃতিলগ্ন। কি লজ্জা, কবির নাম বেবাক মুছে গেছে মন থেকে। কবিতাটি যতোটা মনে পড়ে শোনাই, যদি সহৃদয় কোন পাঠক সুলুক জানান জনক বা জননীর।
হৃদয় জ্বলে প্রখর তাত
বাতাসে ক্রুর সাপের দাঁত
ডাইনে বাঁয় ঝড়ের শর
অন্ধকার দুঃখহর
জীবনে আশা কি দুর্মর
হৃদয় জ্বলে!

তোমার দুটি আলোর হাত
আনবে বয়ে সুপ্রভাত
দগ্ধ মাঠ অনুর্বর
ফেলবে ঝেড়ে শুকনো খড়
ফলাবে সোনা নীল প্রপাত
হৃদয় জ্বলে!
আসলে যে কবিতাটি ভালো লাগতো, মনে হতো পারলে এভাবেই লিখতাম, স্মৃতিতে স্থায়ী ঠাঁই পেতো। বাগনানে সত্তর দশকেই একটি আবৃত্তি শিক্ষার স্কুল খুলেছিলাম। আবৃত্তিমঞ্জিল। শিক্ষক যারা ছিলেন তাঁদের স্মরণশক্তি আমাকেও বিস্মিত করতো। শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম ছন্দনীড়ের উৎপল কুণ্ডু, রামচন্দ্র পাল, রবীন ভট্টাচার্য আর তুষার পর্বত-কে।এছাড়াও যোগাযোগ হয়েছে, পাশে পেয়েছি যাদের তাঁরা হলেন স্বনামধন্য নুপূর বসু, সমীরণ ঢ্যাং, সোমনাথ নাথ— আরও বহুজন।
কবিতা তখন খুঁজে পেতে পড়ছি। আর আমার সুবিধা হলো ভালো লাগা কবিতাটি বাস্তবে মুখস্থই করতে হতো না। সোমক দাসের একটি কবিতা সভায় সভায় মঞ্জিলের ছেলেমেয়েরা বাজী রেখে শুনিয়েছে— ভালো না লাগলে নাবিয়ে দেবেন। কবিতা লেখার একটি অদম্য উসকানি ছিল সোমকের কবিতায়। একটি কাঠামো। এই খাঁচার আদলে শব্দ ভরুক যে যেমন।
সোমকের কবিতাটিও দেখি স্মৃতি থেকে নামাতে পারি কিনা।
কবিতার নাম— যায় আসে, যায় আসে না।
কবি সোমক দাস

পাশের বাড়ি সন্ধ্যাবেলা পাঁচু কিংবা পাঁচুর মা মারা গেলে
আমার কিছু যায় আসে না।
কারণ পাঁচু আমার কেউ না, পাঁচুর মাও আমার কেউ না।
রেডিওয় রবীন্দ্রসংগীত হলে বা মণিলাল সেতার বাজালে
আমার কিছু যায় আসে না।
কারণ সবসময় আমার তলপেটে খুব ব্যথা করে।
আমার বোন পাগল হয়ে গেলে আমার কিছু যায় আসে না।
কারণ সেটা আমার দোষ নয়।
বাংলাবন্ধ সফল হলে আমার কিছু যায় আসে না।
কারণ আমি মন্ত্রী নই।
রাজাবাজারে রায়ট হলে আমার কিস্যূ যায় আসে না
কারণ ভারতবর্ষে কোন মাও-সে-তুং নেই।

রোজ ট্রামে বাসে ট্রেনে ঘেমে নেয়ে অফিস যেতে হলে
আমার কিছু যায় আসে।
সিনেমার টিকিটটা ব্ল্যাকে কাটতে হলে
আমার কিছু যায় আসে।
সন্ধ্যায় কোন না কোন বান্ধবীর সঙ্গে দেখা না হলে
আমার কিছু যায় আসে।
আমাকে দেখলে বন্ধুরা যদি কেবল মুখ ফিরিয়ে নেয়
আমার কিছু যায় আসে
কোলকাতার নর্দমায় যদি কোন উলঙ্গ পাগল
সারা রাত নর্দমার জল চেটে খায়
আমার কিছু যায় আসে

তবু সারা দিন সারা রাত প্রতীক্ষায় থেকে
একটিও কবিতা না আসে
দূর,আমার কিছু যায় আসে না।

কথায় বলে মেজাজটাই তো আসল। এই যে আড্ডায় আছি, বৈঠকে আপনারা আমি যেন পরীক্ষা দিচ্ছি মুখস্থ বলার। উতরোচ্ছি?
যায় আসে,যায় আসে নার ফর্মাটি পছন্দ হল? আপনারাও লিখুন না? কার কি যায় আসে। কার কি যায় আসে না। লিখছেন?
পরীক্ষা নিচ্ছি নিজেই নিজের। কবিতাগুলি উঁকি মারল বলে ছিপে গাঁথলাম। নইলে তলিয়ে যেতো। শুরু তো করেছিলাম পূর্ণেন্দু পত্রীকে নিয়ে।তাঁর কথায় আসি আবার।

কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ মাত্রা পায়, মানে জমে ওঠে দেশ-এর পাতায়। ১৯৬৮ তে। তখন কলেজে পড়ছি। বড়ে গোলাম দেহ রাখলেন। সেই সপ্তাহেই শোকসম্ভূত যে কবিতাটি পূর্ণেন্দু লিখলেন তা বিশ্বের যে কোন ভাষায় বিরল। একটি দৃষ্টান্ত বটেই। ঘরাণায় ধ্রুপদী।
শুনেছি শোকের অভিঘাতে তাৎক্ষণিক সৃষ্টি সে অর্থে কবিতা হয় না। সময় লাগে। তো পূর্নেন্দুর কবিতাটি শুনিয়ে আজ শেষ করি। বাকি শোনাবো পরের কিস্তিতে। আজ আমার ভালো লাগা কিছু কবিতা আপনাদের পড়িয়ে নিলাম। এটিও শোনাচ্ছি স্মৃতি থেকেই।
আলঝাইমার থেকে বাঁচার উপায় অবশ্য অঙ্ক,অ্যালজেব্রা। আমি কবিতায় অঙ্ক কষছি স্মৃতিবিলোপ আটকাতে। ভালো লাগলে পাশে থাকুন।
কবিতাটি।
বড়ে গোলাম / পূর্ণেন্দু পত্রী
ফুলের গন্ধে ফোটার জন্য
নারীর স্পর্শ পাওয়ার জন্য
ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে
আমরা যেদিন যুবক হলাম

বাইরে তখন বক্ষে বৃক্ষে
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে
আমাদের সেই কান্না নিয়ে
গান গাইছে বড়ে গোলাম।

ফুলের কাছে নদীর কাছে
বুকের বিপুল ব্যথার কাছে
বেদনাবহ যেসব কথা
বলতে গিয়ে ব্যর্থ হোলাম

তারাই যখন ফিরে আসে
কেউ ললিতে কেউ বিভাসে
স্পন্দনে তার বুঝতে পারি
বুকের মধ্যে বড়ে গোলাম।

চলবে

5 thoughts on “ধারাবাহিকঃ জীবন কথাঃ যে টেলিফোন আসার কথা

  1. অসাধারণ লেখনী। পড়তে ভালো লাগছে। আগামী তে আপনার কাছে আরো জীবন কথা চাই। অনেক শুভেচ্ছা। ভালো থাকুন।

  2. খুব ভালো লাগলো। স্মৃতিকথা কত সুন্দর হয়ে ক্রমশ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলো ভেবে খুব ভালো লাগছে‌। দাদা চালিয়ে যান আপনার লেখনী। অভিনন্দন।

  3. আপনার আশীর্বাদ আমার পাথেয়।প্রণাম নেবেণ

Leave a Reply to Krittika Bhaumik Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *