ছোটগল্পঃ অদ্ভুত ভূতেরা – ভূমিকা গোস্বামী

ছোটগল্পঃ অদ্ভুত ভূতেরা – ভূমিকা গোস্বামী

আজ বিকেলে একটা মেল এল। ” আজকাল কম লিখছেন কেন ? আপনার গল্পগুলো পড়তে বেশ লাগে। আরো বেশি বেশি করে লিখুন প্লিজ।

পড়ন্ত বিকেলে মেলটা পড়ে নিজের মনেই বললাম- ” আরো বেশি বেশি করে লিখুন না” আপনারা বলেই খালাস। আজকের যুগে গিন্নীরা দশভূজা। দৃশ্যত নয় কার্যত। রান্না করা, কাপড় কাচা, কাজের লোক না এলে বাসন মাজা, ঘর মোছা। তারপর আছে গৃহসজ্জা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এমনকি  ফেসবুক ইউটিউবও তাদের সাহায্য করে।
এছাড়া আছে অতিথি আপ্যায়ন — আজ বিবাহবার্ষিকী। কাল ছেলের জন্মদিন। পরশু ওঁর প্রমোশন। এমনই কত বাহানা। কোন গিন্নী কত সুন্দর নতুন আসবাব , নতুন পর্দা দিয়ে কত সুন্দর করে ঘর সাজালেন। কত নতুন নতুন ডিস পরিবেশন করলেন তাতেই তিনি কতটা সুগৃহিণী প্রমাণিত হবে।

লোকসংখ্যা নিয়ে সরকারের যতই মাথায় হাত পড়ুক — গৃহ লোকশূন্য। প্রত্যেকের প্রায় একটি করে বাচ্চা। তাই বলে ঝক্কি কিছু কম নয়। দশটা বাচ্চার এডুকেশন একটাকে দিতে গিয়ে মা বাচ্চা দুজনেই জেরবার। এর মধ্যে গোদের ওপর বিষফোঁড়া বারোমাসে বারোশ প্রতিষেধক। তাও তো গিন্নীকেই সামলাতে হয় নাকি ! গৃহকর্তার এত বায়নাক্কা সামলানোর সময় কোথায় ? তার অফিস আছে। ট্যাক্সের বিল, লাইটের বিল যেহেতু রবিবার জমা নেয় না,  তাই ওগুলোও গিন্নীকেই করতে হয়।

এত সবের মধ্যেও নিজেকে সুন্দর রাখতেও জানতে হয়। সুন্দর ত্বক। সুন্দর ফিগার। সুন্দর ব্যক্তিত্ব। এটাই আধুনিকতা। যদিও বিজ্ঞানের দয়া আর বিজ্ঞাপনের দাক্ষিণ্যে গৃহিণী থেকে সুগৃহিণী  হওয়া সহজ হয়েছে। কিন্তু  টানাটানি পড়েছে সময়ে। বর্তমান যুগেও সেই চব্বিশ ঘন্টায় একদিন হয় কিনা ! এটাই যা মুশকিল। সকলেরই সময় বাড়ন্ত। আমারও তাই।

টেবিল চেয়ার যথাস্থানে। দিস্তা দিস্তা লেখার কাগজ। কলমদানিতে একগোছা কলম। সব সুন্দর করে সাজানো। অঙ্গন বর্ষার জলে ফুলে ফুলে আলো। বসলেই লেখা হবে। সেই সময় করে বসতে হবে। তবে এখন আর ওদের ইচ্ছে মতো আমি চলি না। আমার ইচ্ছে মত ওদের চলতে বাধ্য করেছি।

তাহলে শুনুন চুপি চুপি বলি, বছর আটেক আগে আমি কিছু ভূতের খপ্পরে পড়ি। কালো ভূত। সাদা ভূত। বয়স্ক ভূত। তরুণ তরুণী ভূত। এমনই বিভিন্ন বয়সের বড়লোক ভূত। গরিব ভূত । আমার চোখের সামনে হেঁটে বেড়াত। তারা হাসতো। কাঁদতো। কথা বলতো। আমিও ভূতে পাওয়া মানুষের মতো ঘোরের মধ্যে ডুবে থাকতাম। এভাবেই যে কখন অনেকটা দিন পেরিয়ে গেছে—–

এতে লাভ যে কতটা হয়েছে জানি না। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ আকাশ ছোঁয়া। এই পুবের জানলা যা সকালে একঘর আলোর সাথে একটি মিষ্টি মুখের মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। জানলা খুললেই প্রতিবেশী বান্ধবীর জানলা দেখা যায়। কখনও কখনও আমরা দুজনেই একসাথে জানলা খুলি। হাসি বিনিময় হয়। কখনও কখনও দু – একটা কথা।

সেদিন শনিবার। ঐ প্রতিবেশী বান্ধবী সকালে আমার বাড়ি বয়ে নিমন্ত্রণ করে গেল। তাদের বাড়িতে শনিপুজো। কথা দিলাম সন্ধ্যায় যাব। এদিকে দুপুর থেকে ভূতেরা ভর করে রয়েছে। ওরা কেউ হাসছে। কেউ কাঁদছে। কেউ বলছে। কেউ শুনছে। কেউ ভাবছে। কেউ বা ভাবাচ্ছে। আমার চোখের সামনে ওদের সব কার্যকলাপ চলছে। আমি দর্শক। অবাক হয়ে দেখছি ওরা নড়ছে চড়ছে। ঝগড়া করছে। আদর করছে। আরো সব কত কান্ড। আমার হাতে কলম। টেবিলে দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ হয়ে যাচ্ছে। এই ঘোরের মধ্যেই সাংসারিক ন্যূনতম কাজ সারা হচ্ছে। শুতে যাবার সময় ঘড়িতে এলার্ম দিতে গিয়ে খেয়াল হল, কাল রোববার। সকালে ওঠার তাগিদ নেই। এর মধ্যে কখন আমি টেবিলে বসে পড়েছি। ভূতেরা কখন আমাকে দিয়ে ওদের কথা লিখিয়ে নিচ্ছে খেয়াল নেই। হঠাৎ পুবের জানলার কোনাকুনি সূর্যকে চোখে পড়ল। বুঝলাম শনিবারের রাত কাবার হয়ে রবিবারের রবি উঠেছেন। সূর্য ওঠা দেখা রোজ তো হয় না। লাল বড় টিপের মত সূর্যটা দেখতে কি যে ভাল লাগছিল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎই সূর্য যেন নড়েচড়ে বসল। দু চোখ সরিয়ে নিলাম। সামনে দেখলাম আমার প্রতিবেশী বান্ধবী জানলার সামনে। যে অন্য দিন আমাকে দেখলেই একগাল হেসে অভিনন্দন জানায়। সে রাতারাতি বেশ গম্ভীর হয়ে  গেছে। মনে পড়ে গেল। নিমন্ত্রণ রক্ষা করা হয় নি।
নিজের দোষ বুঝতে না পারার মত নির্বোধ আমি নই । আমিই যেচে বললাম– কাল পুজোয় যেতে পারি নি বলে ক্ষমা কোরো। দুপুরে মাথাটা এমন ধরল….
সঙ্গে সঙ্গে মেঘ কেটে গেল। গলায় সহানুভূতির সুর–এখন কেমন আছ ?
কারা ধরেছে বলি নি। শুনলে হয়তো ভয় পেত। ধীরে ধীরে ধনী ভূত। ভিকিরি ভূত। দুঃখী ভূত। সুখী ভূত। শোষক ভূত। শোষিত ভূত। ভুলিয়ে দিল আমার সংসারের খুঁটিনাটি নানান কাজ। সামাজিকতা , দায়দায়িত্ব, কর্তব্য।
খালি কড়াই উনুনে চাপাই পুড়ে যায় , তেল দিই না। ভাত পোড়ে। ডাল পোড়ে। পোড়া কড়াই মাজতে মাজতে  ঝি কাজ ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। ডালের জল পড়ে গ্যাস নেভে। উচ্ছে ভাজা পুড়ে কাল হয়ে যায়। ছেলেরা স্কুলে যাওয়ার সময় খাওয়া নিয়ে কান্নাকাটি করে। ছাদে মেলে রাখা কাপড় দুপুরের রোদ খেয়ে সন্ধের হিম খেয়ে বসে থাকে। ছোট ছেলে স্কুল থেকে ফিরে স্কুলে যা যা ঘটেছে জানাতে চায়। শুনতে শুনতে সবটা শোনা হয় না। ছেলের অভিমান বাড়ে।
বাড়ির যত্রতত্র জামা কাপড়ের ভিড় জমতে থাকে। আত্মীয় স্বজন বন্ধুদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। স্নেহশীল চেনা মুখ প্রশ্রয়ের সুরে হেসে বলে – পাগল। কবি বলেছেন–” পাগল যে তুই কণ্ঠ ভরে জানিয়ে দে তাই সাহস করে।”
না আমার সেই সাহসও নেই। এদিকে তরকারি কুটতে হাত কাটছে। শুধু হাতে কড়াই নামাতে গিয়ে হাত পুড়ছে। সময় মত নাওয়া খাওয়া না করে শরীর ভাঙছে।
আত্মীয়রা ছেড়েছে। সন্তানদের অভিমান বেড়েছে। স্বামীর ক্ষোভ বেড়েছে। তবু ভূতেরা আমায় মুক্তি দেয় নি।
বছর আটেক বাদে ছেলেরা কলেজে ঢোকার জন্য তৈরী। স্বামীও বাড়িতেই অফিস করতে চলেছে। আমার ভূতেরা এখন বশ।
এখন আমি দুপুরে টিভির সিরিয়াল দেখতে দেখতে সোয়েটার বুনি। দিনের মধ্যে বার তিনেক আলনার আপাদমস্তক নতুন করে ঢেলে সাজাই। ফুলদানিতে বাসি ফুলের দৃশ্য আর নেই। ঘরের প্রতিটি কোণ এখন সুখী গৃহকোণ। প্রথম সারির পত্রিকার রঙিন পাতার রান্নাবান্না এখন আমার খাবার টেবিলে। আমার ছোট্ট সাজানো বাগানে বা বারান্দার টবে একটি আগাছাও জায়গা করতে পারছে না। এখন কারো জন্মদিন মৃত্যুদিন, কোন ঠাকুরের পুজো, ঠাকুর চেনাতে এলেন যাঁরা তাদেরকেই ঠাকুর বানিয়ে পুজোতেও একটি মুখকে সকলেই দেখতে পাবেন বলা বাহুল্য সেটি আমার।
ঘরে বাইরেতে  এখন আমার জয়জয়কার। ছেলেরা বলে–মা তুমি আজকাল দারুণ সব রান্না কর। প্রতিবেশীরা আমার ঘর সাজানোর প্রশংসা না করে পারেন না। আত্মীয় স্বজন বন্ধুরা খুশি। বলে –ওর মত সামাজিক আর দেখাই যায় না। কর্তা বলেন – তুমি আগের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর।

হে প্রিয় পাঠক, কানে কানে একটা কথা বলে রাখি– এখনও ভূতেরা আসে। তবে আমি ওদের বশে নেই। বরং পাকা ওঝার মত আমি ওদের বশ করে রেখেছি। ওদের ইচ্ছেতে আমি আর চলি না । আমার ইচ্ছেতে ওরা চলবে কথা দিয়েছে। 

5 thoughts on “ছোটগল্পঃ অদ্ভুত ভূতেরা – ভূমিকা গোস্বামী

  1. অসাধার! অসাধার! এই লেখা খুবই প্রশংসনী।

  2. অসাধারণ অসাধারণ!
    এই লেখা খুবই প্রশংসনীয়

Leave a Reply to Ishita Ganguly Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *