গল্পঃ বাঁশি – শ্রীময়ী গুহ

বাঁশি  – শ্রীময়ী গুহ


         বনেদীয়ানা বনেদীয়ানা! রাজরক্ত! আভিজাত্য! শুনতে শুনতে কেমন একটা ঘোর লেগে গেছে তন্দ্রার এই ক’বছরে! কেউ না কেউ কখনও না কখনও এই কথাগুলোই বলে বলে যায় বারবার ওকে! আজ আবার পড়েছে সব আত্রেয়ীকে নিয়ে,-তুই না এবাড়ির মেয়ে! এই পরিবারের রক্ত তোর শিরায় উপশিরায়, অথচ তুইই কিনা এভাবে কেলেঙ্কারিটা করলি! আমাদের বংশের কেউ কখনও এসব করতে পেরেছে? ছিঃ ছিঃ!  এতটা অধৈর্য তুই বংশের কথা বাপ ঠাকুর্দার শিক্ষার কথা এত যে আমাদের রাজবাড়ির নাম সেসব কথা একবারও মনে এল না রে! এমনকি তিন বছরের ছোট বোনটাও কেমন সুন্দর সংসার করছে দ্যাখ গে যা!… আর তুই এভাবে একরত্তি মেয়ে নিয়ে ফিরে এলি, তাও আবার কী না গোঁসা! আসবিই যখন তো জেদ করে অমন পরিবারে বিয়ে করেছিলি কেন ওরা তো কোনোকিছুতেই আমাদের ধারে কাছেও আসে না আর জাত টাত ও তো নীচুই আমাদের থেকে। কতবার কতবার তখন আমরা সবাই তোর ভালোর জন্য নিষেধ করেছিলাম ওরে এ ছেলে তোর যোগ্য নয় আর হোক না পড়াশোনায় ভালো কিন্তু নীচু জাত তো বটে তা তুই মানলি না দেখলি তো এখন এভাবে ফিরতে হল মুখ নীচু করে! ছিঃ ছিঃ!
                       আত্রেয়ী তো এই বনেদী পুরোনো রাজপরিবারেরই মেয়ে! অবাক লাগছে তার আজ এই বিশাল চক মেলানো দালানের মাঝখানে মেয়ের হাত ধরে এসে দাঁড়িয়ে! এরা কারা! এরা কী তারই আপনজন! এভাবে ছোট কেন করছে তাকে! জানে না এরা, কেন ফিরে এসেছে আত্রেয়ী এখানে আবার! তাও তো সে চাকরি করে! এমন তো নয় যে সে হাত পেতে দু মুঠো দুবেলা নিজের আর মেয়ের পেটের ভাতটুকু চাইতে এসেছে! সবই তো জানে এরা আত্রেয়ীর অবস্থা; তাও কেন এত বাগবিতণ্ডা তাকে নিয়ে! বিয়ের পর থেকে আজও কোনোদিন কোনও দরকারে তো এভাবে আসেনি আত্রেয়ী! কিন্তু এখন তো অবস্থা অন্যরকম!  এখন অন্ততঃ কিছুদিন এখানে থেকে মেয়েটাকে একটু ভালো রাখার চেষ্টা তাকে করতেই হবে। যাকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল, যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখেছিল আত্রেয়ী, সে যে এভাবে ঠকাবে তা তো বোঝেনি সে! কেন এত প্রতারণা!পুরুষ বলে কী তোমার সবটাই ছাড়! সবই ভালো!সে তুমি স্ত্রীর বান্ধবীকে নিয়ে হোটেলে রাত কাটালেও সাত খুন মাফ! আর এটাই যদি আত্রেয়ী করত! এটাই তো বলেছে আত্রেয়ী…..তার পরিবর্তে!একসময়ের  ভালোবাসার মানুষ কোমরের বেল্ট খুলে মারল তাকে! বাহ্ পুরুষ বাহ্! এই না হলে তোমার পুরুষত্ব!আর দেরি করেনি আত্রেয়ী। বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরে এসেছে তার বাপেরবাড়িতে। ভরসা ছিল যে, যতদিন কোর্ট কাছারি চলবে, যতদিন এই টানাপোড়েন চলবে, ততদিন অন্তত তার ছোট্ট মেয়েটাকে এখানে মা কাকিমা বৌমনি দাদা বাবা কাকাই এদের ভরসায় রেখে অফিস এবং মামলার ঝামেলা দুটোই সামলাতে পারবে আত্রেয়ী! এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও ফ্ল্যাটের ব্যবস্থাও করতে পারবে সে। কলকাতার কাছাকাছিই দেখবে,…… কারণ মেয়ের আগামী দিনে স্কুল কলেজের সুবিধাও হবে আর আত্রেয়ীরও অফিস যাতায়াতটা সহজ হবে। মাত্র তো কটাদিন! এটুকু সময় মা কাকিমা বৌমনিরা নিশ্চয়ই খুশি হয়েই রাখবে তার মেয়েটাকে সারাদিন! আর তো কিছু নয় শুধু বাচ্চাটাকে একটু চোখে চোখে রাখা! আর্থিকভাবে আত্রেয়ী তো স্বাবলম্বী,….. তাহলে আজ এত প্রশ্ন,… এত ছিছিক্কার কেন উঠছে,…. এটাই তো বুঝতে পারছে না ও। বর লম্পট জেনেও তার সাথেই থাকতে হবে কেন! কেন বিবাহ বিচ্ছেদ করা যাবে না!আশ্চর্য লাগছে, যাদের কাছে এত বড় হয়েছে তারাই আজ বলছে…… পুরুষমানুষের ওটুকু ভুল কিছু নয় মা! মেনে নে!এতে তোরই ভালো রে,! এরা আপনজন! অদ্ভূত! 
              রাজপরিবারের বংশধর এরা ঠিকই,… এখন পড়ন্ত অবস্থা তাও ঠিক,….. কিন্তু ঠাটবাট বা কথায় কথায় তত্ত্ব তালাশ পাঠানো কুটুম বাড়িতে বা বনেদীয়ানার তাল ঠুকে কমাথা ট্রে পাঠালো গো তোমার বেয়াই! কই দেখাও তো!……. বলে,….. বেশ গুছিয়ে বসে বৌমনির বাপের বাড়ির নিন্দে করার সুযোগটা না ছাড়া,….. বা….. আমাদের কী ওসব শাড়ি পরা মানায় রে! আমরা হলাম বনেদী রাজবংশ!…… বলে,….. ইসসসসস এত্তো দামী শাড়ি! গা কচকচ করে গো!করেও শাড়িটা গায়ে জড়ানোর অভ্যাস এখনও চলছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে।এ বাড়িতে এখনও পুরুষমানুষরা ব্যাঁকা হলেও সোনার আংটি তাই ওদের দোষ হয় না। আর মেয়েরা!…….. ওরা  ঐ ঝড়ে পড়া খড়কুটোর মতোই আগান বাগানের জংলা গাছ,…. যেন থাকলে থাক একপাশে,… নাহলে উপড়ে ফেলো।
           আশ্চর্য লাগছে আজ! বাড়িটা যেন আত্রেয়ীর নয়! যেন ও অন্য গ্রহের জীব।মানুষ নয় ও! ও যেন ডাকিনী বা ঐরকম কিছু। মেয়ে তো সিঁটিয়ে রয়েছে ভয়ে আত্রেয়ীর পিছনে!কেন মা কে এত বকছে ওরা! ওরা…. ঐ… যাদের দিদুন বলে চিনিয়েছে মা!ভ্যাঁ করে কাঁদতে যাচ্ছিল সবে পুচকে শ্যামলা চেহারার বড় বড় উজ্জ্বল চোখের একমাথা কোঁকরানো চুলের মিষ্টি মেয়েটা,…. হঠাৎ যেন চিলের মতো ছোঁ মেরে কেউ তাকে করলে তুলে নিয়ে তার নরম ফোলা ফোলা গালে টুপুস করে দুটো চুমু খেয়ে দিল! দেখার আগেই আদরে মাখামাখি আত্রেয়ীর মেয়ে!আমি তোমার মামি হই সোনা! কেঁদো না তুমি! ওরা তো বড়,…. তাই মা কে একটু বকছে,…. তুমি আমার সাথে চলো তো,.. আমরা খেলব কেমন!হাঁ করে তাকিয়ে আছে ঐটুকু মেয়ে তন্দ্রার দিকে! আত্রেয়ীর চোখে বৌমনির প্রতি একরাশ ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা!নীরবে যেন বলল – থ্যাংক ইউ বৌমনি!আর বৌমনিও ঘাড় ঘুরিয়ে একটু হেসে বলল ননদিনীকে-নিয়ে গেলাম রে মেয়েকে! তোর এদিকের কাজ শেষ হলে ওপরে আয়  কেমন!চোখ টিপে ফিসফিস করে বলল -তাড়াতাড়ি আয় তো এসব  মিটিয়ে ! সব শুনব বসে!
         কাকিশাশুড়ির গলা পেল, এই রাজবাড়ির একমাত্র বংশধর আয়ুষ্মানের  বৌ,…. এখনও নিঃসন্তান সাধারণ ঘরের মেয়ে তন্দ্রা…… অন্যের বাচ্চা নিয়ে আদিখ্যেতা ছাড়ো তো বৌমা! নিজের কথা ভাবো! অনেকদিন তো হল তোমাদের!এবার বরং বংশধর আনো বুঝলে!নাহলে লোকে তোমাকেই অপয়া বলবে,…. বাঁজা বলবে! আমার আর কী! তন্দ্রার ইচ্ছে হল বলে-কাকিমা আপনার তো একটিই মেয়ে, কিন্তু ছেলে তো নেই!  আপনাকেও কী শুনতে হয়েছে অপয়া কথাটা!কিন্তু বলেনা! আত্রেয়ীর মেয়েকে কোলে জাপটে নিয়ে চলে যায়!
                তোমাকে কতবার বলেছি ঐ মেয়েকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা আমার পছন্দ হয় না!কোন্ মেয়ে? কার কথা বলছ? কেন? বুঝতে এত কষ্ট হচ্ছে নাকি? আমি ঐ নীচু জাতের মেয়েটার কথা বলছি! ও পাখি! ও তো আত্রেয়ীর মেয়ে! নীচু উঁচু আবার কী! তোমার নিজের বোনের মেয়ে তো গো! ভাগ্নি তোমার! থাক হয়েছে! ভাগ্নি!………. মুখ ভেঙচিয়ে বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করে দাঁত খিঁচোয় আয়ুষ্মান স্ত্রী কে। খবরদার! ওকে নিয়ে এত হৈচৈ করবে না! বোনের মেয়ে তো কী? ওর বাপ তো  নীচু জাতের। আমাদের শরীরে রাজরক্ত বইছে আজও, ভুলোনা তন্দ্রা! 
              ঐ শুরু হল আবার রাজরক্ত, বনেদীয়ানা,তন্দ্রার মাথা ভার হয়ে যায়! উফফফ!এ ছাড়া কী এদের আর কোনও কথা নেই!আয়নায় নিজেকে একবার দেখে, কপালের টিপটা ঠিক করে নিতে নিতে আড়চোখে দেখল স্বামীকে তন্দ্রা!সুপুরুষ ভীষণ আয়ুষ্মান ।শিক্ষিত বিদেশের চাকরি ছেড়ে এখন এখানেই পারিবারিক বিশাল ব্যবসা সামলায়।সম্বন্ধ করেই বিয়ে। এরা চেয়েছিল মোটামুটি শিক্ষিত কিন্তু প্রকৃত সুন্দরী পাত্রী! তা দেখতে গেলে তন্দ্রা বি এ পাশ এবং সত্যিই সুন্দরী। তাই বিয়েটা হয়েই গেল রাজপরিবারের বংশধরের সাথে। কিন্তু এরপর!দু বছর পেরিয়ে গেল তন্দ্রার এখনও কোল জুড়ে এখনও সন্তান আসেনি। তাই শাশুড়ি শ্বশুরমশাইয়ের বিরক্তি মাখা গম্ভীর মুখ, কাকিশাশুড়ির কথার খোঁটা আর বাড়ির কাজের লোকেদের….আহারে বৌদিমনি বুঝি বাঁজা,একথাটা আলতো ভেসে আসা, এসব কেমন গা সওয়া হয়ে আসছিল। ছাতে গা এলিয়ে বসে থাকতে থাকতে বিকেলের মরা রোদটা দেখে যখন কান্না আসত, তখনই তো এল আত্রেয়ীর মেয়েটা! মা হব না কোনোদিন, এই শ্যাওলাপড়া  মনটা হঠাৎই মা মা বলে কেঁদে উঠল!আজ আয়না দিয়ে স্বামীকে দেখে মুখ কুঁচকিয়ে ঘৃণা আসতে গিয়ে কেমন বুক ঠেলে বমি আসতে লাগল তন্দ্রার! ছুটে গেল বাথরুমে সে।
             কে সে? বলো! বলো তার নাম! ছিঃ! এত নীচ তুমি? তুমি দুশ্চরিত্র মেয়েছেলে! খবরদার গালাগালি করবে না!! কীইইই! এত বড় স্পর্ধা তোমার! তন্দ্রা,… এখনও বলো নামটা তার! নাহলে!…… কী করবে নাহলে? বলব না। এ আমার সন্তান। যে আসছে সে আমার, আমাদের….. গরগর করে উঠল তন্দ্রার স্বামী, পড়ন্ত রাজবাড়ির বনেদীয়ানা ঠাটবাট সযত্নে বয়ে নিয়ে চলা হীরের টুকরো পুরুষমানুষটি……. তার হাতের মুঠোয় আক্রোশে খিমচে ধরা স্ত্রীর খোলা চুলের রাশি……… আমাদের মানে? কী বলতে চাইছ কী তন্দ্রা?এক ঝটকায় তন্দ্রা নিজেকে মুক্ত করতে চায় ঘেন্নার ঐ পিশাচটার হাত থেকে……… নাগিনীর মতো ফণা তুলে যেন বলে ওঠে…… কেন?? বুঝতে পারছ না???? এই যে দুবছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে,…. সন্তান আসাটা কী অস্বাভাবিক?তাহলে তুমি কেন অন্য কারুর নাম আনছ? তুমি ই যে এই সন্তানের বাবা এটা কেন মানছ না? তন্দ্রা চুপ করো চুপ করো! তুমি জানো কেন আমি মানছি না! তুমি জানো….. তাও……….
               বলেই এক গর্ভবতী নারীকে  শুইয়ে দিয়ে জোর করে তার মুখ হাত চেপে ধরে তার ওপর যেন ডাকাতের মতো সওয়ার হল সুপুরুষ  তথাকথিত শিক্ষিত মার্জিত এক নিষ্ফল পুরুষ।  হাঁফাতে লাগল রমনীটি প্রতিরাতের মতোই, উত্তেজনায় আবেগে রিরংসায়…… কিন্তু মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ ছাড়া কোনও শব্দ বের করল না! একবারের জন্য বলল না,….. ছেড়ে দাও আমায়! আর সহ্য করতে পারছি না!কীইইই অসম্ভব তেজ ঐ অত্যাচারে দগ্ধ হওয়া সিংহীর! বেশ কিছুক্ষণ পরে বিবাহিতা স্ত্রী কে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে হতাশ হয়ে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ল পাশে কাটা গাছের মতো ভেঙে পড়া এক স্বামী! পারলাম না তন্দ্রা! আজও পারলাম না আমি!ডুকরে কেঁদে উঠল হীরের টুকরো পুরুষমানুষটি……. কিন্তু তন্দ্রা! এ কার? কে এর বাবা?  বলো তন্দ্রা,… কার রক্ত এর শরীরে? কোনও নীচু জাতের কেউ কী? বলো তন্দ্রা বলো!!!
            কী হবে জেনে আয়ুষ্মান! তোমাদের বংশধর চাই! তাই তো! তোমার পুরুষত্বহীন অত্যাচার, এতদিনের অপমান, প্রতিরাতের ধর্ষণ,… সব…. সব তো মুখ বুজে মেনে নিয়েছি আমি,…. তাহলে আজ কেন জানতে চাও, কে এর বাবা! এ আমার একার!!!তোমার যদি আপত্তি থাকে, আমাকে স্ত্রী হিসেবে আর মেনে নিতে, তাহলে…….. এ আমার একার সন্তান। যদিও আমি নিজেকে তোমার স্ত্রী ভাবিই না, তাও আমি আছি এখানে, তুমি বহুবার তোমার পুরুষত্বহীনতার জন্য কেঁদেছ তাই……….. কিন্তু তুমি এই সন্তানকে অস্বীকার করলে বা কোনও প্রশ্ন তুললে আমিও সেই পথই বেছে নেব যা আত্রেয়ী নিয়েছে।ঠিক যেমন আত্রেয়ী একা আছে তার মেয়েকে নিয়ে…. আমিও…… -না তন্দ্রা না! আমাদের বংশের যে অনেক সুনাম! আমাদের শরীরে রাজরক্ত বইছে যে আজও! তুমি চলে গেলে লোকে বদনাম করবে! আমাদের বনেদী পরিবার,….. এসব কখনও হয়নি তুমি জানো!এবাড়ির বৌদের অন্য রকম সম্মান আছে একটা। তুমি না থাকলে আমাদের ব্যবসার দিকেও তো নানারকম কথা ছড়িয়ে পড়বে!না তন্দ্রা! আমি এটা মেনে নিতে পারব না! তন্দ্রার মুখে চিলতে বাঁকা জয়ের হাসি! ব্যঙ্গ প্রতিহিংসার স্পৃহা ঘৃণা যেন সাপের মতোই খেলে বেড়াচ্ছে ওখানে! থাকো তোমাদের ঠুটো বনেদীয়ানা নিয়ে! থাকো তোমাদের রাজরক্ত নিয়ে! মনে ছিলনা এই মেয়েও ফণা তুলতে পারে অন্য ভাবে!যখন আমার বাবাকে ছাপোষা মানুষ আর কটা তত্ত্ব পাঠাবেন! মুরোদ জানা আছে বৌমা তোমার বাপেরবাড়ির…. বলে খোঁটা দিয়ে এসেছ প্রায়ই! এই মেয়ে কিন্তু একলা কেঁদেছে এই রাজবাড়ির বন্দি পুতুল হয়ে!কাউকে বলতে পারেনি, রাতের পর রাত কেন একা ছাতে গিয়ে পুরোনো খিলানে মাথা ঠুকত তন্দ্রা! কেন একা গা এলিয়ে বসে থাকত আকাশের তারাদের দিকে চেয়ে পাথরের মতো! তার বাপের বাড়ির অত ক্ষমতা নেই যে এদের সাথে লড়ে মেয়েকে নিয়ে যায়! তার এত সাধ্য নেই যে বেরিয়ে গিয়ে হুট করে একটা চাকরি জোগাড় করে! কী করত সে কান্না গেলা ছাড়া!আত্মীয় স্বজন সবাই তো জানে কত্তো বড় বাড়ির বৌ সে!রাজবাড়ির আদপ কায়দা এখানে! কত ঠাটবাট! হোক মফস্বল তাও তো রীতিমত বনেদী পরিবার! এরা কখনও খারাপ হতে পারে! ছিঃ তন্দ্রা!এমন শ্বশুরবাড়ি, এমন রাজপুত্রের মতো শিক্ষিত মার্জিত বর….এমন বাজে কথা বলতে আছে! ছিঃ! 
             ঝটকা ভাঙল তন্দ্রার আয়ুষ্মানের  বিদ্রুপ ভরা কথায়….আমি তোমার স্বামী তন্দ্রা। যেমনই হই! আমি তোমাকে কীভাবে ব্যবহার করব সেটা কী তোমার কাছ থেকে আমাকে শিখতে হবে! স্বামী ছুঁলে ধর্ষণ হয় নাকি! 
তন্দ্রার চোখ জ্বলে ওঠে,…….. যেন দাউ দাউ আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়িয়ে ভষ্ম করে দেবে আয়ুষ্মানকে সে…..নিষ্ফল ব্যর্থ পুরুষ তুমি আয়ুষ্মান! ধর্ষণ কী শুধুই শরীরের হয়! মনেরও যে ধর্ষণ হয়,…… সেটা কবে বুঝবে তোমরা!!!!!!! 
          বৌমনি! তোমার ঘাড়ে, হাতে,.. এত লাল দাগ কেন? এত ছড়ল কীভাবে? ও কিছু না রে! দাদাভাই কী তোমাকে…….!……. আরে না রে! ধুর পাগলি! তোর দাদার মতো শিক্ষিত মার্জিত ভদ্র হীরের টুকরো পুরুষ হয় নাকি! ও কিছু না!
           বৌমা সাবধান থেকো এইসময়টা বুঝলে! বংশধর আসতে চলেছে আমাদের! খুউব খুশি হয়েছি মা! কিন্তু শুনলাম আমাদের আয়ুষ্মানের নাকি,… কী একটা অসুবিধা,….. না! না!….. মানে… মানদা বংশী ওরা বলাবলি করছিল  কিনা,…. তাই আরকি!বোঝোই তো ঝি চাকরদের কথা সব!যাক গে তুমি কিন্তু খুব সাবধান থাকবে কেমন! কানের কাছে মুখ এনে বললেন কাকিশাশুড়ি…….. আমাদের দু পুরুষ আগেকার সময়ে তো শুনতাম এই রাজবাড়ির পুরুষদের ক্ষমতা না থাকলে গুরুদেব এলে তাঁর সেবাযত্নের জন্য স্ত্রী দের পাঠানো হত! বংশরক্ষাও হত আবার পুরুষরা দুর্নাম থেকেও বাঁচতেন। কিন্তু এখন তো আর গুরুদেব আসেন নি ,……. অথচ তুমি মা হতে চলেছ! কদিন আগে মনে হল তোমার ঘর থেকে দুপুরে বংশীর ছেলেটাকে বেরোতে দেখলাম বৌমা!বংশীরা সাঁওতাল জানো তো!……… গুরুদেব এলে বরং ভালোই হত এবার দিদি বলছিল তোমার দীক্ষাটাও  দিয়ে দিতেন আর তুমি গুরুদেব এর সেবা করার সুযোগটাও পেতে!যাক গে যার যেমন কপাল! তোমার কপালে গুরুর আশীর্বাদ নেই দেখছি!তা তুমি কী কোনও কাজে ওকে ডেকেছিলে বৌমা!…. ঐ বংশীর ছেলেটাকে? 
           হ্যাঁ কাকিমা! ছেলেটি বড় সুন্দর বাঁশি বাজায়! ওর নাম বুধন! আর জানেনই তো আমি গান গাইত ভালোবাসি, বাঁশি শুনতে ভালোবাসি! তাই ওকে আসতে বলি। ও আমার গানের সাথে সুর লাগিয়ে বাঁশি বাজায় বলে! ওর বাঁশির সুরে বড্ড মায়া যে  কাকিমা!!
                কাকিশাশুড়ি অদ্ভূতভাবে আর কিছু না বলে হেঁটে চলে যান……. নিজের মনেই বলতে বলতে যান……….আশ্চর্য! বংশীকেও তো ডাক দিয়েছিল কেউ, বাঁশির সুর শুনে…… বংশী সাড়া দেয় নি তাকে,. . কিন্তু ওর ছেলে সাড়া দিল তোর ডাকে! শোনাল তোকে বাঁশি!! আশ্চর্য!!…….. যার যেমন কপাল!….. 
               ঘরে ঢোকে একসময়ের ঝলমল করা, আজ পড়ন্ত, কিন্তু বনেদীয়ানার ঠাটবাট রক্ষা করে চলা, রাজরক্তের অহংকার টেনে চলা রাজবাড়ির,.. একমাত্র গর্ভবতী পুত্রবধূ!হাসি গেলে যায় তার ঠোঁটের কোণে! চোখ ভরে আসে  জল!নীচে বসে একমনে বাঁশি বাজাচ্ছে কালো কুচকুচে পেটানো  চেহারার যুবক  বুধন! অদ্ভূত মাদকতা ওর বাঁশির সুরে! ওপরের জানলায় তাকাল একবার  কাজল কালো বড় বড় চোখ তুলে, আবার ফুঁ দিল বাঁশিতে!তন্দ্রার ফণা তোলা ঢেউ খেলেনো চুলের রাশিতে যেন এসে লাগল সেই বাতাস! তন্দ্রার হাত তার পেটের কাছে! বড্ড মায়া! তন্দ্রার বুক জুড়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে বুধনের বাঁশির ধুকপুক তান! 
           ইতিহাসের পাতায় পাতায় কত শত রাজবাড়ির ইট চুন সুরকির ঝরে পড়া ফাঁকফোঁকরে,… কান পাতলে শোনা যায় আজও….. বনেদী শিক্ষার ব্যার্থ যন্ত্রণা!শোনা যায় ফসিল হতে থাকা বংশধর আনার অত্যাচারের কাহিনী!শোনা যায় শারিরীক এবং মানসিক ধর্ষণের কান্নার শব্দ!কেউ কী খোঁজ রাখে,….. কত সহস্র  হীরের টুকরোরা কিন্তু আজও কয়লার খনির অন্ধকারেই থাকে!!!!

3 thoughts on “গল্পঃ বাঁশি – শ্রীময়ী গুহ

  1. খুব ভালো লাগলো। কত কিছু ঘটে যায় রাজবাড়ির অন্দরমহলে!

  2. মুগ্ধতা একরাশ । দারুণ লাগলো গল্পটা ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *