ছোট গল্পঃ মগ্ন অন্তর- ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

মগ্ন অন্তর
ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

আজ সকালটাকে একটু অন্য রকম মনে হল। রাতে কখন যে এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুম এসে যায় বুঝতে পারেনা মাল্যশ্রী। গত আড়াই বছর যাবৎ একাই থাকে সে এই বড় ঘরটায়। প্রসূন চলে গেছে কর্কটের হূলে। কবে যে শরীরে সে বাসা বেঁধেছিল কে জানে। কথা বলার লোক নেই। বই আর লেখালেখি নিয়ে অবসর কাটে। কাজ থেকে ফিরে মাঝেমাঝে সব পানসে, একঘেয়ে লাগত। আর ছিল উদ্বেগ। কেবল ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দূরে সরে যাওয়া, তীব্র পরাজয়ের বোধ, প্রসূনের জন্য শোক আর অনাগতের প্রতি ভয়, এই নিয়ে দিনগুলো ছিল ধুঁকতে থাকা মৃতপ্রায় পথকুকুরের মতো অসহায়, একাকী। বার বার ডাক্তার, ওষুধ, চলা ফেরায় বাধা… কবিতার জগতে নানা আঘাত। আর নিজেকে বোঝাতে না পারার ক্ষোভ তাকে এক বিষন্ন, অবসন্ন ভারাক্রান্ত মানুষী করে তুলছিল।
      একদিন মনে হল চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে  শুধু ভাবে। না লিখতে পারার বেদনা তাতে যদি লাঘব হয়।যদি এই কর্তব্য আর দায়িত্বের  নাগপাশ একটু আলগা হয়। যদি একটু শান্ত হয় ভেতরের অস্থিরতা। ফিরে এল মেডিটেশনের দিন। এখন অনেক সুস্থির মনে হয় নিজেকে। এই তো আজকের এই সকালটাই তো কত সম্ভাবনাময়। বিছানা থেকে মাটিতে পা দিতে অতটা কষ্ট হয়না আর। হট কেটলিতে জল বসিয়ে সব কটা জানালার পর্দা সরাতেই রূপবান এই দিনটা যেন হাসল। এক গ্লাস হাল্কা গরম জল পান করার অভ্যাস তার, তারপর ব্যায়াম। একঘন্টার ওপর পায়ের জন্য, ঘাড়ের জন্য, কোমরের জন্য নানা কসরত। আর এই সময়টা সে বাইরের সবুজ পৃথিবীটাকে চোখ ভরে দেখে। দেখে কাক, শালিখের প্রভাতী তৎপরতা। কোন কোন দিন টিয়ার ছোট্ট ঝাঁক অথবা মাছরাঙার আকাশ চিরে চলে যাওয়ার উপরি পাওনা। আরো কত যে পাখি, কতরকম শব্দ, মানুষের গেরস্থালির আওয়াজ। আর সকালের একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠা। গ্রীষ্মের সকাল তার  সারাদিনের রসদ জুগিয়ে দেয়। প্রাণায়াম করতে করতে সে টেনে নেয় সবুজের অকৃপণ  অক্সিজেন। শরীরে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণ। বেঁচে থেকে অনেক কিছু করার তাগিদ অনুভব করে সে। মনে হয় অনেক কবিতা লেখে, উপন্যাস লিখলেইবা ক্ষতি কী? ছবি আঁকলেও হয়।
   আদা দিয়ে দু কাপ গ্রীন টি, সংগে চিনি ছাড়া বিস্কুট আর খবরের কাগজ। আজকাল আর সংসারের তাড়া নেই। একতলায় মা আর ছেলে যে যার ঘরে ঘুমে অচেতন। পারুলদি সকালের হেঁসেলটা সামলে দেয়।  মায়ের সেবার কোনো ফাঁক রাখতে দেয়না কাউকে। বেরোবার আগে এসব ব্যবস্থা করে দিয়ে যায়। মায়ের জন্য বানানো সামান্য জলখাবার খেয়েই কর্মস্থলে যায় আজকাল।  ছেলেও দুমুঠো ভাত খায় তারপর বেরিয়ে যায় অফিসে। এই সকালগুলো আজকাল মালার একার কিন্তু একাকীত্বের নয়। এইরকম সব সমৃদ্ধ সময় তাকে শক্তি যোগায়। কোথায় কোন বৃদ্ধা কবি তার নাম কাটছে কাব্যসভা থেকে অথবা তার কবিতার নামে নিজের কবিতা লিখছে বা মিথ্যে রটনা করে যাচ্ছে তাতে তার কিচ্ছু ক্ষতি করা যাচ্ছেনা। কোন কাব্যসভায় সে এমাসের কবি হতে পারছেনা। কোন মফস্বল শহরের অহংকারী কবি তার কবিতাকে অন্য কবির নকল বলে আমোদ পাচ্ছে তাতে তার কিচ্ছু এসে যাচ্ছেনা। তার জার্নিটা নিজের অন্তরের দিকে। এভাবে কামড়াকামড়ি করে সাহিত্য সৃষ্টি হয়না মঞ্চ হয়,ছোট ছোট বৃত্ত হয় কিন্তু অনন্তের পথ বন্ধ হয়।  ধ্যান আর ভাবার অভ্যাস তাকে এই সব গলি থেকে উদ্ধার করে দাঁড় করিয়েছে  এক বিশাল লীলাভূমিতে। সেখানে রং রূপ রসের অফুরন্ত ভাঁড়াড়। মাল্যশ্রী বুঝেছে কবিতার কোন আলাদা ছোট সীমানা নেই তার। সমস্ত জগৎটাই কাব্যময়। সেখানে প্রেম আছে মায়া আছে।
আছে প্রতিবাদের মুঠো উঁচু করে ধরার সাহস। আর আছেন নিজস্ব শোক দু:খ অপমানের উপশম।
এখন মালা ছাদে উঠে যাবে। তার ক্যাকটাসের ছোট্ট বাগানে জেগেছে ফুলের সম্ভাবনা। তাদের যত্ন দরকার,দরকার স্নেহ স্পর্শের।আর চঞ্চল পাখিদের দরকার বিশুদ্ধ জল। এতদিন যে সে তার প্রিয় গাছগুলোকে অবহেলা করেছে  তার জন্য সে ওদের কাছে বার বার ক্ষমা চায়। ওদের সাথে দুটো কথা বলে। পাখিদের জন্য জল রাখে।
মাল্যশ্রীর শ্রীহীন দিনগুলো আবার ভরে উঠছে। তার মনে থাকছে  কিন্তু বিদ্বেষ জন্মাচ্ছেনা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর হতবাক করে দেয়া নিষ্ঠুর অপমানে প্রতি। এখন আর  বিস্মিত  হচ্ছে না ভেবে যে কেন তার সাথেই এমন হয়। মনুষ্য চরিত্র এরকম বা ওরকম  এর বেশি কিছু নয়। কাজের জায়গাতেও সেই ভীতু ও ধূর্ত লোকের সংখ্যা বেশি। এটা সে বুঝে গেছে ঈর্ষা আর প্রতিশোধ স্পৃহা মানুষকে পোকার মতো তুচ্ছ করে তোলে। তাই মালা আবার ছেলেবেলার মতো সহজ মন নিয়ে দুনিয়াদারিতে থাকে কিন্তু মগ্ন থাকে এক গভীর অনুসন্ধানে যা তার কবিতাকে আরও ঋদ্ধি দেবে বলে বিশ্বাস করে। 

3 thoughts on “ছোট গল্পঃ মগ্ন অন্তর- ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

  1. উত্তরণের গল্প। ভাল লাগল।
    সমস্ত জীব জন্তু পোকামাকড়ের নিজস্ব স্বভাব আছে। চেনা যায় তাদের। কিন্তু মানুষ কে চেনা কঠিন। মানুষের চেহারার আড়ালে বিভিন্ন জন্তু লুকিয়ে থাকে। সেই মানুষগুলি সমাজে থেকে সমাজের অকল্যাণ করে। অপরকে খামচায়। কামড়ায়। এদের প্রতি উদাসীন হওয়াই একমাত্র পথ।
    মানুষকে মানুষ হতে হয় — মনুষ্যত্বের সাধনার মধ্যে দিয়ে , সুকুমার বৃত্তির অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে। ইন্দ্রানী দত্ত পান্না তাঁর ছোট্ট গল্পের মধ্যে দিয়ে সেটাই ফুটিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *